নীতি-নির্ধারকের অভ্যস্ততা

সৌরিন দত্ত
Published : 3 Jan 2018, 04:05 PM
Updated : 3 Jan 2018, 04:05 PM

দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছুটিতে দেশে আসার সময় এক অসহনীয় দৃশ্য ছিল যখন ভোরবেলাতে ভারতের বিহার রাজ্যের গ্রামীণ এলাকা দিয়ে দ্রুতগামী রাজধানী, পূর্বা বা কালকা এক্সপ্রেস ছুটে যেত। মায়াবী সূর্যোদয়ে জেগে উঠছে দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর আর রেল লাইনের পাশে প্রাতঃক্রিয়ারত নারী-পুরুষ। শুধু ধার্মিকরাই নন, সৌন্দর্যপিয়াসী মানস ও যখন উদীয়মান দিনমণিকে স্বাগত জানাবে, এহেন অশ্লীল দৃশ্য তখন শুধু কুৎসিতই নয় যেকোন মানুষের বিবমীষার উদ্রেক করে।

মজার ব্যাপার এই, যারা করছে তারা কিন্তু নির্বিকার। তাদের সংস্কৃতি, রুচিবোধে একাজ এক সাধারণ নিত্যকর্ম এবং এতে কোন সংকোচ নেই। এ কাজটি যে অশ্লীল তা তারা মনে করে না। অভ্যস্ততার সবচেয়ে বড় সমস্যা তা মানুষের চিন্তাকে ভোঁতা করে দেয়।

আমরা বাংলাদেশিরাও ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি  বছরের পর বছর একই জিনিস দেখে। প্রতিবছর প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে, সারা বছর পরিশ্রম করা ছাত্রটির মেডিকেলে পরার স্বপ্ন ধুলিস্মাত হয়ে যাবে আর দায়িত্বশীলরা নির্বিকার ভাবে বলবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা শুধুই গুজব। ভারতের ঢালু পাহাড় বেয়ে বন্যার পানি নেমে আসবে, বানভাসি মানুষের সীমাহীন দুর্দশা নিয়ে, ত্রাণের অপ্রতুলতা নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো রিপোর্ট করবে প্রতিবছরের অগাস্ট থেকে অক্টোবর।

লঞ্চডুবিতে অনেক মানুষ মারা যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি হবে। প্রতিবছর অবিরাম বর্ষণে ঢাকা-চট্টগ্রাম শহর ডুবে যাবে। প্রতিবছর ঈদে মহাসড়কগুলোতে তীব্র যানজট হবে, কোরবানির পশুবাহী ট্রাকগুলো ব্যাপক চাঁদাবাজীর শিকার হবে। বছরের যেকোন মৌসুম হোক না কেন , রোজার আগে বাজারে দ্রব্যমুল্যে আগুন লাগবে। প্রতি ঈদের দিনে ঢাকা শহর ফাঁকা হবে, তা নিয়ে কোন এক টিভি রিপোর্টার এক নারী বা শিশুকে প্রশ্ন করবেন ঢাকা এখন কেমন লাগছে আর ন্যাকা ন্যাকা হাসি দিয়ে সেই নারী বলবেন সারা বছর যদি ঢাকা এমন হতো কত ভালো হত।

প্রতি শীতে পাটুরিয়ায় কুয়াশায় ফেরী বন্ধ হয়ে দুপাশে গাড়ীর দীর্ঘ লাইন হবে আর শীতে নারী শিশু, বৃদ্ধসহ মানুষ অবর্ণনীয় কষ্ট পাবে। একটি রাস্তা বন্ধ থাকলেই ট্রাফিক জ্যামের শহর ঢাকায় কি অবস্থা হয় জানা সত্বেও রাজনৈতিক দলগুলো রাস্তা বন্ধ করে জনসভা করবে।ভিভিআইপি মুভমেন্টের কারণে অ্যাম্বুল্যান্স স্থির হয়ে থাকবে রোগী নিয়ে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুদল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে এক বা দুজন মারা যাবে এবং অত:পর পুলিশের ভয়ে গ্রাম পুরুষশুন্য হয়ে যাবে। শরতের আগমনী টের পাওয়া যাবে কাশের ফুলে আর হিন্দুদের মূর্তিভাঙ্গার সংবাদে। কদর্যে অভ্যস্ততায় আমরা নিজের বোধ বিসর্জন দিয়ে বসে আছি। কি হওয়া উচিত তা না ভেবে কি হবে তাতেই আমরা বিচলিত হতে থাকি। সকল দেশের রানী হতভাগী বাংলাদেশের পুত্রকন্যারা এখন বছরের পর বছর ধরে  এসকল কুকাজে অতি অভ্যস্ত।

