মানবিক বাংলাদেশ চাই

Published : 5 Feb 2018, 01:02 PM
Updated : 5 Feb 2018, 01:02 PM

১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবাদাতা সংগঠন সন্ধানী। সংগঠনটি এক চল্লিশ বছরে পদার্পণ করেছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের কিছু স্বপ্নচারী তরুণ মানবতার ডাক দিয়ে সমাজ সংসারে ভালবাসার দ্বীপ জ্বেলেছিলেন। এই তো সৃষ্টির সেরা জীব, মানুষের কাজ! গর্বিত চিকিৎসকের কাজ!

শ্রদ্ধার সাথে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এর উদ্যোক্তাদের স্মরণ করছি। তারা ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ছয় বন্ধু- মোস্তাফিজুর রহমান স্বপন, মোশাররফ হোসেন মুক্ত, মো. ইদ্রিস আলী মন্জু, মো. আব্দুল কাইউম, মোস্তফা সেলিমুল হাসনাইন ও খুরশীদ আহমেদ অপুকে, যারা মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিয়ে 'সন্ধানী' প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৭৭ সালের প্রথম দিকে মো. ইদ্রিস আলী জানতে পারেন যে তারই এক সহপাঠী আর্থিক প্রতিকূলতার কারণে সকালের নাস্তা না করে অভুক্ত অবস্থায় দুপুর ২টা পর্যন্ত ক্লাস করেন। তাঁকে ব্যাপারটি ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তিনি তাঁর অন্য পাঁচ বন্ধুদের সকালে নাস্তার টেবিলে এটি জানান।

এ নিয়ে কিছু একটা করতে ছয় বন্ধু একত্রিত হন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের এনেক্স ভবনের কড়ই গাছের নীচে।

নিজেদের মধ্যে আলোচনা ঠিক করেন একজন ৭ টাকা, বাকি পাঁচজন ৫ টাকা করে জমিয়ে তাঁদের এই বন্ধুকে দিবেন। যেহেতু তাঁদের বন্ধু নাস্তার টাকা নিতে চাইবে না তাই সবার টাকা জমা করে মো. ইদ্রিস আলীকে দেওয়া হবে এবং তিনি সহপাঠীকে বুঝিয়ে টাকা হস্তান্তর করবেন।

সহপাঠীকে মাসিক ৩২ টাকা সহযোগিতার মাধ্যমে ১৯৭৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু সন্ধানীর। প্রতিষ্ঠাতা ছয়জন তাঁদের কাজের সাংগঠনিক রূপ দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে 'সন্ধানী' নামে সংগঠনটির নামকরণ করেন।

পরবর্তীতে তাঁরা দেখলেন, রক্তের অভাবে হাসপাতালে অনেক রোগী মারা যাচ্ছে। তারা চিন্তা করলেন সবাই একটু স্বপ্রণোদিত হয়ে রক্তদান করলেই তো অনেকগুলো জীবন বেঁচে যায়! যেমন ভাবা তেমন কাজ। প্রতিষ্ঠার দেড় বছর পর ১৯৭৮ সালের ২ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজে  প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন সন্ধানীর উদ্যোক্তারা।

এরপর ১৯৮৪ সালের ২৫ নভেম্বর রংপুরের কিশোরী বালিকা টুনটুনির চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।

একটা সময় ছিল যখন ছেলে-মেয়েরা নিজেদের বাবা-মাকে জন্য, বাবা-মা এমনকি নিজ ছেলে মেয়েকে রক্ত দিতে ভয় পেতেন। এখন আর সেরকম নেই। এখন প্রয়োজনে যে কেউ রক্ত দিতে এগিয়ে আসছে। এটা সন্ধানীর অবদান।

সন্ধানী দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান কার্যক্রমের পাশাপাশি ভ্যাকসিনেশন, যেকোনও দুর্যোগে ত্রাণ সহায়তা, ওষুধ বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, বৃত্তি দেওয়াসহ নানাবিধ সামজিক ও মানবিক কাজ করে আসছে।

আজকের পৃথিবীর দিকে তাকান। ক্ষমতা আর অর্থ-সম্পদের জন্য মানুষ কেমন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষ মঙ্গল গ্রহে আবাস গড়ার স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশও উন্নয়নের মহাসড়কে। কিন্তু আমরা কী ভেবে দেখেছি মানুষ হিসেবে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমাদের চারপাশ প্রতিনিয়ত হানাহানি, মারামারিসহ মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ছেঁয়ে গেছে। পশুরাও বুঝি আমাদের দেখে লজ্জ্বা পাচ্ছে!

এই অবক্ষয় থেকে মুক্তির একটিই উপায়। সমাজে ভাল মানুষ তৈরি করা, যা কিছু ভাল তাকেই উৎসাহিত করা, প্রণোদনা দেয়া। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উল্টোটা ঘটছে, যা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

তাই এখনই সময় বিবেককে জাগিয়ে তোলার, মানুষের শ্রেষ্ঠ গুণাবলী তুলে ধরার, মানুষ মানুষকে ভালবাসার। ৪১ বছর সন্ধানী আমাদেরকে সেই পথেরই শিক্ষা দিয়েছে। আমরা একটি মানবিক বাংলাদেশ চাই। মানবিক পৃথিবী চাই।

সন্ধানীর প্রথম সংবিধানে উদ্দেশ্য হিসেবে লিখিত ছিল- "যাবতীয় অন্যায় অনাচার থেকে মুক্ত রেখে নিজেদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এবং মানবতার কল্যাণের জন্য সাধ্যানুযায়ী সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।"

আদর্শ-সততা-কল্যাণ, ব্যাপারগুলো সমাজ থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে ধরে রাখতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে। মানুষের উন্নতি হোক, পৃথিবী এগিয়ে যাক। কিন্তু সরলতা, ন্যায্যতা, নষ্ট না হোক। ভাল মানুষ টিকে থাকলে পৃথিবী টিকে থাকবে। মানবতাকে পরাজিত করলে পৃথিবী পরাজিত হবে।

মানবতার জয় হোক।

সন্ধানীর জয় হোক।