শীতল পাটি দেখতে চাইনা জাদুঘরে!

অপূর্ব শর্মা
Published : 7 Jan 2018, 01:27 PM
Updated : 7 Jan 2018, 01:27 PM

শীতল পাটি শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা হিম হিম আবহ খেলা করে মনোভূমিতে। অথচ শীতের এই সময়ে শীতল পাটি-ই উষ্ণতা নিয়ে এলো আমাদের জাতীয় জীবনে! ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের শীতল পাটিকে। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা, বাংলার বাউল সঙ্গীত, ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুনন পদ্ধতির পর বিশ্ব নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় শীতল পাটির সংযুক্তি জাতি হিসেবে আমাদের সৃজনশীলতার আখ্যানকেই তুলে ধরলো বিশ্ববাসীর কাছে।

এই শীতল পাটি নিয়ে অতীতে অনেকবার লিখেছি। সেটা সিলেটের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য যেমন লিখেছি, তেমনই লিখেছি এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থেকে। বাঁচানোর তাগিদ কথাটা বললাম এ কারণে, আজ যে শীতল পাটি বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালির এ ঐতিহ্যকে অধিষ্ঠিত করলো সেই পাটি শিল্প এবং বুনন শিল্পীরা কিন্তু ভালো নেই।

নানা সমস্যা এ পেশার সাথে সংশ্লিষ্টদের টুঁটি চেপে ধরেছে। অনেক পাটি শিল্পী এ পেশার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্ত হয়েছেন অন্য পেশায়। একজন শব্দজীবী হিসেবে অতীতে এ কথাটি বারবার লেখার উদ্দেশ্য ছিলো একটাই, সেটা শীতল পাটি শিল্পকে রক্ষা করা। আজ ইউনেস্কোর স্বীকৃতির প্রদানের পর আমরা স্বাভাবিকভাবেই এ শিল্পকে নিয়ে অহংকার করছি, গর্বভরে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ শিল্পের জয়গান করছি। পত্রিকার পাতায় বড় করে ছাপাচ্ছি স্বীকৃতি পাওয়ার খবর? অথচ এই শিল্পের দুর্দিন নিয়ে কিন্তু আমরা সেভাবে সংবাদ প্রকাশ করিনি! যেটা ছেপেছি সেটা অনেকটাই দায়সারাভাবে! ঠিক যে গুরুত্ব দিয়ে, যতটা গুরুত্বসহকারে এ শিল্পটিকে নিয়ে ভাববার প্রয়োজন ছিলো, আমাদের সংশ্লিষ্টরাও সেভাবে ভাবতে পারেন নি। পাটি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিস্টরা বারংবার তাদের নানা দাবি জানালেও এনিয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি উর্ধ্বতনদের। যদি নিতেন তাহলে ধুকতে হত না এই শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টেদের।

স্বীকৃতির মাধ্যমে নতুন করে আলোচনায় এলেও শীতল পাটি শিল্পের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো এক সময় সিলেটের শীতল পার্টির কদর ছিলো বিশ্বজোড়া। দেশ-বিদেশের চাহিদা পূরণে গড়ে উঠেছিল পল্লী। হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার অবলম্বন হয়ে উঠেছিল এ শিল্প। কিন্তু ঠিক কবে থেকে শীতল পাটি বুনন শুরু হয়, এর কোন সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি আজ পর্যন্ত। তবে, শীতল পাটি বুননের সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও শীতল পাটিযে সিলেট অঞ্চলের শিল্প সচেতন মানুষের আবিস্কার এনিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া, চাঁনপুরম শ্রীনাথপুর, আতাসন, গৌরীপুর, লোহামোড়া, খুজগীপুর, কোয়ারগাঁও, হরিশ্যাম, টেকামুদ্রা, কলমপুর, আলগাপুরসহ আরও বেশ কয়েকটি গ্রামের কয়েক হাজার লোক একসময় শীতল পাটি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ অঞ্চলের অন্যান্য স্থানেও শীতল পাটি তৈরি করা হয়ে থাকে। কিন্তু বালাগঞ্জের শীতল পাটিই অনন্য। এক সময় এ উপজেলায় তৈরি শীতল পার্টি শুধু বাংলাদেশেই বাজারজাত হতো না, তা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেও রপ্তানি হতো। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়ায় শীতল পাটির কদর ছিল ঈর্ষনীয়। ভারতবর্ষে আগমনের প্রমাণ হিসাবে ভিনদেশিরা স্মৃতি হিসেবে ঢাকা মসলিনের পাশাপাশি বালাগঞ্জের শীতল পাটি নিয়ে যেতেন। প্রচলিত আছে, ব্রিটিশ আমলে রাণী ভিক্টোরীয়ার রাজপ্রাসাদে স্থান লাভ করেছিল বালাগঞ্জের শীতল পাটি।

