পুরুষ নির্যাতন দমন আইন প্রণয়নের দাবির নেপথ্যে…

Published : 17 Jan 2018, 09:48 AM
Updated : 17 Jan 2018, 09:48 AM

আমার হৃদয়- এক পুরুষহরিণ-

পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে

চিতার চোখের ভয়- চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে

তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?

– ক্যাম্পেজীবনানন্দ দাশ

সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণ মামলার দায়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জের আগানগর এলাকার এক নারীকে এ বছরের ৪ এপ্রিল কারাগারে পাঠায় ঢাকার ১ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল।

বিচারক জেসমিন আরা বেগম তার তালাকপ্রাপ্ত স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ধর্ষণ মামলা করায় তাকে কারাগারে পাঠান।  স্বামী পুরানো ঢাকার নিমতলীর ৫০ নম্বর নবাব কাটরার বাসিন্দা বেগমবাজারের মুদী ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম ওই নারীর মিথ্যা মামলায় ৭ মাস জেল খাটেন।

মিথ্যা মামলায় হেনস্তার শিকার পুরানো ঢাকার এই ব্যবসায়ী মনে করেন, নারী নির্যাতন দমন আইনে কিছু  ব্যতিক্রম বাদে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের কারণে মারধরের যে মামলা করেন, তার অধিকাংশই ভূয়া অভিযোগে দায়ের করা। আদালতপাড়ার সাংবাদিকদের তিনি ও তার আইনজীবী এ বিবৃতি দিয়ে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন।

মিথ্যা মামলার এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগগুলোও তাই মনে করে। একইরকম মনে করে বিভিন্ন বেসরকারী-স্বেচ্ছাসেবী আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাসহ নারী অধিকার সংগঠনগুলোও। সরকারী, বেসরকারি সংগঠন বিভাগের এ বিষয়ে ভাষ্য হচ্ছে- যৌতুকের কারণে মারধরের বিভিন্ন ধারায় শতকরা ৯০ ভাগই মিথ্যা মামলা।

কিন্তু সরকারের পুলিশ বিভাগ এ বিষয়টির ব্যাপারে একেবারেই গা-ছাড়া। বরং অভিযোগকারী স্ত্রী এবং আসামি স্বামীপক্ষের কাছ থেকে উৎকোচের অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের অনেকেরই অভিযোগ- পুলিশ মামলার বোঝা বাড়ায়। কিন্তু যৌতুকের কারণে মারধরের মামলার অবশিষ্ট দশভাগ কিন্তু মোটেও মিথ্যা মামলা নয়। এ বিষয় সূর্যের অলোর মত সত্য।

এ ধরনের আরেকটি মিথ্যা মামলার উদাহরণ রয়েছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কোকদণ্ডি এলাকার এক নারী ২০১৩ সালে তার প্রতিবেশি মো. হাসান কামালের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। এই ধর্ষণের কাহিনি ছিল সাজানো। সে কারণে চট্টগ্রামের ১ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালের বিচারক রফিকুল ইসলাম অভিযোগকারীকে ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেন।

১৯৮০ সালের 'যৌতুক নিরোধ আইনে' করা অনেক মামলাই মিথ্যা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে যৌতুকের মামলাকে আইন আদালত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন লোকজন 'কৌতুকের মামলা' বলেন।

হয়তো ভরণপোষণ ঠিকমত পান না এবং বিভিন্ন বিষয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়াঝাঁটি হয়, টানাটানি থাকে সংসারে। ঘর-গেরস্থালি, সন্তান পালন ইত্যাদি ব্যাপারে মনোমালিন্য হলেই 'পতি'-র বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার উদ্যোগ নেন অনেক স্ত্রী।

বাজারে এত ভোগসামগ্রী! অর্থাভাবে সেগুলো কিনতে না পারায় স্ত্রীরা পারিবারিক আদালতে ভরণপোষণের মামলা না করে সেসব ঘটনার ওপর রঙ চড়িয়ে যৌতুকের কারণে মারধরের মামলা করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এতে করে স্বামীরা বর্ণনাতীত ভোগান্তিতে পড়েন।

আবার ভরণপোষণ না দেওয়ার মামলার পাশাপাশি কোনও কোনও নারী একটি 'নারী নির্যাতন দমন আইন'-এ যৌতুকের কারণে মারধরের মামলাও সচরাচর করেন। এই বিষয় মুখস্ত রেওয়াজের মতো।

নারীদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সকল সমাজে মাত্রা ভিন্নতায় নির্যাতন ছিল, আছে, আরো অনেক দিন থাকবে- সেই বিষয়ে আমারসহ অনেকেরই দ্বিমতের কোনও অবকাশ নাই। কিন্তু এই নারীদের হাতেই কিন্তু পুরুষও নির্যাতিত হয়। যদিও এর মাত্রা, ধরন, প্রেক্ষিত ভিন্ন। পাষণ্ড-পামর-দুবৃর্ত্ত স্বামীর হাতে স্ত্রীরা যেমন প্রহার, নিগ্রহের শিকার হন তেমনি স্ত্রীর হাতে পতি নিপীড়ণের দৃষ্টান্ত কম নাই।

নির্যাতন নিপীড়ণের শিকার স্বামীকূল অফিসে, আড্ডায়, মাহফিলে কিন্তু অনেকক্ষেত্রে নিজেদের স্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা রকম অনুযোগ জানান। তাদের হাত থেকে পালানোর উছিলা খুঁজতে থাকেন।

নারী নির্যাতনের প্রাবল্যে পুরুষ নির্যাতন প্রসঙ্গ স্থান পায় কি না তা অবশ্যই বিতর্কের। কিন্তু এ লেখাটি 'নারী নির্যাতন দমন আইন' এর অপব্যবহার নিয়ে। অবশ্য সবক্ষেত্রে নয়। এটি প্রতিকারে রয়েছে উদাসীনতা। নারীদের নিয়ে অনেক এনজিও রমরমা 'ব্যবসা' করছে। নারীবাদীরা এ কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবেন আর শাপ-শাপান্ত করতে থাকবেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রথম প্রণীত হয় ১৯৯৫ সালে। ২০০০ সালে এর সংশোধন হয়। তৃতীয়বারের মত ২০০৩ সালের সংশোধিত আইন অনুযায়ী আদালতগুলো এখনকার বিচারকাজ চালাচ্ছে।

এ আইন প্রণয়নের পর থেকেই যৌতুকের কারণে মারধরের মিথ্যা মামলায় আদালত উপচে পড়ছে। যে বিষয় বিভিন্ন সময় নারীবাদী ও আইন সহায়তা দেওয়া বিভিন্ন সংগঠন, এমনকি সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোও বলে আসছে। পরিসংখ্যান তুলে ধরছে। কিন্তু এ ক্ষত বা প্রদাহের উপশম হচ্ছে না। তাই আবারো এ আইন সংশোধনের কথা উঠেছে।

কিন্তু আইন সংশোধনটি যদি বাস্তবতা উপেক্ষা করে তৈরি হয় তবে কিন্তু লবডঙ্কা। আসলে কাঁচের ছত্রছায়ায় বসে যারা তত্ত্ব চর্চা করেন তারা ময়দানের প্রথম বক্তৃতায় মুষড়ে পড়েন।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে সসেজ খেতে খেতে গৃহকর্মীদের সুরক্ষার জন্য আইন তৈরির সুপারিশ করেন অধিকাংশ নামধারী কথিত অনেক নারীবাদীরা (সবাইকে বলা হচ্ছে না) ।  দুর্নীতি আর ভণ্ডামির চেহারাটি মানবিক মুখোশে ঢেকে- স্বামী আর শ্বশুড়বাড়ির লোকদের অত্যাচারের হাত থেকে ইট ভাঙ্গারি নারীদের বাঁচাতে আইন করতে চান তারা। তাই সব গোলমেলে।

এসব কথিত নারীবাদীরা- নারী-পুরুষ সবারই শত্রু। সে কারণে নারী নির্যাতন দমন আইনের গুরুভাগই পুরুষ নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দাবি উঠেছে 'পুরুষ নির্যাতন বিরোধী আইন প্রণয়ন' করার। কারণ বিজ্ঞানের সূত্র বলে, প্রত্যেক কাজের পেছনে কারণ রয়েছে।

নারীদের সুরক্ষায় নিয়ে এতো আইন থাকা সত্ত্বেও কিন্তু ধর্ষণ, নির্যাতন ও নারী পাচার বাড়ছে, কমছে না। নারী ধর্ষণ, নারী পাচারের সত্য ঘটনার প্রচুর উদাহরণও রয়েছে। কিন্তু সঠিক বিচার পাচ্ছেন কয়জন?

