রসিক নির্বাচন নিয়ে সুশীল বিশ্লেষণ সম্পর্কে কিছু কথা

সাইফুর রহমান তপন
Published : 13 Jan 2018, 03:57 PM
Updated : 13 Jan 2018, 03:57 PM

রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচনের ফল সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে হতাশ করেছে বলে মনে হচ্ছে। নির্বাচনের ফল দেখে বিএনপি'র প্রার্থী ও শীর্ষ নেতারা যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা পড়ে রাজনীতি সচেতন যে কারোরই এমনটা মনে হওয়ার কথা।

২২ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁয় স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচনটি 'ওভারঅল' সুষ্ঠু হলেও তাঁদের প্রার্থী তাঁদের প্রত্যাশার চেয়ে কম ভোট পেয়েছেন। সম্ভবত এর অজুহাত হিসেবেই তিনি অভিযোগ তুলেছেন, তাঁদের প্রার্থী অন্য প্রার্থীদের চেয়ে কম প্রচারের সুযোগ পেয়েছেন এবং পুলিশ তাদের নেতা-কর্মীদেরকে নির্বাচনী প্রচারে বাধা দিয়েছে। অর্থাৎ সেখানে 'লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড' ছিল না বলেই বিএনপি প্রার্থীর এ ফল বিপর্যয় ঘটেছে বলে তাঁর ধারণা।

ফখরুল সাহেবের এক নম্বর ডেপুটি রুহুল কবির রিজভী আরও শক্ত অভিযোগ এনেছেন। একই দিনে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে তিনি বলেছেন, রসিক নির্বাচনে সরকার 'সন্ত্রাস', 'কারচুপি'র আশ্রয় নিয়েছে। নির্বাচনে জিতেছে জাতীয় পার্টির প্রার্থী, আর কারচুপির অভিযোগ তোলা হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে!

তিনি সম্ভবত তাঁদের প্রার্থীর সাথে তাল মিলাতে গিয়েই এমন হাস্যকর অভিযোগ তুলেছেন। বিএনপি প্রার্থী বাবলা ফল ঘোষণার রাতেই এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে নির্বাচনী ফল প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, রংপুরে জাতীয় পার্টি-প্রধান এরশাদের জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই, বিএনপি'র ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখেই সরকার লাঙ্গলকে জিতিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, রসিক নির্বাচনে সরকার নিজের নাক কেটে বিএনপি'র যাত্রা ভঙ্গ করেছে।

রসিক নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট পেয়েছেন। সেখানে ভোট পড়েছে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৭২৩ টি; অর্থাৎ ধানের শীষ পেয়েছে কাস্টিং ভোটের ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ, যা মোট ভোটের (৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪) ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। বিগত বিভিন্ন ভোটের ফলের ভিত্তিতে ধারণা করা হয় যে সারা দেশে বিএনপি'র গড় ভোট ৩০-৩২ শতাংশ, আর তার ঘনিষ্ঠ মিত্র, তারেক রহমান একসময়ে যাকে তাদের সহোদর বলেছিলেন, জামাতের ভোট মিলালে তা দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশ। সে হিসেবে রসিক নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী যে ভোট পেয়েছেন তা হতাশাজনকই বটে।

শুধু তা-ই নয়, যদিও এর শক্ত কোন ভিত্তি নেই, বিএনপি'র নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটা বদ্ধ ধারণা বিরাজ করছে যে সাধারণ ভোটাররা তাদের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলেই তারা দলে দলে ভোট কেন্দ্রে এসে তাদের প্রার্থীকে জিতিয়ে দেবেন। সকল বিচারেই রসিক নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ- যে নামেই তাকে ডাকা হোক, হয়েছে; সুতরাং বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওই ধারণা অনুযায়ী সেখানে ধানের শীষেরই জেতার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেখানে ঘটেছে একবাওে উল্টো এক ঘটনা। ভোট পুনর্গণনা চেয়ে হাইকোর্টে বিএনপি প্রার্থীর রিট দেখেও রসিক নির্বাচন নিয়ে দলটির হতাশার গভীরতা বোঝা যায়।

