খালেদা জিয়ার রায়,  লন্ডনে বিএনপির প্রতিহিংসা ও বঙ্গবন্ধুর অপমান

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 8 Feb 2018, 03:36 PM
Updated : 8 Feb 2018, 03:36 PM

রায়ের আগের দিন 'জিয়া এতিমখানা তহবিল মামলা'য় খালেদা জিয়া বিচার সম্পর্কিত টক শো দেখছিলাম। মাঝখানেই হঠাৎ জানানো হলো লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনে বিএনপি সমর্থকরা বিচারের প্রতিবাদে হামলা করেছে।

ক্ষোভ ও সহিংসতা থেকে হামলা হতে পারে—আমি এতে অবাক হবো না। কারণ মানুষের মধ্যে—তা সে বিএনপি দলেরই হোক, কী আওয়ামী দলেরই—সহিংসতা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলা এখন প্রায় বিরল হয়ে গেছে, বিরল বললে কম বলা হয়, বলা উচিৎ রাজনীতির সুস্থ ও শোভন ভাষাটি বিলুপ্তই হয়ে গেছে। এই বিলুপ্তি নিয়ে আমরা সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন হলেও এখন আর অবাক হই না। তবে হামলার ধরনটি দেখার ব্যাপারে আমার একটু কৌতুহল ছিল। পরে পত্রিকাগুলোর ওয়েব সংস্করণে তার কয়েকটি চিত্র দেখে ধরে নিয়েছিলাম, এ আর এমন কিছু নয়।

পত্রিকায় বলা হয়েছে

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্য বিএনপির বিক্ষোভ থেকে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসে ভাঙচুর চালানো হয়েছে।

ঢাকার আদালতে রায়ের আগের দিন বুধবার বিকালে বিএনপির শতাধিক নেতা-কমী‍‍‍ ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে দূতাবাস চত্বরে জড়ো হন।

তারা স্লোগান দেন- 'আমার মায়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে, আমার নেত্রী বন্দি হতে দেব না।'

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু মানুষ ভিতরে প্রবেশ করে শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি খুলে নিয়ে ভাংচুর করে।  (সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)

এই সংবাদে ব্যাপারটা যে- রকমভাবে  দেখতে পাচ্ছি তা খুব একটা বিচলিত করেনি আমাকে, কেন করেনি তার জবাবে বলতে পারি যে ক্ষোভ থেকে তারা করতেই পারেন। আপনারা আবার ধরে নেবেন না যে আমি এই ভাঙচুরকে ন্যায়সঙ্গত মনে করছি। না, তা নয়। আমি ক্ষোভের ভাষাটির বিশ্লেষণ করার স্বার্থে স্রেফ উদারহণ হিসেবেই কথাটা বললাম।

বিএনপির সমর্থকরা স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিল হাইকমিশনে, তাদের দাবী অনুযায়ী শাস্তিপূর্ণভাবেই গিয়েছিল। হাই কমিশন তা গ্রহণ করেনি। আমি মনে করি গ্রহণ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু গ্রহণ করেনি বলে হাই কমিশনের ভেতরে ঢুকে কেবল ভাঙচুরই করেনি, তারা মারধরও করেছে সেখানকার কর্মীদের। আমি এতেও আসলে অবাক হইনি। সহিংস বিক্ষোভকারীদের কাছে এতো নিতান্তই মামুলী ব্যাপার। কিন্তু বিচলিত হয়েছি ওই ভবনের বাইরে যা- ঘটেছিল তার ভিডিও দেখে।

ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোকচিত্রের উপর জুতাঘাত করে তাদের ক্ষোভ মেটাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে আমি ভাবার চেষ্টা করেছিলাম, ক্ষোভ প্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষ অনেক সময়ই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। কিন্তু কতটা জ্ঞানশূন্য হলে এমন একজন মানুষের প্রতিকৃতির উপর জুতাঘাত করা সম্ভব যিনি ঘটনার কারণের সাথে কোনোভাবেই যুক্ত নন?

