পাক-আলেমদের সখাত-সলিল : বাংলাদেশের বোধের দলিল?

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 28 Jan 2018, 01:50 PM
Updated : 28 Jan 2018, 01:50 PM

"গত সপ্তাহে ১৮০০ জন পাকিস্তানি আলেম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত বই-তে আত্মঘাতী বোমা হামলাকে 'অনৈসলামিক' অ্যাখ্যা দিয়ে ফতোয়া জারি করেছেন"- বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৬ জানুয়ারি।

ভালো, দেরিতে হলেও চোখ খোলা ভালো। বাংলাদেশেও মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ-এর নেতৃত্বে একলক্ষ আলেম একই ফতোয়া জারী করেছেন, তাঁদেরকে ধন্যবাদ। পাকিস্তান বহু বছর ধরে 'ইসলামী' হিংস্রতায় ক্ষতবিক্ষত। অহরহ সর্বত্র এমনকি মসজিদেও মুসলিম খুন করে চলেছে মুসলিমকে, পরে সেটা আত্মঘাতী বোমা হামলায় 'উত্তীর্ণ' হয়েছে। ১৮০০ মাওলানার ওই ফতোয়া সে হিংস্রতা বন্ধ করতে পারবে কিনা সে অঙ্কটা আমাদের করতে হবে কারণ আমাদের  উগ্রপন্থীরা ওদের উগ্রপন্থীদের সাথে শুধু সম্পর্কিতই নয় বরং ওদের সাহিত্য ও দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত। দেশে যা কিছু হচ্ছে তা ওখানে আগে হয়েছে। দেখে না শিখলে প্রাকৃতিক নিয়মেই আমাদেরকে ঠেকে শিখতে হবে।

ধর্মীয় হিংস্রতার ডোজ মাদকের মত ক্রমাগত বাড়তে থাকে। আত্মঘাতী বোমা হামলা শূন্য থেকে হঠাৎ সৃষ্টি হয়নি, ওটার জন্ম হয়েছে ধাপে ধাপে বহু বছর ধরে ইসলামের নামে অন্যান্য অজস্র সন্ত্রাসকে ক্রমাগত বৈধ ও প্রতিষ্ঠিত করার পরেই, আগে নয়। এর একটা পরিকল্পিত পদ্ধতি আছে। শুরুতে এক প্রজন্মকে কিছু সন্ত্রাসকে বৈধ ও আল্লাহর ইচ্ছা বলে বিশ্বাস করানো হয়েছে। পরের প্রজন্মকে আরো একধাপ এগিয়ে অন্য কিছু মারাত্মক সন্ত্রাসকে বৈধ ও আল্লাহর ইচ্ছা বলে বিশ্বাস করানো হয়েছে। এইভাবে পুরো জাতটার মন-মগজ সন্ত্রাসের প্রতি শুধু ডি-সেন্সিটাইজড-ই হয়নি, সেগুলোকে বৈধ ও আল্লাহর ইচ্ছা বলে বিশ্বাস করিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আরো এবং আরো হিংস্র হতে হতে আত্মঘাতী বোমাবাজে পরিণত করানো হয়েছে যা কিনা চূড়ান্ত 'ইসলামী সন্ত্রাস'।

সেই ধাপগুলো চিহ্নিত করলে আমরা আত্মঘাতী বোমা হামলার যে ভিত্তি, তার শাখা প্রশাখা ও বীজ  (জঙ্গী ইসলামী সাহিত্য ও স্কুল কলেজের সিলেবাস সন্ত্রাসের বীজ সম্পর্কে) জানতে পারব।

১. ইসলামের নামে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস যা থেকে আত্মঘাতী বোমা হামলার জন্ম তার কিছু উদাহরণ। অনেক শারিয়া-দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শারিয়াবাজদের বর্ণনাতীত সন্ত্রাস প্রকাশ পাচ্ছে অহরহ।

(ক) ২০০৩ সালে মুত্তাহিদা মজলিস-এ আমল নামে শারিয়াপন্থী দল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে নির্বাচনে জয়ী হয়, পরে সে দল বেলুচিস্তানের কোয়ালিশন সরকারেও ছিল। সংসদে এরা প্রথমেই বন্ধ করে জুয়া, মদ, বাস-ট্রেনে সঙ্গীত, বিজ্ঞাপন-পোস্টারে নারীর ছবি, বিচিত্রানুষ্ঠানে-রেডিও-টিভিতে নারীর খবর পাঠ, গান ও নাটক, সাথে বন্ধ করা হয় সব সিনেমা হল। বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা ও সঙ্গীত-শিল্পীদের মারপিট করা হয়, 'প্রাইড অফ পারফরম্যান্স' খ্যাত গায়ক গুলজার আলমের বাসায় পুলিশ হানা দিয়ে তার হার্মোনিয়াম ভেঙে ফেলে এবং তার তিন ছেলে ও ভাইকে ধরে নিয়ে যায় (পাকিস্তান ডিফেন্স নিউজ – ১০-১২ – ২০০৭)। বাংলাদেশে এঁরা ক্ষমতায় গেলে আমাদের দেখতে হবে- 'গায়ক নাচকেরা ভাগো সব ভাগোরে, সবাইকে ফেলে দেব বঙ্গোপসাগরে।' দেশে এ দানব চাই আমরা? কক্ষনো নয়

(খ) তার পরেই মুত্তাহিদা মজলিস-এ আমল সংসদ ঘোষণা করে, "ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার জন্য" আল্ট্রাসাউণ্ড ও ইসিজি পরীক্ষায় রোগিণীরা পুরুষ টেকনিশিয়ানের কাছে যেতে পারবে না। অথচ সারা প্রদেশে ই-সি-জি'র নারী-টেকনিশিয়ান আছে মাত্র একজন, আল্ট্রাসাউণ্ডের একজনও নারী-টেকনিশিয়ান নেই ! সেখানে মা-বোনদের কি অবস্থা তা অনুমান করে নিন। এই তথাকথিত ইসলামী দলগুলো আফগানিস্তানে, ইরাক-সিরিয়া-সোমালিয়া-নাইজিরিয়াতে মানবাধিকারের কি সর্বনাশ করেছে তা তো দুনিয়া দেখছে। ইসলামের ওপর সবচেয়ে মারাত্মক আঘাত করেছে আর কেউ নয়, এরাই। দেশে এ দানব চাই আমরা? কক্ষনো নয় !

(গ) শারিয়া-পুলিশ দেশে দেশে কি বর্বরভাবে মানুষের জান লবেজান করেছে তা বর্ণনাতীত। মক্কার বালিকা-স্কুলে আগুন লাগায় ছাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে আসার সময় তাদের মাথার স্কার্ফ হারিয়ে যায়। বাইরে দাঁড়ানো শারিয়া পুলিশ তাদেরকে পেটাতে পেটাতে আবার স্কুলে ঢুকিয়ে দেয়, বাইরে জনগণ ছুটে এসে সাহায্য করতে গেলে শারিয়া পুলিশ তাদেরকেও পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়। ফলাফল? নিষ্পাপ ফুলের মত যারা ফুটেছিল সেই ১৫ জন বালিকা পুড়ে কয়লা হয়ে যায়, অন্তত: ৫০ জন বালিকা আংশিক পুড়ে যায় (বিবিসি নিউজ ১৫ মার্চ ২০০২)। আহারে! অনেক শারিয়া-দেশে ডাণ্ডা হাতে ঘুরছে 'ইসলামী' পুলিশ (হিসবাহ), খুঁটিয়ে দেখছে হেড-স্কার্ফ থেকে কোন মেয়ের চুল বেরিয়ে আছে, কোন মেয়ে কোন ছেলের সাথে বাজারে গেল, পার্কে বসে থাকা স্বামী-স্ত্রীর কাছে নিকাহনামা আছে কিনা – ধরে পেটাচ্ছে বা টেনে হিঁচড়ে বন্দী করছে থানায়, ভয়াবহ দৃশ্য! দেশে এ দানব চাই আমরা? কক্ষনো নয় !

