যাত্রাপালা: চন্দ্রগুপ্ত-৫। ৫ম অঙ্ক, ১ম দৃশ্য।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 8 Jan 2018, 02:32 PM
Updated : 8 Jan 2018, 02:32 PM

[পাটলিপুত্র নগরের গোপন রাজকীয় মন্ত্রণাকক্ষ। চাণক্য উচ্চাসনে উপবিষ্ট। কক্ষে চন্দ্রগুপ্ত পায়চারী করিতেছেন। সম্রাটকে ঈষৎ উৎকণ্ঠিত মনে হইতেছে।]

চন্দ্রগুপ্ত: হ্যাঁ গুরুদেব, কিছুটা উৎকণ্ঠা আমার আছে বটে। গতকল্য রাত্রে গুপ্তচরের মুখে শুনিলাম, অপরাহ্নে নীলক্ষেত্র সড়কের মোড়ে এক গণশকটের আঘাতে আপনি ভূমিতে পতিত হইয়া আহত হইয়াছেন। আমলক দলের চ্যাংড়াদের নিয়ন্ত্রণহীন সেই শকটের নীচে চাপা পড়িয়া আপনার মৃত্যুও নাকি ঘটিতে পারিত। কী সাংঘাতিক! আমি ক্ষমতাসীন অবস্থায় আমার গুরুদেব ভূমিতে পতিত হইয়া মৃত্যুর আশঙ্কা করিতেছে, ইহা অপেক্ষা দারুণ দুঃসংবাদ এক শাসকের জন্য আর কী হইতে পারে?

চাণক্য: চন্দ্রগুপ্ত, আমি একা নহি, গতকল্য তোমার দলের আয়োজিত শোভাযাত্রায় পাটলিপুত্রের আশেপাশের উপনগরসমূহ হইতে আগত চ্যাংড়াদের অনিয়ন্ত্রিত এবং উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে আপামর নাগরিকের কষ্ট হইয়াছে। শকটজট ছিল প্রায় প্রতিটি রাস্তায়। শহরের বহু মানুষ কলে আটকা ইঁদুরের মতো নিজ নিজ বাহনের খাঁচায় পাটলিপুত্রের দূষণ-সমুদ্রে কয়েক ঘণ্টা ঠায় ডুবিয়া থাকিতে বাধ্য হইয়াছিল। এদিকে  'জয় গৌরমিত্র', 'জয় আর্যাবর্ত' শ্লোগান শুনিতে শুনিতে জনসাধারণের কানের দফারফা। যে শ্লোগানের সহিত বিশ্বাসের যোগ নাই সেই শ্লোগান ফাঁপা বুলি বৈ নয়।

হাজার হাজার ভাড়াটে চ্যাংড়া-চ্যাংড়ি আবর্জনা ফেলিয়া তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তৈয়সী এলাকাকে নরকে পরিণত করিয়াছিল। রাজু ভাষ্কর্যের সম্মুখে দেখিলাম, চুঙ্গার মতো জৈন্স পাতলুন-পরা একাধিক চ্যাংড়া কয়েকটি সদ্য-বিগতযৌবনা অথচ চ্যাংড়ি ভাবাপন্ন এবং মুখমণ্ডলে চুনকামকরা যুব মহিলা আমলক দলীয় নেত্রীর বাহুমূলে নিজ বাহুমূল ঠেকাইয়া কোমর বাঁকাইয়া মৌবইল দিয়া নিজস্বী তুলিতেছে। এই কাজ করিতে গিয়া তাহাদের পশ্চাতে যে প্রতিকারহীন শকট-জটের সৃষ্টি হইতেছে তাহা লক্ষ্য করিবার অবসর বা সদিচ্ছা তাহাদিগের নাই।