ঘটনাটি বিশ্লেষণের স্বার্থে আসুন কল্পনা করে নেই, তাদের ক্ষোভ এই সরকারের প্রতি, যেহেতু এই সরকারের আমলে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার দুর্ননীতির মামলার বিচার কাজ চলছে। এই সরকারের প্রধান এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটা অনুমান করা অতিকল্পনা হবে না যে  শেখ হাসিনার প্রতিকৃতির উপর  তাদের ক্ষোভ ঝারবেন। তেমনটা হয়েছে কিনা ভিডিওতে তা দেখা যাচ্ছে না। হয়তো হয়েছে। না হলেও আমার প্রশ্নটা সেখানে নয়। প্রশ্ন হলো শেখ মুজিবের উপর তাদের ক্ষোভটা কেন? শেখ মুজিব কি এই মামলা রুজু করেছেন বা তিনি কি ঘাতকদের হাতে নিহত হওয়ার আগে ভবিষ্যতবক্তার মতো বলে গিয়েছিলেন যে  ভবিষ্যতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একটা দুর্নীতি মামলার করে দিও যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে? তেমন কিছু তো তিনি বলেননি। তাহলে  বিএনপির ক্ষোভটা কেন শেখ মুজিবের প্রতি?

আমি নিশ্চিত বিএনপির বেশির ভাগ নেতা কর্মীদের কাছে এর উত্তর নেই,  না-থাকার কারণ তারা এই ঘটনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। থাকবার কথাও নয়। সত্য বটে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শত্রু বিএনপি, আর বিএনপির রাজনৈতিক শত্রু আওয়ামী লীগ। তারা রাজনৈতিক ঘৃণা, প্রতিহিংসা ও ক্ষোভ থেকে শেখ হাসিনাকে অস্বীকার ও অপমান করতে পারেন, কিন্তু শেখ মুজিব সম্পর্কে তারা ততদূর যাবেন না। কারণ তারাও তো একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিষ্ঠিত দলেরই নেতা বা কর্মী। যে-জিয়াউর রহমান জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কখনো কটূক্তি পর্যন্ত করেননি, এমনকি আমার যদ্দুর মনে পরে খালেদা জিয়াও কখনো সরাসরি ব্যক্তি মুজিবকে নিয়ে কোনো কটূক্তি করেননি।

কিন্তু তার দলের কোনো কোনো  নেতা বা কর্মী শেখ মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জিয়াউর রহমানকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টাকেও আমি দেখি এক ধরনের রাজনৈতিক ধূর্ততা বা চাতুরী হিসেবে, ওতে শেখ মুজিবের অপমান হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু লন্ডনে আজ যেটা হলো তা শেখ মুজিবকে অপমান করা হলো। শেখ মুজিব নিছক কোনো ব্যক্তি নন, এমনকি নন কেবলই একটি দলের নেতা, কিংবা এককালের প্রধানমন্ত্রী। এই পরিচয়গুলো ছাড়িয়ে তিনি প্রধানত স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। আমরা যদি বাংলাদেশকে স্বীকার করি, আর যদি স্বীকার করি আমরা বাংলাদেশি তাহলে তিনি আমাদের কাছে মহান ও সম্মানিত এক ব্যক্তি। আমার ধারণা বিএনপিও এ ব্যাপারে দ্বিমত করবে না। কিন্তু তারপরেও লন্ডনে অনাকাঙ্ক্ষিত অপমানজনক ঘটনাটি ঘটেছে বিএনপির কর্মী বা সমর্থকদের মাধ্যমে।

আমি অনুমান করি বিএনপির স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এই ঘটনায় বিব্রত বোধ করছেন্। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে  এই দলের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে এই পক্ষের ভূমিকা এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। রাজনৈতিক চাতুরী হিসেবে  ও ক্ষমতায় আরোহনের আশায় বিএনপি জামায়াতের সাথে গাটছড়া বেঁধে দীর্ঘপথ পারি দিয়ে তাদের যা অর্জন করার কথা ছিল তা তো অর্জিত হচ্ছেই না, বরং বিসর্জনের পাল্লাই ভারী হয়ে উঠেছে।

বিএনপির শরীর থেকে রক্ত চুষে নিয়ে জামায়াতের পুষ্টিলাভ হচ্ছে। এই কথাটা বলছি এই কারণে যে লন্ডনের এই ঘটনাটি নিছক বিএনপির হামলাই নয়, এর সাথে জড়িত আছে জামায়াত-সমর্থক কর্মীরাও, তবে তারা আছে বিএনপির ছদ্মবেশে, বিএনপিরই প্রশ্রয়ে। বঙ্গবন্ধুকে জুতাপেটা করার মতো ক্ষোভ বিএনপির নেই, থাকার কোনো যৌক্তিক কারণও নেই, কিন্তু জামায়াতের আছে। জামায়াত এই দেশকে স্বাধীন দেখতে চায়নি, তাদের শত্রু ছিলেন শেখ মুজিব, তাদের শত্রু ছিলেন জিয়াউর রহমানও, যেহেতু তিনিও একই লক্ষে যুদ্ধ করেছেন।

