নির্বাচন অধিকারিকের সাম্প্রতিক উক্তি এবং সহসা উপলব্ধি

মামুন আল মাহতাব
Published : 13 Feb 2018, 01:17 PM
Updated : 13 Feb 2018, 01:17 PM

বেহেস্ত থেকে মর্তে মানুষের আগমন বিবি হাওয়ার সামান্য ভুলে। গন্ধম ফল খাওয়ার লোভ সম্বরণ করতে পারলে স্বর্গসুখেই কেটে যেত মানব জনম। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী সীতার অপহরণ কোনও মারাত্নক ভূলের কারণে না। সামান্য লক্ষণ রেখা পেরোতেই এতসব ঝামেলা, হনুমানের বুদ্ধির কাছে মানুষের পরাজয় আর সবশেষে রাবণ বধ আর লঙ্কা বিজয়।

সামান্য ভুলের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। পা কাটার থাকলে তার জন্য রামদা-চাপাতি লাগে না। সামান্য পচা শামুকই যথেষ্ট। সস্প্রতি এদেশে নির্বাচন সম্পাদনে দায়িত্ব প্রাপ্ত সর্বোচ্চ কর্তা ব্যক্তির সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে কিছু মন্তব্য টিভির পর্দায় দেখে কেন যেন একটু দার্শনিকতায় পেয়ে বসল। শ্রদ্ধেয় প্রধান নির্বাচন অধিকারিক বলেছেন একটি বিশেষ দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নাকি আগামী জাতীয় নির্বাচন নাকি প্রতিনিধিত্বশীল হতে পারে না। যুক্তি দেখিয়েছেন দেশের রাজনীতিতে ঐ দলটির বিশেষ প্রভাব। এখানে সামনে প্রশ্ন আসে দু'টি- প্রথমত, এই ভদ্রলোকের দায়িত্ব পালনের লক্ষণরেখাটা কোথায় গিয়ে থেমেছে এবং দ্বিতীয়ত রাজনীতিতে ঐ বিশেষ দলটির প্রভাব সংক্রান্ত।

আমি চিকিৎসক, রাজনীতি, সমাজনীতি, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে আমার বুৎপত্তি যৎসামান্যের চেয়েও কম। নির্বাচন মানে আমার কাছে সরকারী ছুটি। দেরিতে ঘুম থেকে উঠে ঘরের কাছের ভোট কেন্দ্রে যেয়ে আরও সুন্দর পাঁচটি বছরের প্রত্যাশায় পছন্দের প্রার্থীর ব্যালটে ভোটটি দেয়া এবং অতপর বাসায় এসে টিভির সামনে জমিয়ে বসা। আমার যে যৎসামান্য সাধারণ জ্ঞান, তাতে আমি বুঝি নির্বাচনের দিন আমি যাতে আমার পছন্দের প্রার্থীকে ঠিকঠাক মত ভোটটা দিয়ে আসতে পারি সেটা নিশ্চিত করা।

আমার পছন্দের প্রার্থী তার নাম নির্বাচনী ব্যালটে তুলবেন কিনা সেটি প্রার্থীর স্বাধীনতা। ব্যাপারটা অনেকটা যেন ট্রেনের চালকের মত যার দায়িত্ব হচ্ছে আমাকে নির্বিঘ্নে কমলাপুর থেকে চট্রগ্রামে পৌঁছে দেওয়া। আমি ট্রেনের টিকেট পেলাম কি পেলাম না, না মগবাজারের জ্যামে পরে ট্রেনটি মিস করলাম এ নিয়ে ট্রেনের চালকের মাথাব্যথা থাকতে পারে না। ট্রেন ঠিক সময় প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ঠিকঠিক তার গন্তব্যে ছুটবে। একইভাবে পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন আসবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায়। যারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার তারা নিবেন আর বাকিরা প্রস্তুতি নিতে থাকবেন পাঁচ বছর পরের পরবর্তী নির্বাচনটির জন্য। কাউকে দাওয়াত খাইয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে, 'এসো বাছা এসো' বলে নির্বাচনে নিয়ে আসাটা সম্ভবত নির্বাচন অধিকারিকদের দায়িত্বের মধ্যে পরে না।

