কাঁটাতারে ফেলানীর রক্তাক্ত মৃতদেহ ও এক দরিদ্র কিশোরীর রাষ্ট্র সন্ধান

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 28 Jan 2018, 03:19 PM
Updated : 28 Jan 2018, 03:19 PM

২০১১ সালের ৭ই জানুয়ারি। ফেলানী খাতুনের রক্তাক্ত মৃতদেহ পাঁচ ঘণ্টা ঝুলে ছিল ভারতের সীমান্ত রক্ষা কাঁটাতারে। পনের বছরের কিশোরী ফেলানীর শরীরে পাঁচ ঘণ্টা ধরে ঝরানোর মত রক্ত ছিলনা। থাকার কথাও নয়। কোন মানুষের শরীরেই থাকেনা। লাল জামা পরা ছোট্ট ফেলানীকে একটি বড় পাখির মত দেখাচ্ছিল। আকাশ পথে উড়ে যাওয়া কোন বিমান যাত্রী হয়তো জানালা দিয়ে লালটুকটুকে বড় পাখি দেখে অবাক হয়েছে। এত উপর থেকে তো আর রক্ত দেখা যায় না। সকাল ছয়টায় গুলি বিদ্ধ হওয়ার পর প্রায় এগারটা পর্যন্ত মানুষের নিষ্ঠুরতার প্রতীক, জীবনের দায়, আর কাঁটাতার দিয়ে দম্ভ জানান দেওয়া রাষ্ট্রীয় বড়ত্বকে শ্লেষ করে ফেলানী ঝুলে ছিল কাঁটাতারে।

কিন্তু অবাক হন নি বিএসএফ এর সদস্যরা। হত্যাকারী বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ এর কোনও মানসিক বিক্ষেপ হয়েছিল কি না তাও জানা যায়না। এ যে রাষ্ট্র- রাষ্ট্র খেলা। অমিয় শুধু এক রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছে এই আর কি! নব আবিষ্কৃত ভারতীয় 5.56mm ক্যালিবার এর INSAS রাইফেলের ফায়ার পাওয়ারের আরেকটি সফল পরীক্ষা হয়তো তাদের কাছে!

কিন্তু বিএসএফ সম্ভবত অধিকাংশ সময়ই ভুলে থাকে যে সীমান্ত রক্ষা একটি পুলিশি দায়িত্ব, কোন প্রকার যুদ্ধ তৎপরতা নয়। কিংবা এটাই তাদের নিয়ম- গুলি কর এবং হত্যা কর। বিএসএফ কোন সামরিক বাহিনী নয়, যেমনটি নয় পৃথিবীর কোন দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। তাঁদের মুল পরিচয় তাঁরা সীমান্ত পুলিশ। তারা  স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ভারতের সেন্ট্রাল আর্মড পুলিস ফোর্স (CAPF) এর পাঁচটি বাহিনীর মধ্যে একটি। সুতরাং তাদের পক্ষে একমাত্র নিজের প্রাণ রক্ষা বা সেলফ ডিফেন্স ছাড়া অন্য কোন কারণেই প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অকারণ ফৌজি উগ্র মানসিকতার প্রকাশ নিজেদের পেশাগত অদক্ষতা এবং নীতিহীনতাকেই প্রমাণ করে।

ফেলানীর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই ২০১১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি  প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকনমিস্ট (The Economist) এ Felani's last steps শিরোনামে এক প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা Human Rights Watch  এর বরাতে বলা হয়েছে- গত দশ বছরে বিএসএফ বাংলাদেশ-ভারত ২৫৫০ মাইল সীমান্ত জুড়ে প্রায় এক হাজার বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে। এতে  প্রতি চার দিনে একজনকে  হত্যা করা হয়েছে বলে বোঝা যায়। দ্য ইকনমিস্ট একই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেছে, এই হত্যার সংখ্যা স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন 'ইনার জার্মান বর্ডার' অতিক্রম কালে নিহত লোকের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি।

