ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং অযৌক্তিক আইন

রাশেদ মেহেদী
Published : 2 Feb 2018, 01:11 PM
Updated : 2 Feb 2018, 01:11 PM

আমাদের দেশে আইন কারা তৈরি করেন, আইন তৈরির প্রক্রিয়াই বা কি? এ প্রশ্নের তাত্ত্বিক জবাব সহজ। দেশে সংসদীয় ধারার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে, অতএব এখানে আইন তৈরি করে জাতীয় সংসদ। কিন্তু বাস্তবে কি তাই হচ্ছে? আইন তৈরিতে জাতীয় সংসদের ভূমিকা কতটুকু?

এমনকি আইন তৈরিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকারি দলেরই বা কতটুকু ভূমিকা আমরা দেখতে পাচ্ছি? সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র অর্থ দেশ চলবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এবং আইন তৈরির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেবেন রাজনৈতিক নেতারা। নির্বাচিত রাজনৈতিক দল যখন সরকার পরিচালনা করে যখন নতুন কোন আইন তৈরি করতে যাবে অবশ্যই তার শুরুটা হওয়া উচিত দলের ভেতর থেকে।

সেক্ষেত্রে দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক এবং যে বিষয়ে আইন হচ্ছে সে বিষয় সম্পর্কিত সম্পাদকরেরাই প্রাথমিকভাবে আইনের প্রাথমিক কাঠামো তৈরি করবেন। এরপর এটি নিয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক হবে। তারপর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এটি চূড়ান্ত করে আইন প্রণয়নের যৌক্তিকতাসহ এটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন। এভাবে আইন তৈরি হলে সেটি হবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হওয়া আইন। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মূল কথা।

কিন্তু বাস্তবে সংসদীয় গণতন্ত্রের সময়ও আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া উপেক্ষিত থাকছে এবং আইন প্রণয়ন হচ্ছে পুরোপুরি আমলাতান্ত্রিক অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় । ফলে বেশিরভাগ আইনেই জনস্বার্থের বদলে আমলাতন্ত্রের হীন স্বার্থ সংরক্ষণ প্রাধান্য পাচ্ছে। যেমন সর্বশেষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথাই ধরুন। এই আইন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আরও প্রায় তিন বছর আগে। আমরা বার বার শুনি তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ এটির প্রাথমিক খসড়া তৈরি করছে, এরপর আইন মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করছে। এরপর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, তারপর অমুক সরকারি সংস্থা, তমুক সরকারি সংস্থা মত দিচ্ছে। কিন্তু একবারও জানা গেল না এই আইন তৈরিতে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদকের ভূমিকা কী ছিল, দলটির তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদকের ভূমিকা কতটুকু ছিল, সার্বিকভাবে দলীয় ফোরামের ভূমিকা ছিল? তাদের ভূমিকা সম্পর্কে কিন্তু জাতি কিছুই জানে না।

আসলে নামে সংসদীয় গণতন্ত্র হলেও আমাদের দেশে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার ব্যবস্থার মত আমলাতন্ত্রই প্রাধান্য পেয়েছে এবং পাচ্ছে। যে কারণে রাজনৈতিক সরকারের মন্ত্রীরা জনগণের নয়, আমলাদের আস্থাভাজন হওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এখানে ব্যবস্থাটা এমন জনগণের স্বার্থ নিয়ে সোচ্চার কেউ সকালে মন্ত্রী হলেও বিকেলেই তিনি জনতার দাবি ভুলে যাবেন এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সচিবের সুবিধা-অসুবিধা দেখাই তার কাছে দায়িত্বপালনের মূল বিষয় হয়ে উঠবে!

মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার দিকে তাকালেই বোঝা যায় এই আইনটি প্রণয়নে কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কারণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতিবিদরা এই আইন প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখলে এত মোটা দাগে আমলাদের অনিয়ম-দূর্নীতিকে সুরক্ষিত করার ব্যবস্থা রাখা হত না। এখন মন্ত্রীরা আমলাতন্ত্রের মায়াজালে সম্মোহিত আছেন বলেই তারা এই কালো ধারাকে যেনতেনভাবে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টাকে সমর্থন করছেন।