গৃহকর্মী নির্যাতন করছেন সমাজের প্রভাবশালী, খ্যাতিমান অনেকে। কিন্তু গরীব, দরিদ্রের ইজ্জতের মূল্য আর বিচার চাওয়ার শক্তি কতটুকু? এসব ক্ষেত্রে টাকা দিয়ে আপোস-রফা করে মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্রিকেটার শাহাদাতের মামলাটি উজ্জ্বল উদাহরণ। পুলিশের হাতে হচ্ছে প্রচুর গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।

যা আমরা গণমাধ্যমে দেখি। কিন্তু বিচারের আগেই আপোস-রফা হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এতে কিন্তু এই নির্যাতন বিকৃতির কর্কট রোগটি কমে না, বরং বেড়ে চলে।

গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনের ঘরোয়া কর্ম-অধিবেশনে আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. ইমান আলীর সভাপতিত্বে জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার ৪০টির বেশি ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা এক উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন। এবিষয়ে প্রস্তুত করা হয় ১০ দফা-সম্বলিত একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ হিসেবে 'মিথ্যা মামলা'কেই ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ওই অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী বিচারকেরা একমত হন যে, বাস্তবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ব্যাপক অপপ্রয়োগ ঘটছে। আবার কঠোরতর শাস্তির বিধান ও তা কার্যকর করা সত্ত্বেও নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌতুকের মতো অপরাধের প্রকোপ কমেনি।

এজন্য তাঁরা বিদ্যমান আইনের কিছু ধারা অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে সংশোধনের সুপারিশ করেন। তাঁরা আক্ষেপ করে বলেছেন, আইনের ১১ক ধারায়  যৌতুকের জন্য শুধু মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান আছে। এর ফলে অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে সাজা দেওয়া যায় না, যা মানবাধিকার পরিপন্থী।

আবার স্বামী-স্ত্রী বিরোধে জড়িয়ে প্রথমে মামলা করলেও পরে সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বা অন্য কারণে তাঁরা সংসার টেকাতে আপস করতে চান। কিন্তু আইনে আপসের সুযোগ নেই। এছাড়া ১৬ বছর আগে ওই আইনে যুক্ত করা ৩৩ ধারায় সরকারকে একটি বিধি তৈরি করে দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা করতে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় বা মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় যথা পদক্ষেপ নেয়নি। বিধি না থাকার কারণে মামলা পরিচালনায় বিরাট সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

আমি নিজে আইন পেশা এবং আইন আদালত বিষয়ক লেখালেখি ও সাংবাদিকতা করতে গিয়ে  বিভিন্ন সময় দেখেছি- আইনজীবীদের দপ্তরে অনেক পুরুষ আসেন তাদের স্ত্রীদের দিয়ে হেনস্তার প্রতিকার নিতে। আইনজীবীদের কাছে এসব স্বামীরা অনেক সময়ই সত্য ঘটনার প্রেক্ষিতেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে 'চুরির মামলা' দিতে আবদার করেন। কিন্তু উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে এরকম যে- স্বামীকে না জানিয়ে সংসারের তৈজস বা গেরস্থালির জিনিসপত্র, টাকা পয়সা, গয়নাগাটি নিয়ে গেলেও সেখানে স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনওপ্রকার চুরির মামলা করা যায় না।

আবার অনেক গৃহবধূর সঙ্গে পরপুরুষের সঙ্গে পরকীয়া থাকে। সে কারণে তাদের স্বামীরা ব্যভিচারের মামলা করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত অনেকক্ষেত্রেই ঝামেলায় যেতে চান না। আবার তালাক দেয়ার পরও অনেক স্ত্রী তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেন। স্বামীরা এসব মামলায় গ্রেপ্তার হন কিম্বা আত্মসমর্পন করে জামিন নিতে আদালতে আসেন। পরে প্রমাণিত হয় যে, এ মামলা মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। ততক্ষণে অভিযুক্ত স্বামীর ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক তাঁর নিবন্ধে বলেন- "এই আইনে দায়ের করা মামলার ৮০ শতাংশই যৌতুক-সংক্রান্ত। এর মধ্যে কেবল যৌতুকের দাবিতে মারপিট করে সাধারণ জখম করা কিংবা গুরুতর জখম করা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌতুকের দাবিতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো মামলার সংখ্যা ৫ শতাংশের কম।"

