একজন টনি ফার্নান্দেজ, এয়ার এশিয়া এবং আমাদের শিক্ষা

সাজ্জাদুল হাসান
Published : 7 Jan 2018, 03:20 PM
Updated : 7 Jan 2018, 03:20 PM

ছয় বছর বয়সে নিজস্ব বিমানের স্বপ্ন দেখেছিলেন টনি। বাবাকে কথাটা বলতেই, বাবা অনেকটা মজা করেই বলেছিলেন, ঐ হিল্টন হোটেলের  দারোয়ানের বাঁধা পেরিয়ে টনি যদি ভেতরে প্রবেশ করতে পারে তাহলেই তিনি যথেষ্ট খুশি হবেন। একজন স্বপ্নদ্রষ্টা কেবল স্বপ্নই দেখেন না, স্বপ্নকে অতি যত্নে লালন করেন, করেন স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন।দোসরা ডিসেম্বর, ২০০১ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যখন টনি সত্যি  সত্যি তার নিজস্ব বিমান প্রতিষ্ঠান 'এয়ার এশিয়া'র যাত্রা শুরু করেন।

মালয়েশিয়া সরকারের মালিকানাধীন 'এয়ার এশিয়া' মূলত প্রতিষ্ঠিত হয়  ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠানটি বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু করে। শুরু থেকেই ধুঁকতে থাকে 'এয়ার এশিয়া'। পরিচালন ব্যয় (Operating expenses) নির্বাহ করতে নির্ভর করতে হয় ব্যাংক কর্তৃক অর্থায়নের উপর। এক পর্যায়ে ঋণে জর্জরিত প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হবার উপক্রম হয়। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে, এয়ার  এশিয়ার এরকম এক মহাসঙ্কটময় সময়ে যখন তাদের মাথার উপর ৪০  মিলিয়ন ডলারের বিশাল ঋণের বোঝা, টনি ফার্নান্দেজ এবং তার কিছু  অংশীদার মিলে প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় নামমাত্র  ২৯ সেন্টের বিনিময়ে!

এখানে  উল্লেখ্য, স্বাভাবিকভাবে ৪০ মিলিয়ন ডলার এর ঋণের বোঝাও চাপে তাদের মাথার উপর। দুটো অতি পুরনো বোয়িং ৭৩৭ জেট  বিমান, ২৫০ জন কর্মী আর একটি মাত্র রুট নিয়ে নতুন করে টনি ফার্নান্দেজের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে এয়ার এশিয়া। শুরু হয় সম্পূর্ণ নতুন এক অধ্যায়ের। একের পর এক সফলতা; এ যেন বারংবার   নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার এক অন্তহীন প্রয়াস। তাদের সফলতার গল্প   হার মানিয়েছে রূপকথাকেও!

নতুন নেতৃত্বের অধীনে ২০০২ সাল থেকে মুনাফা করতে শুরু করে  এয়ার এশিয়া । মাত্র দুটো উড়োজাহাজ থেকে বর্তমানে ২২০টি অত্যাধুনিক উড়োজাহাজের সুবিশাল বহর নিয়ে তারা ২২২টি রুটের ১১০টি গন্তব্যে বিস্তৃত করেছে তাদের কার্যক্রম। অনধিক ৬৫মিলিয়ন  যাত্রী পরিবহনের রেকর্ড গড়েছে তারা। ২৫০ জন কর্মী থেকে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নিয়োজিত আছে এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্কাইট্রেক্স (Skytrax) কর্তৃক  পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, পর পর আট বছর (২০০৯-২০১৬) বিশ্বের  সেরা সাশ্রয়ী বিমান সংস্থার (low cost airline) স্বীকৃতি পেয়েছে ।  বিশ্ব ভ্রমণ পুরস্কার (World Travel Award) টানা চার  বছর (২০১৩-২০১৬) নেতৃত্বস্থানীয়  সাশ্রয়ী  বিমান  সংস্থার  পুরস্কারে  ভূষিত  করেছে  এয়ার এশিয়া-কে ।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাদের এ অভূতপূর্ব সফলতার রহস্য কী?   অনেক গবেষণা হয়েছে এ নিয়ে। সকল  গবেষণা, আলোচনা কিংবা  পর্যালোচনায় একটি বিষয় বেশ জোরোলোভাবে প্রতিভাত হয়েছে, আর তা হলো- টনি ফার্নান্দেজের উদ্যমী এবং অনুপ্রেরণীয় নেতৃত্ব।  কে এই   টনি ফার্নান্দেজ আর কীভাবেই বা তিনি পরিচালনা করেন তার কার্যক্রম?

পুরো নাম অ্যান্থনি ফ্রান্সিস ফার্নান্দেজ। ১৯৬৪ সালের ৩০ এপ্রিল মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে তার জন্ম। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বাবা ছিলেন পেশায় একজন চিকিৎসক। তাঁর মা ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন কুয়ালালামপুরের এলিস স্মিথ  স্কুলে।  বারো বছর বয়সে ভর্তি হন ইংল্যান্ডের সারে শহরের এপসন কলেজে।  পরবর্তীতে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে হিসাববিজ্ঞানে  স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ।  ওয়ার্নার মিউজিক কোম্পানিতে তাঁর  কর্মজীবনের শুরু, পরবর্তীতে যোগ দেন রিচার্ড ব্রনসনের ভার্জিন কম্যুনিকেশনে।

১৯৯২ সালে  মালয়েশিয়ায় ফিরে  আসেন এবং  পুণরায় যোগ দেন ওয়ার্নার মিউজিকে। ওয়ার্নার মিউজিক মালয়েশিয়ার ইতিহাসে তিনি  ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পরিচাল। ২০০১  সালে জড়িত  হন এয়ারলাইন ব্যবসায়। এটি ছিল নিঃসন্দেহে বিশাল এক ঝুঁকি কেননা  সে সময়ে বিশ্বের তাবৎ বড় বড় বিমানসংস্থাসমূহ সমস্যা সঙ্কুল সময় অতিবাহিত করছিল। এছাড়াও এ ব্যবসায় তার ছিলো না কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ।

বলা বাহুল্য এ প্রতিষ্ঠানের সফলতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা  রেখেছে টনির কঠোর পরিশ্রম। এমন অনেকদিন গেছে তিনি কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে তাঁর ছোট্ট অফিসে রাত্রিযাপন করেছেন। প্রতি  দুইমাসে অন্তত একবার তিনি হয় 'চেক  ইন' কাউন্টারে, কিংবা কেবিন ক্রু অথবা লোডিং/আনলোডিং এর কাজ করেন। একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি যখন নিজ হাতে যেকোনো কাজ করেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সকলেই কাজের প্রতি থাকেন নিষ্ঠাবান এবং দায়বদ্ধ। প্রতিষ্ঠানে বিরাজ করে এক সুস্থ কর্ম পরিবেশের; পরস্পরের  প্রতি থাকে অগাধ শ্রদ্ধাবোধ। যেহেতু প্রত্যেক বিভাগের কাজের  ব্যাপারে তার রয়েছে হাতে কলমে কাজ করার অভিজ্ঞতা, সে কারণে সঠিক এবং কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি ভীষণ সিদ্ধহস্ত।

টনি  দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, সবার আগে প্রতিষ্ঠানের কর্মীবাহিনী, তারপরে কাস্টমার।  একটি সুখী এবং সন্তুষ্ট কর্মী বাহিনীই কেবল নিশ্চিত করতে পারে যথাযথ গ্রাহকসেবা। কর্মীদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে এয়ার এশিয়ায় রয়েছে একটি নিবেদিত বিভাগ। নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি যে সমস্ত বিষয়ের উপর জোর দেন- উদ্যম,  উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর  বিনয়।

কর্মীদের ব্যাপারে তিনি এতোটাই গুরুত্ব প্রদান করেন যে, তিনি একবার বলেছিলেন, "আপনার কাছে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ থাকতে পারে, থাকতে পারে মেধাবী ধারণা, কিন্তু এর কোনো কিছুই কাজে আসবেনা যদি না আপনার থাকে একটি দক্ষ এবং আন্তরিক  কর্মী  বাহিনী"।

আর  একটি  বিষয়ের ব্যাপারে টনি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেন-  উত্তরাধিকার পরিকল্পনা (Succession planning) , বিশেষ  করে  গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহের ক্ষেত্রে  নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা, যা একটি প্রতিষ্ঠানের টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী সাফল্যের পিছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা  পালন  করে ।

নতুন নতুন বাজার যেখানে প্রতিযোগিতা তুলনামূলকভাবে কম, সে সমস্ত বাজারে এয়ার এশিয়া তাদের ব্যবসাসম্প্রসারণ করছে। প্রতিনিয়ত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে যাতে করে সাশ্রয়ী  খরচে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। ইন্টারনেট প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে তারা – বিপণনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে  সামাজিক যোগাযোগ প্লাটফর্মকে,  তাদের বেশির ভাগ টিকেট বিক্রি  হচ্ছে  অনলাইনে ।

সঙ্গত কারণে নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের জাতীয় পতাকাবাহী উড়োজাহাজ  সংস্থা  বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর জন্য এয়ার  এশিয়া হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত ।

১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি "আকাশে  শান্তির  নীড়" এই স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিমান। প্রতিষ্ঠালগ্নে উত্তরাধিকার সূত্রে পিআইএ থেকে আত্তীকরণ করতে হয় প্রায় দুই হাজার ৪০০জন কর্মীবাহিনীকে।প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছর পরেও নানাবিধ কারণে বিমানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। পেশাদারিত্বের অভাব, অদক্ষতা, দুর্নীতি ইত্যাদি  নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই সংস্থার বিরুদ্ধে।  বিমানকে একটি কার্যকরী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে আমরা বিভিন্ন সময়ে নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে দেখেছি। কোম্পানিতে রূপান্তর, এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অভিজ্ঞ পেশাদার বিদেশি নাগরিকদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান ইত্যাদি  বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সেই অর্থে সফলতা আসেনি। তাহলে  সমাধান  কী?-

নেতৃত্বে। বিমানের প্রয়োজন টনি ফার্নান্দেজের মতো একজন নিবেদিতপ্রাণ,  স্বপ্নদর্শী নেতৃত্ব আর সেই নেতৃত্বের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে থাকতে হবে অকুণ্ঠ সমর্থন, আর কাজ করার অবাধ স্বাধীনতা।