সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং অতি বামদের সঙ্গে সখ্যতাই মমতার সাফল্যের চাবিকাঠি

গৌতম রায়
Published : 14 Jan 2018, 03:09 PM
Updated : 14 Jan 2018, 03:09 PM

রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসেন ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর। তার আগে অবশ্য তিনি অনেককালই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে কংগ্রেস দলের গণ্ডির বাইরে তাঁর সেই রাজনৈতিক ব্যাপ্তি খুব একটা ছিল না।

সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যুব উৎসবে কংগ্রেস কর্মী হিসেবে মমতাকে প্রথম দেখেছিলেন গীতা মুখোপাধ্যায়। সেই সময়ের রাজনৈতিক বিন্যাসে গীতা মুখোপাধ্যায়ের দল সিপিআই তখন কেন্দ্রে এবং রাজ্যে কংগ্রেস দলের সঙ্গে আছে। ওই যুব উৎসবে তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অরুণ মৈত্রের পত্নী গীতিকা মৈত্রের বিশেষ স্নেহভাজন হিসেবে মমতা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

তারপরও কংগ্রেস দলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে মমতা নিয়োজিত থাকলেও তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমণ্ডল সীমাবদ্ধ ছিল দক্ষিণ কলকাতার একটি ছোট্ট অংশের ভিতরে। গোটা রাজ্য তো দূরের কথা, উত্তর কলকাতাতেই সে সময়ে মমতার রাজনৈতিক ব্যপ্তি ছিল না।

ইন্দিরা গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮৫ সালে যে লোকসভা নির্বাচন হয় , সেখানে রাজনৈতিক ইস্যুর থেকে ইন্দিরা হত্যাজনিত আবেগ এবং সহানুভূতিই বেশি কার্যকর হয়েছিল। এই নির্বাচনের পর জ্যোতি বসুর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অসামান্য মূল্যায়ন করে বলেছিলেন; জীবিত ইন্দিরার থেকে মৃত ইন্দিরাই বেশি শক্তিশালী! ইন্দিরা হত্যাজনিত সহানুভূতির ভোটে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো হেভিওয়েট বাম প্রার্থীকে হারিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে মমতার প্রবেশ।

সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী রাজনীতিতে প্রণব মুখার্জী, এ বি এ গণি খান চৌধুরী, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর মতো নেতা ছিলেন। তা স্বত্ত্বেও সংসদীয় রাজনীতির আঙিনায় এসেই মমতা নিজেকে বাম রাজনীতির প্রধান মুখ হিসেবে তুলে ধরতে অতিরিক্ত মাত্রায় সচেতন হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তাঁর কংগ্রেস দলের ভিতরেই কোণঠাসা হয়ে পড়ে তৈরি করেন নিজের দল 'তৃণমূল কংগ্রেস' ।

মমতার এই নিজের দল তৈরির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে প্রথম থেকেই ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা। তাই নতুন দল তৈরি করেই তিনি লোকসভা নির্বাচনের মুখে সমঝোতা করেন চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দল বিজেপির সঙ্গে। ততোদিনে কিন্তু বিজেপি এবং তাদের মূল চালিকা শক্তির দ্বারা হাজার বছরের সমন্বয়ী ভারতের ঐতিহ্যের ধারকবাহক ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো কালান্তক ঘটনা ঘটে গেছে। ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ইতিহাসে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক চরিত্র তখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এই রকম একটি পরিস্থিতিতে কেবল ক্ষমতার মৌতাত উপভোগ করবার তাগিদে মমতা হাত ধরলেন ভারতের ধর্মান্ধ ফ্যাসিবাদী শক্তি বিজেপির।

ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের তাগিদে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির অবাধ বিচরণ ভূমি হিসেবে মেলে ধরার ক্ষেত্রে গত শতকের নয়ের দশক থেকে মমতা যে উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলেন তার ফলশ্রুতি এখন পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মমতার সব থেকে অপরাধ, তিনি এই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে ডেকে এনেছেন- জ্যোতি বসুর মমতা সম্পর্কে এই মূল্যায়ণের যথার্থ এখন কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়, গোটা পূর্বাঞ্চলকে ছাপিয়ে বাংলাদেশে ও তার উত্তাপ অনুভূত হতে শুরু করেছে।

