বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে অশ্বডিম্ব হাতে পাওয়া

সুখরঞ্জন দাশগুপ্তসুখরঞ্জন দাশগুপ্ত
Published : 19 Jan 2018, 02:55 PM
Updated : 19 Jan 2018, 02:55 PM

গল্পের গরু অনেক সময়েই গাছে চড়ে থাকে। কিন্তু স্রেফ বকুনি বাজির বাণিজ্য যে কোন গগনে চড়তে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল কলকাতায় নিউটাউনে সদ্য সমাপ্ত "বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন"-এ।

একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতির বাণও যে কতোটা বে-লাগাম হতে পারে, তার এক নতুন নজির তৈরি হলো নজিরবিহীন জাঁকজমকপূর্ণ এই মহাসমারোহে দেশ-বিদেশ থেকে আসা শিল্প-রত্নদের ভাষণে। আর এর সঙ্গে চমকপ্রদ ছিলো মমতা বন্দনার বৃন্দগীত।

মঙ্গলবার টানা দু' ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানটির আদি অন্ত পুরোটাই ছিলো 'বকোয়াস'। এত কিছু বাগাড়ম্বর শেষে ইতিবাচক একটা সম্ভাবনার দিগন্ত হয়তো বঙ্গবাসী মানুষ জনের দিব্যচোখের দৃষ্টিগোচর হতো, যদি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা হিসাবে তাঁর ভাষণে এমন কিছু নতুন ঘোষণা করতেন যার দ্বারা পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যের যাবতীয় শিল্পসম্ভাবনার পাষাণ আবার প্রাণ ফিরে পেত।

সেই ঘোষণা হলো- এতদিনকার ভুল নীতি বর্জন করে শিল্প অথবা বাণিজ্য যাই হোক না কেন, তার জন্য জমির আয়োজন করার দায়িত্ব এখন থেকে নেবে রাজ্য সরকারই। কিন্তু আরাবুল খুদেদের মতো তৃণমূল নেতা-কর্মীদের জমির দালালির ব্যবসা রমরমাভাবে চলতে দেয়ার স্বার্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে শিল্পর জন্য জমি অধিগ্রহণের রাস্তায় না হাঁটার সিদ্ধান্তে এখানো সমানভাবে অনড় তা তিনি আরো একবার স্পষ্ট করে দিলেন আজও।

তিনি রাজ্যে শিল্প-গঙ্গা আহ্বানের ভগীরথের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন বটে, কিন্তু সে গঙ্গা যে কোন জমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে সে কথা তিনি ঘূণাক্ষরে উচ্চারণ করলেন না তাঁর বিশ মিনিটের ভাষণে। অথচ অনেকেই আশা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র যখন তাঁর ভাষণে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করতে চলেছেন তখন অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি হয়তো নতুন জমি নীতি নিয়েই কিছু বলবেন। বলা বাহুল্য মমতা সেদিনও জল ঢেলেছেন সকলের সেই আশায়।

বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দেয়া শিল্পতিদের একজনও এদিন নতুন করে এক পয়সা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেননি। তাঁরা শুধু মমতা-স্তুতি করেই দায় সেরেছেন। এ বলে আমায় দেখ, এ বলে আমায় এমনটাই ছিলো মমতা বন্দনার ধারা। আম্বানি গোষ্ঠীর মুকেশ আম্বানি এ রাজ্যে একটিও উৎপাদনশিল্প তৈরি করেননি। তার সমস্ত কারখানা উত্তর আর পশ্চিমভারতে। পশ্চিমবঙ্গে শুধু ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা পিটে গেছেন। সেই মুকেশ আম্বানির মতে, ওয়েস্ট বেঙ্গল এখন নাকি মমতার নেতৃত্বে 'বেস্ট বেঙ্গল' হয়েছে।

রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার নাকি চতুর্থ স্থানে এবং বছরে ১৫ শতাংশ হারে এই বৃদ্ধি ঘটছে যা কিনা গোটা দেশের বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেকটাই বেশি। মমতাকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, 'বেঙ্গল মিনস বিজনেস'। মমতার নেতৃত্বে নাকি ধীরে চলো নীতি বিদায় নিয়েছে। মুকেশ জানান, তিনি গত দু বছরে পশ্চিমবঙ্গে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছেন! কিন্তু কোথায়? নিজেই খোলাসা বলেন, মোবাইল ব্যবসায়। আগামী এক বছরে তিনি রাজ্যের সমস্ত গ্রামে জিও পরিষেবা পৌঁছে দিতে চান। শুধু তাই নয়, তিনি দু বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা এ রাজ্যে ব্যবসার বিনিয়োগেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

লন্ডন থেকে উড়ে আসা লক্ষ্মী মিত্তল কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি ভেবে দেখছেন মাত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি লন্ডনে বসেই খবর পেয়ে গেছেন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে। অন্য রাজ্যের অফিসাররা পশ্চিমবঙ্গে এসে নাকি শিখে যাচ্ছেন কীভাবে প্রশাসন চালাতে হয। তিনি এ রাজ্যে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি দূর করার জন্য কী করা যায় তা অবশ্যই ভেবে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।

জেএসডাবলু স্টিলের কর্ণধার সজ্জন শালবনীতে স্টিল ফ্যাকটরি করবেন বলে জমি নিয়েছিলেন । কিন্তু বামফ্রন্ট আমল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত গত দশ বছরে ইস্পাত শিল্পের একটা ইটও গাঁথেননি। বরং সেই জমিতে ছোট একটা সিমেন্ট কারখানা করেছেন। তিনি নাকি এই কারখানা করেই অভিভুত হয়ে গেছেন!

বুঝে নিয়েছেন, মমতা যা বলেন তাই করেন। সজ্জন জিন্দল বিশ্বকাপ আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গের কৃতিত্ব দেখে এতোটাই মুগ্ধ যে- তিনি ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঠিক একইভাবে কোটাক মাহিন্দ্র ব্যাঙ্কের উদয় কোটাক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি এ রাজ্যের গ্রাহকদের জন্য শুধুমাত্র মোবাইল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চালু করবেন। তিন মিনিটেই নাকি সেই অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে।

তিনি দাবি করেন, এ রাজ্য থেকে তিনি যত না টাকা ডিপোজিট করেছেন তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ বা বিনিয়োগ হিসাবে খরচ করেছেন। যদিও ভবিষ্যতে এখানে কোনো বিনিয়োগ পরিকল্পনা আছে কিনা সে ব্যাপারে তিনি একবারের জন্যও মুখ খোলেননি।

রাজ্য সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েঙ্কা যথারীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশংসার পর্বত শিখরে তুলে দিয়ে জানিয়েছেন, তাঁর নেতৃত্ব, অন্তর্দৃষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদির নাকি কোনো তুলনা নেই। এ রাজ্যে রাজনৈতিক স্থিরতা অতুলনীয় যা নাকি দশ বছর আগে ছিলো না। তাঁর এ রাজ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ খুবই ফলপ্রদায়ী।

আগামীদিনে তিনি দুর্গাপুরে কার্বন পার্ক, নতুন একটি হাসপাতাল, এফএমসিজি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে চান। তিনি বলেন, এ রাজ্যে শিল্পপতিদের নাকি সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়। তার সুরে সুর মিলিয়েই হর্য নেউটিয়া বলেন, মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতিদের বহু মুল্যবান পরামর্শ দেন।

শিল্পপতি সঞ্জয় বিয়ানি বলেছেন, তিনি তাঁর নতুন ব্যবসায় রাজ্যের থেকেই ৯৫ শতাংশ কর্মী নিয়োগ করবেন এবং তার মধ্যে ৬৫ শতাংশই হবে দ্বাদশ শ্রেণী পাস শ্রমিক। এই প্রতিশ্রুতি কীভাবে পূরণ হবে তা কিন্তু তিনি বলেননি।

থাইল্যান্ড থেকে আসা অলোক লোহিয়াও বলেছেন, তিনি এ রাজ্য সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা শুনেছেন। যদিও রাজ্যে তিনি কতোটা বিনিয়োগ করতে চান তা খোলসা করে বলেননি। এঁরা ছাড়াও এদিন ভাষণ দেন, শিল্পতি স্বরাজ পোদ্দার, স্পাইস জেট কোম্পানির চেয়ারম্যান অজয় সিং, পোল্যান্ডের ডেপুটি মিনিস্টার ডেরেক বোগারস্কি ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্য দলের এক প্রতিনিধি।

একসঙ্গে পাঁচ হাজার লোক বসতে পারে রাজারহাটের এমন নতুন কনভেনশন সেন্টারে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সহযোগী ছিল আটটি রাষ্ট্র-পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জাপান, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড ও গ্রেট বৃটেন।

এই দেশগুলি থেকে প্রায় শ' তিনেক বাণিজ্য প্রতিনিধিদল কলকাতায় এসেছেন। এঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে অভিনব এই কনভেনশন সেন্টারের ভেতরেই। শিল্পপতিরা প্রত্যেকেই অবশ্য একবাক্যে বলেছেন, এই নতুন কনভেনশন সেন্টারটি বিশ্বমানের। এবারই প্রথম মিলনমেলা ছেড়ে এই নতুন কনভেনশন সেন্টারে বাণিজ্য সম্মেলনের আয়োজন করা হলো।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ভাষণে, তেমন উজ্জ্বল ছিলেন না। বেশ কয়েকবার ইংরেজি বলতে গিয়ে তিনি বাংলায় চলে গিয়েছেন। একবার তো (সম্ভবত মুখ ফসকে) বলে ফেললেন- আমি হান্ড্রেট পারসেন্ট 'কমিউনাল'। হয়তো বলতে চেয়েছিলেন 'সেকুলার'। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সচরাচর এ ধরণের অনুষ্ঠানে দীর্ঘ ভাষণ দেন, এদিন বললেন, অত্যন্ত সংক্ষেপে। মমতা এদিন তাঁর ভাষণে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এনে কেন্দ্রীয় সরকারকে কটাক্ষ করেন।

তিনি বলেন, 'আমি সমস্ত ধর্ম, জাতির মানুষকে ভালোবাসি। পশ্চিমবঙ্গ সবাইকে ভালোবাসে, সবাই পশ্চিমবঙ্গকে ভালোবাসে।' মুখ্যমন্ত্রী এদিনও যথারীতি রাজ্যের শিল্প বিকাশের সমস্ত অন্তরায় চাপিয়ে দিয়েছেন পূর্ববর্তী বাম সরকারের ওপর।

তিনি বলেন, ৩৪ বছরের বাম শাসনের জন্যই নাকি রাজ্য এগোতে পারেনি। সেই সময় ৭০৮ লক্ষ শ্রম দিবস নষ্ট হয়েছিলো, তাঁর আমলে একটিও শ্রম দিবস নাকি নষ্ট হয়নি। মমতা দাবি করেন, তাঁর আমলে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার সমস্ত রাজ্যের চেয়ে এগিয়ে। রাজ্যে ক্যাপিটাল এক্সপেনডিচারের হার নাকি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি দাবি করেছেন, ইস্পাত ও ক্ষুদ্রশিল্পে রাজ্য একনম্বরে রয়েছে। মমতার আরো দাবি, গত ছ বছরে তিনি নাকি ৮১ লক্ষ বেকার যুবককে চাকরি দিয়েছেন গ্রামীণ কর্মবিকাশের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ নাকি এক নম্বরে রয়েছে। রাজ্যের সাতকাহন গেয়ে মমতা বলেন, পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতের সদর দরজা তাই এখানে বিনিয়োগ করলে লাভ বই ক্ষতি নেই।

নামে টাকা দেবে গোরী সেন। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের করের টাকা নয় ছয় করে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য  সম্মেলন করে অশ্বডিম্বই হাতে পেল মমতা সরকার।