শত্রুদেশের কথকতা

মুনতাসীর মামুন
Published : 11 Jan 2018, 02:22 PM
Updated : 11 Jan 2018, 02:22 PM

মুক্তাঞ্চল থেকে ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হতো একটি পত্রিকা, নাম বাংলাদেশ। সেই পত্রিকায় জুলাইয়ের একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয় একটি সংবাদ- "বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানাবার অভিযোগে লাহোরের একটি সামরিক আদালতে বিশিষ্ট পাঞ্জাবী কবি মি. আহমদ সেলিমকে ছয়মাস কারাদণ্ড এবং দুই হাজার টাকা জরিমানা আদায়ে আরও তিনমাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন।

মি. আহমদ মুসলিম 'সদা জয় বাংলাদেশ' নামে একটি কবিতা লিখেছেন এবং কবিতাটি, 'আওয়ামী আওয়াজ' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

অভিযোগ করা হয় যে, পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি ব্যাহত করার উদ্দেশ্য নিয়েই কবিতাটি রচিত।"

পাঞ্জাবি ও পাকিস্তানি আহমদ সেলিমের সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে এসব তথ্য ছিল আমার অজানা।

খুব সম্ভব ১৯৯৫ সালের দিকে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় সেলিমের। তিনি উঠেছিলেন তোপখানার মোড়ে একটি হোটেলে। কে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন খেয়াল নেই। এরপর কয়েকবার এসেছেন ঢাকায়। তখন অনেকে প্রশ্ন করেছেন, এই পাঞ্জাবি এবং পাকিস্তানি ঢাকায় আসেন কেন বারবার? আমাদের সঙ্গেই বা এত যোগাযোগ রাখতে চান কেন?

নির্মূল কমিটির সঙ্গে তার গভীর যোগাযোগ ছিল। আমরা কখনও তাকে নিয়ে সন্দেহ করিনি। কারণ, আমরা তখন জেনে গেছি, সেলিম ন্যাপ করতেন। ১৯৭১ সালের মার্চে যে ক'জন পাকিস্তানি আমাদের সমর্থন করেছিলেন সেলিম তাদের অন্যতম। ১৯৭২ সালে, ঢাকায় এসে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তিনি একমত। পাকিস্তান যেন বাংলাদেশের কাজে ক্ষমা চায় সে প্রচারণাও চালাচ্ছেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে এবং পাকিস্তানে বসে।

এরপর আমার ও শাহরিয়ারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে যখন বিশেষ সম্মাননা দেয়ার প্রস্তাব করে তখন প্রথমই সেলিমের নাম বলা হয়েছিল। পাঞ্জাবি সেলিম কীভাবে বন্ধু হলেন আমাদের? এর অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ, আমার অনুভব এই যে, যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বা সায় আছে, বিশ্বজুড়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ কাজ করে। নিজেও দেখেছি, বিদেশে বাঁ ধারার মানুষজনের সঙ্গে আলাপ করে যে স্বাছন্দ্যবোধ করি, অন্যদের সঙ্গে তা করি না।

সেলিম বাংলাদেশ নিয়ে অনেক লিখেছেন। তার কিছু বই মফিদুল হক 'জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী' থেকে প্রকাশ করেছেন। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলির উর্দু অনুবাদ করেছেন। ২০১৭ সালে আমার জন্য এর এক কপি নিয়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে অনুবাদটির তৃতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে। পাকিস্তানের মতো বর্বর একটি দেশে বসে সেলিম কীভাবে এসব কাজ করছেন তা ভেবে আশ্চর্য হই। আহমদ সেলিম সত্যিই বাংলাদেশের একজন প্রকৃত বন্ধু।

