হিলারির সফরের গুরুত্ব

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
Published : 11 May 2012, 06:36 PM
Updated : 11 May 2012, 06:36 PM

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইদানিং যে তোলপাড় চলছে তার পাশাপাশি সময়ে পরপর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাতসুইয়া ওকাদা, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী। অল্পদিনের ব্যবধানে সফর তিনটি হয়েছে। তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও একটি দল এসেছিলেন। প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্ক খুব গভীর। তাই এই ক'টি সফরের বিরাট তাৎপর্য রয়েছে। আমাদের রাজনীতির ও একই সঙ্গে সামাজিক অবস্থার চলমান কিছু দিক নিয়ে তারা কথাও বলেছেন সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের সঙ্গে। এ দিক থেকে দেখতে গেলে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও অন্যান্য প্রসঙ্গে তাদের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিই তারা তুলে ধরেছেন।

নানাভাবে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমি তার সফরকে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করব। প্রথমত, হিলারি ক্লিনটন এখন মার্কিন সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের মধ্যে বেশ তাগিদ ছিল। গত কিছুদিনে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিগত কিছু পার্থক্য দেখা দিয়েছিল। এসব কারণে সরকার চাচ্ছিলেন, হিলারির মতো একজন ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ সফর করুন। একথা সত্যি, বিশ্বে হিলারি ক্লিনটন একটি ব্র্যান্ড নেম। বিভিন্ন দেশে মার্কিন সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ধরন-ধারণও বোঝা যায় তার সফর এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে। তিনি কোন দেশে কখন যাচ্ছেন, কী কী বিষয় বলছেন তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। আমাদের সরকার হিলারির সফরের ব্যাপারে এসব কারণেই আগ্রহী ছিলেন। বহুদিন ধরে এ সফরের কথা শোনা যাচ্ছিল।

সরকারের মেয়াদের কোন সময় হিলারি এ সফরে এলেন সেটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যদি সরকারের মেয়াদের শুরুতে সফরে আসেন তবে তার অর্থ এক। আর শেষের দিকে এলে তার অর্থ ভিন্ন। তিনি এই সরকারের সাড়ে তিন বছর পার করার পর এলেন। তার মানে, সরকারের মেয়াদও শেষদিকে। এর অর্থ বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন সরকারের সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হয়েছে বলেই মনে করা যায়। আর এ সম্পর্ককে উষ্ণ করতে সরকারের দিক থেকে কিছুটা তাগিদ তো ছিলই।

হিলারি এই সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ ডায়লগের ব্যাপারে চুক্তি করেছেন। এর অধীনে প্রতি বছর বিভিন্ন বিষয়ে দুটো দেশ আলোচনা করবে। সেটা পরিবেশগত ইস্যু থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিষয়, যে কোন ব্যাপারেই হতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তিনি বিভিন্ন্ পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। সরকারপক্ষ, বিরোধী দল এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। সেসব বৈঠকে তিনি মার্কিন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বলেছেন। তিনি কিন্তু এমন কোনও বিষয় নিয়ে বলেননি যা নিয়ে দেশের ভেতরে বিভিন্ন ফোরামে আলাপ হয়নি। গত ক'দিন ধরে দেশে গুম, খুন, হত্যার রাজনীতির মতো কিছু বিষয় নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। হিলারি এমন সময় সফরে এলেন যার কিছুদিন আগে ইলিয়াস আলীর মতো একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গুম হয়েছেন। তার নিখোঁজ রহস্য নিয়ে দেশে নানা কথাবার্তা চলছে। হিলারি এ বিষয়ে কথা বলেছেন।

এর মধ্যে আরেকটি বিষয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের হত্যার ব্যাপারেও কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা চলতে থাকলে বাইরের বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। গার্মেন্টস শ্রমিকের হত্যার প্রসঙ্গটি দেশে কম আলোচিত হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আমাদের গার্মেন্টসের বড় ক্রেতা। তাই আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের অবস্থা নিয়ে তার সরকারের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মনে রাখতে হবে যে মার্কিন সরকারের পদস্থ কর্মকর্তারা তাদের কুটনীতিক বা স্থানীয় দূতাবাসের মাধ্যমে একটি দেশের হাল অবস্থা সম্পর্কে সব তথ্যই পেয়ে থাকেন। তাছাড়া মিডিয়া তো আছেই। আমাদের বিরোধী দলও খুব সঙ্গত কারণেই গুম-খুনের মতো বিষয়গুলো হিলারির সামনে তুলে ধরেছেন। তারাও ক্ষমতায় থাকলে একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারত। বিরোধী দলকে দমন-নিপীড়নের রাজনীতি তো এ দেশে অনেক দিন ধরেই চলছে। তবে এ মুহূর্তে বিরোধী দল হিসেবে তাদের কর্মীরা যে সব নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন সে সব তথ্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে তারা তুলে ধরেছেন। ফলে আমাদের গণতন্ত্রের হাল সম্পর্কে হিলারির মনে কিছুটা ধারণা তৈরি হয়েছে। তাই বাইরের বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার মানে আমাদেরই ক্ষতির মুখোমুখি হওয়া।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুটো দলকে সংলাপে বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের কথা বলেছেন। তার মানে সরকারের কিছু কিছু পদক্ষেপের ব্যাপারেও তাদের সুস্পষ্ট দ্বিমত রয়েছে। তারা যে একতরফা নির্বাচন বা ওই ধরনের কিছু মেনে নেবেন না সেটাও তারা স্পষ্ট করেছেন। নির্বাচন নিয়ে এ দেশ কোনও সাংঘর্ষিক অবস্থায় যাক সেটা ওরা চান না। আমাদের গণতন্ত্রের স্বার্থে সংলাপ জরুরি বলে তারা যে মনে করছেন সেটাও স্পষ্ট হয়েছে।

