শাহাবুদ্দিনের বঙ্গবন্ধু

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 4 Jan 2018, 03:57 PM
Updated : 4 Jan 2018, 03:57 PM

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশের যে কয়জন শিল্পী উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিন। তিনিই সম্ভবত একমাত্র চারুশিল্পী যিনি রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন যাকে নিয়ে গর্ব করেছেন তাঁর একমাত্র রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র হিশেবে।

বঙ্গবন্ধু যে আর দশজন ব্যক্তিত্বের মত শুধু পোর্ট্রেট এর মাঝেই শিল্পীর তুলির যোগ্য হবেন, তা নন। বঙ্গবন্ধুর আবেগ যে একটি শিল্প, বঙ্গবন্ধুর বেদনা যে একটি শিল্প, শাহাবুদ্দিন এর রংতুলি তা প্রমাণ করেছে। আর একজন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পীই পারেন বঙ্গবন্ধুর আবেগকে সত্যিকারভাবে তুলে ধরতে। শাহাবুদ্দিন একজন আজীবন মুক্তিযোদ্ধা, যার তুলি বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে বেড়ায়। তাঁর কাছে বিচিত্র আবেগে, বিচিত্র রঙে বঙ্গবন্ধু জীবিত, অমর, অক্ষয়।

পোর্ট্রেট আঁকানো সবসময়ই ছিল এক ধরনের রাজ-সংস্কৃতি এবং সামন্তীয় সংস্কৃতি। এটি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য দু' জায়গাতেই চালু ছিল। রাজ-রাজরা, জমিদার, নাইট কিংবা বরেণ্যদের বাড়ির বিশেষ কক্ষে  তাদের পূর্বপুরুষদের তৈলরঙের পোর্ট্রেট চোখে পড়ে। সে সমস্ত ছবি তেমন কোন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা নয়। যুগে যুগে রাজ অনুগত কবি কিংবা গায়ক  থাকলেও, রাজ অনুগত চিত্রশিল্পীর কথা খুব একটা শোনা যায়না। শিল্পীরা আদর্শের অনুগত হন, বেদনার অনুগত হন আর ভালবাসার অনুগত হন।

বঙ্গবন্ধু কাউকেই তাঁর ছবি আঁকতে বলেছেন বলে জানা যায়নি। এমন কি তাঁর বন্ধু জয়নুল আবেদীন এর আঁকা কোন প্রতিকৃতিও নেই বঙ্গবন্ধুর। শাহাবুদ্দিন এর কাছে বঙ্গবন্ধু এক ক্রুশবিদ্ধ যীশু, যাঁর মৃত্যুর বেদনাক্লিষ্ট মুখও তাঁর নিজের মানুষদের  ক্ষমা করে দেয়ার  কথা বলে স্রষ্টার কাছে।

শাহাবুদ্দিন এর তুলির আঁচড় জীবনের ক্ষিপ্রতাকে, গতিময়তাকে প্রকাশ করেছে সবসময়।বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি আঁকার সময়ও তুলির ক্ষিপ্রতা ছিল সমান গতিতে। ক্ষিপ্রতা কিংবা গতিময়তা অনেক বাস্তবকে আড়াল করে। কিন্তু শাহাবুদ্দিন এর তুলির ক্ষিপ্রতা বঙ্গবন্ধুর বেদনাকে এক নতুন বাঙ্ময়তা দিয়েছে। যেন এক বেদনা বিধ্বস্ত পিতা সন্তানকে কষ্ট দেখাবেন না বলে এক প্রবল গতিময় দেহভঙ্গীর আড়ালে নিজেকে লুকাচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গত কয়েক বছর বেশ কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তিকে সাম্মানিক ডক্টরেট প্রদান করেছে। শাহাবুদ্দিন এর মত একজন শিল্পীকে সাম্মানিক ডিগ্রি প্রদান করলে এটা বঙ্গবন্ধুর প্রতিই এক ধরনের সম্মান প্রদর্শন করা হত বলে মনে করি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি আবাসিক ছাত্র হল রয়েছে। এই হলটি একটি বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত হল হওয়া উচিৎ ছিল। অথচ এটি আর দশটা সাধারণ হলের মতই। হল প্রতিষ্ঠার অনেক বছর পর বঙ্গবন্ধুর একটি ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। সেটিও এমন উচ্চতায় স্থাপন করা হয়েছে যে সহজে চোখে পড়েনা।