আহমদ সেলিম সম্পাদিত 'উই ওউ অ্যান অ্যাপলজি টু বাংলাদেশ' প্রকাশিত হয়েছে অনেক দিন আগে। ২০১২ সালে। সাহিত্য প্রকাশ বইটি বের করেছে ঢাকা থেকে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে গ্রন্থটি অন্য ধরনের মাত্রা যোগ করেছে। এই বইটি যেসব প্রশ্ন সামনে তুলে এনেছে তাহলো- ১৯৭১ সালে সব পাকিস্তানিই কি পাঞ্জাবিদের সমর্থন করেছিল? বাংলাদেশের জন্য কি পাকিস্তানে অনেকে নির্যাতিত হয়েছিলেন? রাজনীতিবিদরা কি সবাই বঙ্গবন্ধু মুজিবের বিপক্ষে ছিলেন? এসব প্রশ্ন আমাদের মনে জেগেছে এ কারণে যে, পাকিস্তানকে আমরা শত্রু ভাবতে অভ্যস্ত। সেখানে কেউ বাংলাদেশের সমর্থনে আছেন এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। পাকিস্তানের বাম ধারার বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা এ ধারণায় অনেক পরিবর্তন এনেছেন। বাংলাদেশ নিয়ে পাকিস্তানিরা কী ভেবেছিলেন বা এখন কী ভাবেন সে নিয়েই এ সংকলন গ্রন্থিত করেছেন সেলিম।

বইটি গবেষণামূলক কোন সংকলন নয় কিন্তু গবেষণার অনেক উপাদান আছে গ্রন্থটিতে। সেলিম ২৭টি রচনা অন্তর্ভুক্ত করেছেন সংকলনে। লেখকরা হলেন- শেহজাদ আমজাদ, হাফিজুর রহমান, তারিক রহমান, আই এ রেহমান, আখতার পায়ামি প্রমুখ। সেলিমের লেখার সংখ্যা আটটি। ২৭টি রচনার মধ্যে আছে বিবৃতি, সাংবাদিক সম্মেলন ইত্যাদি।

রচনাগুলিকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। ১৯৭১ এবং ১৯৭১ পরবর্তী সময়। ১৯৭১-এর পরবর্তী সময় লেখা রচনার সংখ্যা বেশি। এই সব নিবন্ধের মূল সুর, পাকিস্তান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ওপর অন্যায় করেছে, বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের ক্ষমা চাওয়া উচিত। প্রথম রচনা শেহজাদ আমজাদের 'উই ওউ অ্যান অ্যাপলজি'-ই এ ধরনের রচনাগুলির সুর বেধে দিয়েছে। অন্য রচনাগুলির বিষয় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ও পাকিস্তানিরা কী ভেবেছিলেন, কারা ইয়াহিয়াকে সমর্থন করেছেন, কারা বাঙালিদের।

১৯৯৬ সালে শেহজাদ আমজাদ কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। কারা এই হতভাগ্য দেশটিকে ষড়যন্ত্রের যুপকাষ্ঠে বলি দিয়েছিল? কারা মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল? কর্মহীন, টুটাফাটা পোশাকের একটি জেনারেশনের স্বপ্নকে কারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল? কারা জাতীয় ঐক্যের বুননকে ছিঁড়ে ফেলেছিল এবং সবধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে এবং সমঝোতার সব সম্ভাব্য ধাপ বিনষ্ট করেছিল? ঢাকা পতনের ২৫ বছর পর এ প্রশ্নগুলির উত্তর জরুরি।

শেহজাদের মূল বক্তব্য, যা ঘটেছে ১৯৭১-এ যে ইতিহাসকে ভুলতে চাইলে, চাপা দিয়ে রাখতে চাইলে তা বুমেরাং হবে। তার ভাষায়- "Pakistanis simply can no longer continue to suffer from 'collective amnesia'. And no meaningful attempt is made to day to decisively end this oblivion. Pakistan- both as an ideology and a state- will dissipate into a failed experiment in nation building."  [পৃ.১৫]

বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে ক্ষমতালোভী পাকিস্তানি সৈন্যরা, জানিয়েছেন শেহজাদ, সারা বিশ্ব তা জানে। বাঙালিরা জানে। তা হলে পাকিস্তানিরা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যায় কী ভাবে? যে দেশটি অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন সে দেশের নাগরিক সমাজকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানটি মনে রাখতে হবে-যদি তোর ডাক শুনে কেই না আসে, তবে একলা চলো রে।

এ ধরনের অন্যান্য নিবন্ধগুলি এ সুরেই বাঁধা। হাফিজুর রহমানের প্রবন্ধের নাম 'ক্যান দা বেঙ্গলি ফরগিভ আস?' হাফিজ লিখছেন, বাংলাদেশ থেকে ফিরলে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন জিজ্ঞেস করেন, চলে গিয়ে কি বাঙালিরা এখন দুঃখিত? এ সব লোকেরা ধারণা আমাদের বেনিভোলেন্ট অটোক্র্যাসি ছিল বাঙালিদের জন্য ঈশ্বরের আর্শীবাদের মতো যা বাঙালিরা তখন বুঝতে পারেনি। এখন হয়ত বুঝে আফসোস করছে। হাফিজ বলছেন, 'হোয়াট ননসেন্স!'