দেখুন, এই আইনের মূল বিষয় হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা। তাই সবার আগে বুঝতে হবে ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিরাপত্তা বলতে কী বোঝায় এবং বর্তমানে এই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ কী?  ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অনলাইন ব্যবস্থায় সাইবার হামলা এবং হামলাকারীকে সনাক্ত করা। এ কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবার আগে জরুরী আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনলাইনে অপরাধী সনাক্ত করার সক্ষমতা নিশ্চিত করা। সক্ষমতার ঘাটতি আছে বলেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সাইবার হামলায় ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় অপরাধীদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু দেশে তথ্য প্রযুক্তি আইন থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, উভয় ক্ষেত্রেই ডিজিটাল নিরাপত্তার পরিবর্তে 'ডিজিটাল গালি' ঠেকানোই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন এর আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা জোরদার করার নামে সাইবার হামলার হুমকি সনাক্ত করার প্রকল্পেও সাইবার হামলা মোকাবেলার বিষয় পুরো বাদ দিয়ে মেসেঞ্জারে আড়িপাতার ব্যবস্থাকেই হাস্যকরভাবে 'সাইবার থ্রেট রেসপন্স' হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এবার আইনেও ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার চেয়ে তথাকথিত বৃটিশ ঔপনিবেশের 'অফিস সিক্রেসি' কে আরও পোক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ এ ধারায় বলা হয়েছে, 'যদি কোন ব্যাক্তি বে-আইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্ত্বশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোন সংস্থার কোনর ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ।' এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল অথবা ২০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

৩২ ধারা পড়লেই এই আইন তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ডিজিটাল মূর্খতা এবং অশুভ উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হয়ে যায়। আইনের শিরোনাম 'ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮'। অথচ আইনের এই ধারায় সরকারি অফিসের কাগজ-পত্রের ফাইলের ছবি ডিজিটালল ডিভাইস যেমন ডিজিটাল ক্যামেরা অথবা স্মার্টফোনের ক্যামেরা দিয়ে কেউ তুললে সেটাকে ডিজিটাল অপরাধ কিংবা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য করা হয়েছে। কতটা হাস্যকর! কাগজপত্রের ছবি তোলাকে ডিজিটাল অপরাধ গণ্য করা হচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে এদের ডিজিটাল জ্ঞানের দৌড় চোখের সামনে দেখা কিছু ডিজিটাল ডিভাইস পর্যন্তই। ডিজিটাল ব্যবস্থা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই, সাইবার স্পেস তো বহুদূরের কথা!

এই ধারায় 'গুপ্তচরবৃত্তি' শব্দটি সম্পর্কে নিজের পেশাগত দায়িত্বপালনের একটা অভিজ্ঞতা বলি। তাহলে এ ধরনের একটি হাস্যকর ধারা কেন, কীভাবে ডিজিটাল আইনে যোগ হয়েছে তাও পরিষ্কার হবে।  বছর খানেক আগে সমকালে আমার একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানির অভ্যন্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে। এই রিপোর্ট ছাপার পর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী আমার রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটি গঠনের সময় তিনি বলেছিলেন, এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তিনি সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করবেন। কিন্তু মাস তিনেক পর যখন তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিল তখন মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আর সংবাদ সম্মেলন করলেন না। বরং প্রচণ্ড ব্যস্ততায় তিনি তদন্ত রিপোর্ট দেখার সময় পাচ্ছেন না, সে কথা জানালেন প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। এরপর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নিয়ম অনুসরণ করে সেই তদন্ত রিপোর্টের কপি সংগ্রহ করে রিপোর্ট করলাম। তখন সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল কেন তদন্ত রিপোর্টটি প্রকাশ করা হচ্ছিল না।

আসলে এই তদন্ত রিপোর্ট দিয়ে 'বিএসসিসিএল এর অনমিয়-দূর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করা সাংবাদিককে জব্দ করার একটা পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তদন্ত কমিটি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যে রিপোর্ট দিয়েছিল, তাতে বরং সমকালের রিপোর্টের সত্যতাই প্রমাণিত হল। সে সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে সচিব পদেও রদ বদল হয়েছে। নতুন সচিব মহোদয়ের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তিনি প্রশ্ন তুললেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের বিভিন্ন নথির তথ্য সাংবাদিকরা কীভাবে পাচ্ছে সে সম্পর্কে। আমার সঙ্গে দৈনিক আমাদের সময়ের শাহীদ বাপ্পী ছিলেন। আমাদের দু'জনকেই সচিব মহোদয় বললেন, 'আমরা বেশ বুঝতে পারি মোবাইল ক্যামেরায় ফাইলের ছবি তুলে আপনাদের কেউ কেউ পাঠায়। আপনাদের জানা উচিত এভাবে মোবাইল দিয়ে সরকারি অফিসের কাগজ-পত্রের ছবি তোলা কিন্তু আইসিটি অ্যাক্টেই অপরাধ। এ ধরনের অপরাধকে আসলে গুপ্তচরবৃত্তিও বলা উচিত।'

আমার জবাব ছিল, 'সরকারি অফিসের নথি-পত্র চেয়ে পাওয়া যায় না বলেই এই সমস্যা। যেমন বিটিআরসি'র কমিশন সভা, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির বোর্ড সভার কার্যবিবরণী, সরকারি তদন্ত রিপোর্ট সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এমনকি প্রতিবেশি ভারতেও প্রতিরক্ষা বাদে অন্যসব সরকারি তথ্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে এবং তা অনলাইনেও পাওয়া যায়। আমাদের এখানে এ ধরনের তথ্য-উপাত্ত, নথি-পত্র গোপন রাখা হয় বলেই আমাদের নানা কৌশলে সংগ্রহ করতে হয়।

সে সময় সচিব মহোদয় জোর গলায় বললেন, যা কাগজ-পত্র আমাকে বলবেন, আমি আপনাকে দেব। আমরা দু'জন খুশি হয়ে ফিরলাম। কিন্তু কয়েকদিন পরেই যখন 'এমওটিএন' নামে একটি প্রকল্প সম্পর্কিত কিছু কাগজ-পত্র চাইলাম, তখন দেখা দূরের কথা, সচিব মহোদয় ফোন ধরাই বন্ধ করে দিলেন। শুধু তাই নয়, পরে যখন বিএসসিসিএল এর আরও অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে দালিলিক প্রমাণসহ রিপোর্ট করলাম, তখন উকিল নোটিশ পাঠানো হল, মামলা দায়েরও হল। তদন্ত কমিটি দিয়ে জব্দ করতে ব্যর্থ হয়ে প্রমাণিত সত্য রিপোর্টের জন্য প্রতিহিংসামূলক মিথ্যা মামলা!  এখন বোঝেন হাতে ৩২ ধারা পেলে এই আমলারা কি ভয়ঙ্কর বেপরোয়া হয়ে উঠেবেন!

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে 'গুপ্তচরবৃত্তি' শব্দটা দেখার পর সচিব মহদোয়ের সেদিনের কণ্ঠ আবার কানে বেজে উঠল। আসলে স্মার্টফোনে ক্যামেরা আসার পর সরকারি নথি সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া সাংবাদিকদের পাওয়া আগের চেয়ে সহজ হয়েছে, এটা সত্য। আমলাদের দুর্নীতির আয়োজনেও এ কারণে ঝামেলা বেড়ে গেছে। এই ঝামেলা মুক্ত হতেই আইনের মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিহীন ৩২ ধারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যুক্ত করা হয়েছে, এটা বুঝতে আর কারও বাকী থাকে না।

সাংবাদিকরা কোন ধরনের তথ্য প্রকাশ করে! আমার জানা মতে সাংবাদিকরা কেউই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যান না এবং রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত কোন তথ্যও সাধারণভাবে সম্পাদকীয় নীতিমালাতেই সংগ্রহ না করার জন্য রিপোর্টারদের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে।  সাংবাদিকরা সংগ্রহ করেন আমলাদের প্রকল্প সংশ্লিষ্ট নানা-অনিয়ম দুর্নীতির তথ্য। আর দেখা যায়, আইন দ্বারা  নির্ধারণ না করেই সব ফাইলে গণহারে 'গোপনীয়' লেখা হয়। জনগণকে সেবাদানের সঙ্গে যুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি কিংবা মন্ত্রণালয়ের কোন ফাইলই গোপনীয় হতে পারে না, কোনও কারণ নেই। বরং জনগণের টাকায় জনস্বার্থে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে কি করা হচ্ছে তা অবশ্য সাধারন মানুষের জানার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার কিছুটা হলেও রক্ষা করছে অনুসন্ধানী রিপোর্টাররা। হয়ত রিপোর্ট করেও অনিয়ম ঠেকানো যায় না। কিন্তু জনগণ তো জানে।

