মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউসুফকে নিয়ে অনেক কথাই লেখা হচ্ছে সোস্যাল মিডিয়ায়। বিশেষ করে ফেসবুক এবং অনলাইন পোর্টালগুলোতে মানবিক এই বিষয়টিকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে, এনিয়ে যারা লেখালেখি করছেন তারা কোনও সাধুবাদ পাওয়ার জন্য এটা করছেন না, একটা দায়বোধ থেকেই তারা তুলে ধরছেন সাবেক এই সাংসদের কষ্টগাঁথা!
অগণিতের সে দায়বোধের কারনেই ইউসুফ অসুস্থ এই বার্তাটি পৌঁছেছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। আর সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়েছেন সৎ, মানবিকমূল্যবোধ সম্পন্ন এই রাজনীতিকের চিকিৎসার। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ নেওয়ার সংবাদটি পড়ে কি-যে ভালোলাগা কাজ করেছে তা বলে বুঝাতে পারব না। এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করি, লেখালেখি করি একাত্তরের নানা অনুসঙ্গ নিয়ে তাই কোনও মুক্তিযোদ্ধা অসুস্থ, কিংবা অনটনের কারণে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন মুক্তিযোদ্ধা – এরকম খবর পত্রিকার পাতায় দেখলে বা অন্যকোন মাধ্যমে অবগত হলে রক্তক্ষরণ হয় হৃদয়ে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নির্মাতাদের দুঃখগাঁথা স্বভাবতভাবেই ব্যথাতুর করে আমাকে। মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ-এর অসুস্থতার সংবাদ দেখে তেমনি বেদনাহত হয়েছি। সংযত রাখতে পারিনি নিজেকে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে আবেগাশ্রু। শুধু কি আমার হৃদয়েই ক্ষরণ হয়েছে তাঁর এই পরিণতির ছবি দেখে? নিশ্চয়ই না; আরও অনেকই বেদনাহত হয়েছেন তাঁর এই দুরাবস্থা দেখে। কিন্তু স্বাধীনতার এতবছর পরও কেন আমাদেরকে এমন সংবাদ পড়ে বেদনাহত হতে হবে? কেন একজন মুক্তিযোদ্ধার, সৎ সাবেক সাংসদের মলিন, নির্বাক মুখ দেখতে হবে? সেই প্রশ্নটিই আজ সবচে বড় হয়ে দাড়িয়েছে আমাদের সামনে।
আমরা সততার কথা বলি, নীতির কথা বলি? কিন্তু একজন শতভাগ সৎ মানুষের কী পরিনতি হতে পারে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় তাই যেনো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন ইউসুফ। অন্যায়ভাবে জীবনযাপন না করা এই মানুষটি অসুস্থত হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করলেন, অথচ তাঁর খোঁজ নিলো না কেউ? কেন নিলো না? অচল হয়ে গেছেন বলেই কি তাঁকে ফেলে দেওয়া হলো বাতিলের দলে! ভাবতেই অবাক লাগে। নিজে সংসার করেন নি, তাই একমাত্র চা দোকানি ভাই-ই দেখভাল করে সঙ্গ দিচ্ছেন তাঁকে, পড়ন্ত বেলায়। অথচ একদিন তাঁর চারপাশে ছিল কত কত মানুষের ভীর! তাঁর মতো মানুষের যদি এই অবস্থা হয়, অন্যদের কি হতে পারে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা! কিন্তু এমনটি হবে কেন?
মো. ইউসুফ সাধারণ কোন আসনের সাংসদ ছিলেন না। তিনি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া আসনে সাকা চৌধুরীর মতো প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন নৌকা প্রতীকে ১৯৯১ সালে। একজন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে স্বাধীন দেশে এটা ছিলো একজন মুক্তিযোদ্ধার অনন্য বিজয়। সেই তাঁকে কি করে ভুলে গেলো আওয়ামীলীগ? ভাবতে অবাক লাগে। কেন্দ্রের কথা না হয় বাদই দিলাম, স্থানীয় আওয়ামী নেতাদের কি কোনও কর্তব্য ছিলো না তাঁর প্রতি? বর্তমান সংসদ সদস্যও কি একবার মনে করতে পারলেন না সাবেক এই সাংসদের কথা! প্রশ্ন অনেক? জানি এর উত্তর দেবেনা কেউ! তারপরও বিবেকের তাড়নায় এই প্রশ্নগুলো উত্থাপন করলাম।
সংবাদপত্রে সংবাদ ছাপার পর খোদ প্রধানমন্ত্রীকেই তাঁর চিকিৎসার জন্য নির্দেশ দিতে হলো, অথচ স্থানীয় প্রশাসনের কারো দৃষ্টিগোচর হলো না সংবাদটি? এসব ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মানবিকতায় মুগ্ধ না হয়ে পারি না, আফসোস দেশের নেতা-নেত্রীরা, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা তাঁকে অনুকরণও করতে পারেন না? যদি সেটা করতেন, তাহলে সত্যি সত্যিই বদলে যেতো আমাদের সমাজ! তখন অনেকেই এগিয়ে আসতেন, স্থাপন হতো দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত!
সহর্মিতার উদ্যোগ নেওয়া আসলে সমাজপতিদের জন্য খুব কঠিন কোনও কাজ নয়? দেশের প্রতিটি উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় শহরেই সরকারী হাসপাতাল আছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। নির্দেশনা দিয়ে খোঁজ-খবর নিলেইতো হয়ে যায়। পকেটের টাকা খরচ না করলেও চলে। তারপরও তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেই সরকারি হাসপাতালে সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে, সেখানে একজন মন্ত্রী বা নেতা যদি বেসরকারি কোনও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিকিৎসার উদ্যোগ নিতে বলেন, আশাকরি কেউ সেটা অগ্রায্য করবে না। কিন্তু এটুকু করতে চায়না কেউ! সত্যিকথা কি, দায়িত্ব নেওয়ার লোকের অভাব। এই যে দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে দেশে সেটা যে ভালো কোনও লক্ষণ নয় তা উপলব্ধি করতে পারছিনা আমরা, পারছেন না আমাদের সমাজপতিরা।
অথচ ভোট এলে আমরা ঠিকই মানবিক হতে পারি, ভোটের জন্য মানবিকতা দেখাতে পারি? শুধু মানবিক হতে পারিনা মানবতার জন্য। সত্যিই 'কি বিচিত্র' আমাদের দেশ! কথায় কথায় আমাদের রাজনীতিকরা বলে থাকেন তারা রাজনীতি করেন মানুষের জন্য। তাহলে সত্যিকারের জনসেবা করতে তাদের আপত্তিটা কোথায়? রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণে, মানুষের জন্য হয়ে থাকে তাহলে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া অন্য রাজনীতিকদের কি কোনও দায় নেই? তারা কি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন না? কেন পারেন না, কেন? তখন কি আমরা সেই সমাজকে, সমাজপতিদেরকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারিনা। বলতে পারিনা, তারা 'বিবেকহীন'?
মো. ইউসুফের মতো আমাদের সমাজের যে বা যারাই সততার পথে চলেন, সৎ থাকেন কিংবা সৎ থাকার চেষ্টা করেন এর বিনিময়ে সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র কোন কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা তাদের নেই। তাই বলে সমাজ বা রাষ্ট্রের কি কোনও দায় নেই তাদের প্রতি? অবশ্যই আছে। কিন্তু তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনা। বলা হয়ে থাকে, গুণের কদর না করলে গুণির জন্ম হয়না। তেমনি যদি সৎ আদর্শবান নীতিনিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে আমরা যথাযথ সম্মান জানাতে না পারি কিংবা বিপদে তাদের পাশে না দাড়াই তাহলে এ পথে পথ চলতে কি কেউ উদ্বুদ্ধ হবে? নিশ্চয়ই না!
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফকে নিয়ে আপ করা ভিডিওটির শেষ কথা দিয়ে শেষ করতে চাই লেখাটি। একটি প্রশ্ন রেখে সমাপ্ত হয়েছে ভিডিওটি। তাতে বলা হয়েছে, 'অনেকেরই প্রশ্ন, রাজনীতিতে সৎ ছিলেন বলেই কী এক মুক্তিযোদ্ধার এমন পরিণতি?' এই ভিডিওটি প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ দেখেছেন। আমার বিশ্বাস তাদের প্রত্যেকের হৃদয়েই রক্তক্ষরণ হয়েছে এটি দেখে।
মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফের নির্বাক চাহনি দেখে মনে হয়েছে তাতে যেনো লুকিয়ে ছিলো অনেক অনেক অব্যক্ত কথা। বোধহীন এই মানুষটির নির্লিপ্ত চোখ যেন আমাদের যেন জিজ্ঞেস করছিলো, কেন আজ আমায় ঠিক এভাবে চোখের জল ফেলতে হবে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে হবে? অনুচ্চারিত উত্তরে আমরা অনুধাবন করি, 'সৎ থাকার কারণেই তার এমন পরিণতি?'
তখন জানতে ইচ্ছে করে, ঠিক আর কতকাল সততার জন্য, নীতি আদর্শের জন্য, এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে মুক্তিযোদ্ধাকে, দেশপ্রেমিক মানুষকে। কেন স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারবে না সাধারণ মানুষ? না-কি দিন দিন আমরা স্বার্থের বৃত্তে বন্দি হতে হতে এমন এক জায়গায় পৌঁছাবো যেখানে থাকবে না, শ্রদ্ধা সৌজন্যতা, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা আর নীতি আদর্শের বালাই। এসব নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। নইলে অনুতাপ ছাড়া আগামিতে আর করার কিছুই থাকবে না আমাদের!