প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখের বেশি মানুষ নতুন করে দেশের শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। দেশের ভিতরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উল্লেখিত শ্রমশক্তির ৫ লাখের কম সংখ্যক মানুষের জন্য মানসম্মত কাজের সুযোগ থাকলেও বাকি বিপুল সংখ্যক আগ্রহী জনগোষ্ঠির উপযুক্ত চাকুরির ব্যবস্থা সরকারের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
আরেকদিকে গত ১০ বছরের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৫ লাখ কর্মী বিভিন্ন পেশার চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন যা দেশের জন্য সুখবর।
এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৯ লাখ ৩০ হাজারের বেশি কর্মী নানা পেশায় বিভিন্ন দেশে চাকরি নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছেন যা অতীতের সব রেকর্ডকে অতিক্রম করেছে। ২০১৫ সালে যেখানে সাড়ে ৫ লাখ কর্মী বিদেশে যায়, সেখানে গত বছরে সাড়ে সাত লাখ শ্রমিক বিদেশে গেছেন।
অর্থাৎ বছর বছর বিদেশে কর্মসংস্থানের আগ্রহী কর্মীর বিদেশ যাওয়ার হার বেড়ে চলছে। এবছরও সেই ধারা রয়েছে। সুতরাং দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত হতে পারে।
যদিও উল্লেযোগ্যহারে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে আগ্রহী কর্মীরা চাকরি নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন, মানসম্মত জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা আমরা কতটুকু করতে পেরেছি তা বিবেচনা করা দরকার।
সরকারের বিএমইটি এর তথ্য যাচাই করলে জানা যায় ১৯৭৬ থেকে এ পর্যন্ত যেসব মোট বিদেশগামী কর্মীর প্রায় অর্ধেকই ছিলেন অদক্ষ।
ফলে কর্মসংস্থানের বিপরীতে কাঙ্খিত রেমিটেন্স আনতে আমরা পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। যদি আরও বেশি দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করা যায় তাহলে রেমিটেন্সের হার অনেক বাড়বে।
একটি ইতিবাচক দিক হলো- সরকার ২০১১ সালে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ননীতি প্রণয়ন করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে চেয়ারপার্সন করে গঠিত হয়েছে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল (এনএসডিসি) যা দেশের শীর্ষ দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদ হিসেবে বিবেচিত। যেখানে সরকারি উচ্চ পর্যায় ও বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরও অংশগ্রহণ রয়েছে।
এটি এখন থেকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সার্বিক কাজের তত্ত্বাবধান করবে। এছাড়াও এনএসডিসি এর সচিবালয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির লক্ষ্যে যে সব নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করবেন ।
এছাড়াও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালায় বর্তমানে ৮টি স্তরের জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো গৃহীত হয়েছে।
এই কাঠামোটির আলোকে দেশের যুব সম্প্রদায়, নারী, স্বল্পদক্ষতা সম্পন্ন মানুষ, প্রতিবন্ধী, অভিবাসী, দেশের ভিতর স্থানচ্যুত মানুষ, বয়স্ক শ্রমিক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বিভিন্ন সংস্কৃতির সংখ্যালঘু শ্রেণী এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীসহ সকল নাগরিকের এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকৃতির শিল্প, উপানুষ্ঠানিক অর্থনীতি, পল্লী খাত ও আত্ম-কর্মসংস্থানে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করা হবে।
যার ফলে ইতোমধ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের কারণে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং দক্ষতার প্রশিক্ষণে অতীতের তুলনায় অগ্রগতি কিছুটা লক্ষ্যনীয়। তবে এই অগ্রগতি যে দেশের জনসংখার চাহিদার প্রয়োজনে কতটুকু সাড়া দিতে পারছে যা দেখা জরুরী।
সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ বর্তমানে সরকারের ১৯টি মন্ত্রণালয়, বেসরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, শিল্প ভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ সংস্থা এবং এনজিও পরিচালিত দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহ পরিচালিত হচ্ছে। প্রতি বছর এই সব কেন্দ্র থেকে প্রচুর পরিমানে প্রশিক্ষণার্থী চাকরির চাহিদাভিত্তিক বিভিন্ন কোর্স সম্পন্ন করে মানসম্মত চাকরিতে নিয়োজিত হচ্ছেন।
এছাড়াও বর্তমানে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন ফ্রেম-ওয়ার্ক অনুসারে যাদের কোনও ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা নেই তারাও সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিশেষ টেস্টে অংশগ্রহণ করে পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ নিয়ে কাজে যোগ দিচ্ছেন যা সংক্ষেপে আরপিএল নামে পরিচিত ।
শুধু বিদেশের চাহিদার লক্ষ্য পূরণে বিএমইটি এর তত্ত্বাবধানে বর্তমানে বেশকিছু সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (সরকারি টিটিসি) স্থাপন করা হয়েছে যেখানে প্রতিবছর আনুমানিক প্রায় দেড় লাখের বেশি প্রশিক্ষণার্থী বিদেশের চাহিদানুযায়ী ট্রেডভিত্তিক কোর্স সম্পন্ন করতে পারছেন।
তবে সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র বিদেশের চাহিদার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এখনো শতভাগ প্রস্তুতি অর্জন করতে পারে নি।
এছাড়াও বিদেশের চাহিদা চিন্তা করে বর্তমানে সারাদেশে বেশকিছু বেসরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রও গড়ে উঠেছে যা রিক্রটিং এজেন্সি, বেসরকারি উদ্যোগ বা বিদেশে ছিলেন এমন ব্যক্তিরাও পরিচালনা করছেন।
যদিও বেসরকারি এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি কিন্তু এখানে নিজ এজেন্সি বা জব লিংকেজ সেলের মাধ্যমে প্রশিক্ষনার্থীরা বিদেশে যাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছেন।
আমাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার বর্তমান একটি বড় চ্যালেঞ্জ হল কোর্স শেষে প্রশিক্ষণার্থীর দেশে বা বিদেশে উপযুক্ত চাকুরির ব্যবস্থা করা। এছাড়াও কাজের উপর প্রশিক্ষণ ছাড়াও ভাষা শেখা ও গন্তব্য দেশের নিয়মকানুন, সেখানকার খাদ্যাভাস, আবহাওয়া, ও সামাজিক আচার-আচরণ জেনে নিলে নিজেকে সহজে মানিয়ে নিতে পারবেন।
তবে প্রতিষ্ঠানের ধরণ সরকারি বা বেসরকারি যা-ই হোক না কেন- প্রশিক্ষণার্থীরা সবাই শতভাগ মানসম্মত প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন কিনা এটি নিশ্চিত করা দরকার।
কর্তৃপক্ষের খেয়াল রাখা উচিত এসব প্রশিক্ষণে সার্টিফিকেট প্রদানের চেয়ে কোর্সের গুণগতমান রক্ষা করার প্রতি জোর দেয়া। ফলে প্রশিক্ষণার্থীরা প্রশিক্ষণ শেষে বিদেশে যেতে না চাইলে অর্জিত দক্ষতার মাধ্যমে দেশে অন্তত আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
সরকারের উচিত নীতিমালার আলোকে নিয়মিত মনিটরিং করে এসব প্রতিষ্ঠানের গুনগতমান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। তাছাড়া যারা মানসম্মত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে অবদান রাখছে সরকারি ও দাতা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ ও অর্থায়ন করলে প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার বাড়বে।
দেশের শ্রম শক্তির চালচিত্র বা গতিবিধি জানার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কয়েক মাস আগে 'কোয়ার্টালি লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৫-২০১৬' একটি সার্ভে সম্পন্ন করেছে। সারাদেশের ৬৪টি জেলার প্রায় ৩০ হাজার থানাতে এই জরিপ চালানো হয়। জরিপে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী স্বরূপ, কর্মক্ষেত্রের ধরন, বেকারত্বের হার, তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য কাজের সুযোগ, শ্রম ঘণ্টা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান ইস্যুতে নানাবিধ তথ্য উপাত্ত তুলে ধরা হয়েছে।
এই ধরনের জরিপ বা গবেষণা যত বেশি হবে ততো নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে শ্রম শক্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ সার্ভে অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ লোকেরা কাজের সুযোগ বেশি পাচ্ছেন, তবে মজুরি কম। সুতরাং বলা যায় অধিক আয়ের লক্ষ্যে দক্ষতার বিকল্প নাই।
আমাদের জিডিপিতে রেমিটেন্সের অবদান প্রায় ১০ শতাংশের মত এবং প্রতিবছর গড়ে ১৫ বিলিয়নের বেশি রেমিটেন্স দেশে আসে। বর্তমানে নারীরাও প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে যেতে উৎসাহিত হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের যথেষ্ঠ সহযোগিতা রয়েছে।
তবে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও নিরাপদ নারী শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করা গেলে অধিক হারে শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে এবং রেমিটেন্স আনয়নের পরিমান বাড়বে। সরকারি তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নারী কর্মীদের বিদেশগমনের হার বছর অনুপাতে ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে স্বপ্ন দেখছে যা অর্জনে দক্ষ জনশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকার ঘোষিত আমাদের সর্বশেষ ৭ম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনাতে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে যোগ্য জনশক্তি তৈরীর প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে দ্রুুত বর্ধণশীল শিল্পখাতসমূহসহ অন্যান্য খাত এবং বিদেশের শ্রম বাজারে বিভিন্ন ট্রেডে যোগ্য শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
সুতরাং দক্ষতা বিষয়ে সরকার যে নীতিমালা করেছে তার সঠিক বাস্তবায়ন ও প্রতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করলে সবাই সুফল পাব। যদিও বিশ্বব্যাংক মতে আমাদের বেকারত্বের হার প্রায় ৪ দশমিক ৫ শতাংশ কিন্তু জনসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের ইতিবাচক পরিবর্তণ তথা টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন আমাদের পক্ষে সম্ভব।
জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতে দারিদ্র দূরীকরণ, অভিবাসন, দক্ষতা ও অংশীদারিত্বকে অন্তর্ভূক্ত করে কতগুলো টার্গেট নির্ধারন করা হয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে সরকারের সাথে আমরা সবাই এই এসডিজি অর্জনে বদ্ধপরিকর। আশাকরি আমাদের সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও অগ্রাধিকার বিবেচনায় করনীয়গুলোকে নিয়ে যদি এখনি এগিয়ে যাই তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে সকল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজতর হবে যা থেকে আমরা দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হতে পারব।