তিনি লিখেছেন- "তাহলে প্রশ্ন আসে, বাকি মামলাগুলো কী মিথ্যা? এর জবাবে বলা যায়, শুধু যৌতুকের দাবিতে মারধর করে সাধারণ জখম হওয়ার মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে যৌতুকের জন্য মারপিট করার উপাদান অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।

তবে এই মামলাগুলো একেবারেই মিথ্যা নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কারণে মতের অমিল হলে কিংবা তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া না থাকার কারণে, বনিবনা না হলে কিংবা স্বামীর আত্মীয স্বজনের সঙ্গে স্ত্রীর মতামতের পার্থক্যের কারণে পারিবারিক জীবন অশান্তিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী কোনো উপায়ন্তর  না দেখে এবং এ-সংক্রান্ত  কোনো ফোরাম না পেয়ে বাধ্য হয়ে দ্রুত প্রতিকার লাভের আশায় স্বামীকে এবং তাঁর নিকটাত্মীয়দের আসামি করে এই আইনের ১১(গ) ধারার বিধান অনুযায়ী মামলা দায়ের করে থাকেন।"

ওই আইনের ৯ (৪) (খ), অর্থাৎ ধর্ষণের চেষ্টা এবং ১০ ধারার যৌনপীড়ণ ইত্যাদি অপরাধের ক্ষেত্রে প্রায়ই মামলা আমলে নেওয়ার পর এবং আসামি গ্রেপ্তার কিংবা তাঁর স্বেচ্ছায় হাজির হওয়ার পর জামিনের আবেদন-সম্বলিত যে দরখাস্ত ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়, তাতে বিচারকেরা দেখেন যে, বর্ণিত ধারাগুলোর অপরাধের উপাদান অনুপস্থিত। অথচ পক্ষদের মধ্যে টাকাপয়সার লেনদেন,জমিজমা-সংক্রান্ত জটিলতা অথবা সীমানা-সংক্রান্ত বিরোধের কারণে সেসব সমস্যা চিহ্নিত না করে দ্রুত নিষ্পত্তির আশায় কিংবা প্রতিপক্ষকে কারাগারে পাঠানো কিংবা হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এসব মামলা করা হয়।

আমার পেশাগত জীবনে দেখা নারী নির্যাতন দমন আইনে শত শত মিথ্যা  মামলার উদাহরণ দেখেছি। প্রায় ১৪ বছর আগের একটি মামলার উদাহরণ টানি।

ঢাকার নবাবগঞ্জ থানার বাংলাবাজার এলাকার (গ্রামের নাম ও বাদী ,আসামির পরিচয় দেয়া গেল না) একটি হিন্দু পরিবারের এক যুবক, তার পিতামহ, জ্যাঠা, ভাই ও বোন এবং বিরুদ্ধে পাশের বাড়ির এক মুসলমান পরিবারের নারী ধর্ষণের মামলা করেন। অভিযোগকারী নারীর স্বামী বিদেশে সাময়িক সময়ের জন্য শ্রমজীবী হিসাবে চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন।

মামলার অভিযোগে ওই নারী বলেন,  ধর্ষণ কাজে এক সঙ্গে সবারই অংশগ্রহণ ছিল। অদ্ভুত এ ঘটনার মামলা  তৎকালীন ঢাকার  ১ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে সাড়া ফেলে। মামলাটিতে আমার বেশিদূর যেতে হয়নি। মাঝপথেই ভুক্তভোগি আসামিপক্ষরারা মুক্তি পেয়েছিলেন। কারণ তাদের সঙ্গে আসলে বাড়ির সীমানা ও জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল। এর জের ধরে এ মিথ্যা মামলা ঠুকে দেয়া হয়েছিল। এছাড়া এ রকম অনেক কথিত ধর্ষণ মামলায় আসামিদের খালাস করিয়েছি মামলাগুলো পুরোটাই মিথ্যা।

আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। ঢাকার শাহবাগ এলাকায় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদালয় (পিজি হাসপাতাল) এলাকায় পপুলার টেলিকমের সত্ত্বাধিকারী সামছুর রহমান বাদী হয়ে তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার উর্মিকে আসামি করে তার বিরুদ্ধে ১৯৮০ সনের  যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় একটি  মামলা করেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে।