আর যদি রাজনীতিতে কারো প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে হয় তাহলে আরো আগে প্রশ্ন আসে কোন রাজনীতি, কাদের জন্য রাজনীতি আর কাদের রাজনীতি? রাজনীতি করলে কি যা কিছু বলা কিংবা করা সিদ্ধ কিংবা সম্ভব? যে দল বির্তকিত করে স্বাতীনতার ঘোষক আর ঘোষণাকে, অপমান করে জাতির জনককে তারা কি প্রকারান্তরে সংবিধানকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলছে না? স্বাধীনতার ঘোষণা আর জাতির পিতার মতন বিষয়গুলোতো আমাদের সংবিধানের মুখবন্ধেই চিরদিনের মত বাণীবদ্ধ করা আছে।

সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত একজন চিহ্নিত যুদ্ধপরাধীর জন্য যখন কোন রাজনৈতিক দল তার সর্বোচ্চ দলীয় ফোরামে শোক প্রস্তাব আনে কিংবা আদালতের সম্ভাব্য রায়ের বিরুদ্ধে নৈরাজ্য কায়েম করে তখন কোথায় থাকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, কোথায় যায় দেশের সার্বভৌমত্ব? ভারতে বসে কি সম্ভব পাকিস্তানের রাজনীতি করা আর এই যে ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তান, সেখানে কি করা যায় ভারতপন্থী রাজনীতি? আর তাই যদি হবে তবে কেন উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটে চলা বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন এই অশনি সংকেত, কেন বারবার পিছনে চলার আর পিছিয়ে পরার অপচেষ্টা?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঐ বিশেষ দলটির প্রভাব আছে সত্যি, তবে জঙ্গিবাদের লালন আর বিস্তার আর ২০১৩-২০১৪ এর আগুন সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে ঐ রাজনীতি আর এই রাজনৈতিক দলের স্বরূপ এখন উন্মোচিত। আরও আগে তাদের হাত ধরেই এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুণরুত্থান আর রাজাকারদের পুনর্বাসন। প্রবন্ধের পরিসর বাড়াতে হলে কিংবা চায়ের কাপে ঝড় তুলতে হলে যুক্তি-বিতর্ক টেনে আনা যেতেই পারে, তবে এই নিয়ে কোন লেখালেখি, বিতর্ক কিংবা যুক্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কাজেই পিছিয়ে চলার রাজনীতির অলিতে-গলিতে যাদের বিচরণ, দেশের সংবিধান আর সার্বভৌমত্বের প্রতি যাদের এত অবজ্ঞা, তাদের জন্য কিসের এত মায়াকান্না?

২০১৮ সালের শেষ প্রান্তে কোনও এক শীতের সকালে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার সময় আমি শুধু এটুকুই প্রত্যাশা করব যে এদেশের মাটি ও জলে বেড়ে ওঠা প্রতিটি বাঙালি ঐ রাজনীতির ব্যালটে সিল দেয়াতো দূরে থাক, তাদের প্রতীকের দিকে তাকাবেও চরম বিতৃষ্ণায় আর ভোট কেন্দ্র ফেরত আমি টিভির সামনে যখন জমিয়ে বসবো তখন নির্বাচনী ফলাফলে প্রত্যাশা করব শুধুই তাদের ভারডুবি।

সেই যে কোন কবে আর্কিমিডিস গোসল করতে যেয়ে আবিষ্কার করেছিলেন চৌবাচ্চায় গোসল করতে গেলে নিজ ওজনের সমপরিমাণ জল চৌবাচ্চা থেকে উপচে পরে, তেমনি ২০৪১ -এ উন্নত বাংলাদেশের প্রত্যাশায় ২০১৮ এর নির্বাচনে আমি ঐ রাজনীতির এমন ভরাডুবি প্রত্যাশা করি যার তোড়ে উপচে ওঠা জলোচ্ছাস ভাসিয়ে নিয়ে যাবে যত জ্বরা আর গ্লানি, আর আমরা গাইব অনাগত নতুন দিনের জয়গান।