(ঘ) ২০০৫ সালে বিবিসির খবরে দুনিয়া শিউরে উঠেছিল যখন ইরানের সরকারী শারিয়া কোর্টে স্ত্রী আবেদন করেছিল তার স্বামীকে আদেশ দিতে, যেন সে তাকে প্রতিদিন না মেরে সপ্তাহে একদিন মারে। স্বামী দাবি করেছিল বৌ-পেটানো তার ইসলামি অধিকার। মুসলিম বিশ্বে এ ধরনের ভয়াবহ খবরে ক্রমাগত প্লাবিত হয়ে যাচ্ছে বিশ্ব, ইসলামের ওপরে এর চেয়ে বড় আঘাত আর কি হতে পারে? এসব জেনে দুনিয়ার সাধারণ শান্তিপূর্ণ অমুসলিমরা ইসলামকে ভয় তো পাবেই, ঘৃণা তো করবেই! দেশে এ দানব চাই আমরা? কক্ষনো নয় !

(ঙ) পাকিস্তানের যে বর্বর আইনে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তিন হাজারের বেশি ধর্ষিতা দশ-বারো বছর জেল খেটেছে সেটার ব্যাপারে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর সন্ত্রাসের কথা না বললেই নয়।  আইনটা হল – "পরকীয়া ও ধর্ষণের প্রমাণ চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য বা অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি" − হুদুদ আইন নং ৭ (১৯৭৯), নং ২০, ৮-এর খ (১৯৮০) দ্বারা সংশোধিত।

বহু বছর ধরে প্রগতিশীল শক্তি ও কোন কোন সরকার এ আইন বাতিলের চেষ্টা করে প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর প্রবল বিরোধিতার জন্য। ক'বছর আগে সংসদে সেটা বাতিলের দাবি গৃহীত হলে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর আমির মওলানা মুনাওয়ার হাসান সংসদে ক্ষিপ্ত হয়ে বলেছেন শারিয়া মোতাবেক এই আইনই সঠিক, এর কোন রকম পরিবর্তন কোরান ও শারিয়ার খেলাফ। এ আইন বাতিল হলে পাকিস্তান অবাধ যৌনতার স্বর্গ হবে। ধর্ষিতারা আদালতে চারজন বয়স্ক পুরুষ মুসলমানের চাক্ষুষ সাক্ষ্য হাজির করতে না পারলে তাদের উচিত হবে পুলিশে না গিয়ে চুপ করে ঘরে বসে থাকা। বাংলাদেশে এ দানব চাই আমরা? কক্ষনো নয় !

সব মিলিয়ে-

একি ইসলামের ছবি?

দুনিয়া দেখছে সবই,

দ্বীনের নবী, – শিউরে উঠে চক্ষু বোঁজে,  

চারদিক এই হাহাকার,

কতদিন চলবে যে আর

মানবতার, – আর্ত বাণী পানাহ খোঁজে..  

২. এবারে সব সন্ত্রাসের বীজ – ইসলামের ঘৃণাভিত্তিক ও হিংস্রতাভিত্তিক সাহিত্য ও স্কুল-কলেজের সিলেবাস।

(ক) ইসলামের ঘৃণাভিত্তিক ও হিংস্রতাভিত্তিক সাহিত্য। বিশাল বিষয় এটা, অতি সংক্ষেপে বলছি। জঙ্গল পরিষ্কার করতে গাছের মাথা কেটে নিশ্চিন্তে দিবানিদ্রা দিলে লাভ নেই যতক্ষণ শাখা প্রশাখা এবং বীজ পরিষ্কার করা না হচ্ছে। মওদুদীর বইসহ শারিয়াপন্থীদের বইগুলো মোহময় আকর্ষণীয় শব্দে বাক্যে ভরপুর। সেগুলো মানুষকে অপরাধহীন সমাজ ও ইহকাল পরকালের সাফল্যের স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু ওগুলোর মধ্যে যে ফাঁকি আছে তা জানতে গেলে দীর্ঘ বহু বছরে শত শত বইয়ের হাজার হাজার পৃষ্ঠার লক্ষ লক্ষ তথ্যের সমীকরণ করতে হয়।