অনেকে বলতে পারেন, তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাইলেই হয়, সাংবাদিকদের এভাবে ছবি তুলে দলিল সংগ্রহ করতে হবে কেন? তথ্য অধিকার আইন আছে, কিন্তু এ আইনে তথ্য পাওয়া এখনও অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় এ আইন প্রয়োগ করে যথাযথ তথ্য একবারও পাইনি। আইন ভাল, কিন্তু আমলাদের অসহযোগিতার কারণে এ আইন জনগণের তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখেনি, সাংবাদিকদের জন্যও খুব বেশী কাজে আসেনি। এমনকি তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী অধিকাংশ সরকারি অফিসে কাগজে-কলমে দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার পদবী থাকলেও কর্মকর্তার সন্ধান এখনও পাওয়া যায় না।

ক্লাউড কম্পিউটিং এর সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সারা দুনিয়া জুড়ে দুশ্চিন্তা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সার্ভার থেকে ব্যক্তিগত কম্পিউটারকে সাইবার হামলা থেকে রক্ষা করা। এ কারণে  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সাইবার স্পেসে হামলা প্রতিরোধ এবং চিহ্নিত হামলাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। কিন্তু পুরো আইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গালি দেওয়া বন্ধের জন্য ১৭ থেকে ২৯ এর মধ্যে কয়েকটি ধারা আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গালি বন্ধের বিষয়টিও এখানেও ছোট আকারে আসতে পারে। কিন্তু আইনে এটিই প্রাধান্য পেয়েছে, সাইবার নিরপত্তা উপেক্ষিত থেকেছে, বরং ৩০ ধারায় অনলাইনে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অবৈধ লেনদেনের জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বেঁধে দিয়ে অর্থনৈতিক সাইবার অপরাধকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানহানিকার বক্তব্য, মিথ্যাচার, অপপ্রচার, উস্কানি কিংবা ব্যক্তি চরিত্র হনন বন্ধ করতে কি তাহলে আইন থাকবে না? অবশ্যই থাকবে, এবং আইন আছে। গত ২৯ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ের সময় এর জবাব কেবিনেট সচিব মহোদয়ই দিয়েছেন। তার কাছে যখন জানতে চাওয়া হল এই আইনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার সংজ্ঞা কি হবে? তার চমৎকার জবাব, পেনাল কোডে ধর্মীয় অনুভূতির যে সংজ্ঞা আছে সেটিই প্রযোজ্য হবে।' এটাই তো সঠিক।

ধর্মীয় অনুভূতিসহ মানহানি, গালি দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে পেনাল কোডে শাস্তির সুনির্দিষ্ট বিধান আছে। যদি দুর্বল শাস্তির ব্যবস্থা থাকে তাহলে সেখানেই সংশোধন করে সেটা শক্তিশালী করা হোক। অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গালি দেওয়া কে আলাদা করে ডিজিটাল অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে কেন?  আপনি মানহানি করে গালি দিয়েছেন এটাই বিষয়, এ অপরাধেই বিচার হবে।  সামনে দাঁড়িয়ে দিলেন, না মাইক বাজিয়ে দিলেন সে বিচার আসবে কেন? খুনের বিচারের ক্ষেত্রে সেটা ছুির দিয়ে না গুলি করে হত্যা তা বিবেচনা করে কি পৃথক আইন আছে? বিচারক খুনের সময়ের পরিস্থিতির নৃশংসতা বিবেচনা করে শাস্তি নির্ধারণ করেন। মানহানি, গালির  জন্যও সেটাই হবে, এর জন্য ডিজিটাল আইনে এ নিয়ে এত টানা-হেঁচড়া কেন?

এর আগে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপ্রয়োগের ভয়াবহতা আমরা দেখেছি। প্রত্যাশা ছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করার আগে এ আইন প্রণয়নের সময় অপপ্রয়োগ ঠেকানোর একটি ব্যবস্থা অবশ্যই সংরক্ষিত থাকবে। সেটাও নেই। যে মন্ত্রীরা এখন বলছেন, ৩২ ধারা পাশ হলে সাংবাদিকদের কোন সমস্যা হবে না, তারা কী এর আগে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ ঠেকাতে পেরেছেন? ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ার পর এর ভয়াবহ অপপ্রয়োগের আশঙ্কা আরও তীব্র হচ্ছে। দু:খিত, সাধারণ বিবেচনায় এ আইনটিকে সাইবার সুরক্ষায় কার্যকর ও জনস্বার্থ রক্ষার আইন হিসেবে গণ্য করা যাচ্ছে না।