এছাড়া "বঙ্গবন্ধু হল" এ  বঙ্গবন্ধুর জীবনও কর্মের পরিচিতমূলক একটি জাদুঘর করা যেতে পারে। সেখানে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের বঙ্গবন্ধু বিষয়ক কিছু শিল্পকর্ম থাকতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে ধরনের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছেনা।

বঙ্গবন্ধু হলের সামনেই চারুকলার শিক্ষক হামিদুজ্জামান খানের করা কিছু চমৎকার ভাস্কর্য ছিল। এটি ছিল এই হলের বিশেষ সৌন্দর্যের দিক। আজ সেসব ভাস্কর্য কোথায় হারিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ জবাব দেবেন কি?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড এর শেষ প্রান্তে বর্তমান উদয়ন বিদ্যালয়ের সামনেই রয়েছে প্রখ্যাত ভাস্কর শামীম শিকদার এর একটি ভাস্কর্য সমাহার। এই সমাহারে বাংলাদেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের মাঝে সবচেয়ে উচ্চতায় স্থাপন করা আছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। শামীম শিকদার খ্যাতিমান ভাস্কর হলেও তাঁর করা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর যে তর্জনী আমাদেরকে ৭ই মার্চের বিখ্যাত ভাষণে স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিল তা ছিল ডান হাতের তর্জনী। অথচ এই ভাস্কর্যে বঙ্গবন্ধু বাম হাতের তর্জনী উঁচিয়ে আছেন। এটি একটি গুরুতর ভুল।

এটি বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের সাথে মানানসই নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কি এটি খেয়াল করেন নি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে চারুকলা অনুষদ, রয়েছে ভাস্কর্য বিভাগ। কেউ কি এই ত্রুটি লক্ষ্য করেন নি? বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের দৃষ্টি কেন এত নির্বিকার? এ চিন্তা আমাকে মর্মাহত করে। শিল্পী শামীম শিকদারকে ত্রুটি ধরিয়ে দিলেই তিনি তা সংশোধন করবেন। আশা করি কর্তৃপক্ষ এই ত্রুটি দ্রুত সংশোধন করার ব্যবস্থা করবেন।

শামীম শিকদার এর অগ্রজ, প্রখ্যাত কম্যুনিস্ট বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদার বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে শামীম শিকদার এর কোন কার্পণ্য নেই। এখানেই হয়তো শিল্পীর মহত্ব। আমাদের মত সাধারণদের থেকে শামীম শিকদার তাই অনেক উপরে। শামীম এর জবানিতে জানা যায়, অগ্রজ সিরাজ শিকদারই শামীমকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গড়তে বলেছিলেন। মতাদর্শিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে এক অনন্য সিরাজ শিকদার এখানে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য যখন স্কুল বালক তখন বঙ্গবন্ধু তাঁদের বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন বলে শিশির স্যার এর এক লেখায় পাই। কিশোর শিশির নিজ হাতে একটি ছবি এঁকে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সাথে ক্ষুদে আঁকিয়ের এই ছবি গ্রহণ করেছিলেন। এক ক্ষুদে  শিল্পীর সামনে বিনয়ের যে নম্রতা তা-ই বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করেছে মধ্যযুগের সামন্তদের থেকে। তাঁর দৃষ্টিতে শিল্পের অসম্পূর্ণতার কোন ভ্রূকুটি ছিলনা। ছিল একটি শিল্পকর্ম  উপহার  পাওয়ার লাজুকতা ভরা কৃতজ্ঞতা।

বঙ্গবন্ধু জনতার। জনতা যেভাবে তাঁকে নির্মাণ করেছে তিনি তাঁর কোনটিকেই অস্বীকার করেন নি। এখানেই তিনি আমাদের সকলের পিতা হয়ে উঠেন। জাতির পিতা হয়ে উঠেন, নিজ গুণে।

বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্ম, তাঁর স্বপ্ন আর তাঁর বেদনা নিয়ে আমাদের মত সাধারণের মাঝে উপস্থিত থাকেন প্রতিদিন। আর আমাদের প্রকাশের অক্ষমতার দায়িত্ব নিয়ে তাঁকে রঙে কিংবা মৃত্তিকায় প্রকাশ করেন শাহাবুদ্দিন কিংবা শামীম শিকদার।