বেহাল অর্থনীতি ও মোদির সাঙ্গোপাঙ্গদের ধাক্কা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 28 Feb 2018, 04:03 PM
Updated : 28 Feb 2018, 04:03 PM

ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার তাদের প্রায় চার বছরের রাজত্বকালে দেশ শাসনে পথে না হেঁটে নানা দিক থেকে শোষণের পথেই এগিয়েছে। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে ছাত্রীগণের কথা।

তখন ভারতে খাদ্যের অভাব হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। এমন আইজিটিএ-এর ঘটনা গ্রাম রাস্তায় রাস্তায় শোনা যেত, 'আমরা যখন বলি খাদ্য, সীমান্তে বেজে উঠে রসবাদ্য রণবাদ্য।' এই ভোট যে চার বছরে আমরা দেখছি, কৃষকরা যখন বলছেন, অর্থের অভাব আমরা শেষ করতে পারছি না। মহাজনের ষড়যন্ত্রে পড়ে আমরা সর্বস্বান্ত। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বছরে তিন কোটি লোককে চাকরি দেবেন, অর্থাৎ এতদিনে ১২ কোটি লোকের চাকরি পাওয়ার কথা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী চাকরি পেয়েছেন আড়াই লক্ষের কিছু বেশি লোক। তাই ভারতীয়দের সামনে প্রশ্ন উঠেছে কোনটা আগে? ধর্মীয় উন্মাদনা, হিন্দুত্ববাদ, না রাসমন্দির?

বিজেপির এসপি ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অন্যতম আসামী, যার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে, সেই বিনয় কারটিয়া হঠাৎ মন্তব্য করেছিলেন মুসলিমরা পাকিস্তানে চলে যাক। তাঁর এই জঘন্যতম সাম্প্রদায়িক উক্তি সারা দেশকে আবার ধর্মীয় উন্মাদনার দিকে ঠেলে দিল।

নোটবন্দি থেকে শুরু করে সম্প্রতি একের পর এক সরকারি ব্যাংক দুর্নীতিতে মোদি সরকার তাল সামলাতে না পেরে উল্টোপাল্টা কথা বলতে শুরু করেছে।

সম্প্রতি একদিনে চারটি ঘটনা ঘটেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন উদ্ধৃতি দিয়ে পাকিস্তানকে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। একই দিনে শ্রীনগরে বসে জন্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যা মিটিয়ে নেয়ার কথা বলেছেন। সেইদিনই আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, সামরিক বাহিনি যদি যুদ্ধ করতে না পারে, তাহলে আরএসএস বাহিনী গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। কী ভয়ঙ্কর কথা! গেরুয়া বাহিনীর এহেন হুমকি দেখে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীসহ একুশটি বিরোধী রাজনৈতিক দল মন্তব্য করেছে, আমাদের সামরিক বাহিনীকে এইভাবে অপমান করার অধিকার মোহন ভাগবত বা গেরুয়া বাহিনীর নেই। তারা পাকিস্তানের সঙ্গে ৪৮ থেকে ৬৫ এবং ৭১ সালে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। তখন দেশ শাসন করতো কংগ্রেস। গেরুয়া বাহিনী নয়। তাঁরা শহীদ। সেই শহীদদের অপমান করলে দেশের মানুষ সহ্য করবে না।

বিজেপির এইসব কাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে ভোট ব্যাংক। শুধু নাগপুরের মোহন ভাগবত নন, ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধানও ছেলেবেলা থেকেই আর এসএস এর কর্মী ছিলেন। সম্প্রতি তিনি আবার আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করেছেন। বারহাটিতে বসে বলেছেন, আসামের নাগকিদের সমীকরণ বদলে গেছে। আর ২৪ ঘণ্টা আগে ঢাকায় সফররত ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের কোনও নাগরিক ভারতের আসাম রাজ্যে নেই।

বিপিন রাওয়াতের এই উক্তির পর সারা দেশে বিরোধীরা ফেটে পড়েছেন। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, সামরিক বাহিনীর প্রধানের উর্দি পরে তিনি কী করে বিদেশি রাষ্ট্র সম্পর্কে এমন মন্তব্য করলেন। এটা তাঁর উর্দিরই অপমান।

