অনিশ্চয়তায় ঘেরা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন

Published : 28 Dec 2017, 02:36 PM
Updated : 28 Dec 2017, 02:36 PM

প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই নির্দিষ্ট সময়ের পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা আগামী দিনে তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের কাজ করবে এই ধরনের সরকারকে বাছাই করে। ফলে, নির্বাচিত হবার পরে সরকারের মূল কাজ হয় সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে সরকার পরিচালনার বিষয়টি নিশ্চিত করে দেশের উন্নতি সাধন করা।

একটি দেশের জন্য নির্বাচনের গুরুত্ব আপরিসীম। তাই তো, প্রাচীন গ্রিক সমাজেও আমরা নির্বাচনের অস্তিত্ব লক্ষ্য করি। তবে সময়ে পরিবর্তনের সাথে সাথে দেশ ভেদে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের ধরনে পরিবর্তন এসেছে।

যদিও বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মধ্যে গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসকরা এই দেশ পরিচালনা করে।

১৯৯০ সালে গণ-বিপ্লবের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতনের পর দেশে দ্বিতীয়বারের মতো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলমান থাকে। এর পরে ২০০৬ সালের শেষের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কেন্দ্র করে দেশে এক ধরনের অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

এই পরিস্থিতিতে দেশের সবচেয়ে বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ার ফলে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ ধরনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা দখল করে এবং দুই বছর দেশ পরিচালনা করে। অনেক ঘটনা প্রবাহের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মাধেনে পুনরায় দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

পাঁচ বছর পরে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে পুনরায় অরাজকতা সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের  ব্যাপারে তাদের অবস্থান সুসংহত করে। অন্যদিকে বিএনপি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোন ধরনের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। দুই দলের দ্বিমুখী অবস্থানের মধ্যে আলাপ আলোচনা অব্যাহত থাকে।

আলোচনার এক পর্যায়ে  আওয়ামী লীগ বিএনপির সামনে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরে। আওয়ামী লীগ সকল দলের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাব দেয়।

কিন্তু, বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘের মধ্যস্থতাতেও সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভবপর হয় নি। ফলে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, দেশবাসী নির্বাচনের ব্যাপারে কোন ধরনের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেখতে ব্যর্থ হয়। বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতে পোঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় গোটা দেশ অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়।

হরতালের নামে এসিড, পেট্রোল বোমা এবং গাড়িতে আগুন দিয়ে শয়ে শয়ে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এই ধরনের পরিস্থিতি দেশবাসী খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছে। বিএনপি ও এর শরীকদের বাঁধা সত্ত্বেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন এবং বাকি সদস্যরা আওয়ামী লীগ ও এর শরীকদের দলের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ফলে সরকারকে দেশে ও বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।

২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠনের পর ধীরে ধীরে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে এবং ২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত স্থিতিশীল থাকে। ফলে দেশবাসী এক ধরনের স্বস্তি বোধ করতে থাকে। আমরা আশা করেছিলাম যে, আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা হবে।

আমরা আরও আশাবাদী হয়েছিলাম এই কারণে যে,২০১৭ সালের জুন মাস পর্যন্ত বিএনপির প্রায় সকল কেন্দ্রীয় নেতাই নির্বাচনের ব্যাপারে ইতিবাচক মন্তব্য করতে থাকেন।

উদাহরণস্বরুপ বলা যায় যে,২০১৭ সালের ১৮ জুন বেগম খালেদা জিয়া একটি ইফতার পার্টিতে স্পষ্টভাবে বলেন যে, তারা আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে জিতবে দিবে না। তিনি উপস্থিত সকলের নিকট বিএনপির পক্ষে ভোটও চেয়েছিলেন। খালেদা জিয়া ছাড়াও আন্যান্য নেতৃবৃন্দ ( যেমন,ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল  রুহুল আলম চৌধুরী, ড: খন্দকার মোশারফ হোসেন) বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাদের ইচ্ছার কথা জনগণের কছে প্রকাশ করেন। এছাড়াও, নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপেও বিএনপি অংশগ্রহণ করে।

বিএনপির মতো আওয়ামী লীগকেও নির্বাচেনের ব্যাপরে ঐক্যমতে পৌঁছানোর ব্যাপরে ইতিবাচক মনে হয়েছিল। আওয়ামী লীগও দেশে ২০১৪ সালের মতো কোন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চায় না,কারণ এই ধরণের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। ফলে দেশবাসী প্রত্যাশা করেছিল যে,আওয়ামী লীগও বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে এবং তাদের নির্বাচনের আনার ব্যাপারে যা যা করণীয় তা করবে।

কিন্তু এই ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবেশ পরিবর্তিত হতে লাগলো বেগম জিয়ার লন্ডন যাত্রার পর থেকে। লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর থেকে তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে থাকেন।

অন্যদিকে মওদুদ আহমেদসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যে কোন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকেন। ফলে, দলীয় প্রধানের আকস্মিক নীতি পরিবর্তন কেবল দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেই নয় বরং সচেতন নাগরিকদের মধ্যেই এক ধরণের অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। দেশবাসী এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করেছে যে,লন্ডনে গিয়ে কি এমন ঘটনা ঘটলো যার ফলে বেগম জিয়া তার অবস্থান পরিবর্তন করলেন।

তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে কিছুটা হলেও মতবিরোধ রয়েছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায় যে, বিগত রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পরে মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বললেন যে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। অন্যদিকে রিজভী আহমেদ বললেন যে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে এই ধরনের মতবিরোধ দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়কেই নির্দেশ করে। এখান থেকে আরেকটি বিষয় বেরিয়ে এসেছে যে, বিএনপি নেতৃবৃন্দ নিজেরাও জানে না তারা সরকারের কাছে কি চায়!

উপরোক্ত পরিস্থিতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো-বিএনপি যদি আবার নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে কি ধরনের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে? বিএনপির অনমনীয় অবস্থান আওয়ামী লীগকেও অনমনীয় করে তুলছে। ফলে তারাও এখন কোন ধরনের সমঝোতা করতে চাচ্ছে না বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির সাথে।

এই পরিস্থিতিতে আমরা কি আবার ২০১৪ সালের মতো সেই অবস্থার দিকেই যাচ্ছি যেখানে এসিড ও পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করা হবে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষ মেরে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আদায় করার কৌশল কখনই কাম্য হতে পারে না।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন পৃথিবীর সকলের নজর কেড়েছে। এই প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নির্ভর করছে দেশের স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের উপর। আমরা বিশ্বাস করতে চায় যে, বিএনপি কোন সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল নয়। ফলে, নির্বাচন হচ্ছে ক্ষমতায় যাবার একমাত্র পথ। বিএনপি যদি আগামী সংসদ নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মূখীন হবে। একই সাথে, আওয়ামী লীগ এমন একটি রাজনৈতিক দল যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।

সুতরাং,আমরা বিশ্বাস করি বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য তারা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। উভয় পক্ষের প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনের উপর যে কালো মেঘ জন্মেছে তা কেটে যাবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।