নীলক্ষেত্র মোড়ে কয়েকজন আত্মসমর্পী ধর্মের তরুণ অনুসারী দাঁড়াইয়া শকট-মিছিল দেখিতেছিল। শকটস্থিত চ্যাংড়ারা তাহাদিগের আ-গোড়ালি-লম্বিত জোব্বা এব শ্মশ্রুর দিকে ইঙ্গিত করিয়া ইয়ার্কি দিতে লাগিল। আমি ভূমিতে পতিত হইবার মুহূর্তপূর্বে চ্যাংড়াপূর্ণ এবং চ্যাংড়াচালিত এক গণশকটের আঘাতে এক ত্রিচক্রযান চুরমার হইয়া গেল। ত্রিচক্রযানের ভীত-সন্ত্রস্ত চালক বিলাপ করিতে করিতে একা কোনোমতে তাহার দামী যানটি এবং অমূল্য জানটি যখন সড়কের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরিত করিতেছিল তখন তাহাকে সাহায্য করিবার মতো সমব্যথী কেহ আগাইয়া আসে নাই। নীলক্ষেত্রের মোড়ে যে নগররক্ষীরা থাকার কথা, কোনো কারণে তাহারা ঐ মুহূর্তে উধাও। আমি যখন ত্রিচক্রযানচালককে সাহায্যের জন্যে অগ্রসর হইতেছিলাম, ঠিক তখনই অন্য একটি চ্যাংড়াবাহক শকট আমাকে আঘাত করিয়াছিল।

চন্দ্রগুপ্ত: গুরুদেব, আমাকে ক্ষমা করুন। সন্দেহ নাই, রাজনীতির নামে এই সমস্ত নোংরামি আমার কিংবা আমার পারিষদ-করণিকগণের ইচ্ছায় কিংবা আদেশে ঘটিতেছে। কিন্তু কী করিব প্রভু? সম্মুখে নির্বাচন মহাসমর। খৈলদা জৈয়য় সম্প্রতি নাতিদীর্ঘ প্রবাস-জীবনান্তে পাটলিপুত্রে প্রত্যাবর্তন করিয়া আন্দোলনের পাঁয়তারা করিতেছেন। তদুপরি দুই দুই বার ক্ষমতায় থাকার কারণে আমলক দলের নেতা-কর্মীদিগের শরীরে মেদ ও মনে স্থবিরতা আসিয়া জমিয়াছে। তাহাদিগকে উজ্জীবিত করিবার প্রয়োজনেই পারিষদগণের পরামর্শে রাজধানী ও অন্যান্য নগরে শোভাযাত্রার আয়োজন করিতে বাধ্য হইয়াছি।

চাণক্য: শোনো চন্দ্রগুপ্ত, প্রথমত, ষষ্ঠীদশকের আর্যাবর্তে জনসংযোগের যে উপায় ব্যবহৃত হইত তাহা বর্তমানে ব্যবহার করিয়া তুমি জনগণ তথা নাগরিকগণকে স্রেফ বিরক্ত করিতেছ। শীতকালে গ্রীষ্মকালের ওয়াজ করিও না। জনসভার জনসমাগম দেখাইয়া জনসমর্থন প্রমাণ করার যুগ শেষ হইয়া গিয়াছে। চ্যাংড়াদিগের ভাষায় বলিলে: 'জনসভার আর বেইল নাই' বা জনসভায় আর কেহ 'ক্রাশ খায় না!' এখন ডিজিটাল যুগ। ফৌসবুক, টউটর ইত্যাদি অ্যাপস ব্যবহার করিয়া গণসংযোগ করিতে হইবে। ইহাতে খরচ এবং ঝামেলা দুইই কম। ফৌসবুক ব্যবহার করিয়া দুর্বৃত্তরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাইতে সক্ষম হইতেছে, অথচ তুমি তোমার সরকারের জনপ্রিয়তাটুকু যাচাই করিতে পারিতেছ না!

