ফানুস তো বেলুন নয়

Published : 12 Feb 2018, 08:24 AM
Updated : 12 Feb 2018, 08:24 AM

এ বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীতে ফানুস না ওড়ানোর জন্য নগরবাসীকে অনুরোধ জানান ডিএমপি কমিশনার। তিনি এই বিষয়ে সতর্ক করে গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেন।

বিজ্ঞপ্তিতে আইন অমান্যকারীদের বিরদ্ধে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার।

বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, "ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কিছু কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে আকাশে ফানুস উড়িয়ে দিচ্ছেন। এসব ফানুসে কেরোসিন দ্বারা প্রজ্জ্বলিত বাতি থাকায় এগুলো অনির্বাপিত অবস্থায় জনবহুল মহানগরীর বিভিন্ন জায়গায় পতিত হচ্ছে। এতে অগ্নিকাণ্ডসহ নানাবিধ নিরাপত্তাজনিত হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে। মহানগরীতে ফানুস ওড়ানো অব্যাহত রাখলে যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। এমতাবস্থায় ঢাকা মহানগর এলাকায় যে কোনো ধরনের ফানুস ওড়ানো থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হলো। এর ব্যত্যয় হলে নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।"

এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সেই থেকে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর আলোচনা- সমালোচনা হচ্ছে। অনেকে এটাকে কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলেও মনে করছেন।

ফানুস কী

কেউ বলেন ফানুস বাতি। দেখতে ডোলের ন্যায় বলে কেউ বলেন ডোলবাজি। কিন্তু বৌদ্ধ পরিভাষায় এর নাম হল 'আকাশ প্রদীপ'। বাঁশের কাইম দিয়ে শৈল্পিক কাঠামো তৈরি করে তার উপর রঙ্গিন কাগজ ব্যবহার করে বিভিন্ন আকৃতি দান করে ফানুস তৈরি করা হয়। তবে ফানুসের গায়ে কোন ছিদ্র রাখা যাবে না। তারপর ফানুসের মুখে গুনার গোলাকার চাকা সৃষ্টি করে তাতে পোড়া মবিলে ভেঁজা হালকা কাপড় বেঁধে দেওয়া হয়।

এরপর এতে আগুন ধরিয়ে দিলে কিছুক্ষণ পরে ফানুসের ভেতরে প্রচণ্ড তাপ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে ফানুস উপরের দিকে টান নেয়। তখন আর ধরে রাখা যায় না। ছেড়ে দিলে বায়ু বেগে আকাশের বুকে ছুটে চলে। ছুটতে ছুটতে একসময় চোখের অন্তরালে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আকাশের বুকে মিটমিট করে জ্বলে। এতে এক আকর্ষণীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। এই দৃশ্য জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে বিমোহিত করে। পরে পোড়া মবিলের কাপড় নিঃশেষ হয়ে গেলে ছাই হয়ে আপনাআপনি মাটিতে পড়ে যায়। তখন পতিত এই ছাইয়ে কোন আগুন থাকে না। তাই কারো কোনও ক্ষতিও হয়না। ফানুস ওড়ানো যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় এভাবে চলে আসছে।

ফানুস কেন ওড়ানো হয়

রাজ কুমার সিদ্ধার্থ (পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ) দুঃখমুক্তি লাভের দৃঢ় সংকল্পে রাজ্য, রাজত্ব, ভোগ বিলাস ধনকুম্ভ সবকিছু ত্যাগ করে সংসার পরিত্যাগ করেছিলেন শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে। তিনি সারথি ছন্দককে সাথে নিয়ে অশ্ব কন্থকের পিঠে চড়ে অনোমা নদীর তীরে পৌঁছলেন। রাজ আবরণ সারথি ছন্দককে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করলেন। তিনি ভাবলেন, আমি এখন সন্ন্যাসী, রাজকীয় বাহারি চুল কিবা প্রয়োজন। তরবারি দিয়ে চুলের গোছা কেটে নিলেন। তিনি মনে মনে অধিষ্ঠান করলেন 'যদি বুদ্ধ হওয়ার মত পারমী আমার মধ্যে থেকে থাকে তাহলে উর্ধ্ব দিকে নিক্ষিপ্ত চুলের এই গোছা মাটিতে না পড়ে আকাশে স্থিত থাকুক।' এই সংকল্প করে  তিনি চুলের গোছা উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেন। আশ্চর্যের বিষয় হল একটা চুলও মাটিতে পড়ল না। বৌদ্ধধর্ম মতে স্বর্গের ইন্দ্ররাজা এই চুলগুলো হীরা, মণি মানিক্য খচিত স্বর্ণপাত্রে ধারণ করে তাবতিংস নামক স্বর্গে উক্ত কেশ ধাতু স্থাপন পূর্বক একটি চৈত্য নির্মাণ করেন এবং এই চৈত্যের নাম রাখা হয় চুলামনি চৈত্য। স্বর্গের দেবতারা এখনও উক্ত চুলামনি চৈত্যের পূজা করে থাকেন বলে বৌদ্ধদের বিশ্বাস। কিন্তু মর্ত্যের বুদ্ধভক্ত পূজারীরা তো স্বর্গে আরোহণ করতে পারেন না। তাই তারা পরম শ্রদ্ধায় কাগুজে ফানুস তেরি করে একটি বিশেষ দিনে ধর্মীয় রীতি নীতি মেনে চুলামনি চৈত্যকে পূজা করার উদ্দেশ্যে আকাশ প্রদীপ হিসেবে ফানুস বাতি উত্তোলন করে থাকেন। ধর্মীয় গাঁথা বা মন্ত্র পাঠ করে উৎসর্গ করে খালি পায়ে বৌদ্ধরা প্রদীপ বা বাতি হিসেবে ফানুস উড়িয়ে উক্ত চুলামনি চৈত্যকে বন্দনা জানান। বিশেষ করে বৌদ্ধ ভিক্ষুর দ্বারা মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে সাধু ধ্বনির সুরে সুরে ফানুস ওড়ানো হয়। যেই স্মৃতির উদ্দেশে ফানুস ওড়ানো হয় সেই হিসেবে আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিনে ফানুস ওড়ানোর কথা। কিন্তু আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে বৃষ্টি এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় অনেক সময় ফানুস ওড়ানোর পরিবেশ এবং সুযোগ কোনটিই থাকে না। তাই দীর্ঘ তিনমাসব্যাপী বর্ষাব্রত পালন করার পর প্রবারণা পূর্ণিমা বা আশ্বিনী পূর্ণিমা দিনে ফানুস ওড়ানো হয়।

