আবার জঙ্গি: পাকিস্তানি বনাম বাংলাদেশি গণমানস

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 10 Jan 2018, 03:06 PM
Updated : 10 Jan 2018, 03:06 PM

আবারো জঙ্গি! সেদিন পুঠিয়ায় চার ও চট্টগ্রামে দুই জঙ্গি ধরা পড়েছে।  অর্থাৎ কালনাগিনীটা নিহত হলেও তার লেজটা এখনও নড়ানড়ি করছে। সেই কত আগে পাকিস্তানে (আত্মঘাতিসহ) জঙ্গি-উত্থানের পর থেকেই জঙ্গি-তাত্ত্বিকরা বলে আসছিলেন বাংলাদেশেও জঙ্গি ও আত্মঘাতি হামলা হবে কারণ  বাংলাদেশের উগ্রপন্থিরা পাকিস্তানের উগ্রপন্থিদের সাথে শুধু সম্পর্কিতই নয় বরং তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত।

এখন তো এমন একটা সপ্তাহ প্রায়ই যায়না যখন পাকিস্তানে রাস্তাঘাটে হাট-বাজার-বাসে এমনকি মসজিদেও জঙ্গি হামলায় সাধারণ মানুষ নিহত হয়না। কেউ বলেনা জঙ্গিরা খুনি, বলে না একটা সভ্য দেশে কোনো কারণেই আইন হাতে তুলে নেয়া যায়না। জঙ্গিদের প্রতি দু'দেশের সাধারণ মানুষের মনোভাব কি? ব্যাখ্যার চেয়ে উদাহরণে সেটা বেশি স্পষ্ট হবে (কিছু  ব্যতিক্রম সবকিছুরই থাকে)।

১। ০৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৯, লাহোর। এক প্রিন্টিং প্রেসের উল্টোদিকে দালানের কোণে লুকিয়ে আছে ইলমুদ্দীন। সবল সুঠাম ২১ বছরের তাগড়া তরুণ, হতদরিদ্র কাঠমিস্ত্রির নিরক্ষর ছেলে। ক্রোধে ধ্কধক করে জ্বলে জ্বলে উঠছে তার তীব্র দুচোখ। হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের ভেতরে মারাত্মক চাপাতি।  ইস্পাতের চাপাতি, অসম্ভব শক্ত আর ধারালো। দুদিন আগে পুরো একটা টাকা খরচ করে কিনেছে সে ওটা। ওই একটাকায় অনেকগুলো রুটি কেনা যেত। কিন্তু দরকার হলে না খেয়ে থাকবে সে, তবু  ইসলামের শত্রুকে খুন  করতে সবচেয়ে শক্ত সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্রটাই তার চাই।  প্রেসের মালিক  রাজপাল ১৯২০ সালে মহানবী (স)-এর  যৌনতা নিয়ে কুৎসা করে লেখকের নামহীন এক বই বের করেছে, 'রঙ্গীলা রসুল'।  কোথায় কোন মুসলিমেরা নাকি হিন্দুদের সীতাকে পতিতা বানিয়ে লিফলেট ছেড়েছে বলে উড়ো খবর এসেছে, তারই প্রতিবাদে এই বই।  ওই লিফলেট আর এই বই নিয়ে হিন্দু-মুসলিম ঘৃণা-আক্রোশে উত্তাল ভারতবর্ষ, দাঙ্গা প্রায় লাগে লাগে।

গল্প নয়, 'ধর্মানুভূতি' আইনের রক্তাক্ত ইতিহাস। পুরো উপমহাদেশকে ঝাঁকি দিয়ে গেছে এ ঘটনাগুলো, পাকিস্তান-বাংলাদেশের বর্তমান ভবিষ্যতে এগুলোর প্রভাব প্রবল ও সুদুরপ্রসারী।

ইলমুদ্দীনের একাগ্রতা টিকটিকির মত। বাল্বের কাছের উজ্জ্বল আলোতে ওই যে দেয়ালে বসে আছে একটা পোকা। দূর থেকে তার দিকে তীরের মত ছুটে এল টিকটিকিটা, কিছুটা দুরে এসে হার্ড ব্রেক করে থামল। দু'চোখের দৃষ্টি তার তীরের মত বিঁধে আছে পোকাটাকে, তার চিন্তা চেতনায় এখন ওই পোকাটা ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই! এবারে অতি সন্তর্পণে অতি সাবধানে কয়েক পা এগিয়ে আবার থামল সে, জ্বলন্ত দুচোখ তার যেন পোকাটাকে গিলে খাচ্ছে। একাগ্রতার চাপে খেয়ালও নেই তার লেজ ওপরে উঠে পাক খেয়ে যাচ্ছে স্ক্রুর মত।

তারপরেই ছোট্ট একটা লাফ।

নির্ভুল।

এবং নির্মম।

'রঙ্গীলা' রসুল" প্রকাশের জন্য ১৯২৩ সালে রাজপালের কারাদণ্ড হলেও সে আপিলে ছাড়া পেয়েছিল কারণ তখনো ভারতে "ধর্মানুভূতি" আইন ছিল না। ইলমুদ্দীনের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তুললেন ইকবাল ও আলেম সমাজ, বিরাট হিরো হয়ে গেল সে। কেউ বললনা সে একটা খুনি, বললো না একটা সভ্য দেশে কোনো কারণেই আইন হাতে তুলে নেয়া  যায়না।  বরং কবি ইকবাল তার প্রশংসায় বয়ান দিলেন – 'এই নিরক্ষর ছেলেটা আমাদের সবাইকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে' !!  ইকবালের অনুরোধে ইলমুদ্দীনের পক্ষে লড়লেন স্বয়ং জিন্নাহ। মামলাটা স্পষ্ট ছিল এবং কোর্টে  সে নিজেকে খুনি বলেই দাবি করেছিল তাই তার ফাঁসি হয়ে গেল ৩১ অক্টোবর ১৯২৯ সালে। জীবনে এই একটা মামলা হেরে গেলেন জিন্নাহ। জাতি তার ফাঁসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, জনতার মুখে মুখে সে হয়ে গেল 'গাজী ইলমুদ্দীন শহীদ'।

একইসাথে 'গাজী' ও 'শহীদ' খেতাবের জগাখিচুড়ি বোধহয় শুধু পাকিস্তানেই সম্ভব।  সেই আমলে তার জানাজায় হয়েছিল প্রায় দু'লক্ষ লোক, তার নামে পার্ক, রাস্তা, হাসপাতাল হয়েছে, এমনকি তার ওপরে একটা নয় বরং কয়েকটা মুভি বানানো হয়েছে এবং সেগুলো প্রভূত জনপ্রিয় হয়েছে।

১৯২৭ সালে ব্রিটিশ 'ধর্মানুভূতি' আইন বানায়, ১৯৮২ সালে পাকিস্তানে 'ধর্মানুভূতি' আইনের ২৫৯খ ধারায় আজীবন কারাদণ্ড ও ১৯৮৫ সালে ২৫৯গ ধারায় মৃত্যুদণ্ডের আইন করে। এই ভয়ংকর আইনের ব্যাপক প্রয়োগে প্রেম, ব্যবসা, জমিজমা ইত্যাদিতে প্রতিপক্ষের ওপরে ষড়যন্ত্র করে 'ইসলাম বিরোধী' কথা বা কাজের অপবাদ দিয়ে অজস্র নিরপরাধ বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের সর্বনাশ হয়েছে। (এখনকার বাংলাদেশের মতই) অজস্র সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ করে তাদের সম্পত্তি গ্রাস করা হয়েছে, এর মধ্যে কিছু ইমামও জড়িত।

২। ৮৮ বছর পর এই সেদিন, ৪ জানুয়ারি ২০১১। পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির। সব নাগরিকের সমান অধিকারের কঠোর প্রবক্তা, ধর্মানুভূতি আইনের তীব্র সমালোচক, ধর্মানুভূতি আইনের শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শক্তিশালী বন্ধু।  ইসলামাবাদে মিটিং শেষে তিনি গাড়িতে উঠতে যাবেন, মুমতাজ কাদরীর (তাঁর দেহরক্ষীদের একজন) অজস্র গুলি হিংস্র বর্শার মত তাঁর শরীর ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে গেল, লুটিয়ে পড়ল তাঁর প্রাণহীন দেহ। আনন্দে ফেটে পড়ল ইসলামী নেতারা আর সারা জাতি, প্রায় ৫০০ মওলানা জাতিকে আহ্বান করল তাসিরের জানাজা বর্জন করতে।  কোর্টে যাবার পথে হাজার জনতা কাদরীকে অজস্র ফুলে ফুলে ঢেকে দিল, তার সমর্থনে এগিয়ে এল ৩০০ আইনজীবী।  ২০১৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি তার ফাঁসি হলে ইসলামী দলগুলোর নেতৃত্বে সারা জাতি আবারো বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, ভাঙচুর ধর্মঘটে দেশ অচল হয়ে পড়ে, বোমা বিস্ফোরণে ৬৯ জন নিহত হয়, লক্ষ লোক হয় তার জানাজায়। তার কবরটা তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, বহুলোক সেখানে জিয়ারত করে। তার নামেও বানানো হয়েছে মসজিদ।  কেউ বলেনি ও একটা খুনি, বলেনি একটা সভ্য দেশে কোনো কারণেই আইন হাতে তুলে নেয়া যায়না।  শুধু সালমান তাসিরের স্ত্রী জাতিকে বলেছেন সতর্কবাণী – জাতি কোন সর্বনাশা পথে চলছে তা আজ বুঝতে পারছেনা, টের পাবে ভবিষ্যতে।

জঙ্গীদের প্রতি আমাদের মন-মানস কি? পাকিস্তানি মানসের সাথে আমাদের মানসের মিল ও তফাৎ কি?

বাংলাদেশে জঙ্গিরা বৌদ্ধ ধর্মগুরু, পুরোহিত, বিচারক, বাউল,  লেখক,  প্রকাশক, বিদেশি ও  সাধারণ মানুষসহ প্রচুর মানুষ হত্যা করেছে। কিছু নারী-জঙ্গিও জন্মেছে যা পাকিস্তানে তেমন দেখা যায়নি। বাংলাদেশে- 'আগে  জানলে  আমি  প্রাণপনে  ওকে  বাধা  দিতাম, – ও আমার  ছেলে  নয়' – ঘৃণাভরে বলেছেন হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের জঙ্গির পিতা মীর হায়াৎ কবির – সিএনএন  নিউজ। জঙ্গীদের আত্মীয়েরা এমনকি মায়েরা পর্যন্ত জঙ্গীদের মৃতদেহ  নিতে যাননি – এমনকি মুখ পর্যন্ত দেখেননি। এতে স্পষ্ট হয়ে  ওঠে এ জাতির মরমীয়া শক্তি কতটা প্রবল যা পাকিস্তানে কল্পনাও করা যায়না। এটাও পাকিস্তানে কল্পনা করা যায় না, যশোরে তিনজন, আগে আরো চারজন, বগুড়ায় আরো কিছু জঙ্গী আত্মসমর্পণ করে বলেছে- 'দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। কুরআনের অপব্যখ্যার শিকার হয়ে আমরা ইসলাম রক্ষার নামে মানুষ হত্যায় প্রলুব্ধ হয়েছিলাম…'। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জঙ্গীরা নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য দোয়া কামনা করে অন্য জঙ্গীদের ফিরে এসে স্বাভাবিক জীবন যাপন করার অনুরোধ জানায়। (সূত্রঃ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)

অর্থাৎ-

ক. বাংলাদেশের সরকার সর্বশক্তিতে  ঝাঁপিয়ে  পড়েছে  জঙ্গীদের ওপরে, একেবারে  হাড্ডাহাড্ডি  লড়াই। পাকিস্তানে সরকারের বাগাড়ম্বর  ছাড়া  জঙ্গিদের সাথে কার্যকর কোনো লড়াই-ই নেই কারণ সরকারের প্রতি জঙ্গিবিরোধী জনসমর্থনই নেই। তাছাড়া ওখানে সর্ষের মধ্যেই ভূত, আর্মি-পুলিশের মধ্যে ঢুকে আছে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিপ্রেম।

খ. ওদের জঙ্গিরা জাতির বিরাট হিরো, আমাদের জঙ্গিরা জাতির ঘৃণার পাত্র। ওদের জঙ্গি-খুনিদের সমর্থনে জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, আমাদের জঙ্গি-খুনিদের বিরুদ্ধে জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ।

গ. ওদের জঙ্গিদের নামে মৃতদেহের ওপর গড়ে ওঠে মাজার-মসজিদ আর আমাদের জঙ্গিদের মৃতদেহ এতিমের মত পড়ে থাকে হাসপাতালের হিমঘরে, আত্মীয়েরা এমনকি বাবা-মাও তাদের মৃতদেহ নিতে যায় না। ওদের জঙ্গিদের নামে পার্ক-রাস্তা-হাসপাতাল হয়, আমাদের জঙ্গিরা নিক্ষিপ্ত হয় ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

ঘ. ওদের জঙ্গিরা সবার সামনে বুক ফুলিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকে, আমাদের জঙ্গিরা ইঁদুরের মত পালিয়ে বেড়ায়।

ঙ. আমাদের জঙ্গিরা কয়েকজন হলেও ভুল বুঝতে পারে সুপথে ফিরে আসতে পারে কিন্তু ওখানে তা  কখনোই হয়নি।

এই হল জঙ্গিদের প্রতি ওদের মন-মানসের সাথে আমাদের মন-মানসের তফাৎ।

তফাৎ কেন? কারণ শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিকেরা রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় উগ্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন করেছে।  ওদের শিরা-উপশিরায় বইছে মওদুদীর বিষাক্ত প্রবাহ, ওখানে বেশিরভাগ সংবাদ-মাধ্যম, সুশীল সমাজ, ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক-বুদ্ধিজীবী, আলেম মওলানা ও মসজিদ মাদ্রাসাগুলো জাতির শিরা-উপশিরায় ঢেলে দিয়েছে জঙ্গিবাদের মহামারী, সেই সর্বগ্রাসী তাণ্ডবের সামনে সরকার অসহায়। আর বাংলাদেশের শিরা-উপশিরায় বইছে হজরত শাহ জালাল-শাহ পরান-শাহ মখদুম-হাজী দানেশমন্দ-দের দেয়া মরমীয়া ইসলামের নির্যাস, তাই তো জঙ্গির বিরুদ্ধে জাতি ফেটে পড়ে ভৈরব গর্জনে, ফেটে পড়ে সংবাদ মাধ্যম, সুশীল সমাজ, ছাত্র শিক্ষক সাংস্কৃতিক কর্মীরা, লেখক বুদ্ধিজীবী ও বেশিরভাগ আলেম মওলানা। এজন্যই সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে হার্ড-লাইনে যাবার শক্তি ও সাহস পেয়েছে।  এটা জঙ্গিদের জন্য হতাশাজনক। অনেক ব্যপারে সরকার যৌক্তিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ, কিন্তু জঙ্গি দমনে সরকারের সাফল্য প্রশংসার দাবি রাখে।

রাজনৈতিক ক্ষমতা হাতে এলে ধর্মীয় নেতৃত্ব সাধারণত, হিংস্র হয়ে ওঠে এটা ইতিহাসের শিক্ষা। ধর্মীয় উগ্রতায় পাকিস্তান এখন টার্মিনাল কেস, সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও এই সর্বনাশা পথে হেঁটেছেন ও হাঁটছেন। চালাকি করে স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে কিন্তু জাতির মঙ্গল করা যায়না। একদিকে ধর্মান্ধতার সাথে আপোষও করবেন অন্যদিকে তাকে দমনও করবেন তা হয়না।  অনেক সময় মাত্র একটা শব্দের ভেতর এমন বজ্রশক্তি থাকে যা একটা জাতির দিক পরিবর্তন করতে পারে।

ওবামার প্রথম নির্বাচনে কোটি জনতার হাতে ব্যানারে মাত্র একটা শব্দ ছিল 'চেঞ্জ' যা দিয়ে আমেরিকায় এই প্রথম বিপ্লব হয়েছিল, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিল।  দেশে এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে চললে বিশ পঁচিশ বছর পরে বাংলাদেশেও একটা শব্দ কেয়ামত নেমে আনতে পারে – যদি কোন রাজনৈতিক দল একটা শব্দ নিয়ে নির্বাচনে নামে –'শারিয়া'।  ব্যস আর দেখতে হবেনা – আমরা ডুবে যাব অতলে…

অলক্ষ্যে অট্টহাসি হাসছে বাংলাদেশের নিয়তি, সাবধান !