দ্বিতীয়ত, যে ভাষণ ইতিমধ্যে মৌর্য ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হইয়াছে, ঐয়নস্ক দূরে থাক, বিশ্বের কোনো প্রতিষ্ঠানেরই স্বীকৃতির প্রয়োজন সেই ভাষণের নাই। মহান শাক্য মজ্জবের বিখ্যাত সপ্ত মর্চ তারিখের ভাষণের সহিত মৌর্য জাতির আবেগ এতটাই  জড়িত রহিয়াছে যে ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে ইহাকে লইয়া জাতীয় পর্যায়ে অনর্থক নর্তন-কুর্দন মৌর্য নাগরিকদিগের মনে গর্বের পরিবর্তে বিরক্তি উৎপাদন করিয়াছে। দোহাই তোমার চন্দ্রগুপ্ত, তুমি এইবার সর্বজনশ্রদ্ধেয় শাক্য মজ্জবকে রেহাই দাও। তিনি মৌর্য জাতির জন্য তাঁহার সাধ্যের অতিরিক্ত করিয়া গিয়াছেন। বিনিময়ে অকৃতজ্ঞ মৌর্য জাতি তাঁহাকে সপরিবারে খুন করিয়াছে। তবে যতদিন মৌর্যজাতি কিংবা মৌর্য সাম্রাজ্য থাকিবে, ততদিন শাক্য মজ্জবের অবদান কেহই অস্বীকার করিতে পারিবে না, করিলেও তাহা সাময়িক। অর্জনের দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিলে মৌর্য জাতির ইতিহাসে অন্য কোনো নেতা তাঁহার সমকক্ষ দূরে থাক, তুলনীয়ও নহেন। জৈর্য়হমনের সঙ্গে যাহারা শাক্য মজ্জবের তুলনা করিবার ধৃষ্ঠতা করে তাহারা রাম এবং রামছাগলের পার্থক্য জানে না। ইহাদের কথা ভাবিয়া তুমি বেহুদা উদ্বিগ্ন হইও না। ব্যক্তিকে খুন করা যায়, তাহার কর্মকে মুছিয়া ফেলা যায় না। মানুষ অবিচার করিতে পারে, ইতিহাস সাধারণত অবিচার করে না।

শোনো চন্দ্রগুপ্ত, পূর্বপুুরুষের কীর্তিকলাপের কথা সেই ব্যক্তিই বার বার উল্লেখ করিতে থাকে নিজের জীবনে যে কিছুই করিতে পারে নাই। তোমারতো সেই অবস্থা নহে। শাক্য মজ্জবের হত্যাকারী এবং মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সুবিচার করিতে তুমি সক্ষম হইয়াছ। শুধু এই দুই কর্মের জন্যেই মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাসে তুমি স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। তোমাকে ক্ষমতাচ্যুত করিবার কম চেষ্টা কি হইয়াছে? জনসভার সম্ভাব্য স্থানে বোমা পাতিয়া রাখা, গ্রেনেড বিষ্ফোরণ, গজাগার বিদ্রোহ, বিমানের ইস্ক্রপ-শিথিলতা, রৈহঙ্গ সমস্যা … কিন্তু  রাখে হরি মারে কে? মহান শাক্য মজ্জব যাহা করিবার অবসর পান নাই তাহা সমাপ্ত করিবার জন্যই ঈশ্বর তোমাকে বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। সত্য বলিতে কী, তুমি যাহা করিয়াছ, শেষ পটল পত্রিকার সম্পাদক মইত্যরহম্য গং স্বীকার করুন বা না করুন, মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্য কোনও নেতা, এমনকি মহান শাক্য মজ্জবও তাহা করিতে পারিতেন বলিয়া আমি অন্তত মনে করি না। সুতরাং শাক্য মজ্জব কিংবা তাঁহার ভাষণ লইয়া বাড়াবাড়ি করা তুমি বন্ধ কর। দিনরাত জনতার কানে মহান শাক্যের ভাষণের দুরমুশ পিটাইবার প্রয়োজন নাই। ইহাতে রাষ্ট্রপিতার প্রতি মানুষের যে স্বাভাবিক শ্রদ্ধা আছে তাহা নষ্ট হইতে পারে। কেবলমাত্র জাতীয় দিবসগুলিতে শাক্য মজ্জবের ভাষণ বাজিলে উত্তম হয়। মুখের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে জোর করিয়া ঠাঁসিয়া দিলে সুমধুর রসগোল্লাও বিষবৎ মনে হইতে পারে।

চন্দ্রগুপ্ত: গুরুদেব, যতক্ষণ আপনার সম্মুখে থাকি, ততক্ষণ আপনার উপদেশই অবশ্য পালনীয় বলিয়া মনে হয়। কিন্তু পারিষদ ও মহাকরণিকগণের পরামর্শওতো একেবারে ফেলিতে পারি না, কারণ তাঁহাদের লইয়াইতো আমার সরকার-সংসার।

চাণক্য: প্রথমত, তোমার পারিষদ ও মহাকরণিকগণের বেশিরভাগের মস্তিষ্কে মগজের তুলনায় স্নেহ পদার্থের পরিমাণ অধিক। দ্বিতীয়ত, আর্যাবর্তে বহুযুগ যাবৎ পরিবারে উচিৎ শিক্ষা নাই, স্কুলেতো নাইই। এই অশিক্ষা ও কুশিক্ষার প্রভাব রাষ্ট্রের চতুরঙ্গ: শাসনবিভাগ, বিচার বিভাগ, দেশরক্ষা ও শিক্ষার উপর পড়িয়াছে এবং এখনও পড়িতেছে। মৌর্যপরিবারে গণতন্ত্রের পরিবর্তে স্বৈরাচার শেখানো হয়, নৈর্ব্যক্তিক চিন্তা করিতে শেখানো হয় না। পিতা বলে: 'চুপ, তুই বেশি বুঝস?' শুনিয়া মাতা ও সন্তানেরা টু শব্দটি করে না। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি এমন এক একটি বাহিনী কিংবা জঙ্গীগোষ্ঠীতে পরিণত হইয়াছে যেখানে প্রশ্ন কিংবা আপত্তি করা দস্তুর নহে। অথচ শিক্ষা-প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণটাই প্রশ্ন ও উত্তর নির্ভর। প্রশ্নই যদি করিতে না শিখিল, তবে শিক্ষা বা জ্ঞান পাইবে কী প্রকারে? বাহিনী-পরিচালিত বা সামরিক ধ্যানধারণায় পরিচালিত শিক্ষায়তন, যেখানে শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তাভাবনার সুযোগ বড় একটা নাই, সেখানে নৈর্ব্যক্তিক চিন্তা করিতে শিখানো সম্ভব কিনা বা ঐসব প্রতিষ্ঠানে উচিৎ শিক্ষাদান আদৌ সম্ভবপর কিনা তাহা ভাবিবার বিষয়। সার্কাসের প্রশিক্ষকেরা পশুর অঙ্গে তপ্ত লৌহদণ্ডের ছ্যাঁকা দিয়া অথবা মৃদু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করিয়া নৃত্য শিখাইয়া থাকেন। অতিশাসন-নির্ভর এই শিক্ষা শিক্ষার্থীগণের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে বটে, কিন্তু মননের বিকাশে কোনো ভূমিকা রাখে বলিয়া মনে হয় না, যার প্রমাণ, কর্মজীবনে প্রবেশ করিয়া এই সব শিক্ষার্থী সার্কাসের পশুর মতো লম্ফঝম্প করে, কিন্তু শিল্পসম্মত নৃত্য করিতে শেখে না।

তদুপরি জনশ্রুতি এই যে তোমার দ্বিতীয় ও তৃতীয় শাসনামলে গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত তোমার প্রিয়  শিক্ষা-অমাত্য শিক্ষার বারোটা বাজাইয়া চলিয়াছে। আবোল-তাবোল প্রলাপ বকাতে সমগ্র আর্যাবর্তে কেহই তাঁহার সমকক্ষ নহেন। প্রশ্নফাঁস, নির্মাণকার্যে বাঁশ ইত্যাদি একাধিক বিষয়ে অমাত্যের বক্তব্য শুনিলে তাঁহার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ হয়। তিনি পূর্বে কর্মনষ্ট দলের সদস্য ছিলেন, যৌবনে পূঁজিবাদী শিক্ষাকে আমূল পরিবর্তন করিবার শপথ করিয়াছিলেন। পরিণত বয়সে, তোমার ছত্রছায়ায় তিনি ইচ্ছামত ও ক্রমাগত পুঁজিবাদী হইতে শুরু করিয়া সকল রকম শিক্ষাকে ধ্বংস করিতেছেন। এই শিক্ষায় শিক্ষিত হইয়া যাহারা করণিক, সৈনিক, বিচারক, শিক্ষক, সাংবাদিক হইয়া থাকেন, তাহাদিগের ভদ্রতাবোধ এবং দায়িত্ববোধ বলিয়া কিছু থাকে না, শিক্ষা ও জ্ঞানতো 'বহুত দূর কী বাত'।

তোমার করণিকগণ প্রকাশ্যে দাবি করে যে সরকার প্রদত্ত অত্যাধুনিক মবৈল দূরালাপনী দিয়া প্রতিদিনের ই-নথি তাহারা ঝটপট 'খালাস' করিয়া দেয়। তাহাই যদি হয়, তবে মন্ত্রণালয়ে ফাইলের মহাস্থবিরতা ইতিহাসে পরিণত হয় না কেন? চন্দ্রগুপ্ত, তোমার সাধের 'ডিজিটাল' আর্যাবর্তের স্বরূপ কেমন জান? ব্রহ্মদেশের ইয়াবা কিংবা ভারতবর্ষের ফৈনসিডৈল গলাধঃকরণ করিয়া এখানে 'প্রতিটি ডিজি টাল হইয়া' আছেন। ডিজিটাল নহে, ডিজি টাল! তোমার করণীকেরা, অর্বাচীন সংস্কৃত প্রবাদে যেমন বলে: 'মুখে মারিতং জগৎ, কাজের বেলায় ঠনঠনায়তে!' প্রমাণ চাহ? (হাতে তালি দিতেই শৈশরক প্রবেশ করিলেন) অধ্যাপক শৈশরক, আপনি বর্তমান শিক্ষা মহাকরণিকের অতি সাম্প্রতিক একটি অসদাচরণ সম্পর্কে সম্রাটকে অবহিত করুন।

শৈশরক: মহামান্য সম্রাট, তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাকেন্দ্রে সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হইয়াছিল। সেই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হইবার প্রস্তাব দিলে শিক্ষা মহাকরণিক সানন্দে রাজি হইয়াছিলেন। আমি নিজের হাতে তাঁহার কর্মকক্ষে গিয়া আমন্ত্রণপত্র পৌঁছাইয়া দিয়া আসিয়ছিলাম। সর্বত্র অর্থাৎ নিমন্ত্রণপত্রে, সম্মেলনের ব্যানারে এবং পুস্তিকায় শিক্ষা মহাকরণিকের নাম উল্লেখিত হইয়াছিল। সম্মেলন সাড়ে নয় ঘটিকায় শুরু হইবার কথা। দেশি-বিদেশি অতিথিগণ উপস্থিত হইয়া অপেক্ষা করিতেছেন, কিন্তু প্রধান অতিথির অনুপস্থিতে  সম্মেলন নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করা যাইতেছিল না। দশ ঘটিকায়ও মহাকরণিকের 'আমার যে সব দিতে হবে সেতো আমি জানি' ধরনের ঝাঁ চকচকে টাকটি দৃষ্টিগোচর না হওয়াতে তাহার সহিত দূরালাপনীতে যোগাযোগ করিবার চেষ্টা করিলাম। দূরালাপনী বন্ধ। পরে একান্ত সচিবের সহিত যোগাযোগ করিতে তিনি জানাইলেন, শিক্ষা মহাকরণিক মহোদয় বাণিজ্য মন্ত্রকের একটি সভায় ভীষণ রকম ব্যস্ত রহিয়াছেন।