যখন তখন ফানুস ওড়ানো নয়

ফানুস কোন বেলুন নয় যে যখন তখন যেনতেনভাবে ওড়ানো যাবে। বেলুন ওড়ানোর ক্ষেত্রে কোন কালাকাল নেই, সময় অসময় নেই। রীতি নীতি বা ধর্মীয় মন্ত্রের প্রয়োজন নেই। কিন্তু ফানুসের ক্ষেত্রে পালনীয় অনেক বিধি বিধান আছে। ফানুসের সাথে জড়িয়ে আছে একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি। সাম্প্রতিক সময়ে যে কেউ যেনতেন ভাবে যখন তখন ফানুস ওড়াচ্ছেন। তাদের কাছে এটা কেবল বেলুন সর্বস্ব আনন্দ লাভের উপায় মাত্র। আবার অবৌদ্ধরা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য এটা করেন বলে মনে করিনা। তাদের মনোযোগ থাকে আসলে আনন্দ লাভের দিকে। প্রবারণা পূর্ণিমা দিনে দেশব্যাপী বৌদ্ধদের সাথে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও মিলেমিশে ফানুস ওড়াতে দেখা যায়। এটা সম্প্রীতির ক্ষেত্রে ভাল দিক। কিন্তু বিশেষ দিন ছাড়া বেলুন হিসেবে যখন তখন এভাবে ফানুস ওড়ানো ঠিক হচ্ছে না।

এটা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ কিনা

ফানুস ওড়ানো নিয়ে ঢাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে ঘোষণা এসেছে তা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে বলে মনে করিনা। কারণ বৌদ্ধদের বিশেষ দিনে অর্থাৎ প্রবারণা উদযাপনের সময় ফানুস ওড়াতে রাষ্ট্র বা প্রশাসন কখনো নিষেধ করেনি। গেল বছরের প্রবারণায় রোহিঙ্গা ইস্যৃতে ভয়, উৎকণ্ঠা আর সমবেদনা জ্ঞাপন যে কারণেই হোক না কেন ফানুস ওড়ানো থেকে বৌদ্ধরা স্বেচ্ছায় বিরত থেকেছেন। বরং ফানুস ওড়ানোর জন্য প্রশাসন বার বার সমন্বয় করেছেন। তবে বিষয়টা বিবেচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এক এক জায়গা থেকে শত শত ফানুস উত্তোলন করা আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা এ বিষয়টিও বিবেচনা করার দরকার আছে। ফানুস উত্তোলনে আনন্দ যেমন আছে, তেমন ঝুঁকিও আছে। একথা অস্বীকার করার জো নেই। অনভিজ্ঞ যে কেউ যেনতেন ভাবে ফানুস ওড়ালে এটা আগুন নিয়ে খেলা করার মত হয়ে যাবে। ফানুসের আগুনে ঘর-বাড়ি কিংবা সম্পদের ক্ষতি হয়েছে এমন অভিযোগ তুলে যেকোন সময় দুর্ঘটনা ঘটানোর সুযোগের অপেক্ষায় ওঁতপেতে কেউ থাকে না এমন নিশ্চয়তাও দেওয়া যায় না। আবার কেউ সুযোগ নিতে চায় বলে আমরা আমাদের সংস্কৃতিকেও ভুলে যেতে পারবো না। তবে ফানুস ওড়ানোর ক্ষেত্রে একটি নিয়মের মধ্যে ফিরতে পারলে ভাল হত বলে মনে করি।