দ্য ইকনমিস্ট এর প্রতিবেদনের সমর্থন পাওয়া যায় ২৩জুলাই ২০১১ এ দ্য গার্ডিয়ান (The Guardian) এ ব্রাড অ্যাডামস এর প্রতিবেদনে। India's shoot-to-kill policy on the Bangladesh border  শিরোনামে লেখায় তিনি উল্লেখ করেন যে 'ভারতের বিএসএফ' সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে গুলি-করে-হত্যা-কর (shoot-to-kill) নীতি বজায় রেখেছে, এমন কি নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের ক্ষেত্রেও। গত দশ বছরে ভারতীয় নিরাপত্তা রক্ষীরা  প্রায় এক হাজার লোককে হত্যা করেছে, যার অধিকাংশই বাংলাদেশি। এতে করে সীমান্ত এলাকা পরিণত হয়েছে 'দক্ষিণ এশিয়ার বধ্যভূমি'তে (south Asian killing fields)।

ব্রাড তাঁর প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেন- "এইসব হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি, যদিও প্রমাণ রয়েছে যে এগুলো ছিল ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড এবং মানুষগুলো ছিল নিরস্ত্র এবং প্রতিরোধহীন।"

ব্রাড তাঁর লেখায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, ভারতীয় কর্তারা এই ধরণের গুলি বর্ষণকে বৈধতা দিয়ে কথা বলছেন। এমনকি যদি সীমান্ত অতিক্রমকারী ব্যক্তি নিরস্ত্রও হয়ে থাকে। যেমনটি বলেছেন  ফেলানী হত্যাকাণ্ডের সময়ের বিএসএফ প্রধান রমন শ্রীবাস্তব-  "এইসব মানুষদের জন্য দুঃখ বোধ করার কিছু নেই। যেহেতু তারা রাতের বেলায়ও ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করে, তাদেরকে ঠিক নির্দোষ বলা যাবে না। সুতরাং তাদের প্রতি গুলি বর্ষণ বৈধ ছিল।"

ফেলানী ফিরছিল তার বাবার সাথে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি থানার অনন্তপুর সীমান্ত দিয়ে। মা জাহানারা বেগম তখনো তাদের ভারতীয় নিবাসে, আসামের বনগাঁইগাঁও এ ।তার বাবার আদি বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থানার দক্ষিণ রামখানা গ্রামে। বাবা নুরুল ইসলাম এর ভাষ্য মতে ফেলানীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তাই তার বিয়ে দেয়ার জন্য তাকে নিয়ে ফিরছিলেন তিনি ভারত থেকে।

'ফেলানী' নামটি বলে দেয় কতটা প্রান্তিক এই ছোট্ট কিশোরী। যেখানে প্রজন্মান্তের আমাদের বোনদের, সন্তানদের নামগুলো কথিত আধুনিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে, সেখানে সে 'ফেলানী' ই রয়ে গেছে। অনুবাদে যার নামের অর্থ দাঁড়ায় 'যে ফেলে দেওয়ার যোগ্য'।

আসলে প্রান্তিক মানুষের কোন নামই থাকেনা, অন্তত আমরা যাকে 'নাম' বলে থাকি। আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে ভাসে, আমাদের গ্রামে ভোটার তালিকা করতে আসা সরকারী লোকটি  গ্রামের একটি পরিবারের  কয়েক  ভাই এর নাম শুনে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি ভাবছিলেন এই নামের বানান তিনি কী ভাবে লিখবেন। সংস্কৃত, আরবী কিংবা ফার্সি  শব্দের খটোমটো জটিলতাপূর্ণ নাম ছিলনা।  সে নামগুলো ছিল প্রান্তিক মানুষের ভাষাহীন অব্যয় ধ্বনিপূর্ণ এক ধরণের নাম। আমার দাদী নামগুলোর একটি সহজ ভাষ্য তৈরি করে তাই লিখতে বললেন সরকারী লোকটিকে। রাষ্ট্রের তালিকায় তাদের অব্যয় ধ্বনির ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ নামগুলো উঠেনি।

