ফাল্গুনের ফুল ফোটার আগেই ঝলসে উঠা রক্তের এক ১৪ ফেব্রুয়ারি

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 20 Feb 2018, 03:39 PM
Updated : 20 Feb 2018, 03:39 PM

১৪ ফেব্রুয়ারি। দিনটি আমাদের দেশে এখন উদযাপিত হয় "ভ্যালেন্টাইন'স ডে" বা 'ভালবাসা দিবস' নামে। এই উদযাপন আমাদের দেশে আগে ছিলনা। আশির দশকের শেষ বছরে শুরু হয়ে নব্বই দশকের মাঝ বরাবর প্রলম্বিত হওয়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই দিনটির কথা আমরা কখনো শুনিনি।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ তাঁর এই অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা আরোহণ মেনে নেয়নি। এই দেশে সবসময়ই গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকারের প্রশ্নে ছাত্রদের কণ্ঠই ছিল সুউচ্চ আর তাতে সমর্থন যুগিয়েছে শ্রমিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। এরশাদের সময়ও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮২ সালের ৯ই নভেম্বর গঠিত হয় 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'। স্থান অনিবার্যভাবেই মধুর ক্যান্টিন। চৌদ্দটি ছাত্র সংগঠনের জোট 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বাদ দিয়ে ডানের এবং বামের প্রধান ছাত্রসংগঠনগুলোর একটি জোট ছিল এই 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'।

এক দুঃখজাগানিয়া বিস্ময় এই যে, স্বৈরশাসন বিরোধী প্রতিবাদের শুরুটা এত রক্তাক্ত হওয়ার পরও কীভাবে তা সময়ের আড়ালে চাপা পড়ে গেল! আরও বিস্ময়কর মনে হয় যখন দেখি সেই রক্তমাখা শোকের দিনটি আমাদের কালপঞ্জিতে চিহ্নিত হয়েছে শুধু 'ভালবাসা দিবস' হিসেবে। সময় কি এতটা স্মৃতি বিধ্বংসী? না কি সাংস্কৃতিক আবহের আড়ালে স্বৈরতন্ত্র তার বিজয়ের অট্টহাসি হাসছে? আর তা কি আমাদের বিস্মৃতিকে আশ্রয় করে?

হ্যাঁ, আমি ১৯৮৩ এর ১৪ ফেব্রুয়ারির কথা বলছি। সেদিন ছিল বসন্তের প্রথম দিন। সবাই ছিল উদযাপনে ব্যস্ত। এর মধ্যেই কিছু ব্যতিক্রমধর্মী তরুণ-তরুণী জড়ো হয়েছিল অপরাজেয় বাংলার পাদদেশের বটতলায়। সমাবেশের আয়োজক চৌদ্দটি ছাত্র সংগঠনের জোট 'ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ'। উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরশাসক এরশাদ এর শিক্ষামন্ত্রী ডঃ আব্দুল মজিদ খান প্রস্তাবিত 'মজিদ খান শিক্ষা নীতি' এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। শিক্ষার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সংকোচন করে ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষার ৫০ শতাংশ ব্যয় বহনের প্রস্তাব করা হয়  এই নীতিতে।  ছাত্র সমাজ এটা  মেনে নিতে  পারেনি। এছাড়াও এই নীতিতে প্রস্তাব ছিল প্রাথমিক পর্যায় থেকেই আরবি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা। এটি ছিল বায়ান্নের এবং  একুশে'র চেতনার পরিপন্থী। সর্বোপরি এটি ছিল সামরিক শাসকদের প্রথাগত ধর্মাশ্রয়ী ভণ্ডামির বহিঃপ্রকাশ।

স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত হন ১৯৭৩ সালে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে অবস্থান কালে তার ভুমিকা ছিল পাকিস্তানী সামরিক জান্তার পক্ষে। বাংলাদেশে এসে মুখ গুঁজে সামরিক বাহিনীতে  চাকরী করতে থাকা এই কাপুরুষটিই ঘটনার পরিক্রমায় ১৯৮২ সালের ২৪ শে মার্চ বাংলাদেশের হর্তাকর্তা হয়ে উঠেন।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর যে পাকিস্তানপন্থী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জোট এক  আহত পরিত্যক্ত বাংলাদেশের ক্ষতস্থানের রক্ত চেটে পান করার নারকীয় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, সেই চক্রের সর্বশেষ নেকড়েটি হচ্ছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আর তার এই রক্ততৃষ্ণার শিকার হয় ১৯৮৩ এর ১৪ ফেব্রুয়ারি জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা, মোজাম্মেল এবং আইয়ুব সহ আরও দশ জন। বসন্তের শিমুল-পলাশ কেঁদে উঠেছিল এই নির্মমতায়।

নিজের পূর্বসূরি জেনারেল আইয়ুব খান এর মত এরশাদও চেয়েছিলেন নতুনভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সাজাতে। যে সাজানোর আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রতিক্রিয়াশীলতায় ভরা। একাত্তর, বায়ান্নের চেতনা বিরোধী এবং ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতাকে লালনের হাতিয়ার ছিল এরশাদের এই  শিক্ষা প্রস্তাব। আইয়ুব খান গঠিত 'শরিফ কমিশন' এর বাস্তবায়ন ছাত্রসমাজ ১৯৬২ তে রুখে দিয়েছিল। ঠিক সেভাবেই ১৯৮৩ তেও ছাত্রসমাজ এরশাদ এর শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান এর শিক্ষানীতি রুখে দেয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি সরকার 'মজিদ খানের শিক্ষা নীতি' প্রত্যাহার করে নেয়। এটা শুধু শিক্ষানীতির বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ ছিল না, একই সাথে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিল প্রথম জোড়ালো প্রতিবাদ।

বসন্তের রঙের আহ্বান উপেক্ষা করে, উদযাপনের আনন্দকে তুচ্ছ করে, প্রিয়জনের হাত সযত্নে সরিয়ে দিয়ে তাঁরা অধিকারের মিছিলে শামিল হয়েছিলেন। মিছিলটি কার্জন হল পেরিয়ে শিক্ষাভবন এর কাছে পৌঁছালে পুলিশ গুলি চালায়। ঝরে পড়ে অন্তত দশটি তাজা প্রাণ। এর মধ্যে যাঁদের নাম জানা যায় তাঁরা হলেন  জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা, মোজাম্মেল, আইয়ুব। সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশগ্রহণকারীদের ভাষ্য মতে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি, হয়তো পঞ্চাশও হতে পারে। পুলিশ অনেক লাশ ফেরত দেয়নি। বায়ান্ন এর পর আর কোন ছাত্র মিছিলে একসাথে এত জন মারা যায়নি।

১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ এর ছাত্র আন্দোলনই ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বৈরশাসন বিরোধী জোটবদ্ধতার অনুঘটক। এই ঘটনারই ফলাফল হিসেবে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরশাসন বিরোধী বৃহৎ রাজনৈতিক জোট গঠন শুরু করে। সাত দল, আট দল এবং পরবর্তীতে পনের দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে  স্বৈরশাসন বিরোধী যে রাজনৈতিক সংগ্রাম চলে প্রায় এক দশক ধরে, তার অনুপ্রেরণা এবং সাহস যোগান দিয়েছিল মধ্য ফেব্রুয়ারির এই ছাত্র আন্দোলন।

এই হত্যাযজ্ঞকে 'দিনের আলোতে গণহত্যা' বলা উচিৎ। পাকিস্তান প্রত্যাগত এক নীতিহীন সামরিক অফিসার হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে এই গণহত্যা'র জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিৎ। কারণ এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বিনা প্ররোচনায়, শান্তিপূর্ণ মিছিলে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিল ২৫ মার্চ রাতের আঁধারে। আর বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দিশেহারা আহত বাংলাদেশকে পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের প্রেতাত্মা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং তার সহযোগীরা অনেক  অসহায় ভেবেছে, তাচ্ছিল্ল্যের সাথে দেখেছে। আর সে জন্যই সামরিক জান্তা  প্রত্যক্ষ দিবালোকে  ছাত্র গণহত্যা করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল।

কী দুর্ভাগ্য! এই ত্যাগ আজ হারিয়ে গেছে 'ভালবাসা দিবস' এর উৎসবের আড়ালে। জীবনের জন্য ভালবাসা যেমন জরুরি, পূর্বসুরীদের আত্মত্যাগের স্মরণও জরুরি। এই দুয়ের এক সৃজনশীল শ্রদ্ধাপূর্ণ সমন্বয়ই হোক আমাদের আগামীর ১৪ ই ফেরুয়ারিগুলো।