সিলেট অঞ্চলে এই শিল্প গড়ে উঠার মূল কারণ শীতলপাটি তৈরির প্রধান উপকরণ মূর্তা বেতের সহজলভ্যতা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া মূর্তা গাছের জন্য সহায়ক হওয়ায় প্রচুর মূর্তাগাছ জন্মে এ অঞ্চলে। এই গাছ থেকে আহরিত বেত দিয়েই তৈরি করা হয় শীতল পাটি। পরিকল্পিতভাবে মূর্তা বেতের চাষাবাদ করা না হলেও বিশেষ ধরণের এই গাছ সিলেটের বনাঞ্চলের স্যাঁতস্যাঁতে মাটি ও বাড়ির পাশ্ববর্তী ভেজা নিচু জমিতে প্রচুর পরিমাণে জন্মে থাকে।

সিলেট অঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ির ডোবা অথবা পুকুরের পাশে একসময় মূর্তা গাছ দেখা যেতো। আঞ্চলিকভাবে সহজলভ্যতাই এ শিল্পকে ব্যাপক করেছে। শুধু সিলেটেই নয় বৃহত্তর ঢাকা বিভাগ, বরিশাল ও চট্টগ্রামের কিছু অংশেও শীতল পাটির মূল উপকরণ মূর্তা গাছ জন্মে থাকে। কিন্তু এসব স্থানে কোন বুননশিল্পী নেই। বুননশিল্পীদের প্রায় সবাই সিলেট বিভাগের অধিবাসী। জাতীয় জাদুঘরের এক সমীক্ষা অনুযায়ি, বৃহত্তর সিলেটের ১০০ গ্রামের প্রায় ৪ হাজার পরিবার এখনো এই কারুশিল্পের সঙ্গে জড়িত।

শীতলপাটির বুননশিল্পীদের স্থানীয়ভাবে 'পাটিয়াল' বা 'পাটিকর' বলা হয়ে থাকে। পারিবারিক শিল্প হিসেবে নারী-পুরুষ উভয়েই শীতল পাটি বুনন কাজের সঙ্গে যুক্ত। তবে, পুরুষ অপেক্ষা নারীরাই অধিকতর ভূমিকা রাখেন পাটি তৈরিতে। পুরুষরা মূর্তা গাছ কেটে তা থেকে বেত তৈরি করা, রং দেওয়া এবং রোদে শুকানোর পর বুননের উপযোগী করে নারীদের হাতে সেটা তুলে দেন। নারীরা নানা নকশায়, নান্দনিকতায় ভরে তোলেন এর জমিন। শীতল পাটির রয়েছে হরেক রকম নাম। তবে নাম অনেক ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য প্রস্থের উপরও নির্ভর করে। বেতের প্রস্থের মাপে শীতল পাটির নামকরণ করা হয়ে থাকে সিকি, আধুলি, টাকা, সোনামুড়ি, নয়নতারা, আসমানতারা প্রভৃতি। একেকটি পাটি তৈরি করতে একজন দক্ষ শিল্পীর ৩-৪ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যায়। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই সংশ্লিষ্টদের অত্যধিক দামে বিক্রি করতে হয় শীতল পাটি।