তাঁরা চার ভাই বাংলাভাষী ছিলেন। কিন্তু তাঁদের নামের ভাষাটি কি ছিল আমি জানিনা।নিঃসন্দেহে সন্তানের জন্মের পর গভীর আবেগে ওই অব্যয় ব্যঞ্জনার নাম উচ্চারণ করেছিলেন তাদের মা কিংবা বাবা। আর অপর জন তাতে সায় দিয়েছিলেন। আমাদের কাছে তাঁদের নামের কোন অর্থ না থাকতে পারে, কিন্তু তাঁদের পিতামাতার গভীর আবেগের জগতে এই নামগুলোর অর্থ ছিল। তাঁদের মা যখন তাঁদের নাম ধরে ডাকতেন  তখন গভীর আবেগ ছড়িয়ে পড়ত সেই অর্থহীনতার মধ্যেও। আমাদের রাষ্ট্র আজও প্রান্তিক মানুষের নাম পড়তে শিখেনি। আমরাও তাদের নাম পড়ার মত শিক্ষিত হয়ে উঠিনি। এ দুর্বলতা আমাদের, এই অপূর্ণতা আমাদের।

তবুও ফেলানী আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার নামটি ভদ্রলোকেরা উচ্চারণ করতে পারছেন। চায়ের কাপে ঝড় তোলার সময় নামটি অন্তত উচ্চারণ করতে পেরেছেন সবাই-বাংলাদেশ এবং ভারতের ভদ্রলোকেরা। তাঁরা ফেলানীর হত্যার বিচারের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। ফেলানী হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য সোচ্চার হয়েছে 'মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ' (MASUM) নামে পশ্চিমবঙ্গের একটি মানবাধিকার সংগঠন।

নিরাপদে দেশে ফিরে এলে ফেলানী হয়ে যেত বাল্য বিবাহের বলি। জীবনের এক ভয়াবহ ফাঁদ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তার গায়ের লাল পোশাকগুলো না কি বিয়ে উপলক্ষেই কেনা। গায়ে ছিল গয়না। বিয়ে ঠিক হয়েছিল ঢাকায় কর্মরত খালাতো  ভাই গার্মেন্টস শ্রমিক লালমনিরহাট এর আমজাদ আলীর সাথে। কিন্তু জীবনের ফাঁদের দিকে এগোতে গিয়ে ফেলানী আটকা পড়ে যায় রাষ্ট্র-ফাঁদে। সীমানা পার করার দালালের দেওয়া মই বেয়ে সে উঠেছিল সামরিক কায়দায় তৈরি করা কাঁটা তারের বেড়ার উপর। কিন্তু তার পরনের জামা আটকে যায় কাঁটাতারে। আর কিশোরীর স্বভাবসুলভ আকুলতায় সে চিৎকার করে সাহায্য চায় তার আগেই পেরিয়ে যাওয়া তার বাবার কাছে। আর তখনই ছুটে আসে বিএসএফ এর নির্দয় গুলি। বিএসএফ এর  ১৮১ ব্যাটালিয়ন এর কনস্টেবল অমিয় ঘোষ এর একটি গুলি তাকে স্তব্ধ করে দেয়।

ফেলানী গুলিবিদ্ধ হয়ে পানি পানি বলে চিৎকার করছিল। গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক ঘণ্টা পর্যন্ত ফেলানী জীবিত ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যে জানা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র এক নির্দয় আততায়ী। রাষ্ট্র তার বধ্যকে জলের যোগান দেয় না। রক্ত ঝরতে ঝরতে আর পানির জন্য হাহাকার করতে করতে নিজের সন্তানকে মরে যাওয়ার নির্মম দৃশ্য দেখতে হয়েছে নুরুল ইসলামকে। এই রকম ভয়াবহ দৃশ্য পৃথিবীর খুব কম মানুষকেই দেখতে হয়েছে হয়তো।

ফেলানীর দেহটা ঝুলে ছিল ভারতীয় অংশে। পাশে দু'টি মই দৃশ্যমান। মইয়ের যোগানদার ভারতীয় চোরাকারবারী মোশারফ হোসেন ও বুজরত। ভারতের  মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এই সব অবৈধ লোক পরাপার বিএসএফ এর সম্মতিতেই হয় এবং এক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনও হয়ে থাকে। সুতরাং ভারতীয় অংশে কুচবিহার  চৌধুরী হাট বিএসএফ ক্যাম্পের কনস্টেবল অমিয় শুধু একা দোষী নয়, দোষী এই অবৈধ পারাপার চক্রের অন্য বিএসএফ সদস্যরাও, মই যোগান দেওয়া মানবপাচার চক্রের লোকেরাও।

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের গবেষক সাহানা ঘোষ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দু (THE HINDU) এ Actions that border on the barbaric শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছেন- "এটা ওপেন-সিক্রেট যে বিএসএফ ব্যাপকভাবে আন্তঃসীমান্ত চোরাচালানে জড়িত। অবৈধ চোরাচালান ভিত্তিক সীমান্ত অর্থনীতির সুবিধা নিয়ে তারা তাদের অপর্যাপ্ত বেতনে কিছু অর্থ যোগ করে থাকে।"

জনমত, মানবাধিকার সংগঠন এবং সংবাদ মাধ্যমের চাপে বিএসএফ তার কনস্টেবল অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে বিএসএফ আইনের (THE BORDER SECURITY FORCES ACT 1968) ৬৪ এবং ৬৫ ধারা মোতাবেক জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্ট (GSFC) গঠন করে এবং ২০১২ সালের অগাস্ট মাসে উক্ত কোর্টে চার্জশিট দেয়। তার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় হত্যা (culpable homicide not amounting to murder) এবং বিএসএফ বিধির (THE BORDER SECURITY FORCES RULES 1969) ১৪৬ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

১৩ অগাস্ট ২০১৩ তারিখে বিচার শুরু হয় কুচবিহার শহরের কাছে সোনারি ক্যাম্পে। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে বিএসএফ এর বিশেষ আদালত কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে 'সিদ্ধান্ত অযোগ্য ও অপর্যাপ্ত প্রমাণ' (Inconclusive and Insufficient evidence) এই মর্মে নির্দোষ ঘোষণা করে। জিএসএফসি এর প্রধান ছিলেন আসাম-মেঘালয় ফ্রন্টিয়ার ডি আই জি এস পি ত্রিবেদী। সাথে ছিলেন আরও চারজন কর্মকর্তা। কিন্তু বাংলাদেশের আপত্তি এবং ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর চাপে ১৬ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে রিভিশন ট্রায়ালে বসে ওই একই আদালত এবং ২ জুলাই ২০১৫ তারিখে  অমিয়কে আবারও নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। ফোর্সেস কোর্টের রায়টি পাঠানো হয়েছে বিএসএফ এর ডিজি এর কাছে। তিনি  অনুমোদন করলেই সেটিই চূড়ান্ত। ছাড় পেয়ে যাবেন অভিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবল অমিয় ঘোষ।

ইতিমধ্যে ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন ফেলানীর পরিবারকে পাঁচ লক্ষ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। এ বিষয়ে তারা ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের GSFC কোর্টের রায় চূড়ান্ত হওয়া পর্যন্ত  সাময়িক স্থগিতাদেশের আপিল খারিজ করে দিয়েছে।

কমিশন তাঁর পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন যে- "কমিশন এই বিষয়ে সচেতন যে নিরাপত্তারক্ষীরা সীমান্তে অত্যন্ত সংবেদনশীল কর্মে নিযুক্ত আছে। তারপরও তাদেরকে এই ধরণের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অবশ্যই শৃঙ্খলা এবং কিছু মানদণ্ড বজায় রাখতে হবে।"