সম্প্রতি সরাসরি ব্যাংক লুট করে গুজরাটের আরেক মোদি পালিয়ে যাওয়ার পর কংগ্রেস সভাপতি বলেছেন, 'মোদিই হলেন মধ্যমণি'। ব্যাংক লুট হওয়ার ২০ দিন কেটে যাওয়ার পরে সরকারও নিরব হয়ে রয়েছে। আগে যেমন বেফাঁস মন্তব্য করে রাজনীতিবিদরা বলতেন, তাঁদের 'মিসকোট' করা হয়েছে। এখন সে কথা সরকারি আমলা এবং সেনাকর্তারাও বলতে শুরু করেছেন। কিন্তু টেলিভিশনের পর্দায় সেসব ধরা পরে যাচ্ছে তা তারা বুঝেও বুঝতে পারছেন না। তাই সারা দেশে স্লোগান উঠেছে, 'চোরেরা দিল নীরবে বিদেশে পাড়ি, মোদি ভাই নামেই চৌকিদারি।'

নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেই বলেছিলেন, 'না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা। আমিই চৌকিদারি করব যাতে কেউ দুর্নীতি করতে না পারে।'

মোদির সে চৌকিদারি তত্ত্বই পাল্টা তাঁর দিকেই ফিরে আসছে। তবে মোদির ফানুস ইতিমধ্যে ফুটো হতে শুরু করেছে। তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাটেই একের পর এক স্থানীয় নির্বাচনেও ধাক্কা খেতে শুরু করেছে। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে কোনও রকমে হার বাঁচিয়ে গদি রক্ষা করতে পেরেছিল বিজেপি। কিন্তু তার পরের ধাপে গুজরাটের ভোটসভায় নির্বাচন এবং তারও পরে সদ্য ঘটা পঞ্চায়েত নির্বাচনেও কংগ্রেসের কাছে একের পর এক আসনে ধাক্কা খেতে হয়েছে বিজেপিকে। যে রাজ্যের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, খোদ নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের রাজ্যেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বোঝাই যাচ্ছে বিজেপির পায়ের নিচের মাটি আলগা হতে শুরু করেছে।

মোদির নির্বাচনী প্রচারের একটি বড় অংশ জুড়েই ছিল বিদেশে গচ্ছিত ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কালো টাকা উদ্ধার করে এনে প্রত্যেক ভারতীয়ের অ্যাকাউন্টে ১৬ লাখ টাকা করে দিবেন।

সেই কালো সম্পদের কানাকড়িও নিয়ে আসতে পারেননি মোদি। বরং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের জমানো টাকা (পুরোটাই কর দেয়ার পর সাদা টাকা) তছরুপ করে প্রতারকরা বিদেশে গা ঢাকা দিয়েছে। সেও মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটেরই ব্যবসায়ী। নীরব মোদি। সম্প্রতি ডাভোসের একটি সম্মেলনে এই নীরব মোদিকেই সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নীরব মোদির পর এই ধরনের আরও প্রতারক ব্যবসায়ীদের কাণ্ড সিবিআই এর কাছে রিপোর্ট করা হচ্ছে।

১১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা তছরুপ করে নীরব মোদি সুইজারল্যান্ডে সপরিবারে পালিয়ে গেছেন। এখনও পর্যন্ত তার মেন্টর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটা কথাও বলেননি।

দায়সারা মন্তব্য করে বলেছেন, দুর্নীতিবাজরা কেউ পার পাবে না। কিন্তু এই কথা তিনি গত চার বছর ধরে বলে আসছেন। তাঁর যাবতীয় মিথ্যা যে নেহাতই কথার কথা, তা দেশের সবাই জেনে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দেশের টাকা চুরি করে যারা বিদেশে পালিয়েছে তাদের আর ফেরানো যাবে না। আরেক প্রতারক বিজয় মালিয়াকেও ফেরানো যায়নি। নোটবন্দি, জিএমটি'তে এমনিতেই ঘায়েল হয়েছিল অর্থনীতি। তার উপর নরেন্দ্র মোদির সাঙ্গোপাঙ্গরা আরও বড় ধাক্কা দিয়ে গেল।