চাণক্য: দেখ চন্দ্রগুপ্ত, শিক্ষা মন্ত্রকের এই মহাকরণিক অসৌহর্রব হৈস্যন এতটাই অপেশাদার যে তিনি জানেনই না কোন কর্মদিবসে কখন, কোথায় তাহার থাকিবার কথা। কথা দিয়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে অনুপস্থিত থাকিবার জন্য কোনো প্রকার দুঃখপ্রকাশ করিবার ভদ্রতাটুকু পর্যন্ত তিনি দেখান নাই। কোনো সরকারের শিক্ষামন্ত্রকের মহাকরণিক যদি এই পরিমাণ অবিমৃশ্যকারী হয় তবে সেই সরকারের আমলে শিক্ষার বারোটা বাজাটা কি আদৌ আশ্চর্যের? এই ধরণের অপেশাদার, অহঙ্কারী ও অভদ্র So Cheap ('সচিব' শব্দের সহিত উচ্চারণমিল কাকতালীয়!) কায়স্থে তোমার মহাকরণ গিজগিজ করিতেছে। কখন কোন ফিকিরে বিদেশ ভ্রমণ করিয়া ভ্রমণভাতা পকেটস্থ করিবে, কোন প্রকল্প হইতে কী পরিমাণ মুদ্রা উৎকোচ গ্রহণ করিবে- এইসব চিন্তা করণিকগণের মস্তিস্ক এতটাই দখল করিয়া থাকে যে দেশের ও দশের উন্নয়ন লইয়া মাথা ঘামাইবার অবসর তাঁহাদিগের মিলে না (সম্প্রতি শুনিলাম, দিলখুশায় অবস্থিত মৌর্য ভবনের পুষ্করিণী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জ্ঞানঅর্জন করিতে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণে যাইতেছেন! কত বিচিত্র উপায়ে যে তোমার করণিকেরা জনগণের অর্থ আইনসঙ্গতভাবে তছরুপ করিতে পারে, ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়!)