ড. তারিক রহমান ১৯৯৮ সালে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করে লিখেছিলেন, ১৯৭১ সাল যদি আমাদের কিছু শিখিয়ে থাকে তাহলে, তা'হলো সত্যিকারের স্বাধীনতা আন্দোলন শক্তি দিয়ে দমানো কখনো উচিত নয়।

"It is as much a genuine movement of resistance to oppression as the Bangladesh movement was in 1971. If 1971 can teach us anything in South Asia-all of us-it is that genuine independence movements should not be suspsened by force. An apology will be the beginning of such a lesson." [পৃ.২২]

আই এ রেহমান লিখেছেন, ১৯৭১ স্বীকার না করলে 'র‌্যাশনিলিজম অব স্যানিটি' সমাজে ফিরবে না, ১৯৭১ স্বীকার না করায় পাকিস্তানে জিয়াউল হকের আবির্ভাব হয়েছিল, বালুচিস্তান ও সিন্ধুতে হত্যাযজ্ঞ চলেছিল। লিখেছেন তিনি ১৯৯৮ সালে-

"The present level of intolerance and fratricidal madness in our society may be older than 50 years, but these tendencies were greatly consolidated by what we hid or allowed to be done in our name in 1971."  [পৃ.২৯]

আহমদ সেলিম পাকিস্তানি পত্র পত্রিকা থেকে একটি সংকলন করেছেন। মার্চ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরা কী বলেছিলেন সে সম্পর্কে। এই বক্তব্যগুলি পড়লেও কিছু পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে ধারণার খানিকটা পরিবর্তন হবে। সংবাদগুলিতে দেখা যায়।

১. ভুট্টো পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলে পাকিস্তান ডেমোক্যাটিক পার্টি [পি ডি পি] নেতা নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান ও সালাহউদ্দিন খান বিস্ময় প্রকাশ করেন।

২. পাঞ্জাব পাকিস্তান ফ্রন্ট [পিপি এফ] এর নেতা মালিক গুলাম জিলানীর বাসায় পার্টির এক বৈঠক হয় [৩-৩-১৯৭১] সেখানে পিপিএফ নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকে সমর্থন জানান ও পাকিস্তানিদের ভূট্টোকে পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান।

৩. আসগার খান ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য [৪.৩.১৯৭১]।

৪. জামাতুল উলেমাই ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মওলানা গুলাম গাউস হাজারভি শেখ মুজিবকে সমর্থন করেন, সমালোচনা করেন ভূট্টোর। [৪.৩.১৯৭১]।

৫. বালুচিস্তান প্রভিনসিয়াল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) কোয়েটায় দলের সভাপতি মোহাম্মদ হালিম খান গিলজাইয়ের সভাপতিত্বে এক সভায় পরিষদ বাতিলের নিন্দা জানিয়ে ১২ মার্চ দুপুর ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত হরতাল ঘোষণা করে [৪.৩.১৯৭১]।

৬. পাঞ্জাব আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রাক্তন প্রতিরক্ষা সচিব এম. খুরশিদ অবিলম্বে পরিষদ ডাকার তারিখ ঘোষণার দাবি জানান [৪.৩.১৯৭১]।

৭. পিপিএফের মালিক গোলাম জিলানী জানান, ভূট্টোর হত্যার রাজনীতি পাকিস্তানের ধ্বংস ডেকে আনছে- "Mad game of brazen-faced power politics in which Mr. Bhutto has indulged and brought this country to the verge of immediate disaster." [4.3.1971]

৮. ভাওয়ালপুর ইউনাইটেড ফ্রন্টের নেতা এমএনএ মিয়া নিজামউদ্দিন মুজিবকে সমর্থন জানিয়ে বলেন- "In the present circumstances he is the only man who can keep Pakistan together and I appeal to people to rally around Sheikh Mujibor Rahman." [7.3.71]

৯. লাহোরে ১৩ তারিখে জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘিষ্ট সদস্যরা একটি সভা করে নীতিগতভাবে শেখ মুজিবের চারদফা মানার আহ্বান জানান। এর মধ্যে কাউন্সিল, কাইয়ুম মুসলিম লীগও ছিল।