ওদিকে ড. ইউনূস এবং ফজলে হাসান আবেদের মতো নাগরিক সমাজের দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় বসে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি। এর আগেও বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সরকারের অবস্থানটা ছিল এমন যে গ্রামীণ দারিদ্র্য দূরীকরণে ড. ইউনূসের এবং তার গ্রামীণ ব্যাংকের বিরাট অবদান রয়েছে। সরকার যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ না করেন, এই জায়গাগুলোতে তাদের অবস্থান যে একই রয়েছে তাও এই সফরের সময় তার বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট করলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

হিলারি ক্লিনটন চলে যাওয়ার পরও তার বক্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা হবে এটাও স্বাভাবিক। তবে আমাদের মন্ত্রীরা ড. ইউনূস প্রসঙ্গে হিলারির বক্তব্য নিয়ে যেভাবে মন্তব্য করছেন, সেটাও নতুন কিছু নয়। আমি ভেবেছিলাম আমাদের রাজনীতিবিদরা কিছুটা পাল্টাবেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এখানে যে রাজনীতি চলছে তা বদলে যাওয়া এত সহজ নয়। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মন্তব্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে খুব ভালো নয় তা বোঝা যাচ্ছে। এমনকি সম্পর্ক উন্নয়নের যে সম্ভাবনা ছিল সেটাও শুরু হতে দেরি হবে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের রাজনীতিবিদরা তো অবশ্যই অভিজ্ঞ। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন অনেকেই। তাই আমি মনে করি, তারাই বুঝবেন তারা এসব কেন করছেন। তারা হয়তো মনে করছেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কোনও দরকার নেই। আমি জানি না এটাই তাদের চিন্তা কিনা। আমার বুদ্ধিতে বিষয়টা কুলাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা নানা সম্পর্কে জড়িত। বাণিজ্যিক থেকে শুরু করে সামরিক বিভিন্ন ইস্যুতে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যে সারপ্লাস প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যরাও কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি করার জন্য তাগাদা দিয়েছেন আরও খোলাখুলিভাবে। তারা বলেছেন বাইরের বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার কথা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র বাইরের বিশ্বে আমাদের বড় বাজার।

তাই সরকারের এই কাজকর্মে, আমার ধারণা, দেশের মানুষ চিন্তিত। এ ধরনের মন্তব্যে সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে বড় কোনও প্রভাব পড়বে কিনা তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই। তবে সম্পর্ক উন্নয়ন যে জরুরি ছিল এটা বলতে পারি। ইদানিং ভারত এবং চীনের মতো রাষ্ট্রও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের খাতিরে ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জীও কিন্তু সংলাপের কথা বলেছেন।

হিলারির সময়েই বাংলাদেশ সফর করেছেন প্রণব। তার সফরটি অবশ্য ভিন্ন কারণে ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শ'তম জন্মদিনের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে সমাপনী টানার দায়িত্ব ছিল তার। যেহেতু তার সফরটি রাজনৈতিক নয়, তাই ওভাবে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার তেমন সুযোগ ছিল না। তবে তিস্তা চুক্তিসহ কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের সরকার বরাবরই জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছেন। এখনও বলছেন যে চুক্তিটা হবে।

আমি মনে করি দুটো কারণে এটা সম্ভব নয়। প্রথমত, ভারতের কংগ্রেস সরকার খুবই দুর্বল। তারা এই মুহূর্তে কোনও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে যাবে না। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছেন। ফলে খুব শিগগির এ বিষয়টির সমাধানের কোনও কারণ আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না। ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগে এ বিষয়টি নিয়ে আর কোনও ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে আমাদের সরকারের আস্থা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের দিক থেকে কিছুটা দক্ষতার ঘাটতি ছিল বলেই আমার মনে হয়। তবে এ বিষয়ে জনগণের মনে আর কোনও প্রত্যাশা তৈরি না করে খোলাখুলি সত্যটা বলা উচিত। হয়তো সরকার বলতে চাচ্ছেন না এই ভয়ে যে সেক্ষেত্রে বিরোধী দলও জনগণের মনে প্রত্যাশা তৈরি নিয়ে কথা বলবেন।

তবে আমার কথা হল, আমাদের দেশের চলমান সংকটগুলো নিয়ে জাপানি উপ-প্রধানমন্ত্রী, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারতের অর্থমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যেভাবে বলেছেন, সেগুলোর কিছুই নতুন নয়। ঘরের মধ্যে এগুলো নিয়ে আলোচনা চলছিলই। এখন বাইরের লোকেরাও বলছেন, এটাই হল আসল কথা।