যে মামলাটি করা হয় ৫ লাখ টাকা যৌতুক চাওয়া হয়েছে দাবি করে। আর ঢাকার একজন মহানগর হাকিম ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সে মামলায় স্ত্রী উর্মির বিরুদ্ধে দেয়া রায়ে উর্মিকে একহাজার টাকা জরিমানা করেন।  রায়ে শর্ত দেয়া হয় এ জরিমানার টাকা না দিলে উর্মিকে তিনদিন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। বাদী শামসুর রহমানের পক্ষে মামলাটি আমি নিজে লড়েছিলাম। রায়টি ছিল ব্যতিক্রমী ।

'যৌতুক নিরোধ আইন' অনুযায়ী যৌতুক দুই পক্ষই চাইতে পারে। ঢাকার আদালতে দেখা গেছে এরকম প্রায় প্রতিবছর স্বামী-স্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করে থাকেন। যদিও প্রায় প্রতিটিই রায় পর্যন্ত যায় না। আপোস নতুবা মামলা খারিজে চলে যায়।

শত শত অনেক নির্যাতিত পুরুষ আইনজীবীদের কাছে আসেন স্ত্রীর অত্যাচারের ব্যাপারে আইন সুযোগ কি আছে জানতে। কিন্তু আইনজীবী এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন তাদের নিরাশ করে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তারা অত্যাচারের শোধ তুলতে চান।

ধর্ষণের ঘটনা ইদানিং আরও বেড়েছে। এটা পুরুষেতন্ত্রের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এ কথা ঠিক। ধর্ষকের এখন শুক্লপক্ষ। আর কৃষ্ণপক্ষ নারীদের। কিন্তু ধর্ষণ মামলায় সঠিক ও কার্যকর বিচারে তো নারী সংগঠনগুলো মোটেও সফল নয়। আর যে কারণে ধর্ষণের প্রাবল্য কমছে না। কেন নারী অধিকার কর্মীরা মোটেও সফলতার মুখ দেখে না তা ভেবে দেখার বিষয়।

একদিকে নারী অধিকার কর্মীরা প্রতিবাদ করছেন উল্টেদিকে  নারী নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে সমানতালে। পুরুষ কর্তৃক নারী ধর্ষণের সত্য ঘটনার বিচার পেতে অনেক বেগ পেতে হয়। আবার আইন ফাঁক-ফোকর গলে অনেক ধর্ষক পিছলে বেরিয়ে যায়। আবার তুলনায় স্বল্প হলেও ধর্ষণের মিথ্যা মামলারও উদাহরণ রয়েছে।

রয়েছে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন। গৃহকর্মীদের এ নির্যাতনে কিন্তু শুধু নায়কের উপস্থিতি থাকে না, নায়িকার উপস্থিতিও যথেষ্ট মাত্রায় থাকে। অর্থাৎ গৃহকর্মীদের বিশেষত বালিকা গৃহকর্মীদের খুন্তির ছ্যাঁকা অথবা বেলুনি দিয়ে প্রহারে নারীর অংশগ্রহণ কিন্তু কম নয়। বরং পুরুষের চেয়ে বেশি বলেই দেখা যায়।

আইন ও সালিস কেন্দ্র, মহিলা পরিষদের দায়ের করা অনেক যৌতুকের মামলাই মিথ্যা ঘটনার রসায়ন দিয়ে নির্মিত হয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরে দেখছি। উদাহরণ আর নাই বা দিলাম।

নারীদের হাতেও পুরুষরা নানাভাবে হেনস্থা হন, তাদের স্বাধীনতা হারান।

'পীড়িত পতি পুরুষ পরিষদ' নামে একটি সংগঠন কলকাতায় ১০/ ২০ বছর আগে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছে নারীবাদীদের বিরুদ্ধে।

তারা বলতেন তাদের শত্রু নারীরা নন। বরং নারীবাদী স্ত্রীগণ। যারা যদিও এখন তাদের কর্মকাণ্ড এখন আর চোখে পড়ে না বলে জানিয়েছেন এক কোলকাতার একজন কবি, লেখক। যিনি এখন ঢাকার একটি অনলাইন গণমাধ্যমে কাজ করেন।

বাংলাদেশে সংসদে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ হাজী সেলিম  এবং আরও একজন সাংসদ 'পুরুষ নির্যাতন দমন আইন' প্রণয়নের দাবি তুলেছেন।

ঢাকার নিম্ন আদালতপাড়া অর্থাৎ জেলা ও দায়রা জজ এবং ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে নারীর হাতে পুরুষের  নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের শেষদিকে মানববন্ধন এবং সমাবেশও হয়েছে।

কিন্তু এসব সমাবেশ এসব ক্রন্দন আসলে সমাজের মাত্রাজ্ঞানহীন সংস্কৃতির ভারসাম্যহীন চর্চায় হারিয়ে যায়।

আমার মতে, পুরুষ নির্যাতন দমন আইনের দাবি সমাজের একটা অংশ চাইছেন বটে।  কিন্তু এ আইন কীভাবে তৈরি হবে, এর প্রয়োগ কীভাবে হবে, তারা কিন্তু তাদের মনষ্কতা দিয়ে বিষয়টি ধরে সার্বজননীন জায়গায় নিতে পারবেন না।

কেননা নারী নির্যাতনের প্রাবল্য ও মাত্রা এতটাই বেশি যে সচেতনতা দিয়ে গভীরভাবে দেখে উপলব্ধি করে পুরুষ নির্যাতনের মতো ছোটমাত্রার পেটি ক্ষুদ্র ঘটনায় কি করা যায় সে পথ বাতলানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই সাংস্কৃতিক মান তাদের নেই। সামাজিক বৈষম্য নিরসনের জন্য যে  দৃষ্টিভঙ্গী থাকা দরকার সেটি তাদের নেই।  সে কারণে সঠিকভাবে দাবি করা ও কর্মসূচী দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

সংসার করতে হলে সমহারে তা করতে হবে। ভালোবাসা মান-অভিমানের মাত্রা থাকবে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের স্বাধীনতায় হাত দেবেই । কিন্তু এই স্বাধীনতা হরণ যেন খুব বেশি মাত্রা ছাড়িয়ে না যায় সে বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, এক অপরকে ছাড় দিতে হবে , একত্রে একসঙ্গে সব বিষয় যতটুকু সম্ভব দুজন মিলে ভাগ করে নিতে হবে।

আসলে  আমরা কতৃত্ববাদী পুরুষতন্ত্র হটিয়ে কি কর্তৃত্ববাদী নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই ? আর যদি তা না চাই তবে নারী ও পুরুষের সাম্যতা বা সমঝোতা কীভাবে আসবে? নারী পুরুষের সাম্যতা নিয়ে আমরা আসলে কোন দিকে এগাবো?

এটা আসলে তুলনামূলক বিচার দিয়ে নয় বরং বৈশিষ্ট্যমূলক বিচার দিয়ে নির্মিত হওয়া জরুরী। নারীর বৈশিষ্ট্য কী, পুরুষের বৈশিষ্ট্য কী, সেসব অনুযায়ী সংসারে সমাজে প্রতিবেশে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে।

কী করতে পারে নারী আর পুরুষ কী করতে পারে? এসব প্রশ্নে না যাই- তবে নারীর সৃজনের যে রূপ তাকে আমরা মাতৃরূপ বলি। সে মাতৃরূপ কিন্তু পুরুষেরও থাকতে পারে। অর্থাৎ সংসারের দায়িত্ব ভাগ নেয়া ।

নারীই যে শুধু সন্তান প্রতিপালন করবে তা কিন্তু নয়। এটি পুরুষকেও দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। যদি অবস্থা বা পরিপার্শ্ব সেটা দাবি করে। অর্থাৎ সন্তান মায়ের স্পর্শে যেমন উজ্জ্বীবিত হবে বাবার স্পর্শেও কিন্তু এর চেয়ে খুব বেশি কম উজ্জিবীত হবে না।

সুষম বন্টন থাকলে নারী কর্তৃত্ব বা পুরুষে কর্তৃত্ব থাকবে না। নারীবাদী বা পুরুষবাদী যুযুধানের অবসান সম্ভব হবে। তখন হয়তো নারী নির্যাতন দমন আইন আর পুরুষ নির্যাতন দমন আইন চালু করা বা না করা, প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ নিয়ে এভাবে ভাবতে হবে না।