কমিশন তাঁর পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করেন, "উল্লেখিত ক্ষেত্রে ভিকটিম একটি নিরস্ত্র বালিকা। সুতরাং এই অভিযুক্ত কনস্টেবল বিএসএফ সদর দপ্তর এর নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছে। এমনকি বিএসএফ এর স্টাফ কোর্ট অব এনকোয়ারী বলেছে যে উক্ত কনস্টেবল "আত্মরক্ষার অধিকার" বা RIGHT TO SELF DEFENCE এর সীমা লঙ্ঘন করেছে। একটি নিরস্ত্র বালিকাকে গুলি করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারেনা।"

ফেলানী হত্যাকাণ্ডের সুবিচার চেয়ে ভারতীয় মানবাধিকার কমিশনে লড়াই করেন পশ্চিমবঙ্গের মানবাধিকার সংগঠন MASUM। নিঃসন্দেহে তারা সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ পেতে পারেন MASUM এর নির্বাহী প্রধান কিরীটী রায় এবং সংশ্লিষ্ট অন্যরা। MASUM এর নির্বাহী প্রধান কিরীটী রায় একে 'নৈতিক বিজয়' বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন, "আর্থিক ক্ষতিপূরণ সন্তান হারানোর কোন সান্ত্বনা নয়। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের রায় প্রমাণ করেছে আমরা যে অভিযোগ করেছি তা সত্য এবং বিএসএফ  যা  করেছে তা অন্যায়।"

হয়তো এটুকুই ফেলানীর পরিবারের জন্য সুবিচারের  সান্ত্বনা হয়ে থাকবে, যদি আইনের জটিলতায় আর কোন প্রতিকার নাও মেলে। আর বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের শান্তিকামী এবং বন্ধুভাবাপন্ন মানুষেরা শান্তি পাবেন যেদিন সীমান্ত হত্যা সত্যিকারভাবেই শূন্যে নেমে আসবে।

কিন্তু সুবিচারের সবগুলো দরজা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে একথা বলা যাবেনা। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে ফেলানীর বাবা ভারতীয় সংগঠন MASUM এবং বাংলাদেশী মানবাধিকার সংগঠন  আইন ও সালিশ কেন্দ্র (ASK) এর সহযোগিতায় ভারতের ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টে সুবিচার এর আবেদন করেন। রিট আবেদনকারী ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম এবং MASUM এর নির্বাহী পরিচালক কিরীটী রায়। ফেলানী'র গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুতে ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত 'জীবনের নিরাপত্তার অধিকার' লঙ্ঘিত হয়েছে।

কারণ এই অধিকার শুধু ভারতীয় নাগরিকের জন্যই প্রযোজ্য নয়, ভারতে অবস্থানকারী দেশি বিদেশি সব নাগরিকের জন্যই প্রযোজ্য। এই মর্মে রিট মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারা সিবিআই এর মতো স্বাধীন সংস্থা দ্বারা এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের আবেদন জানান, যাতে অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা যায়। সেই মামলা বিচারাধীন আছে। সুপ্রিম কোর্ট বিএসএফ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে এই বিষয়ে।

বিএসএফ এর নিজস্ব আদালত জিএসএফসি তাদের প্রথম রায়ে কনস্টেবল অমিয় ঘোষকে 'সিদ্ধান্ত অযোগ্য ও অপর্যাপ্ত প্রমাণ' এর কারণে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিলে ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি এর প্রধান অ্যাডভোকেট সালমা আলী ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে ২০১৩ সালেই আরেকটি রিট মামলা দায়ের করেছিলেন ভারতীয় একজন আইনজীবীর সহায়তায়।

এছাড়া ফেলানীর হত্যার বিষয়ে বিএসএফ এর নিজস্ব আলাদতের রায় নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে পরিস্কার আইনি ব্যাখা চেয়ে আরেকটি রিট মামলা দায়ের করেছেন ভারতের মানবাধিকার সংস্থা অ্যামেনেস্টি ইন্ডিয়া।