নব্বইয়ের দশকে বিজেপির সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা করে মমতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকারের সাড়ে ছয় বছরের শাসনকালের প্রায় পুরোটা সময়ই কেন্দ্রে মন্ত্রিত্ব করে গেছেন। এই সময়কালে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি গোটা দেশে সংখ্যালঘু মানুষদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে। অস্ট্রেলিয় মিশনারী গ্রাহাম স্টুয়ার্স স্টেইনসকে দুই শিশুপুত্রসহ বন্ধ গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে নির্মমভাবে হত্যা করেছে আর এস এসের শাখা সংগঠন বজরং দল। যার নেতৃত্বে ছিল ওই ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক সংগঠনের স্থানীয় নেতা দারা সিং।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বহাল তবিয়তে কেন্দ্রের মন্ত্রিত্বের মৌতাত উপভোগ করে গেছেন। বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ পর্যন্ত করেননি। সেই সময়েই আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সেদিন প্রলয়ঙ্কারী গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে গুজরাটে। রাষ্ট্রীয় মদতে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের নেতৃত্বে হত্যালীলা চালানো হয়েছে গুজরাটের নিরপরাধ মুসলমানদের উপরে। মমতা সেদিন কেন্দ্রের মন্ত্রী, কিন্তু বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, নরেন্দ্র মোদি আবার জিতে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মমতা মোদিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ফুল পাঠাতে পর্যন্ত বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি। সেদিন আরএসএস প্রকাশ্য সভাতে মমতাকে 'দেবী দূর্গা' বলে অভিহিত করেছিল। মমতাও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে সেদিন দ্বিধাহীন ভাবে আরএসএসের সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। এই সময়কালেই বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মমতা খুব খোলাখুলিভাবেই আরএসএস-কে তাঁর 'স্বাভাবিক মিত্র' বলে অভিহিত করেছিলেন।
ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে তখন মমতা একদিকে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মেরই ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলতে শুরু করেন। অপর দিকে ক্ষমতার অলিন্দে পৌঁছতে তিনি আপোষ করতে শুরু করে অতি বাম শক্তি গুলির সঙ্গে।সি পি আই সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁর শূন্য আসন পাঁশকুড়ার উপনির্বাচন কে কেন্দ্র করে একদিকে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শিবির , অপর দিকে নকশালপন্থী অতি বামপন্থী শিবিরের সঙ্গে সমঝোতা করেন মমতা।তিনি নিজে কিন্তু তখন কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। পাঁশকুড়া উপনির্বাচনের এই পর্বকে তিনি নামকরণ করেছিলেন 'পাঁশকুড়া লাইন' হিসেবে। পরবর্তী সময়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে মমতা যখন ক্ষমতা দখলে দুর্নিবার হয়ে ওঠেন, তখন এই পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নিয়ে অতি বামপন্থীদের সঙ্গে তাঁর সখ্যতাটা আবার দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে যায়। পরবর্তী এই পর্বে অতি বাম শিবিরের পক্ষ থেকে মাওবাদী নেতা কিষাণজী (যিনি মমতা ক্ষমতায় আসার পরই আবার মমতার পুলিশের দ্বারা নিহত হন) এবং লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী সংযোগকারীর ভূমিকা পালন করেন মমতার সঙ্গে উগ্রতায় বিশ্বাসী বামপন্থী বলে দাবি করা লোকজনদের। তাঁরা সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম পর্বে আন্দোলন নামে অরাজকতা তৈরি করে মমতার ক্ষমতায় আসার পথকে মসৃণ করেন অনেকখানি।

মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে প্রথম ইউপিএ সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে বামেরা বাইরে থেকে সেই সরকারকে সমর্থন করেছিল মূলত সাম্প্রদায়িকতাকে রুখবার তাগিদে। এই সরকারের কার্যকালের প্রায় শেষ পর্বে পরমাণু চুক্তি ঘিরে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের মতপার্থক্য চূড়ান্ত আকার নেয়। যার জেরে বামেরা মনমোহন সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেন।

বামপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেসের রাজনৈতিক বিরোধ আবার তীব্র হয়ে ওঠায় মমতা বিজেপি সঙ্গ ছেড়ে আবার হাত ধরেন কংগ্রেসের। মমতার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে রাজনৈতিক সখ্যতার প্রশ্নে নীতি বা আদর্শবাদের তাগিদ কোনোদিনই বিন্দুমাত্র ছিল না। ব্যক্তিস্বার্থ এবং ক্ষমতার অলিন্দ্যের কাছাকাছি থাকা এবং চূড়ান্তভাবে ক্ষমতা দখল করা- এই তিনটিই হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ধ্যানধারণার মূলকেন্দ্র বিন্দু। তাই দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর বিজেপির নেতৃত্বাধীন অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রী থেকে, গুজরাট গণহত্যার বর্বরতারকালে একদম নীরবতা পালন করেও পরবর্তীতে বিজেপি কিছুটা রাজনৈতিক ভাবে কোনঠাসা বুঝে আবার ছেড়ে আসা কংগ্রেস দলের হাত ধরতে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় নি।

মনমোহন সিং দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই সিঙ্গুর – নন্দীগ্রামকে ঘিরে আন্দোলনের নামে মমতার অরাজকতা একটা বল্গাহীন আকার নিয়েছিল। এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বামপন্থীদের উৎখাত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে সীমাহীন ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। এই ষড়যন্ত্রে সেই সময়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল এবং ক্ষমতাসীন দ্বিতীয় দফার ইউপিএ সরকার ওতোপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। ক্ষমতালিপ্সু মমতা সেই সরকারের রেলমন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী হিসেবে মেরুকরণের রাজনীতি করতে গিয়ে মমতা এমন কিছু পদক্ষেপ নেন যার কোনো সমর্থন কার্যত ভারতবর্ষের সংবিধানে ছিল না। রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা পশ্চিমবঙ্গে কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্যে হাসপাতাল এবং নাসিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করবার সরকারী সিদ্ধান্ত নেন।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে কেবল একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্যে হাসপাতাল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করবার আদৌ কোনো সুযোগ নেই। মমতা কার্যত দেশের সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চরম মৌলবাদী অবস্থানে থাকা তথা তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠ টিপু সুলতান মসজিদের তৎকালীন ইমাম বরকতিকে দিয়ে মমতা সেই নার্সিং ট্রেনিং কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করান। সাংবিধানিকভাবেই এই ধরণের কলেজ কেবল একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্যে করা সম্ভব নয়। বাস্তবে সেই কলেজের কাজ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর আজ পর্যন্ত আর এক চুলও এগোয়নি। অথচ মমতা নিজেকে সংখ্যালঘুপ্রেমী হিসেবে দেখাবার জন্যে খোদ ভারতবর্ষের সংবিধানকে এভাবে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিলেন সেদিন।
মমতার ক্ষমতায় আসার পিছনে অতি বামেদের যে পূর্ণ সহযোগিতা ছিল – তা আর আজ বলার অপেক্ষা রাখে না। অতি বামেদের রাজনৈতিক স্তরেই মমতাকে সাহায্য করবার এই রাজনৈতিক অধ্যায়কে অভিহিত করা হয়ে থাকে 'কিষাণজী – মহাশ্বেতা' লাইন হিসেবে। যদিও বিরোধীনেত্রী থাকাকালীন প্রকাশ্যে মমতা মাওবাদীদের অস্তিত্বকে আদৌ স্বীকার করতেন না।

মমতা ক্ষমতায় এসেই যাঁরা তাঁকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছে, সেই আরএসএস- জামাত- মাওবাদীদের রাজনৈতিক মাইলেজ দেওয়ার উদ্দেশে মেরুকরণের রাজনীতি শুরু করে দেন ইমাম- মুয়াজ্জিনদের ভাতা দেওয়ার ভিতর দিয়ে। সংখ্যালঘু উন্নয়নে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন মমতা ক্ষমতায় এসেই সেসব উদ্যোগ, কর্মসূচিকে কার্যত বাতিল করে দেন। যেমন, বামফ্রন্টের আমলে স্বামী পরিত্যক্তা মুসলমান মেয়েদের আর্থ – সামাজিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে একটি বড় অঙ্কের টাকার ফান্ড ছিল। মমতা ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছরের বাজেটেই সেই ফান্ডটিকে অবলুপ্ত করে দেন। সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের জন্যে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা নয়, আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা নয়, আধুনিক চিকিৎসার জনপ্রিয়তা তৈরিতে কোনো উদ্যোগ নয়, মমতার কাছে ইমাম – মুয়াজ্জিনদের ভাতা দেওয়াটাই হয়ে ওঠে সংখ্যালঘু উন্নয়নের একমাত্র মানদণ্ড।