এদিকে, বিএনপি'র এ হতাশা দূর করার লক্ষ্যেই যেন আমাদের সুশীল সমাজের (মিডিয়াসৃষ্ট) নেতারা রসিক নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু বিশ্লেষণ, যদিও তা হাস্যকর, হাজির করেছেন। তারা নানান অংক কষে বলছেন, সেখানে প্রতিযোগিতা হয়েছে আওয়ামী লীগের সাথে 'মূলত' বিএনপি'র, জাতীয় পার্টির নয়, এবং তাতে বিএনপি প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।

তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থী সরফুদ্দীন ২০১২ সালে ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়েছিলেন আর এবার পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০ ভোট; অর্থাৎ তার ভোট কমেছে ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী ২০১২ সালে পেয়েছিলেন ২১ হাজার ২৩৫ ভোট আর এবার পেয়েছেন ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট। অর্থাৎ তার ভোট বেড়েছে ৬৫ শতাংশ।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি'র মধ্যে কে বেশি জনপ্রিয় তা যাচাইয়ে অন্তত রসিক নির্বাচনের ফল কোন মাপকাঠি হতে পারে না এটা বুঝতে কাণ্ডজ্ঞানের বেশি জ্ঞান লাগে না। এটা একটা ওপেন সিক্রেট যে সেখানে আওয়ামী লীগ তার ঘনিষ্ঠ নির্বাচনী মিত্রকে ওই বিজয়টি 'উপহার' দিয়েছে। সরফুদ্দীনকে প্রার্থী করার এটাও একটা কারণ। ২০১২ সালে তিনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন না। তাকে তখন বলা হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। আর ওই নির্বাচনে জয় লাভের পর তিনি সংবাদমাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন তা-ও অনেকের মনে থাকার কথা।

তিনি তখন বলেছিলেন, 'আমি আওয়ামী লীগের কোনও নেতা নই। গত পাঁচ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগও নেই। জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা আমাকে করা হলেও এর কী কাজ তা আমি জানি না।'

এবারের নির্বাচনে জাতীয় বা স্থানীয় উল্লেখযোগ্য কোন আওয়ামী লীগ নেতা যে সরফুদ্দীনের পক্ষে প্রচারে নামেননি তার কী কোনও কারণ নেই? অন্তত স্থানীয় নেতারা নির্বাচনী কাজে তাদের গড়হাজিরার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একাধিকবার বলেছেন যে সরফুদ্দীন সিটি কর্পোরেশন চালিয়েছেন দলের সাথে কোন সম্পর্ক না রেখে। এ সময়ে দলীয় কোন কর্মসূচিতে তাকে পাওয়া যায়নি। মোট কথা, ২০১২ সালের বিজয়কে যেমন সরফুদ্দীন দলের নয় তাঁর নিজের বিজয় হিসেবে দাবি করেছিলেন, এবারের পরাজয়ও তার নিজেরই পরাজয়, দলের নয়।

ফলে ২০১২ সালে তার প্রাপ্ত ভোটকে যারা সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগের ভোট বলে দেখাচ্ছেন তারা অন্তত সম্পূর্ণ সত্য বলছেন না। এ কথা ঠিক যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সহযোগিতা ছাড়া তিনি ২০১২ সালে জয় লাভ করতে পারতেন না। আবার এ কথাও ঠিক যে ওই নির্বাচনে দলটির নিজস্ব একজন প্রার্থী ছিলেন, যার নাম সাফিউর এবং যিনি দলের রংপুর মহানগর কামিটির সভাপতি।

তাই সরফুদ্দীনের প্রাপ্ত ২০১২ সাল ও ২০১৭ সালের ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা যাচাই করা সমীচীন হবে না। উপরন্তু, গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে না বেড়েছে তা বোঝার জন্য তুলনা যদি করতেই হয়, যদিও এ ধরনের তুলনা বাস্তবতাকে তুলে ধরে না, তা করতে হবে ২০১২ সালের নির্বাচনে দলটি সমর্থিত সাফিউরের প্রাপ্ত ভোট এবং সরফুদ্দীনের এবারের প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে। সাফিউর ওই নির্বাচনে দলের সমর্থন নিয়ে ৪ হাজার ৯৫৪ ভোট পেয়েছিলেন।