১০. কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা মিয়া মমতাজ মুহাম্মদ খান দৌলতানা ১৩ মার্চ লাহোরে ঘোষণা করেন-শেখ মুজিবের দাবিসমূহ যুক্তিযুক্ত।

১১. ভাওয়ালপুর ইউনাইটেড ফ্রন্ট নেতা বেগম তাহিরা মাসুদ ঘোষণা করেন 'ভাওয়ালপুরের ৩২ লক্ষ মানুষ আছেন শেখ মুজিবরের সঙ্গে।'

১২. ভূট্টো ক্ষমতা হস্তাস্তর করতে বলেছিলেন তার এবং মুজিবের কাছে। এতে প্রতিবাদ জানানÑ

১. মিয়া তোফায়েল মোহাম্মদ- ভারপ্রাপ্ত আমীর, জামায়াতই ইসলামী।

২. মালিক হামিদ সরফরাজ – সাধারণ সম্পাদক, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ।

৩. সৈয়দ আলী আসগর শাহ- সভাপতি, মুসলিম লীগ [কনভেনশন]Ñ।

৪. মিয়া নিজামউদ্দিন হায়দার- ভাওয়ালপুর ইউনাইটেড ফ্রন্ট।

৫. খাজা মাহমুদ আহমদ মান্টো- প্রেসিডেন্ট, কাউন্সিল মুসলিম লীগ।

৬. মোহাম্মদ মাহমুদ-সাধারণ সম্পাদক [প্রাক্তন] সর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।

৭. মাহমুদুল হক উসমানী – সাধারণ সম্পাদক, ন্যাপ (ওয়ালি)।

৮. কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ – সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।

৯. পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা।

২৫ মার্চ পর্যন্ত মোটামুটি তারা একই কথা বলে গেছেন। এরপর আর কেউ তেমন কিছু বলেন নি। তবে ৭ এপ্রিল লাহোর থেকে মালিক গুলাম জিলানী দীর্ঘ এক 'খোলা চিঠি' লেখেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে [বইয়ে ছাপা ২২ পৃষ্ঠা] এর উপসংহারটি আমি উদ্ধৃত করতে চাই। ৭ই এপ্রিল এ ধরনের 'খোলা চিঠি' লেখা ছিল দুঃসাহসের ব্যাপারে। দুঃসাহস এ কারণে যে, জিলানি বলেছিলেন পাকিস্তান থাকবে না এবং ইয়াহিয়ার এই কাজটি যুগের পর যুগ স্মরিত হবে। বিচারের দিন খুব কাছেই। তার ভাষায়-

"So, Mr. President, whatever inscrutable purpose Providence might have had in bringing soon to the helm of affairs in this God given land of Pakistan. It does not seem likely that it was the preservation of Pakistan. The reverse seems like lies- i,e. the physical demolition of Pakistan, brick by brick, cobblestone by cobblestone, bone by bone, piece by piece. That will be the accomplishment by which posterity will remember you and  judge you. But, perhaps, it will not fall to the lot of posterity to judge. As I see it, the Day of Judgement is near, very near, I give you three months at the most and that too by a long stretch of imagination." [পৃ.১৩৩]

জিলানি একটু কম সময় দিয়েছিলেন। তিন মাস নয় নয় মাস লেগেছিল।

মাজহার আলী খান 'রিয়ালিটি অব বাংলাদেশ' নামে দীর্ঘ এক প্রবন্ধ লিখেছেন। ১৯৭২ সালের নভেম্বরে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। তারপর দিল্লি হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন মাজহার আলী ও পাকিস্তানি প্রতিনিধিরা। তিনি জানালেন, বঙ্গবন্ধু শান্তভাবে কথা বলেছেন তাদের সঙ্গে, জানিয়েছেন, পুরানো কথা তুলে তিনি তাদের ভারাক্রান্ত করতে

চান না। তিনি প্রাক ১৯৭১ এবং ১৯৭২ দুটি পর্বই আলোচনা করেছেন, সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।

আহমদ সেলিম 'কিলার্স অ্যান্ড কোলাবরেটরস' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ঐ প্রবন্ধে দেখতে পাই, ২০ মার্চ ১৯৭১ সালের আগে যেসব রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন জানিয়েছেন তারা কীভাবে ভোল পাল্টে ফেলেছেন। প্রথমেই ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন করেন জামায়তুল ইসলামের সভাপতি গুলাম গাউস হাজারভি; তারপর জামায়াত ইসলামের মওদুদী। ভূট্টো, কাইয়ূম খান। একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের ডানপন্থিরাও গলা মেলান। বাংলাদেশে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান বাহিনীর সহোযোগী গ্রুপের।

পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবিদের একাংশ কীভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তা সেলিম বিবৃত করেছেন, 'দি আদার সাইড অব দি মেডাল'-এ। অন্যদিকে, 'ভারতীয় আগ্রাসন' এর প্রতিবাদ জানাবার মানুষেরও অভাব ছিল না।

৭ এপ্রিল ১৯৭১ রাইটার্স গিল্ড হাউসে এক সভায় ভারতকে নিন্দা জানিয়ে, চীনকে প্রশংসা করে কিছু লেখক কবি বিবৃতি দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা আবু আমর হাফিজ জলন্ধরী। তার সঙ্গে যোগ দেন, লাহোরের প্রথম সারির কবি লেখক আহমদ নাদিম কাসিমি, হামিদ আহমদ খান, মুহাম্মদ সফদর মীর, জামিল উদ্দিন আলী, মির্জা আদিব, মওলানা হামিদ আলী খান, কাতিল সিফাই, আনোয়ার সাজ্জাদ, ইশরাত রহমানি এবং সৈয়দ কাসিম মাসুদ। সেলিম লিখেছেন, তাদের বিবৃতিটি জামায়াত ইসলামের বিবৃতির হুবহু বলে মনে হয়েছিল। পাকিস্তানের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী নিশ্চুপ ছিলেন। তবে, চারিদিকে ভয়ের রাজত্ব থাকার পরও সিন্ধুর শেখ আয়াজ, বালুচ গুল খান নাসির, পস্তুর আজমল খটক, পাঞ্জাবি আহমদ সেলিমসহ অনেকে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। পাঞ্জাবের ফয়েজ আহমদ ফয়েজও সুর মিলিয়েছিলেন।

সেলিম যখন গ্রেফতার হন তখন তার চার বছরের ভাতিজি তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তার চাচাকে পুলিশ কেন গ্রেফতার করল?

'তোমার চাচা ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে একটি কবিতা লিখেছেন', মার উত্তর।

'তাতে কি হলো', জানালো ভাতিজি, 'ইয়াহিয়া খানও তো চাচার বিরুদ্ধে একটি কবিতা লিখতে পারত।'

'ইয়াহিয়া খান কবিতা জানলে,' উত্তরে জানালেন তার মা, 'তো গণহত্যা চালাতেন না।'

সেলিম লিখেছেন, কবিতা লেখায় তার যে শাস্তি তা তুচ্ছ বাঙালি সাহিত্যিকরা যে নিপীড়ন সহ্য করেছেন তার তুলনায়।

সেলিম তার আরেকটি প্রবন্ধ 'বাংলাদেশ লিটারেরি রিসপন্স টু দি ট্র্যাজেডি অব নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান' এ বিষয়টি আরো সম্প্রসারিত করেছেন।

অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হওয়ার পর ২৭ মার্চ সেলিমসহ কয়েকজন মিছিল করে প্রতিবাদ জানান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শাহ হোসেন কলেজের প্রিন্সিপাল মনজুর আহমদ ও মজলিস-ই শাহ হুসাইনীর শাফকাত তানভীর মির্জা।

অন্যদিকে হাফিজ জলন্ধরী ও তার সহযোগীদের কথা আগে উল্লেখ করেছি। রাওয়ালপিন্ডিতে বসবাসরত সাহিত্যিকরাও একই কাজ করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর একটি সজ্জিত ট্রাকে লেখকরা রাস্তা প্রদক্ষিণ করে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের পরে অনেকে যুদ্ধ বন্দীদের দুঃখকষ্ট নিয়ে লিখেছেন। সেলিম উল্লেখ করেছেন, তিনি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, হাবিব জালিবসহ কয়েকজন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। প্রতিবাদ না জানানোকে তিনি 'দি কনসপিরেসি আর সাইলেন্স' বলে উল্লেখ করেছেন। এই 'কনসপিরেসি অব সাইলেন্স' ভঙ্গ করেছিলেন কয়েকজন যাদের কথা আগে উল্লেখ করেছি। এরা ছাড়া অন্যরা হলেন- শাহার আনসারী, আনওয়ার আহসান সিদ্দিকি, এমআর হাসান, ফেহমিদা রিয়াজ, আতাশাদ, গনি খান, আসিফ শাহকার।