বর্তমানে এক একটি শীতল পাটি ২ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়ে থাকে। বড় আকৃতির শীতল পাটি এর চেয়েও অধিক মূল্যে বিক্রি করে থাকেন পাটিকররা। তবে এই দামও শ্রমের বিপরীতে একেবারেই নগন্য। গড়ে প্রতিমাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার বেশি রোজগার করতে পারেন না পাটিকররা। রোজগার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের যেমন হতাশা রয়েছে, তেমনই রয়েছে কাঁচামালের সংকট। ৯০ দশক পর্যন্ত মূর্তাবেত সহজলভ্য ছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যে যে জমিতে এক সময় মূর্তা গাছ জন্মাতো মানুষ তাতে গড়ে তুলতে শুরু করে জনবসতি। ফলে মূর্তা বাগান কমতে থাকে। বর্তমানে বালাগঞ্জসহ সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মূর্তা বাগান থাকলেও তা এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। এসব কারণে অনেক শিল্পীই নিজেদের আদি পেশা ছেড়ে অন্য পেশার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছেন।

আর যারা বাপ-দাদার উত্তরাধিকার হিসেবে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের পোহাতে হচ্ছে নানা দুর্ভোগ। যার ফলে এক সময়ের বিখ্যাত এ শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এই শিল্প রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতীয় জাদুঘরে শীতলপাটির এক বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্বোধনীতে এসে প্রদত্ত সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের বক্তব্য যেন তারই আভাস দিচ্ছে। তিনি বলেছেন, 'শীতলপাটির প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।…যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এই শিল্পের সাথে নতুনত্ব এনে তাকে রক্ষা করতে হবে। প্রয়োজনে আমরা শিল্পীদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের সহযোগিতার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেব।' তাঁর এই বক্তব্য আমাদেরকে আশাবাদী করে তুলেছে। সত্যি কথা বলতে কি, করণীয়টা খুব বেশি আহামরি কিছু নয়। প্রথমে সহজলভ্য করতে হবে এর উপকরণ। উদ্যোগ নিতে হবে বাণিজ্যিকভাবে মূর্তাচাষের। অন্যদিকে এই শিল্প সংশ্লিষ্টদের দিতে হবে সরকারি প্রণোদনা এবং রপ্তানী বাজার তৈরিতে রাখতে হবে ভূমিকা। তাহলেই গতি পাবে এই শিল্প।

শীতল পাটি শিল্প ও পাটিকরদের জন্য স্বীকৃতি কিংবা সম্মান নতুন কিছু নয়। ১৯০৬ সালে কলকাতায় কারু শিল্প প্রদর্শনীতে বালাগঞ্জের যদুরাম দাস শীতল পাটির জন্য প্রথমবারের মতো স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৮২ সালে জাতীয় পর্যায়ে শীতল পাটির জন্য শ্রেষ্ঠ কারুশিল্পী হিসেবে পুরস্কৃত হন বালাগঞ্জের পবঞ্জয় দাস।

১৯৯১ সালে ইতালির রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্বের কারুশিল্প প্রদর্শনীতে বালাগঞ্জের মনিদ্র নাথ শীতল পাটি নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করে পুরস্কার লাভ করেন। সর্বশেষ সাফল্যের পালকে যুক্ত হলো ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি। যদিও এই স্বীকৃতি অনেক বড় গৌরবের বিষয় তারপরও বলবো এই স্বীকৃতি নিয়ে শুধু গর্ব আর হৈচৈ করলেই চলবে না। সংস্কৃতিমন্ত্রী যে 'বিশেষ পদক্ষেপ' নেওয়ার কথা বলেছেন, সেটি গ্রহণ করতে হবে দ্রুততর সময়ে। শীতল পাটি রপ্তানি করে কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব সেই ভাবনাটিও ভাবতে হবে। সেরকমটি করতে ব্যর্থ হলে সত্যি সত্যি একদিন হারিয়ে যাবে শীতল পাটি; কালের গহ্বরে বিলীন হবে এর গৌরবগাঁথা। তখন শীতল পাটি দেখতে যেতে হবে জাদুঘরে। এ ছাড়া অন্যকোনো পথ খোলা থাকবে না আমাদের সামনে। আমরা জাদুঘরে দেখতে চাইনা শীতল পাটিকে! আমরা চাই শীতল পাটি ছড়িয়ে পড়–ক বিশ্বময়। তাহলেই যথার্থতা পাবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি।