দৃষ্টান্ত দেশ বাংলাদেশ

সদানন্দ ধুমে
Published : 2 Sept 2013, 03:05 PM
Updated : 10 May 2012, 06:28 PM

এক সময়ের 'তলাবিহীন ঝুড়ি' এখন তার সমপর্যায়ের দেশগুলোর চেয়ে ধর্মীয় দিক থেকে অনেক উদার এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বেশি বাস্তবমুখী।

১৬ কোটি মানুষের দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে তেমন জায়গা করতে পারেনি। এটা এমন এক অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে প্রধান অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভারত নেতৃত্ব দেয়, পাকিস্তান অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো ক্ষুদ্র দেশও মাঝে মাঝে অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে হাজির হয়।

তারপরেও শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় পা রেখেছেন । প্রায় এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ মার্কিন কর্মকর্তা হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সফর করলেন। তিনি এমন একটি দেশে গেলেন যে দেশ তার অঞ্চলের অন্য সব দেশকে একটি বা দুটি বিষয়ে ভালো শিক্ষা দিতে পারে।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ বাংলাদেশ উদারতার একটি দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। অন্য মুসলিম দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মুসলমানরা অনেক বেশি সহনশীল। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ ছয় নেতাসহ মোট নয় জন বর্তমানে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারাবন্দি রয়েছে।


১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তারা মুক্তিযোদ্ধা ও হিন্দু-মুসলিমদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিলো।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের বাবা শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-৭৫) ওই স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বিরোধিতাকারীদের বিচারের মাধ্যমে ইতিহাসকে কলঙ্কমুক্ত করতে চায় সরকার।

একইভাবে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদ দমনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রেকর্ড সবচেয়ে ভালো।

সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টাল-এর মতে ২০০৮ সালের শেষদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মাত্র নয় জন মানুষ মুসলিম জঙ্গিদের হামলায় নিহত হয়েছে। অন্যদিকে তার আগের সরকারের আমলে চার বছরে বাংলাদেশে ৫৬ জন ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী (হুজি-বি) ভারতেও সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহনশীলতার অভাব সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন বিষয়ে মানুষ প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে বিভক্ত থাকে। তবে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশ শুধু ধর্মবিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে চলে না। বেশিরভাগ বাংলাদেশি একইসঙ্গে গর্বিত বাঙালি ও গর্বিত মুসলিম হওয়ার মধ্যে কোনো সংকট বোধ করে না। এই আত্মবিশ্বাস বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ দমনে সক্ষম করেছে। আর অন্য মুসলিম দেশগুলোর এই বিশ্বাসের অভাব রয়েছে।

এবার উন্নয়নের ক্ষেত্রে ঢাকার কার্যকর ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপের প্রসঙ্গে আসা যাক। গত পাঁচ বছর ধরে প্রতিবছর গড়ে ৬ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বমানের পোশাক শিল্প গড়ে তুলেছে যেখানে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ কাজ করছে যাদের বেশিরভাগই নারী। এইচ অ্যান্ড এম, ওয়ালমার্ট ও টমি হিলফিগারের মতো বিশ্বের অভিজাত ব্র্যান্ডের কাপড় সরবরাহ হয় বাংলাদেশের পোশাক কারখানা থেকে।

চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ঠিকভাবে কাজ করতে পারলে চীনের পরিবর্তে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের প্রতি ব্যবসায়ীরা বেশি আগ্রহী হবে তার সস্তা শ্রমের কারণে।

গোল্ডম্যান সাকস এর 'পরবর্তী ১১' এর তালিকায় ভবিষ্যতে বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশে পরিণত হওয়ার সক্ষমতা রয়েছে এমন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান।

বড় প্রতিবেশি দেশ নিয়ে কয়েক বছরের দুশ্চিন্তা শেষে বাংলাদেশ এখন বাস্তবমুখী হয়ে ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে জিইয়ে থাকা সংকট নিরসনের পথ খুঁজছে। প্রতিবেশি দুই দেশ ইতোমধ্যে দীর্ঘদিনের স্থলসীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যও বাড়ানো শুরু করেছে। উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি ট্রানজিট চুক্তির সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যেই এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আটকে যাওয়ায় ট্রানজিট চুক্তিও আটকে আছে।

ঢাকা ও নয়াদিল্লি এখনো ওই চুক্তির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তারা সফল হবে যা ওই অঞ্চলে শান্তির একটি নতুন অধ্যায় শুরু করবে।

তবে বাংলাদেশ একেবারে সমস্যামুক্ত নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার প্রধান প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধান খালেদা জিয়ার মধ্যে এখনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বিরাজমান। গত মাসে এক নেতার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে সম্প্রতি কঠোর আন্দোলনে নেমেছে বিএনপি। তারা এর জন্য ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করছে। এ নিয়ে তারা দুই দফায় পাঁচ দিন হরতাল করে পুরো দেশ অচল করে দিয়েছে।

ওই বিএনপি নেতা নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কেউ কোনো উত্তর দিতে পারছে না। এ ধরনের আরো কয়েকটি নিখোঁজের ঘটনা দেশটির আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির নজীর দেয়। দেশটিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা আলাদা কোনো গোষ্ঠী কোনো জবাবদিহি ছাড়াই বিচার-বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসছে।

এদিকে ইসলামপন্থী সন্ত্রাসবাদ কমে আসলেও একেবারে নির্মূল হয়নি। বিএনপি এখনো ইসলামী কট্টরপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। একই ধরনের ইসলামপন্থী গোষ্ঠী পাকিস্তানকে জেকে ধরেছে।

এছাড়া ২০০৮ সালের শেষদিকের পর থেকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনীও প্রশংসার দাবি রাখে। অন্তত গত সাড়ে তিন বছরের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভিজ্ঞতায় একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, দেশটিতে গণতন্ত্র টিকে থাকবে। ১৯৭৫ সালে দেশটিতে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং পরেও তারা এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।

কিন্তু বর্তমানে এসব দুশ্চিন্তা অনেক দূরের বিষয়। একদিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে দেশকে তলাবিহীন ঝুঁড়ি বলেছিলেন এ সপ্তাহেই সেই দেশ তারই উত্তরসূরিকে দেখিয়ে দেবে তার বক্তব্যকে কতোটা ভুল প্রমাণ করেছে তারা।

ভাষান্তর: আজিজ হাসান