বয়ঃসন্ধিকাল, আচরণীয় সমস্যা ও যৌনশিক্ষা

ফারহানা মান্নানফারহানা মান্নান
Published : 13 May 2012, 05:43 PM
Updated : 13 May 2012, 05:43 PM

ছেলেটির নাম বাঁধন। বয়স বর্তমানে ১৬। এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা থাকলেও সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আগামীতে আবার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের একটা আশা থাকলেও সেটা হয়ে উঠবে এমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কয়েক বছর আগেও ছেলেটি ছিল সহজ, স্বাভাবিক। বিভাগীয় জেলা স্কুলে প্রি-টিনেজ সময়কাল অতিবাহিত করেছে স্বচ্ছন্দে। কিন্তু সাবালক হবার দৌড়ে বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক, মানসিক ও আচরণীয় পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি। পরিবারের প্রতি অযাচিত ক্রোধ, আক্রোশ, ঘৃণা, হীনম্মন্যতা তার ব্যক্তিত্ব ও সক্রিয়তা তৈরিতে বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছিল।

বয়ঃসন্ধিকালের ১৩-১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে এ ঘটনা নতুন না হলেও এ ধরনের সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে বাবা-মা, বিদ্যালয়ের সুস্থ পরিবেশকে প্রাধান্য না দিয়ে একজন মনোচিকিৎসাবিদের দারস্থ হওয়াকেই প্রাধান্য দেয় এ সমাজ। একজন মনোচিকিৎসক ব্যক্তির আচরণ বিশ্লেষণ করেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি দক্ষ। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যে বাবা-মা বছর বছর ধরে তার সন্তানকে লালন -পালন, পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন, সে সন্তানের আচরণীয় পরিবর্তনের ধারা সম্পর্কে একজন মনোচিকিৎসকের চেয়ে বাবা-মা বেশি ভালো জানবেন সেটাই আশা করা যায়।

বয়ঃসন্ধিকালের এ সময়ে ছেলেমেয়েদের একটি বড় ধরনের আচরণীয় পরিবর্তন ঘটে হরমোনজনিত এবং শারীরিক পরিবর্তনের কারণে। কয়েক বছর ধরে চলা puberty-এর সময়কালে ব্যাপক হারে দৈহিক বৃদ্ধি ও দ্রুত মানসিক পরিবর্তন ঘটে। এভাবে (ছেলেদের জন্য ১২/১৩, মেয়েদের ১০/১১ বছর শেষে) চূড়ান্ত পর্যাপ্ত যৌনতার বিকাশ ঘটে। সাধারণত শিশুর তৃতীয় বছরে যৌনকৌতূহল শুরু হয়। প্রথমে পুরুষের সঙ্গে নারীর, বয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে শিশুর দৈহিক পার্থক্য তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শৈশবে এ কৌতূহলের কোনো বিশেষত্ব নেই। এটা তার সাধারণ কৌতূহলের অন্তর্গত, প্রকৃতপক্ষে রহস্যের বেড়াজালে আবৃত বিষয়ের প্রতিই শিশুরা প্রচন্ড কৌতূহলী হয়। শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিষয়টি সত্য কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিষয়টি শঙ্কাহীন চিত্তে আলোচনার বস্তু নয় কখনোই। যৌন-সম্পর্কিত বিষয় এত কুসংস্কার ও নিষেধের বেড়াজালে ঘেরা যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের মানসিক, আচরণীয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এ বিষয় আমলে আনেন না। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বয়ঃসন্ধিকালের নানা পরিবর্তনের ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয় না এবং পাঠ্যপুস্তকেও প্রাধান্য পায় না যৌনশিক্ষার বিষয়টি।

মনঃসমীক্ষকরা দেখেছেন যে, শৈশবেও যৌনপ্রবৃত্তি বিদ্যমান থাকে। যৌনপ্রবৃত্তির প্রকাশ শিশুদের ক্ষেত্রে বয়স্ক ব্যক্তিদের আচরণ থেকে আলাদা। শিশুর পক্ষে বয়স্ক ব্যক্তির মতো যৌন ব্যাপারে লিপ্ত হওয়া দৈহিক দিক দিয়ে সম্ভব নয় কোনোভাবেই। প্রথম যৌবনাগমন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে এক প্রক্ষোভময় আলোড়ন সৃষ্টি করে। লেখাপড়ার মাঝখানে বয়ঃসন্ধিক্ষণের রঙ্গীন উম্মাদনা স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণের পথে সংকট সৃষ্টি করে। ছেলেমেয়েদের আচরণে চিন্তাভাবনায় মানসিকতায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এই সব সংকট অতিক্রম করে কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা বাবা-মা ও শিক্ষক উভয়ের জন্যই বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার ধারায় পরিবর্তন এনে শিক্ষার্থীদের বয়ঃসন্ধিকালের বিবিধ ইস্যু বা বিষয়ে শ্রেণীকক্ষে অবহিতকরণ, যৌন-সংক্রান্ত ব্যাপারে সুস্থ, স্বাভাবিক, মার্জিত শিক্ষা, লুকায়িত শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে আচরনীয় পরিবর্তন ঘটানো দরকার।

জন্মের পর শিশুর জীবনের প্রথম কয়েক বছরে শিশু তার চারপাশের মানুষ ও সমাজের সহায়তায় সক্রিয়তা অর্জন করে। এ সময়ে শিশুর পরিচর্যার ভার যদি অশিক্ষিত পরিচারিকার উপর ন্যস্ত করা হয় তবে যৌনসংক্রান্ত কুসংস্কারগুলো দুরীকরনণর ক্ষেত্রে তা প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এ সব অভিভাবকদের বেশিভাগেরই শিশু মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানের অভাব লক্ষ্য করা যায়। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অনেকেই মনোবিজ্ঞান নিয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখেন না। মনোবিজ্ঞান প্রকৃত অর্থে বৈজ্ঞানিকভাবে মানসিক ক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে। যৌবনারম্ভে যে দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে সে ব্যাপরে আগে থেকে তাকে অবহিত না করলে তাদের ভেতর আচরণগত অস্বাভাবিকতা চলে আসতে পারে। প্রকৃতপক্ষে কিশোর-কিশোরীদের কাছে এ বিষয়টি যেন উম্মাদনাকর।

এ বিষয়ের আলোচনা তার শৈশবে যতখানি বিজ্ঞানসম্মত মনোভাবের সঙ্গে গ্রহণযোগ্যতা পায়, যৌবনের বিকাশের পর ঠিক তেমনভাবে আর পায় না। কাজেই যৌনজীবনের ব্যাপারে কুৎসিত আলোচনা করার সম্ভাবনা বাদ দিলেও বালক বা বালিকাকে যৌবনারম্ভের আগে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেয়া উচিত এবং এ শিক্ষা বালক এবং বালিকা উভয়ের ক্ষেত্রেই সমান হওয়া দরকার। বার্ট্রান্ড রাসেল-এর মতে,

'যৌবনাগমনের কতদিন আগে এ শিক্ষা দেয়া উচিত তা কতকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করবে। অনুসন্ধিৎসু এবং বুদ্ধিসম্পন্ন শিশুকে জড়-প্রকৃতির শিশুর চেয়ে আগে এ শিক্ষা দিতে হবে। কখনো কোনো অবস্থাতেই শিশুর কৌতূহল অপরিতৃপ্ত রাখা উচিত হবে না। শিশু বয়সে যত ছোটই হোক, সে যদি জানতে চায় তার কৌতূহল মেটাতেই হবে। কিন্তু সে যদি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কোনো প্রশ্ন না করে কুসংসর্গ থেকে খারাপভাবে কিছু জেনে ফেলে, সে দোষ নিবারনণর জন্য দশ বছর বয়সের আগেই তাকে যৌনজীবনের ব্যাপারে শিক্ষা দিতে হবে। এমন ক্ষেত্রে গাছপালার বংশবৃদ্ধি ও প্রাণীর প্রজনন সম্বন্ধে আলোচনার ভিতর দিয়ে স্বাভাবিকভাবে তার কৌতূহল উদ্দীপ্ত করা প্রয়োজন। এজন্য কোনো গুরুগম্ভীর ভূমিকার প্রয়োজন নেই। অতি সাধারণভাবে দৈনন্দিন যে কোনো ব্যাপারের মতোই এ প্রসঙ্গ তুলতে হবে। এ জন্যই শিশুর কোনো প্রশ্নের উত্তর হিসেবে এ বিষয়ে আলোচনা করলেই ভালো হয়।'

উপরে উল্লেখিত বার্ট্রান্ড রাসেলের আলোচনা বা মতামত সাপেক্ষে প্রসঙ্গের উত্থাপন করা অবশ্যই যথোপযুক্ত একটি উপায়। তবে পদ্ধতি বা প্রকৃতি যেমনই হোক, দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা ভেদে এ প্রসঙ্গের উত্থাপনের ধরন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মোদ্দা কথা হল, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের শিশু মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা, যৌনসংক্রান্ত বিষয়ে যৌবনাগমনের আগেই পারিবারিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশে আলোচনা এবং পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ের স্পষ্ট উপস্থিতি বয়ঃসন্ধিকালের শিক্ষার্থীদের অযাচিত আচরণীয় সমস্যা নিরসনে আশানুরূপ ভূমিকা রাখবে। তবে বিষয়টি আমাদের সমাজ ব্যাবস্থায় গ্রহণযোগ্য করে উত্থাপন করতে হলে, ধর্মীয় রীতি, সংস্কৃতির রূপ, রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থার রীতি এবং সমাজের অন্যান্য মানুষের ইতিবাচক হস্তপেক্ষপকে বিবেচনায় আনতে হবে। একটা সুস্থ সমাজ গঠনে এবং বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা নিরসনে তাই যৌনশিক্ষাকে মানুষের চরিত্র এবং আচরণ গঠনের ক্ষেত্রে অন্যান্য শিক্ষার মতোই প্রাধান্য দিতে হবে।

সুতরাং অভিভাবকরা পারিবারিকভাবে ছেলেমেয়েদের যৌবনাগমনের আগেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারলে ভাল হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকেরা মানবদেহ, প্রজনন ইত্যাদি বিষয় আলোচনার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকেও সম্পর্কযুক্ত করে উত্থাপন করতে পারেন। পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি উল্লেখের ক্ষেত্রে কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদএবং পাঠ্যপুস্তক রচনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য পন্ডিত, বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের মতামত আমলে নেওয়া দরকার। সংলাপের ভিত্তিতে এসব কাজ যত দ্রুত শেষ করা যায় (অন্তত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে) ততই মঙ্গল। এতে তরুণ সমাজের অস্থিরতা কিছুটা লাঘব হবে বলে আশা করা যায়।

প্রস্তাবিত এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে, আমার ধারণা ইভটিজিং এবং অপ্রত্যাশিত যৌন-অপরাধও অনেক কমে আসবে।