আমলাতন্ত্রই যাহারা ঠিকঠাকমতো চালাইতে পারে না সেই অযোগ্য করণিকেরা আর্যাবর্তের যত সরকারী ইনস্টিটিউট, পরিদপ্তর দখল করিতে সদাতৎপর। উহাদের বুভুক্ষার অন্ত নাই। রাক্ষসের গোষ্ঠী (তবে শিক্ষাস্বল্পতার কারণে সবগুলা দাঁত উঠে নাই বলিয়া দেশকে ইচ্ছামতো চিবাইয়া খাইতে পারে না)! আর্যাবর্তে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান রহিয়াছে যেইগুলার উচ্চতম পদে বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রাপ্ত পেশাদার ব্যক্তি থাকা অপরিহার্য এবং রাণী ভিক্টোরিয়া আমল হইতে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র এই পরম্পরা চলিয়া আসিতেছে। কিন্তু শিব ঠাকুরের আপন দেশে চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। সরকারের সহিত বিশ্বাস ও মতের অমিল আছে এমন যে কোনো করণিককে আর্যাবর্তে পত্রপাঠ ওএসডি করা হইয়া থাকে। এত শত ওএসডি করণিককে দায়িত্ব দিতে হইবে, কিন্তু পদ কোথায়? ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী! করণিকগণ কর্তৃক ইনস্টিটিউট, পরি বা অধিদপ্তর দখল হইবার ইহা অন্যতম কারণ। অদূর ভবিষ্যতে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাধ্যক্ষ পদে ঐকত্রজম্মনের স্থলে কোনো অবসৃয়মান কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কোনো মহাকরণিককে দেখা গেলেও অবাক হইবার কিছু থাকিবে না। দেশরক্ষা, শিক্ষা, এমনকি বিচারবিভাগেরও আঠারো আনা করণিকায়ন ঠেকাইবার ক্ষমতা আর্যাবর্তের কোনো শাসকের আছে বলিয়া মনে হয় না।  অপরিণামদর্শী, অশিক্ষিত এবং অজানা ভয়ে কম্পমান অমাত্যবর্গও করণিকগণের অন্যায় আবদারে সায় না দিয়া পারে না। এমকি চন্দ্রগুপ্তের মতো সাব্যস্তের শাসককেও মহাকরণিকেরা সাত-পাঁচ চৌদ্দ বুঝাইয়া স্বমতে আনিয়া ফেলে। ইহার ফলশ্রুতিতে 'আমি কী না পারি!' মানসিকতার করণিকদিগের হাতে পড়িয়া কালক্রমে সেগুন-উদ্যানস্থ আন্তর্দেশীক পিতৃভাষা ইনস্টিটিউট কিংবা বিষ্ফোরক নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানসমূহের বারোটা বাজিতে থাকিবে (ইতিমধ্যেই অনেক প্রতিষ্ঠান, যেমন গৌর একাডেমির বারোটা বাজিয়াছে) এবং আখেরে সাড়ে বারোটা বাজিয়া যাইবে সমগ্র আর্যাবর্তের।

যাহা হউক, একজন শিক্ষা মহাকরণিক এতটা বে-আক্কেল কেন হইবেন যে তক্ষশীলার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে তিনি সক্ষম হইবেন না? পাটলিপুত্রের মহাকরণের দেয়ালে মহান শাক্য মজ্জবের বক্তব্য লিপিবদ্ধ আছে: করণিকেরা যেন বিস্মৃত না হন যে তাহারা 'গণদাস' অর্থাৎ 'পাবলিক সার্ভেন্ট'। চৌর না শোনে ধর্মের কাহিনী! অবশ্য এই পদগর্বী করণিকেরা যেখানে জীবিত চন্দ্রগুপ্তের কথাতেই পারতপক্ষে কর্ণপাত করেন না, মৃত শাক্য মজ্জবের উপদেশ তাহারা শুনিবে কেন? মৌর্যজাতির কপালের ফেলে দাসগণ প্রভূতে পরিণত হইয়াছে, চন্দ্রগুপ্তের নামে প্রকৃতপক্ষে আর্যাবর্তে দাসবংশের কুশাসন চলিতেছে। আর্যাবর্তের বেশির ভাগ সমস্যার মূল কারণ করণিকগণের অপেশাদার আচরণ ও মস্তিষ্ক-ক্ষীণতায় নিহিত রহিয়াছে বলিয়া আমি মনে করি। এই সব পারিষদ ও করণিকগণের সকল পরামর্শকে অতি গুরুত্বের সহিত গ্রহণ করিলে তোমার সমূহ ক্ষতি হইতে পারে।

চন্দ্রগুপ্ত: আসলেই প্রভু, কল্পনাশক্তি ও আক্কেলহীন এইসব অপদার্থ করণিক লইয়া কাজ করা যে কী কঠিন,  তাহা আমি পদে পদে অনুভব করি। কিন্তু আমি অসহায়, কারণ, ঠক বাছিতে গেলে গাঁ উজার হয় অথবা লোম্ব বাছিতে গেলে দারুণ শীতের রাতে কম্বলই আর থাকে না। যাহা হউক, অধ্যাপক শৈশরক, শিক্ষা মহাকরণিকের কেশকলাপের বিবরণ দিতে গিয়া হাস্যোদ্দীপক কী একটা কথা যেন আপনি বলিয়াছিলেন। একবার পুনরাবৃত্তি করিবেন কী? কাঠখোট্টা, নিরস (সর্বার্থে) করণিক ও অমাত্যগণের সহিত দিনের পর দিন থাকিতে থাকিতে জীবনটা খটখটা সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছে (যদিও সাহারা খাতুন এখন অমাত্যসভায় নাই!)। ঈষৎ হাস্যরস সিঞ্চন করিয়া সম্রাটের মনকে উৎফুল্ল করুন।

শৈশরক: মহান সম্রাট আমার প্রগলভতা মার্জনা করিবেন। আমার কৌতুকবোধ কিঞ্চিৎ বেশি হওয়ায় নিজেকে সামলাইতে না পারিয়া আমি মুখ ফসকিয়া ঐ কথাটি উচ্চারণ করিয়া ফেলিয়াছি। তবু সম্রাট যখন আদেশ করিয়াছেন, তখন বলিতেই হয়। প্রভূ, মনুষ্যমস্তকোপরি কমবেশী পঞ্চ প্রকারের টাক পড়িয়া থাকে। প্রথম প্রকার, আগেই বলিয়াছি, 'আমার যে সব দিতে হবে সেতো আমি জানি'। এই টাক পড়িলে মস্তকের সম্মুখ দিক সম্পূর্ণভাবে কুন্তল-বিরল হইয়া যায়। দ্বিতীয় প্রকারের টাকে মস্তকের সম্মুখভাগে, কপালের ঠিক উপরে, মহাসাগরে দ্বীপের মত সামান্য কুন্তলগুচ্ছ অবশিষ্ট থাকে। ইহার নাম: 'স্মৃতিটুকু টাক!' তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যপ্রাক্তন উপাধ্যক্ষ ঐরাবিণের সিপাহসালার বায়তুল্য কৈদরের টাক এই প্রকারের। তৃতীয় প্রকারের টাকে মস্তকের দুই পার্শ্বে কুন্তল থাকে, মধ্যভাগে কিছুই থাকে না। ইহার নাম 'এই পাড়ে আমি, আর ঐ পাড়ে তুমি।' চতুর্থ প্রকারের টাকবান মনুষ্য মস্তকের দক্ষিণ বা বাম পার্শ্বের কুন্তলকে অতি দীর্ঘ করিয়া তৈলসিঞ্চনপূর্বক কাঁকই দিয়া আঁচড়াইয়া সযত্নে মস্তকোপরি পাট করিয়া বিছাইয়া দেয়। তক্ষশীলার সাবেক উপাধ্যক্ষ অজৈদ চৌথহরির টাক অনেকটা এই প্রকারের ছিল। এই টাকের নাম: 'তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে…' হইলে মন্দ হয় না।  কোনো কোনো বিস্তারিত টাকে এখানে ওখানে কুন্তল-শলাকা কিংবা হাল্কা কুন্তলগুচ্ছ উতল হাওয়ায় ফরফর করিয়া উড়িতে থাকে। এই পঞ্চম প্রকার টাকের শুভনাম: 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?' বাহুল্যবোধে উদাহরণ দিলাম না। অমাত্য, করণিক ও বশংবদ অধ্যাপকগণের মধ্যে সম্রাট অবশ্যই এই পঞ্চটাক লক্ষ্য করিয়া থাকিবেন।

(সমস্ত পটোকল [শব্দের সূচনায় 'প্র'-কে 'প' উচ্চারণ করা সম্রাটের অন্যতম মুদ্রাদোষ] বিস্মৃত হইয়া মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত অট্টহাসিতে ফাটিয়া পড়িলেন। চিরগম্ভীর চাণক্যের ওষ্ঠপ্রান্তে দ্বিতীয়া তিথীর চন্দ্রমাতুল্য ক্ষীণ হাসির রেখা দৃষ্টিগোচর হইল।)