পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও গাধা সমাচার

Published : 16 May 2012, 03:30 PM
Updated : 16 May 2012, 03:30 PM

গত ৬ মে তারিখে বিডিনিউজটোয়ান্টিফোরডটকমএর ইংরেজী সংস্করণের Opinion বিভাগে আমি একটা কলাম লিখি যার শিরোনাম ছিল Public universities in Bangladesh: Asking a donkey to give cow's milk.

লেখাটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মাধ্যমে যে বিতর্ক এবং প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখা। আমার মূল কথাগুলো ছিলো এই রকম:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি। দুই একজন বাদ দিলে, গত পঞ্চাশ বছরে এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বুদ্ধিজীবি তৈরি হয়নি; একটা ধারা তো দূরের কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের কথা বললে সবাই বলে ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১, এরশাদ বিরোধী ও আরো কিছু অর্জনের কথা। কিন্তু কেউ ভাবনা-চিন্তা, বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্রে কোন গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের কথা বলেন না।

ক্ষমতাবান শ্রেণী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। সেই কারনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য প্রমাণিত। সুতরাং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি সফল কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়। এর কারণ এই সব সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্য ছাত্রদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকা।

এই উদ্দেশ্যে শিক্ষকবৃন্দের ভূমিকা রয়েছে। নিজেদের চাকরি রাখতে ও উন্নতি সন্ধান করতে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে দল করে যেমন লাল, সাদা, নীল ইত্যাদি। এই প্রক্রিয়ার সবলতম প্রমাণ হচ্ছে ভিসি পদের চাকুরির জন্য দলের লোক বসানোর মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করাটাই প্রধান উদ্দেশ্য, লেখাপড়া বা জ্ঞানচর্চা নয়।

একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমুহ অত্যন্ত সফল। শিক্ষা প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রায় একেবারেই বিফল।

তবে এই পর্যবেক্ষণটি আমাদের ভাবনার সমস্যাপ্রসূত। আমরা শিক্ষাপ্রদান ও জ্ঞানচর্চা আশা করছি এমন একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যার মূল ভূমিকা রাজনৈতিক। আমাদের বোঝা উচিত কে কোনটা দিতে পারে। যে যেটা পারে তার কাছ থেকে সেটাই চাওয়া উচিত। অর্থাৎ গাধার কাছ থেকে গরুর দুধ চেয়ে লাভ নেই।

লেখাটা পড়ে অনেকে কিন্তু ক্ষিপ্ত হয়েছেন, খুশিও হয়েছেন অনেকে। লেখাটির বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এসেছে তা নিম্নরূপ:

– পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাকে আমি "গাধা" বলেছি যাতে তাদের সম্মানহানী ঘটেছে।

– আমি ক্যাম্পাসে রাজনীতির বিরুদ্ধে বলেছি যেটা আসলে একটি ষড়যন্ত্রের অংশ।

– আমি আসলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে লিখেছি কারণ আমি ব্র্যাক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত, অতএব আমি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসারের জন্য এই সব বলছি।

– এর বাইরে কিছু বক্তব্য আছে কিন্তু এই সবই হচ্ছে প্রধান উপস্থাপিত বিষয়।

আমার বক্তব্য হচ্ছে নিম্নরূপ:

– আমি কখনই কাউকে "গাধা" বলিনি। "গাধার" সমার্থক "বোকা/বুদ্ধিমান" কাউকে বলতে চাইলে আরও হাজার পথ আছে। যদি লেখাটা পড়েন দেখবেন আমার প্রধান বক্তব্য হচ্ছে এই যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক, অন্য কোন কিছু নয়। এটা একটি রাজনৈতিক অনুসারী ও সেই রাজনীতির সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ তৈরির কারখানা, শিক্ষিত মানুষ তৈরির নয়। এই উদ্দেশ্যে তারা সফল কারণ এইটাই তাদের উদ্দেশ্য। এবার বাক্যের সাথে বিষয় মেলান, ব্যাপারটা বুঝতে সোজা হবে।

তবে যে ক্ষিপ্ততার সাথে আপনারা "গাধা" হিসেবে নিজেদের সনাক্ত করেছেন, চটেছেন সেটা বরং আশ্চর্য্যজনক। তবে যদি এই মনিহার আপনাদের সাজে বলে মনে করেন এবং এটা বরণ করে নেন সেটা আপনাদের বিষয়।

তাহলে "গরু" বললে কি কম ক্ষিপ্ত হতেন? আর যদি বলা হত "বাঘের কাছ থেকে ছাগলের দুধ কি আশা করা যায়" তাহলে আনন্দ হত?

আপনাদের ভাবনার প্রক্রিয়ায় "গাধা" শব্দটা স্থান করে নিয়েছে সব কিছুর উপরে কিন্তু যে বিষয়টা উত্থাপিত হয়েছে সেটা হচ্ছে যার যেটা কাজ সে সেটা করে। যার কাছ থেকে যেটা পাওয়া যায় সেটাই আশা করা উচিত, এই বিষয়টি খেয়াল করেন নি। এটা একান্তই আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু গাধা তো গাধার দুধই দিতে পারে। গরু তো গরুর দুধই দিতে পারে। গাধা গরুর দুধ দিবে কী করে। এই বিষয়টি কি এতই কঠিন ছিল বোঝা? অনেকেই তো বুঝেছেন।

আমি বলেছি যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নয়। তাদের রাজনৈতিক ইতিহাস আছে কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের ইতিহাস নেই। থাকলেও সেটার কোন ধারবাহিকতা নেই।

যেখানে শিক্ষাগত যোগ্যতা নয়, বরং দলীয় ও অন্য কারণে বহু মাস্টার নিয়োগ করা হয়–সেটা রাজনৈতিক না বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য? ভিসি নিয়োগ করা হয় কি যোগ্যতার ভিত্তিতে? বাদ দেওয়া গেল অন্য সব পদসমূহ।

পত্রিকায় এনিয়ে এত কথা এত বার এসেছে যে এটা আর যাই হোক গোপন কিছু নয়।

ছাত্র-শিক্ষক মিলে আন্দোলন করা এক কথা কিন্তু এটাই যখন প্রধান অর্জন হয়ে যায় তখন প্রশ্ন আসবেই। ঐতিহ্যের যে পরিমাপ তাতে রাজনীতির অর্জনের কথা যেমন আসে তেমনি বুদ্ধিবিদ্যার অর্জনের কথা কেন আসে না? নিশ্চয় কোন প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য যেটা থাকে সেখানেই তার অর্জন হয়।

আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষার মান বেড়েছে এমনটি কেউ বলছে না। বলছে না যে, যে ধরনের রাজনীতি চালু আছে সেটা শিক্ষার জন্য সহায়ক। ১৮ বছরের বেশি বয়স্ক বাংলাদেশীর সব কিছু করার অধিকার আছে রাজনীতিসহ, অতএব এটাই বাস্তব কিন্তু শেখ হাসিনা-খালেদা মার্কা যে রাজনীতি চালু আছে সেটাকে কী রাজনীতি বলেন?

এই সব কিছু মানতে ইচ্ছা করছে না? করুন না করুন এতে কারও কিছু এসে যাবে? আপনার চাকুরিটা থাকবে, ইজ্জত থাকবে, উপরি আয়ের সুযোগ থাকবে, এই ব্যবস্থা সমর্থন করার পুরস্কার হিসেবে। কিন্তু লেখা পড়াটা হবে না, রাজনীতিটা হবে।

আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোন কোথা্ও উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। অতএব এখান থেকেই যারা পাস করবে তারাই সকল স্থানে আছে বা থাকবে। এটা বুঝতে দার্শনিক হতে হয় না কিন্তু তাদের মানটাই প্রশ্নের ব্যাপার। যদি কেউ মনে করে তারা মানসম্পন্ন এবং পাস করা প্রমাণ করে বর্তমান ব্যবস্থা ভাল সেটা বলার দায়িত্ব আপনাদের, আমার নয়।

যদি পারা যায় তবে নিজের পরিসরের বাইরে লোকজনদের জিজ্ঞাসা করে দেখা যেতে পারে তারা কী মনে করেন এ বিষয়ে।

যে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সেটা তৈরি হয়নি কারণ না আছে গবেষণা করার রসদ, না আছে পরিবেশ, না আছে প্রয়োজন। দুই একজন তো নিশ্চয় নিরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন কিন্তু তারা তো একটা গোটা ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না।

যখন সবাই বিদ্যাচর্চা করে–তাদের ইচ্ছায় ও চাকুরিতে টিকে থাকার শর্ত হিসেবে– তখন সেটা কাঠামোর অংশ হয়। কাউকে বলতে শুনিনি এটা হয়েছে।

যে বিষয়টি অনেকেই উঠিয়েছেন সেটা হল, যেহেতু আমি ব্র্যাকের সাথে জড়িত তাই আমি এই সব প্রসঙ্গ এনেছি কারণ আমি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ওকালতি করছি। আমার এজেন্ডা পরিষ্কার– এটাই তাদের বক্তব্য।

এটা কি বুদ্ধিবৃত্তিক হত না একটু জিজ্ঞাসা করলে যে আমার অবস্থানটা কী? উপসংহারে পৌঁছাবার আগে অনুমান ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রয়োগের ভিত্তিটা কি পরিস্কার করে জানা দরকার ছিলো না?

"তার এজেন্ডা বোঝা গেছে"–এই কথাতে তো এই ভাবনার সীমাবদ্ধতাই প্রমান হয়। এখানেই বড় সমস্যাটা।

আমার কোন অবস্থাতেই মনে হয়নি যে এই দুই ব্যবস্থা কোনভাবে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করছে। অতএব প্রাইভেটের দালালী করার কোন কারণ, সুযোগ, প্রয়োজন ও ইচ্ছা নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় একটি কাঠামোর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত কিন্তু এখনও প্রাইভেদের সেটা হয়ে ওঠেনি। উঠতে পারবে কি না ঠিক নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটাই নির্ভরশীল সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর। যতদিন না তাদের নিজেদের শিক্ষকবাহিনী তৈরি হবে ততদিন পর্যন্ত এই বিষয়ে আলাপ করার কোন মানেই হয় না। পৃথিবীর অনেক জায়গাতে সরকারী বেসরকারী ব্যবস্থা একই সাথে রয়েছে। অতএব এই দুইয়ের পরিসর অনেকটাই আলাদা, যদি কোন দিন অবস্থার পরিবর্তন হয় বির্তক উঠতে পারে। এখন ওঠানো কোন মানে হয় না।

বেশীর ভাগ বাবা-মা চায় সন্তানেরা নিয়ম মেনে কয়েক বছর পড়ে ডিগ্রি নিয়ে বার হয়ে চাকুরি করবে, বিদেশে যাবে ইত্যাদি। বাচ্চাদের শিক্ষাই তাদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। যাদের সঙ্গতি আছে তারা সন্তানদেরকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে। চাহিদা এত বেশী যে প্রতি মাসে একটা করে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে মনে হয়। সবাই সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পাচ্ছে না, তাদের মধ্যে অনেকেই প্রাইভেটে যাচ্ছে। এটা এখন আর ভাল মন্দের বিষয় হিসেবে নেই।

এটা মনে হয় যে প্রাইভেটে যারা আসে জ্ঞান চর্চার উদ্দেশ্য তাদের কাছে প্রধান নয়। এরা পড়বে নিয়মিত, সময়মত ক্লাশ শেষ করে ডিগ্রি নিয়ে খালাস হতে চায়। অনেকটা Teaching only University– এখানে এটাই উদ্দেশ্য, জ্ঞানচর্চা নয়। যেমন পাবলিকদের উদ্দেশ্য রাজনীতি, জ্ঞানচর্চা বা শিক্ষা প্রদান নয়।

যে কাঠামোর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে হাসিনা-খালেদা শাসন করে তার অংশ হয়ে গেছে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা। অতএব রাজনীতি বাদ দিয়ে শিক্ষাপ্রদান এই ব্যবস্থায় সুযোগ কম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্র সহসা পাল্টাবে না। তার অঙ্গ সংগঠনসমূহও পাল্টাবে না। যারা টাকা দিতে পারবে তাদের অনেকে অন্যত্র চলে যাবে, যারা পারবে না তাদের কপালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার নামে রাজনীতি ভোগ করা ছাড়া খুব একটা বিকল্প চোখে পড়ে না।