কিন্তু রাজনীতি অনৈতিকতার রম্য প্রহেলিকায় প্রবেশ করে ক্ষমতার লোভে, তাই সে শক্রকেও মিত্র করে নেয়, যেমন নিয়েছে আওয়ামী লীগ অল্প সময়ের জন্য আর বিএনপি  অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময়ের জন্য বুকে টেনে নিয়েছে জামায়াতে ইসলামীকে। জামায়াতকে বন্ধু করার বিপদটা উভয় দলই করেছে, তবে এই বিপদের মাসুল গুণতে হচ্ছে অনেক বেশি বিএনপিকে। লন্ডনের ঘটনাটা সেই মাসুলের প্রকাশ। বিক্ষোভ নতুন কিছু নয়। এর চেয়েও তীব্রতর কোনো বিক্ষোভ যদি বিএনপি বাংলাদেশের কোথায়ও ঘটাতো তাহলে সেটা কোনোদিনই স্বাধীনতার স্থপতিকে অপমানের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাতো বলে মনে হয় না।

আমার ধারণা বিএনপির নেতাকর্মীরাই সেরকম করার কোনো প্রয়োজন বোধ করতেন না। কেনই বা করবেন! সোজা হিসেব: শেখ মুজিব এখানে আসবে কেন? শেখ মুজিবের দোষটাই বা কী? কিন্তু বিএনপি এখন এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারেক জিয়ার নেতৃত্ব যে জামায়াতের লক্ষ্যকেই তাদের নিজের লক্ষ্য করে নিয়েছে। এর নজীর গত কয়েক বছরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে তাদের প্রতিক্রিয়াতেই আমরা লক্ষ্য করেছি। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে যদিও বলেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কথা, কিন্তু তা যে মূলত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন ছাড়া অন্য কিছু নয় তা সবাই বুঝে নিয়েছেন। লন্ডনের হামলাটিও সেই পক্ষাবলম্বনের আরেকটি প্রতীকি প্রকাশ ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিকে অপমানের মাধ্যমে।

ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য বিএনপি যে আত্মঘাতী পথ বেছে নিয়েছে—এটা স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুকে অপমানের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকেই অপমান করেছে, অপমান করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই। এবং এই অপমান এক অর্থে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় বলেছিলেন, "মহান জাতীয় নেতা, বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।"

এটা সত্য যে বাংলাদেশের মানুষ এখনও প্রধানত দুইটি দলে বিভক্ত: বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ। কিন্তু তারা উভয়ই স্বাধীনতারই পক্ষের। বৃহত্তর মানুষের মনস্তত্ত্বকে অবহেলা বা অপমান করে কোনো রাজনৈতিক দলই কোনো বিষয়ে বিজয় অর্জন করতে পারে না।

সহিংসতা কোনো রাজনৈতিক সমাধান নয়। বিএনপির নেতৃবৃন্দও  বলছেন তারা সহিংসতায় বিশ্বাস করেন না। তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বা প্রতিবাদ অব্যাহত রাখবেন। তাহলে লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনে এই সহিংসতার পথ বেছে নিলেন কেন? একি তাহলে বিএনপির আদর্শ থেকে বিচ্যুত তারেক জিয়ার একক নির্দেশে ঘটেছে? আমার ধারণা এটি তারেক জিয়ার অবিবেচনাপ্রসূত পরিকল্পনারই বহিঃপ্রকাশ।

এই ধরনের পদক্ষেপ মানুষের কাছে বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকে কমিয়ে দেবে। তারেক জিয়ার বোঝা উচিৎ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের চৌধুরী মইনুদ্দিনদের ইচ্ছার দাস হয়ে শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিকে অপমান করতে পারবেন হয়তো, কিন্তু রাজনৈতিক বিজয় সম্ভব নয়, বরং এতে করে বিএনপিকে নৈতিকভাবে আরও দেউলিয়া করা হবে।  তার চেয়েও যেটা বেশি বেদনার তাহলো বিএনপির কাঁধে ভর করে  জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার অপমান করতে পারছে।

হামলার আরও একটি ভিডিও:

https://www.facebook.com/100010184359103/videos/617947451888061/