অতীত বর্তমানে শারিয়াপন্থীদের নির্মম অত্যাচার জানতে হয়। এসব সাধারণ জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। ওগুলোর বিপক্ষের বই প্রায় নেই বললেই চলে। একটা উল্লেখযোগ্য বই হল আলেম উলামা প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী সংগঠন নাহদালাতুল উলামা'র 'ইসলামী রাষ্ট্রের বিভ্রম' (ইলিউশন অব ইসলামিক স্টেট)। ইসলামী বিশেষজ্ঞদের এরকম আরো বই 'টুয়ার্ডস ইসলামিক রিফর্মেশন' (ড: আবদুল্লা আন নাঈম), দি চ্যালেঞ্জ অব ফান্ডাসে (ড: বাসাম তিবি) এর মতো বইগুলো অনুবাদ করে দেশে ছড়ানো দরকার। 'শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি' বইতেও অনেক দলিল-প্রমাণ আছে।

(খ) স্কুল-কলেজের সিলেবাস। পাকিস্তানের স্কুল কলেজের সিলেবাস অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ও হিংস্রতায় ভরপুর, মাদ্রাসার তো কথাই নেই। নিবন্ধ লম্বা হবে বলে উদ্ধৃতি দিচ্ছিনা, ইন্টারনেটে ওগুলো পাওয়া যায়। এর ওপরে জরিপ হয়েছে, সরকার তা স্বীকারও করেছে এবং সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ২০০৬ সালে। কিন্তু জামাতসহ শারিয়াপন্থী দলগুলোর প্রবল প্রতিরোধে কিছুই করতে পারেনি, পারবে বলেও মনে হয়না। ওই কাঁচা বয়সে ইসলামের নামে বাচ্চাগুলোর মাথায় ওই যে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হয় ওরা সারা জীবনেও তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা। জরিপে নতুন প্রজন্ম বলেছে, দেশে অমুসলিমদেরকে যে সীমিত অধিকার দেয়া হয়েছে তাতেই তাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত এবং তাদেরকে সরকারে কিংবা আর্মিতে বড় পদ দেয়া যাবেনা।

৩. কালতামামী

সতর্ক হতে হবে আমাদের। আবহকালের অ'তে অজগর, আ'তে আম, সেখানে মোহময় শব্দে ঢুকে পড়েছে জঙ্গিবাদের বীজ, অ'তে অজু, আ'তে আজান.. হঠাৎ হয়নি, পরিকল্পিতভাবে হয়েছে এটা – আপোষকামী পংকিল রাজনীতি, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, সর্বত্র দুর্বৃত্তের ক্ষমতায়ন… চারদিকে অনেক কাজ জমেছে আমাদের।

কাজ জমেছে, কাজ !!

অনেক অসমাপ্ত কাজের হিসেব হবে আজ

কাজ জমেছে ড্রইংরুমে এবং রান্নাঘরে,

কাজ জমেছে বারান্দা আর ঘরের মেঝের পরে

কাজ জমেছে ধুলো ঝাড়ার পোষাকে-আষাকে,

পানি দেবার কাজ জমেছে ফুলের চারাটাকে।

কাজ জমেছে গঞ্জে গ্রামে, অন্দরে বন্দরে,

আরো অনেক কাজ জমেছে চিত্তের কন্দরে

অনেক বছর কাউকে যেন কেউ দিয়েছে ফাঁকি,

তাই দেখি আজ অনেক কাজের অনেক কাজ-ই বাকি,

হচ্ছে প্রচুর চিন্তা করা, প্রচুর কথা বলা,

সুক্ষ্মভাবে হচ্ছে শুধু কাজ এড়িয়ে চলা …

কোথাও কি কেউ নেই?

বলবে, তোমার কাজটা হবে করতে তোমাকেই,

তোমার এ কাজ, তোমারই কাজ! কেউ দেবে না করে,

করোনি, তাই অজস্র কাজ রয়েছে আজ পড়ে।

চতুর্দিকে পাহাড় প্রমাণ কাজ জমেছে, তাই,

দুর হয়ে যাও বাক্যনবাব, কর্মদানব চাই ….