ফেলানীর বাবা নুরুল ইসলাম তাঁর বালক বয়সে ভারতের আসামে চলে যান। তারা তিন ভাই। সেখানে তিনি কখনো তিনি ইটভাটায় কাজ করে, কখনো রিক্সা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করেছেন। এক সময় বাংলাদেশে  কুড়িগ্রামে এসে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে আবার চলে যান আসাম। তিনি আসামে তাঁর স্ত্রী তিন ছেলে আর তিন মেয়ে নিয়ে বসবাস করতেন। তাঁর ছয় সন্তানের মধ্যে ফেলানী সবার বড়। তাঁর সব সন্তানের জন্ম হয় সেখানে। নুরুল ইসলাম আসামে একটি পান দোকানের মালিক যা তাঁর স্ত্রী দেখাশোনা করতেন। মেয়ের মৃত্যুর পর নুরুল ইসলাম অন্য পাঁচ সন্তান এবং স্ত্রীকে এখন বাংলাদেশেই থাকেন।

ফেলানীর দেশ কোনটি? ফেলানী জন্মেছিল ভারতে। আসামের আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠেছে জীবনের পনেরটি বছর। হয়তো অসমীয়া ভাষাও শিখেছিল। পাড়ার চায়ের দোকানে ভুপেন হাজারিকার গান কিংবা 'বিহু গান' কি তার হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়নি? গিয়েছে নিশ্চয়ই।কাঁটাতার পেরিয়ে ফেলানী আসছিল তার স্বামীর বাড়ি-বাংলাদেশে। বাংলাদেশ কি তার দেশ ছিল? তার বাবা হয়তো বলবেন- তাই। বাংলাদেশের, ভারতের আইন হয়তো বলবে তাই। কিন্তু কোনও দিন কি রাতের খাবারের সময় ফেলানী তার বাবার সাথে দ্বিমত করে বলেনি যে তার দেশ ভারত। বলাই স্বাভাবিক। যেমনটি আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ইউরোপীয় কিংবা আমেরিকান বাঙালী সন্তানেরা বলে থাকে।

তার মাতৃভূমি নিয়ে দ্বিধায় জড়িত ছিল ফেলানী- এতে কোন সন্দেহ নেই। আর এইসব দ্বিধা সংশয়ের সমাধান ফেলানীরা পায় একভাবেই। আর সেটা হচ্ছে, আমার পরিবারই আমার কাছে দেশ। যেখানে আমার বাবা আমার মা আমাকে নিয়ে বসবাস করবেন সেই মাটি আর আকাশের ঠিকানা যতই অজানা হোক, বাবার বুক আর মায়ের কোলই আমার দেশ। এ কথা ভূমধ্যসাগরের বালিতে  মুখ গুজে পড়ে থাকা আইলান কুর্দির জন্য সত্য, নাফ নদীর বালিতে পড়ে থাকা রোহিঙ্গা শিশুর জন্য সত্য এবং ফেলানীর জন্যও সত্য। রুটি-রুজির সন্ধান, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গণহত্যা কিংবা যুদ্ধ এড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো পরিবারগুলোর শিশু ও  কিশোর-কিশোরীদের কোন দেশ নেই। তাদের বাবার বুক আর মায়ের কোলই তাদের দেশ।

ফেলানী কাঁটাতারের আটকে গিয়ে চিৎকার করে তার বাবাকে ডেকেছে। ফেলানী তার দেশকে ডেকেছে, যে দেশ তাকে সস্নেহে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারে। ফেলানীর দেশের নাম 'বাবা'। ফেলানী মৃত্যুর আগে তার মায়ের কথা ভেবেছে। ফেলানীর দেশের নাম 'মা'। ফেলানীর দেশের নাম বাংলাদেশও নয়, ভারতও নয়।

ফেলানীর রাষ্ট্র কাঁটাতারের নয়, বন্দুকের নয়, আইনের নয়, সংবিধানের নয়, ফ্ল্যাগ মিটিং এর নয়, ফেলানীর রাষ্ট্র এক গভীর ভালবাসা মাখা বাবার বুক আর মায়ের কোল।