এই ইমাম-মুয়াজ্জিন ভাতার ভিতর দিয়ে মমতা একদিকে মুসলমান সমাজের ভিতরে যাঁরা ধর্মাশ্রয়ী জীবন যাপন করেন তাঁদের উৎসাহ দিয়ে আধুনিকমনস্ক মানুষদের ভিতরে একটা বিরক্তিজনিত বিভাজন তৈরি করলেন। কারণ, আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের কাছে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের ডোল দেওয়া অপেক্ষা সমাজের সমষ্টিগত উন্নয়ন অনেক বেশি জরুরি। মমতা কিন্তু সেই পথ দিয়ে হাঁটলেন না। অপরপক্ষে তিনি ঢালাওভাবে খারিজি মাদ্রাসাগুলোকে অনুমোদন দিয়ে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। যদিও তাঁর শাসনকালের প্রায় সাত বছর অতিক্রান্ত । এই সময়কালের ভিতরে কয়টা মাদ্রাসা সরকারি অনুমোদন পেয়েছে , তা হাতে গুণে বলা যায়।

অপর পক্ষে বিগত বামফ্রন্ট সরকারের আমলে মাদ্রাসা শিক্ষায় যে আধুনিকতার পরশ সংযুক্ত হয়েছিল, মমতার শাসনকালের বিগত প্রায় সাত বছরে তা একদম ধ্বংস হয়েছে। বামফ্রন্টের আমলে মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধর্মীয় শিক্ষার আঙ্গিক বজায় রেখেই তাকে আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক শিক্ষাতে উন্নীত করা হয়েছিল। কেবল অতিরিক্ত 'থিয়োজফি' বিষয়টি ছাড়া এ রাজ্যের মাধ্যমিক বোর্ড বা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের শিক্ষাক্রমের থেকে মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষাক্রমে বিন্দুমাত্র ফারাক ছিল না। বামফ্রন্টের আমলে পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কেবল সর্বভারতীয় স্তরেই প্রশংসিত হয়নি, সেই সময়ের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আরব দেশগুলিতে পর্যন্ত উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল। এই মর্যাদাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বিভাজনের রাজনীতির সাহায্যে আজ একেবারে নীচে টেনে এনে নামিয়েছেন।

মমতার এই সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের আর্থ- সামাজিক উন্নয়নকে অস্বীকার করে কেবল কতিপয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে কিছু পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির ফলে তারই 'স্বাভাবিক মিত্র', হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির মুখপাত্র আরএসএস দারুণভাবে উৎসাহিত। মমতা 'মুসলিম তোষণকারী' এটা প্রচার করে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি গোটা পশ্চিমবঙ্গে সামাজিক মেরুকরণ রেখাটিকে আরো তীব্র করে তুলছে। এই প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় যুক্ত হয়েছে মমতারই দলের তথা মমতার বিশেষ স্নেহভাজন বীরভূম জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের নেতৃত্বাধীন 'ব্রাহ্মণ সন্মেলন'।

একই ভাবে কলকাতার অতি সন্নিকটে দক্ষিণেশ্বরে এইরকম আর একটি ব্রাহ্মণ সন্মেলন হয়ে গেল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন মমতা মন্ত্রীসভার সদস্য রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনকে কেন্দ্র করেও এ রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস আর কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির ভিতরে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। বস্তুত স্বাভাবিক মিত্র বিজেপি – আরএসএসের রাজনৈতিক কর্মসূচি 'সাম্প্রদায়িকতা'র প্রসার ও প্রয়োগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস এখন আত্মনিবেদিত।