অভ্যস্ততা আরো খারাপ যখন তা আমাদের নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে বিস্মৃত করে। অস্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়ার বোধের উদ্রেক করে। আমাদের অভ্যস্ততা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এখন আমরা বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডকে সমস্যার সমাধান হিসাবে  হিসাবে মেনে নিয়েছি।  এক মন্ত্রণাদাতা বলেছেন, মাদকের সাথে জড়িতদের দেখামাত্র গুলি করে মেরে ফেলাই মাদক নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায়। হয়ত আপনার কথাই সত্য কিন্তু যে মহান সংসদে আপনারা অপরাধের শাস্তি বিধানের আইন প্রনয়ন করেন, দেখামাত্র অপরাধীকে গুলি করা কি আপনার আইন ও বিচার বিভাগের প্রতি অসন্মান প্রদর্শন নয়? মাননীয় মন্ত্রী , আপনার মাদক নির্মূলে আপনার মহতী স্বপ্নের সাথে আমি একমত কিন্তু তার বাস্তবায়নের যে পদ্ধতি আপনি চান তা কি রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক নয়?

বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড কখনোই কোন অপরাধ নির্মুলের একমাত্র পথ হতে পারে না। পত্রিকার পাতায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা আমাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে। হয়ত বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসুত্রিতা বা স্বচ্ছতার অভাব কারো কারো মনে এই বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে কিছু যুক্তিরও জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সংবিধানকে হাতে তুলে শপথ নেয়া ব্যক্তিই তো জনগণের মন থেকে এক সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার বিরোধী নিন্দনীয় চর্চাকে বন্ধ করবেন। আপনি যদি সেই ব্যবস্থার পক্ষে বলেন , তবে আমরা কার মুখের দিকে তাকাবো?

এমনেস্টিসহ মানবাধিকার সংঘটনগুলো মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি দেখায় যে তা মানুষের এক মৌলিক অধিকার –বেঁচে থাকার অধিকার তাকে অমর্যাদা করে। যে অস্থির সময়ে আমাদের বসবাস তা আমাদের মানবিকতাকে ক্রমশঃ হরণ করছে। আমরা সবকিছুতে এত অভ্যস্ত যে দিনমজুরের ছেলের মেডিকেলে চান্স পাওয়া আমাদের কাছে খবর হয়ে আসে যেন তা খুব আশ্চর্য কিন্তু সীমিত বেতনের কর্মকর্তার অ্যাকাউন্টে একশ কোটি টাকা থাকলে তা আমাদের অবাক করেনা। যদিও আইন ও নীতিগত ভাবে প্রথমটিতে কোন বাধা নেই কিন্তু দ্বিতীয়টি আইন ও নীতিগতভাবে অসম্ভব।

রামায়নের যুদ্ধে হনুমানকে বিশাল্যকরণী ভেষজ আনতে বলায় সে গোটা গন্ধমাদন পর্বতটাই উড়িয়ে এনেছিল। এতে তার বিশাল শারীরীক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া গেলেও তার বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়না। মাদক নিয়ন্ত্রণে কোন নীতিনির্ধারক যদি "শুট অ্যাট সাইট" এর পক্ষে কোন সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তবে আমরা হয়তো বুঝি তিনি এই সমস্যার সমাধানকল্পে কতটা দৃঢ়কল্প। কিন্তু আমরা এটাও বুঝি যে সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ নিয়ে তিনি এই পদে আসীন হয়েছেন তিনি সেই সংবিধানের প্রতি যথেষ্ট দায়িত্ববান নন।