এখানে আরও মনে রাখতে হবে যে বাবলা ২০১৭ সালের মতো ২০১২ সালেও বিএনপি'র একক প্রার্থী ছিলেন এবং ২০১২ সালে ভোটের রাতে কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাছাড়া এবার জয়ের ব্যাপাওে তিনি গণমাধ্যমে এ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন যে গতবার দলের সবাই তার পক্ষে কাজ করেননি, এবার তারা তা করছেন। কথাটা এ জন্য বলা হলো যে, বিএনপি প্রার্থীরই বক্তব্য মতে, তারা গতবারের রসিক নির্বাচনে এবারের মতো সিরিয়াস ছিলেন না; অর্থাৎ গতবারের চেয়ে এবার বিএনপি'র ভোট আহামরি বেড়েছে এমন দাবি করাটা একটু বেশি সরলীকরণ হয়ে যায়।

রসিক নির্বাচন নিয়ে সুশীল সমাজের বিশ্লেষণকে স্ববিরোধী বললেও ভুল বলা হয় না। বিএনপি বা সরকার বিরোধী অন্য দলগুলোর মতো তারাও জাতীয় পার্টিকে সরকারের 'বি-টিম' মনে করেন। সে হিসাবে জনমনে সরকারবিরোধী ক্ষোভ শুধু আওয়ামী লীগ কেন জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধেও থাকার কথা। এর প্রভাবে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, জাতীয় পার্টিরও ভোট কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু সুশীল সাহেবদের বিচারে রসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে ৪১ শতাংশ এবং জাতীয় পার্টিও ভোট বেড়েছে ১০৬ শতাংশ!

গত বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিএনপি প্রার্থীর কাছে ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যায়, যদিও স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদেরও অনেকে স্বীকার করেন যে তাদের এ জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান সরকারদলীয় স্থানীয় এমপি'র। দু'জনে মিলে নাকি সেখানে এক কঠিন সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, যার মাধ্যমে ওই নগরে শুধু সিটি কর্পোরেশন নয় সব সরকারি বিভাগে যত টেন্ডার হয় তার সব নিয়ন্ত্রিত হয়। বিএনপি'র এই একই প্রার্থীর কাছে ২০১২ সালের কুসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন। মজার ব্যাপার হলো, যে-সুশীল বিশ্লেষকেরা বলছেন রংপুরে আওয়ামী লীগের ভোট কমেছে, কারণ ভোটাররা দলটিকে এক কঠিন সতর্ক বার্তা দিতে চেয়েছেন, তারাই আবার কুমিল্লায় যে আওয়ামী লীগের ভোট বেড়ে গেল সে-সম্পর্কে একেবারে স্পিকটি নট।

এটা তাঁরা স্বীকার করুন বা না করুন, বিএনপি'র মতো এই সুশীল বিশ্লেষকেরাও কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছেন যে আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হোক। সে-জন্যই তাঁরা পরিসংখ্যানের প্যাঁচ কষে এমন এক ঢক্কা নিনাদ তুলতে চাচ্ছেন যে একটা 'নিরপেক্ষ' নির্বাচন হলেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় নেবে। কিন্তু রসিক নির্বাচন তাঁদের সে আশার বেলুন ফুটো করে দিয়েছে বলেই মনে হয়।

কারণ এ নির্বাচন আর যা-ই করুক না করুক আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যকার বোঝাপড়াকে আরও পোক্ত করেছে এটা নিশ্চিত। রসিক নির্বাচনের চারদিন পর কুয়াকাটায় দেওয়া জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের বক্তব্যটি খেয়াল করুন। তিনি অনেকটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে শেখ হাসিনার অধীনে এবং সে-নির্বাচনে বিএনপি এলে তাঁরা মহাজোটগতভাবেই অংশগ্রহণ করবেন। আর এ দুই দলের মিলিত শক্তি ভোটের রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে তা কি নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে?