ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্ব গ্রহণের বর্ষপূর্তি

অনিন্দ্য আরিফ
Published : 18 Jan 2018, 02:22 PM
Updated : 18 Jan 2018, 02:22 PM

ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। একটি অবাধ নিরেপক্ষ নির্বাচনে আমেরিকানরা একজন বর্ণবাদী, জাতিবিদ্বেষী, রিয়েল এস্টেট টাইকুনকে নির্বাচিত করেন।

গত বছরের ২০ জানুয়ারির সকাল ৯ টায় মার্কিন সংবিধানকে রক্ষার শপথ নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসেন। নিরেপক্ষ নির্বাচনে ট্রাম্পের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন আরেক দুর্নীতিগ্রস্থ কর্পোরেটের অনুচর হিলারি ক্লিনটন। হিলারি মার্কিন নির্বাচনে এদের মধ্যে সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি বার্নি স্যান্ডার্সকে প্রার্থিতা থেকে সুকৌশলে সরিয়ে দেন। হিলারি এবং একজন বুজরূক ব্যক্তির মধ্যে মার্কিনরা বুজরূককেই বেছে নেয়।

তার রাষ্ট্রপতিত্বের প্রথম বছরে একমাত্র গুরত্বপূর্ণ বিল পাস হয়-তাহলো কর কর্তন। কিন্তু তার রিপাবলিকান সহচররা যেমন সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা মিচ ম্যাককনেল এবং স্পিকার পল রায়ান ছিলেন আরও কর কর্তনের পক্ষে। প্রকৃতঅর্থে, রিপাবলিকানরা ব্যাপক কর কর্তনের পক্ষে ওকালতি করে। আসলে তারা ধনীদের প্রতিনিধি। যেমন তাদেরই একজন বেন কারসন চাইছিলেন ফ্লাট কর হবে ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আরেকজন ফ্লাট করের পক্ষালম্বনকারী টেড ক্রুজ চাইছিলেন পুরো ব্যয়ের উপর ১০ শতাংশ, ব্যবসায় ১৬ শতাংশ ধার্য করতে।

তিনি আরো চাইছিলেন বেতন কর পরিহার করতে। তিনি আভ্যন্তরীণ রাজস্ব সেবা (আইআরএস) বাতিলেরও পক্ষে ছিলেন। তাই ট্রাম্পকে রিপাবলিকান সহকর্মীদের মন জোগাতে কর কর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

ট্রাম্প তার প্রথম বছরে হোয়াইট হাউজের আরেকটি ক্ষতি করেছে। সেটি ছিল তার প্রাথমিক বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া। ওবামা প্রশাসনের সময় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অবাঞ্ছিত মিচ ম্যাককনেলকে রিপাবলিকান জয়ের পর আবারো নিযুক্ত করা হয়েছে। ট্রাম্প অনেক আইন সম্পর্কে অল্পশিক্ষিত ব্যক্তিদের বিচারক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন।

ট্রাম্প সরকারি সংস্থাগুলোর শীর্ষে এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়েছেন যারা ঐসব সংস্থার প্রকৃত লক্ষ্যকে ধারণ করেন না। তারা জীবাশ্ম জ্বালানি এবং অন্যান্য পরিবেশ বিনষ্টকারী উপাদানগুলোর প্রতি অনুরক্ত। তাদের ব্যাংকিং, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শ্রমিক নিরাপত্তার ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গী একইরকম- ধনীদেরকে আরো ধনী করা।

ট্রাম্প একদিন তো মুসলিমদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন, আরেকদিন পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে বাইরে রাখেন। পরেরদিন আবার মেক্সিকান সীমান্তে দেওয়াল তুলতে যান- কেননা তারা ধর্ষক বলে তার ধারণা। আবার তার পরেরদিন তিনি তার জীয়নবাদী অর্থদাতাদের তুষ্ট করতে একটি ঐতিহাসিক নগরীকে চুরি করেন। তার আগে অবশ্য তিনি হাস্যকরভাবে হাইতিয়ানদের উদ্দেশে বলেছেন যে 'তাদের সকলের নাকি এইডস আছে'

ট্রাম্পের এক বছরে স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো উল্লেখযোগ্য হারে আর্থিক আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে। স্বাস্থ্য এবং মানবিক সেবা দপ্তরের (এইচএইচএস) বাজেট ১২ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কাটা হয়েছে। যা ২০১৭ থেকে ১৬ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে।

স্বাস্থ্যসেবা করুণ পরিণতির দিকে হাঁটছে। জাতীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের বজেটের ৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কেটে নেওয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা গবেষণাকে উৎসাহিত করা হতো। ফলে যেসব চিকিৎসা বিজ্ঞানী মানুষের স্বাস্থ্যসেবার উপর গবেষণা করতেন তাদের কাজের যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটেছে।

ট্রাম্প অনবরত মিথ্যা কথা বলছেন, প্রতারণা করছেন, দুর্বলদেরকে অপমানিত করছেন। তিনি অস্ত্র বিক্রি বাড়িয়ে দিয়ে আরবের অত্যাচারী শাসকদের মুসলিম হত্যায় উৎসাহিত করছেন।

তিনি ইসরায়েলকে আরো প্যালেস্টাইনি হত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করছেন এবং জীয়নবাদীদের তুষ্ট করতে জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করেছেন।

যেসব আমেরিকান চিন্তা করছেন ট্রাম্প একজন রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী- তারা ভুল। রাজনৈতিকভাবে, তিনি একজন যুদ্ধের প্ররোচনাকারী। প্রকৃতঅর্থে, তিনি একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নন, একজন কাপুরুষ। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রেও তিনি একইরকম। তার অভিলিপ্সা হলো বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনপরিবেশের ধ্বংসসাধন এবং তার ধনী মদদদাতাদের আরো সমৃদ্ধ করা।

এই লুণ্ঠন খুবই উঁচু মাত্রার। ট্রাম্পের নিম্মমানের অর্থনীতির শিকার তার দেশের জনগণ। তার যে কর প্রণালী তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্ররা আর লাভবান হচ্ছে ধনীরা।

ট্রাম্পের গর্হিত নীতি কিছু প্রচার মাধ্যমকে ভালো অবস্থানে নিয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। তারা আরা আবার বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। তারা সমস্যার সুযোগ নিচ্ছে। এনওয়াইটি ইরাক যুদ্ধকে বেঁচে কিনে খেয়েছিল। অবশ্য তারা রাজনীতির সম্পূর্ণ আর্থিকীকরণকে বুঝতে ব্যর্থ হয়। মার্কিন রাজনীতি আর্থিক অভিজাতদের আভ্যন্তরীণ ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছে এবং মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে বৈধ ও স্বাভাবিক করছে।

ইতিমধ্যে ট্রাম্প আলবামা এবং ভার্জিনিয়ায় বড় ধাক্কা খেয়েছেন। তার দল ঐ দুটি প্রদেশের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতায় গোটা বিশ্ব ভীত। অথচ ট্রাম্প বলে কিনা ঠাণ্ডা আবহাওয়ার চেয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ভালো।

ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বে আমেরিকানদের সমস্ত আশার ফানুস উবে গিয়েছে, ভয়ঙ্কর ও সহিংস সামরিকতাবাদের ভীতি বাড়ছে, পরিবেশ ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছে, মার্কিনের কুখ্যাত মিত্র সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের সহযোগিতায় ইয়েমেন ও প্যালেস্টাইনে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে, আমেরিকান সমাজের সবচেয়ে দরিদ্ররা আরো নিম্মমানের জীবনের দিকে ঝুঁকছে এবং সবচেয়ে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে।

ট্রাম্পের এক বছরে, তিনি তার যেকোন পূর্বসুরীদের চাইতে বেশী মিত্র হারিয়েছেন এবং বেশি শত্রু তৈরি করেছেন। তাই আমরা কোরিয়া উপদ্বীপ থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত সর্বত্রই যুদ্ধের হুমকি দেখতে পাই। চির বৈরী কিউবার সাথে ওবামার সময় সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটেছিল। কিন্তু ট্রাম্প এসে সম্পর্ককে যেকোনও সময়ের চাইতে আরো বেশি তিক্ত করেছেন। সম্প্রতি তিনি আফ্রিকার দেশগুলোকে অকারণে কটাক্ষ করেছেন। রাষ্ট্রপতি বুশের 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের' অন্যতম সহযোগী, পুরানো মিত্র পাকিস্তানে সহায়তা বন্ধের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক তিক্ত করেছেন।

সম্প্রতি পাঁচটি মহাদেশের ৩৭টি দেশে একটি জরিপে দেখা গেছে, খুব অল্পেরই ট্রাম্পের রাষ্ট্রপতিত্বের প্রতি আস্থা আছে। ৭৪ শতাংশই ট্রাম্পের বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা রাখে। আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে একটি মেরুকরণ স্পষ্ট। সেক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার ওয়াশিংটন থেকে তেল আবিব হয়ে রিয়াদ পর্যন্ত ধনীরা একই মেরুতে অবস্থান করছেন। তারা সারা বিশ্বকে শঙ্কিত করছে এবং আমরা খারাপ পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছি।