চিকিৎসকের অর্থনীতি পাঠ এবং উপসংহারে ‘রাবিশ’

মামুন আল মাহতাব
Published : 23 Jan 2018, 11:39 AM
Updated : 23 Jan 2018, 11:39 AM

'পুঁথিগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন – নহে বিদ্যা নহে ধন, হলে প্রয়োজন'- এই আপত্ত বাক্যে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি সুযোগ পেলেই বিদ্যা আহরণের চেষ্টা করি আর মাঝে-মাঝেই এদিক ওদিক সেগুলো জাহিরও করি। তবে ইদানিং নিজে পুঁথি না পরে অন্যের পুঁথি পড়া বিদ্যাটা আরোহণের চেষ্টাটা বেশি।

চেম্বার আর ট্রাফিকের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা এই আমার ইদানিং খুব বেশি আর 'বুক' অর্থাৎ বই পড়া হয়ে ওঠেনা। এখন 'বুক' বলতে শুধু 'ফেসবুক'-ই পড়ি আর তাই এই ফাঁকিবাজির অভ্যাস। কোন-কোন আড্ডায় আমি নিষ্ঠাবান শ্রোতা। আমার নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট বক্তা। আবার কোন-কোন আড্ডায় আমি নিজেও বক্তা সেজে বসি। শ্রোতারা শোনেন আর ভাবেন 'লোকটা এত কিছু পড়ার সময় পায় কখন?'

আমি সাধারণত, আড্ডা মারার সুযোগগুলো হাতছাড়া করি না। আর আমার পছন্দের আড্ডাবাজরা যদি কোন আড্ডায় থাকেন তাহলে তো না-ই। আমার পছন্দের চার আড্ডাবাজ হলেন 'ন্যাসভ্যাক' খ্যাত ডাঃ ফজলে আকবর ভাই, একাত্তর টিভির মোজাম্মেল বাবু ভাই, সুচিন্তা ফাইন্ডেশনের আরাফাত ভাই আর সহধর্মিনী ডাঃ নুজহাত চৌধুরী। আড্ডা দেয়ায় তাদের দক্ষতা বা জ্ঞ্যানের গভীরতা অবশ্য এই ক্রোনোলজির ভিত্তি না। এরা প্রত্যেকেই যার-যার অঙ্গনে এবং নিজ-নিজ অঙ্গনের বাইরেও দিকপাল। ভাবছিলাম কার নাম আগে আর কারটা পরে লিখি। তারপর ভাবলাম বয়স অনুযায়ী সাজালেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

কয়েকদিন আগে আরাফাত ভাই একটা টিভি টকশোতে অর্থনীতির একটা জটিল তত্ত্বের সহজ বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তত্ত্বটি সম্ভবত গিনি কো-এফিশিয়েন্ট। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আর অর্থনীতিতে তার প্রভাব এই তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

আমার সন্ধ্যাগুলো কেটে যায় ল্যাবএইডের চেম্বারে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, রাত হয় আরও গভীর আর ঘড়ির কাটার হিসেবে যখন ভোর, তখন ফিরি ঘরে। নিজেকে অনেকটা পেঁচা পেঁচা মনে হয়। বাসায় ফিরে আবার তাড়া থাকে মোড়গ ডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দৌড় লাগানোর। টকশো দেখা তাই ইদানিং বিলাসিতা আমার কাছে।

পরিচিত একজন যখন আরাফাত ভাইয়ের ঐ টকশোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, আমার মনে তখন কালো মেঘ। আহা যদি দেখতে পারতাম! খেদটা কাটাতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। হঠাৎ এক আড্ডায় আরাফাত ভাইকে পেতেই জানতে চাইলাম বিষয়টা নিয়ে। আরাফাত ভাই আবার শোনালেন তত্ত্ব আর সদ্য অর্জিত এই জ্ঞান বিলানোর উত্তেজনায় উত্তেজিত আমি তাই পরদিন চেন্নাই থেকে কেরালাগামী স্পাইস জেটের ফ্লাইটে বসে খাতা-কলম খুলে বসি। তাছাড়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকেও ক'দিন আগেই লেখার জন্য তাগাদা দিয়েছে। অতএব সুযোগটা হাতছাড়া করা অবশ্যই অন্যায় হবে।

ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কোন অর্থনীতিতেই কাম্য নয়। কিন্তু বিকাশমান একটি অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থে সীমিত পর্যায়ে এই বৈষম্যের সহায়ক ভুমিকা অনস্বীকার্য। চমৎকার করে বুঝিয়ে দিলেন আরাফাত ভাই। ধরুন দবিরের আয় ১০০ টাকা আর সগিরের ২০ টাকা। তাদের আয়ের ব্যবধান ৮০ টাকা। দেশের উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে দবির-সগিরের আয়ও। উন্নয়নের মহাসড়কে দেশের অগ্রযাত্রার দশম বর্ষপূর্তিতে দবিরের আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০০ টাকা আর সগিরের ৪০ টাকা। তাদের আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। আগে ছিল ৮০ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৬০ টাকা। এসব সংখ্যা দেখে 'আমার মত অর্থনীতিবিদদের' চোখ কপালে ঠেকলেও, আরাফাত ভাইদের বেলায় তা হয়না। তারা এর মাঝে ভালোটা খুঁজে পান। তারা দেখেন যে দবির আর সগির দু'জনের আয়ই দ্বিগুন হয়েছে।

তারা অর্থনীতির সম্ভাবনাটা বোঝেন। দবিরের আয় দ্বিগুণ হওয়ায় তার বিনিয়োগ সক্ষমতা বেড়েছে, বেড়েছে দবির আর সগির দু'জনেরই ক্রয় ক্ষমতা। এতে দেশে যে নতুন-নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে তাতে করে অনেক নতুন আবুল-কাবুল আর যদু-মধু একদিন ১০০ টাকা করে আয় করবে। আর মানুষ যখন একটা নিয়মের মধ্যে আয় করে, তা সে যতই কম হোক না কেন, তখন সে একটা নিয়মের মধ্যে থাকে। আর নিয়মিত আয়ের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসলে সমাজে বাড়ে অপরাধ প্রবণতা আর অস্থিতিশীলতা। সে সমাজে তখন আর বিনিয়োগে আগ্রহী হন না দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাই। কাজেই অর্থনীতির চাকাও ঘোরে ধীর থেকে ধীরতর।

তাহলে সরকার কি করবে? সরকার কি দবির আর সগিরের আয়ের এই বৈষম্যকে বাড়তে দিতেই থাকবে? নিশ্চয়ই না। একটা ভাল সরকার জানে অর্থনীতির লাগামটা কখন কতটুকু টেনে ধরতে হয়। ধরুন সরকার হস্তক্ষেপ করলো। দবিরের আয় কমে আসলো ৭০ টাকায় আর সগিরের ১০ টাকায়। তাদের আয়ের ব্যবধান ৮০ টাকা থেকে কমে আসল ৬০ টাকায়। আমার মতন অর্থনীতি বোদ্ধারা খুশি হবেন, কিন্তু আমরা খেয়াল করব না যে, এই বৈষম্য কমাতে যেয়ে দবির আর সগির দু'জনের আয়ই কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এতে কমেছে দবিরের বিনিয়োগ সক্ষমতা আর সগিরের ক্রয়ক্ষমতা যা অর্থনীতির কোন বিচারেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।

আমার ধারণা যে কোন ভাল সরকারের মত বর্তমান সরকারও অর্থনীতির এই রশি টানাটানিটা খুব দক্ষ হাতে করছে। অন্তত পক্ষপাতদুষ্ট আর পক্ষপাতিত্বহীন দেশি-বিদেশি জরিপেই দেশের অর্থনীতির তড়তড়িয়ে বেড়ে ওঠার চিত্রটাতো পরিষ্কার। টানা আগুন সন্ত্রাস, একাধিক অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি সত্ত্বেও বছরের পর বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ঘরে ধরে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়।

আমি অর্থনীতিবিদ নই। আমার ক্ষেত্র লিভার, অর্থনীতি নয়। কিন্তু দেশটা যে ভাল চলছে, দেশের অর্থনীতি যে দৌড়াচ্ছে তা বোঝার জন্য বোধ করি অর্থনীতিবিদ হওযার প্রয়োজন পরে না। আর এতকিছুর পরও যারা দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ আর অর্থনীতিকে প্রশ্ন করেন, আমার কেন যেন মনে হয় তারা আসলেই 'রাবিশ'।