ড. আজিজুল হক ও তার চীনাপন্থি গ্রুপ 'ইয়ং পিপলস ফ্রন্ট' বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিল, মিছিল করেছিল। সেলিম যখন জেলে তখন তার পরিবারের দেখা শোনা করেছিলেন যদিও সেলিম ছিলেন মস্কোপন্থি। জালিব সবসময় সামরিক শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। গণহত্যা নিয়ে তার লেখা কবিতার চারটি চরণ সেলিম অনুবাদে উদ্ধৃত করেছেন-

You are trying sowing love with bullets

you are smearing the face of our country with blood.

You think you are nearing the destiny.

But I am sure you are losing the way.

শাহার আনসারীও এ ধরনের কবিতা লিখেছিলেন। জনপ্রিয় বালুচি সাহিত্যিক গুলখান নাসের লিখেছিলেন, বালুচিদেরও উচিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা। আওয়ামী নেতা ও বিখ্যাত সিন্ধি কবি শেখ আয়াজকে সুক্কার জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। জেলে বসে তিনি বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অফিসার আরেকজন সিন্ধি কবি আনওয়ার পীরজাদাও দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন যার শেষ কটি লাইন [অনুবাদ]-

The blood of martyrs will live for centuries

This living blood.

The game of blood will lead us to our destination

The red revolution.

পাকিস্তানে সম্প্রতি ১৯৭১ নিয়ে কী লেখা হয়েছে তার একটি বিবরণও দিয়েছেন সেলিম। কিন্তু তার আগে বলতে হয় আসিফ ফারুকির প্রবন্ধ 'টু সাইডস অফন স্টোরি'র কথা। সংকলনের সেরা লেখা এটি। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন শিশু। একাত্তর সাল সম্পর্কে জেনেছেন বিভিন্ন জনের স্মৃতি কথায়, আলাপ আলোচনায় যারা এসেছেন 'ওপার' [অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান] থেকে।

হার্ভাডে তার বন্ধু চট্টগ্রামে তার শৈশবের কথা বলতেন, ১৯৭১ সালে করাচি চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি ১৯৭১ এর কথা বলতেন না, বলতেন পাকিস্তানের নিঃস্বভাবে এসে কীভাবে বেঁচেছেন সে কথা। শাবানা [ছদ্মনাম] নামে একটি মেয়ে তার সঙ্গে কাজ করতেন। দেখে মনে হতো সব সময় তরুণীটি অনিশ্চয়তায় ভুগছে। একদিন বস্তিতে এক বাঙালি নারীকে দেখতে গেছেন। অসুস্থ সেই মহিলা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। তাকে সান্ত¦না দিতে গিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে শাবানা বাংলায় কথা বলা শুরু করলেন। শাবানা জানালেন, তারা নারায়ণগঞ্জ থাকতেন। তার বাবা ছিলেন একটি মিলের ম্যানেজার। গণহত্যার সময় একদিন তার বাবার বাসায় অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল কারণ তিনি ছিলেন পাকিস্তানি।

পাকিস্তানি সেনারা বাড়িতে ঢুকে তার বাবাসহ অনেককে গুলি করে হত্যা করে। শাবানার মা তার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে দৌড়াতে থাকেন যতক্ষণ না এক আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছান। তারপর তারা করাচি আসেন। শাবানা ফারুকিকে যতটা না ১৯৭১-এর কথা বলছিলেন তারচেয়ে বেশি বলেছেন কী যন্ত্রণায় তারা করাচিতে বসবাস করেছেন। শাবানা বলেছেন, পরে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের 'ভুলের' জন্য মাফ চায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে বীর হিসেবে তার বাবার নামে সড়কের নাম রাখা হয়েছে।

১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে উর্দু সাহিত্যিকরা কী লিখেছেন তার বিবরণ দিয়েছেন ফারুকি। ১৯৭১ নিয়ে তারা লিখেছেন কিন্তু উর্দু সাহিত্যের মেইনষ্ট্রিমে তাদের নাম উল্লেখ করা হয় না। বাংলাদেশের উর্দু সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন গোলাম মোহাম্মদের কথা।

ফারুকি জানিয়েছেন উর্দু ভাষার সাহিত্যিকদের দু'বার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। একবার ১৯৪৭ সালে। দেশভাগ নিয়ে তারা প্রচুর লিখেছেন। আধুনিক উর্দু সাহিত্যই গড়ে উঠেছে দেশ ভাগ নিয়ে লেখা গল্প কবিতা উপন্যাসে। কিন্তু ১৯৪৭ সালে যারা বাস্ত্যুচ্যুত হয়ে এসেছিলেন তারা হত্যা, ধর্ষণ দেখেছেন, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষাই বড় হয়ে উঠেছিল। ১৯৭১ তারা দেখেন নি। যা শুনেছেন তা পাকিস্তানি প্রপোগান্ডা। যে ক'জন লিখেছেন, তার মধ্যে মুফতি মাহমুদের কথা উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য মুফতি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ছিলেন। পাকিস্তানে তার সঙ্গে আমারও কথা হয়েছিল। মুফতি মাহমুদের কথা নিয়ে সেলিমও তার পূর্বোক্ত লেখায় উল্লেখ করেছেন। মাহমুদ একপেঁশে। আমি তার সঙ্গে একমত।

যারা ১৯৭১ সাল নিয়ে লিখেছেন তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন ফারুকি। আমি কয়েকজনের কথা উল্লেখ করছি-

১. পারভিন সানওয়ার। ছোট গল্প লিখেছেন। তার সেইসব গল্প ইংরেজি অনুবাদে পেঙ্গুইন প্রকাশ করেছে হোম অ্যান্ড হার্থ নামে।

২. পারভিন থেকে ভালোভাবে ১৯৭১ উপস্থাপন করেছেন আলতাফ ফাতিমা তার গ্রন্থ চলতা মুসাফির-এ।

৩. সবচেয়ে বেশি লিখেছেন ইনতিজার হুসাইন। যার উপন্যাস 'বস্তি' উল্লেখযোগ্য। তার কিছু ছোট গল্প সংকলিত হচ্ছে। শেহর-এ-আফসোস-এ।

৪. মাসুদ আসহার লিখেছেন উপন্যাস বন্ধ আঁখো পার দোনো হাত।

৫. আখতার জামালের গল্প এক পাকিস্তানি লেড়কা।

৬. সেলিম আখতারের উপন্যাস মাহাজ ১৯৭১।

৭. হাসান মানজারের গল্প ইনসান কা দেশ।

এরকম আরো কিছু লেখকের উল্লেখ করেছেন।

সম্প্রতি এ ধরনের বেশ কিছু বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে যেমন-

রাজিয়া ফারেসি আহমদ সাদিজয়া কী জারি, ফাহমিদা রিয়াজ [Breaking links] জিন্দাবাহার [Zinda Bahar Lane] তাহির মাহমুদ : আল্লা মেঘ দে ও মুসতানসার হুসাইন তারার রাখ তাকে, কামাল শামসির ইংরেজিতে লেখা কর্টোগ্রাফি ও সোরাইয়া খান নূর ও হামিদ শহীদের মিট্টি আদম খাতি হ্যায় [The Earth Gobbles up Adam]

আহমদ সেলিমও তার পূর্বোক্ত এক প্রবন্ধে এদের অনেকের কথা উল্লেখ করেছেন।

এ গ্রন্থে আহমদ সেলিমের ঐ সময়ের লেখা অনেকগুলি কবিতার ইংরেজি অনুবাদও সংকলিত হয়েছে।

এ গ্রন্থটির গুরুত্ব আছে একটি কারণে। পাকিস্তান ও পাকিস্তানিরা আমাদের শত্রু- এটি ১৯৭১ সালে আমরা দেখেছি। এখনও সুযোগ পেলে তারা শত্রুর মতো আচরণ করে। কিন্তু সেই শত্রু পুরিতে বসেও অনেকে গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছেন, এখনও পাকিস্তানি সরকারের ন্যারেটিভের বিপরীতে লিখছেন। সংখ্যায় তারা কম হতে পারেন, কিন্তু ইতিহাসে তো তারাই থাকবেন, অন্যরা নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় আমরা যুদ্ধের অন্যান্য পক্ষের কথা তেমন আলোচনা করি না, লেখালেখিও হয় না। কিন্তু এ ধরনের গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা ও বহুমাত্রিকতা তুলে ধরে। বর্তমান জেনারেশনের গবেষকদের কাজ হবে সেই বহুমাত্রিকতা তুলে ধরা।