একাত্তরের গণহত্যা, মানবতা যেখানে মুখ লুকোয় লজ্জায়

আরিফ রহমান
Published : 20 Dec 2017, 12:22 PM
Updated : 20 Dec 2017, 12:22 PM

১৯৭১ সালের পর ৪৬ বছর পার হয়েছে। সামনেই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে খুবই অপছন্দ করেন।

তাদের দাবি পুরোনো ঘটনা নিয়ে ঘাটাঘাটি করে নাকি কোনও লাভ নাই। এই ভূখণ্ডে ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে নজিরবিহীন গণহত্যা পরিচালনা করেছিল সেরকম আরেকটি গণহত্যার উদাহরণ খুঁজে পাওয়া এক রকম অসম্ভব।

১৯৮১ সালে ইউ এন ইউনির্ভাসাল হিউম্যান রাইটসের ডিকলেয়ারেশানে লেখা হয়েছে-

"মানব ইতিহাসে যত গণহত্যা হয়েছে এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৯৭১ এর গণহত্যায় স্বল্পতম সময়ে সংখ্যার দিকে সর্ববৃহৎ। গড়ে প্রতিদিন ৬,০০০ – ১২,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এটি হচ্ছে গণহত্যার ইতিহাসে প্রতিদিনে সর্ব্বোচ্চ নিধনের হার।"

আমি আজ আমার এই লেখাটিতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের যে অবর্ণনীয় অত্যাচার করে হত্যা করতো সেরকম কিছু অত্যাচার আর নিপীড়নের তথ্য তুলে ধরতে চাই। সম্ভবত যেই ঘটনাগুলো আমাদের অধিকাংশেরই অজানা। পৃথিবীময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন গণহত্যা ইতিহাসের একজন নীরব পাঠক হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গণহত্যার ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমি বারবার শিউরে উঠেছি। বারবার নতুন করে আবিষ্কার করেছি মানুষ কত নিষ্ঠুর হতে পারে।

একইভাবে যখন আমার দেশের গণহত্যার ইতিহাস পড়েছি তখন আরও বেশি যেন শিউরে উঠেছি, রাতের পর রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। বুঝতে পেরেছি হিটলারের বাহিনী কিংবা মুসোলিনির বাহিনী কিংবা পৃথিবীর কোনো একনায়ক- কোনো রাষ্ট্র- কোনো যুদ্ধ এতো বেশি ভয়াবহতা দেখেনি, এতো নিপীড়ন করতে পারেনি মানুষকে। যেমনটা করেছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম থেকে প্রকাশিত বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমিরগুলোর লেখা বই 'বধ্যভূমির গদ্য' বইতে উঠে আসা খুলনার প্লাটিনাম জুটমিল বধ্যভূমিতে বাঙালি নিধনের কাহিনী শুনে শিউরে উঠতে হয়-

'খুলনা সদরে প্লাটিনাম জুট মিলের হত্যাকাণ্ড ছিল যেমন লোমহর্ষক, তেমনি নির্মম ও নিষ্ঠুর। মিলের জ্বলন্ত বয়লারের ভেতরে ফেলে কমপক্ষে ৫৬ জনকে পুড়িয়ে হত্যা করে হানাদাররা। বয়লারের সামনে বিশ ফুট উঁচু পাকা প্রাচীরের পাশে বাঙালি শ্রমিকদের এনে বসানো হতো। এরপর তাদেরকে বস্তাবন্দি করে পায়ের দিক থেকে জ্বলন্ত বয়লারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। ঢোকানো অংশ পুড়ে গেলে দেহের বাকি অংশ মাথা একটু একটু করে বয়লারে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এসব হতভাগ্যদের মধ্যে হারুন, হেমায়েত, আজিজ প্রমুখের নাম জানা যায়।' [১]

অধ্যাপক আনিসুর রহমান শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি দেখে এসে বলেছিলেন-

'ইতিহাসে পৈশাচিকভাবে হত্যার অনেক কাহিনী পড়েছি। কিন্তু শিয়ালবাড়িতে ওই পিশাচরা যা করেছে এমন নির্মমতার কথা কি কেউ পড়েছেন বা দেখেছেন? কসাইখানায় কসাইকে দেখেছি জীবজন্তুর গোস্তকে কিমা করে দিতে। আর শিয়ালবাড়িতে গিয়ে দেখলাম কিমা করা হয়েছে মানুষের হাড়। একটা মানুষকে দুটুকরো করলেই যথেষ্ট পাশবিকতা হয়, কিন্তু তাকে কিমা করার মধ্যে কোন্ পাশবিকতার উল্লাস?…সত্যি আমি যদি মানুষ না হতাম, আমার যদি চেতনা না থাকতো, এর চেয়ে যদি হতাম কোন জড় পদার্থ তাহলে শিয়ালবাড়ির ওই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষ নামধারী এই দ্বিপদ জন্তুদের সম্পর্কে এতটা নিচু ধারণা করতে পারতাম না। মানুষ যত নিচই হোক, তবুও ওদের সম্পর্কে যে সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধ ছিল তা একেবারেই উবে যেত না, আর মানুষ কেন কোন প্রাণীই কি পারে এত নির্মম, এত বর্বর, এতটা বোধহীন হতে?… শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চাই না বলে মাটি, ভুল বললাম মানুষের হাড়ের ওপর বসে পড়তে হয়েছে। সারা এলাকার মানুষের হাড় ছাড়া অবিমিশ্র মাটি কোথায়?

আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির ওপর পা ফেলতে পারিনি। দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়।' [২]

চট্টগ্রাম শহরতলীর লালখানবাজারে বিনা উসকানিতে নিরীহ তিনশ মানুষ হত্যার ঘটনা বর্ণনা করা যায়। ১৯৭১ সালের ২৯ শে মার্চ দুপুরে ওয়াসার মোড়ে পাকিস্তানি সেনাদের আচমকা গোলা-গুলি হয়। এর পর থেকে বিদ্যুত-পানি সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে লালখান বাজারে পানি সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে।

৩০ মার্চ সকালে 'দামপাড়া ওয়াসার মোড়ে কল থেকে পানি দেয়া হচ্ছে' গুজব ছড়িয়ে পড়লে লালখান বাজার এলাকার এলাকাবাসীরা গুজবের সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে প্রয়োজনীয় পানি আনতে ওয়াসার মোড়ে জড়ো হয়, হটাৎ পানির জন্য অপেক্ষমান এলাকাবাসীদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু করে পাকিস্তানী হায়েনারা, গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শতশত মানুষ, রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ সহ আশেপাশের সবকিছু। [৩]

চট্টগ্রামের কথা যখন আসছেই তখন চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি দামপাড়া বধ্যভূমির কথা একটু বলে নেয়া যায়। গরীবুল্লাহ শাহ মাজার এই বধ্যভূমির অনেকটা অংশই মাজার কর্তৃপক্ষ দখল করে রেখেছে। এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেনা পাহারায় ৫/৬টি ট্রাক বোঝাই জীবন্ত মানুষ এখানে ধরে নিয়ে আসা হতো। লাশ পুঁতবার জন্য গভীর গর্ত খনন করা হতো। তারপর চোখ বেঁধে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো। মাত্র কয়েকদিনের লাশে এই গভীর গর্ত ভর্তি হয়ে গেলে সদ্যমৃত লাশগুলোকে ট্রাকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হতো। ধারণা করা হয় এখানে আনুমানিক ৪০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। [৪]

গত ১২ আগস্ট ২০১৫ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাগেরহাটের রাজাকার নেতা সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ। জানা যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় ওনার রুটিন ছিল প্রতিদিন সকালে কিছু হিন্দু আর মুক্তিদের নিজ হাতে জবাই করা। তারপর সিরাজ মাষ্টার নাস্তা করতে বসতেন। তার সম্পরকে খুব প্রচলিত একটা উক্তি ছিলো জবাই করার আগে সে বলতো-

"বাবারা নড়াচড়া করিস না,
তোদেরও কষ্ট হয় আমারও কষ্ট হয়…" [৫]

নারী নির্যাতনের ঘটনা না জানলে আসলে পাকিস্তানি বাহিনীর নিপীড়নের মাত্রা বোঝা যায় না। তপন কুমার দে লিখিত "বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ" গ্রন্থ থেকে একটি ঘটনা উদ্ধৃত করা যায়-

"১৯৭১ সালের ১০ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বিক্রম সিং ক্ষিপ্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে সাতক্ষীরার দিকে যাচ্ছিলেন। তার সাথে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মূসা সাদিকসহ অন্য কয়েকজন। হঠাৎ মাহমুদপুর ঘোনার মাঝামাঝি স্থানে তাঁর গাড়ির সামনে এসে দাড়ায় তিন কৃষক ও দুই বালক। যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আচমকা এই ঘটনায় সতর্কতার সাথে গাড়ি থামিয়ে ক্যাপ্টেন বিক্রম সিং জানতে পারলেন ঘটনা – কাছের একটি মসজিদে পাকিস্তানী খান সেনারা ঘাঁটি করে কয়েক মাস থেকে তাদের এলাকার ১১টি মেয়েকে আটকে রেখেছে। এরা মৃত না জীবিত তার কোন খবর তারা পাচ্ছে না।

সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন বিক্রম সিং তার ফোর্স নিয়ে মসজিদের দিকে যান এবং কিছু দূর থেকে গুলি ছোঁড়েন, পাল্টা জবাব না পেয়ে তিনি মসজিদের কাছে গিয়ে মেয়েদের কান্নার শব্দ শুনতে পান। সাথে সাথেই তিনি বাঙালিদের ডেকে বললেন, সেখানে পাকিস্তানি সৈন্য নেই। এ কথা শুনে লোকজন হুড়মুড় করে মসজিদে ঢুকে দেখেন তাদের ১১ জন কন্যা মসজিদের মধ্যে বিবস্ত্র অবস্থায় একে অপরকে ধরে লজ্জা নিবারনের চেষ্টা করছে, আর অঝোরে কাঁদছে। পাক সেনারা কোন সময় যে এখান থেকে চলে গেছে তা তারা জানেই না।

ক্যাপ্টেন বিক্রম সিং শিশুর মত কেঁদে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতে নিজের মাথার পাগড়ি খুলে- পাশের লোকদের হাতে তুলে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে চলে যান গাড়িতে।" [৬]

ডা. এম এ হাসান প্রণীত "শীর্ষ পনেরো পাকি যুদ্ধাপরাধী" গ্রন্থে বেশ কয়েকজন সাক্ষি কথা বলেছেন। সাক্ষী- এ কে এম আবু ইউসিফ সিদ্দিকের সাক্ষ্য উঠে এসেছিল স্টেডিয়ামে বন্দি বাঙালি নারীদের কথা-

"স্টেডিয়ামে অসংখ্য মহিলাকেও বন্দী করে রাখা হয়েছিল। মেয়েদের রাখা হয়েছিল আমাদের পাশের একটা রুমে। সব মেয়েকে এক জায়গায় রাখা হত। আমি আমার রুম থেকে মেয়েদের দেখতে পেতাম। পাকি আর্মি ওদের উপর আমাদের মতই নির্যাতন করত। অনেক মেয়েদেরকে আমাদের সামনেও অত্যাচার করত। ওরা মেয়েদের স্তন কেটে ফেলত। যৌনাঙ্গে রাইফেলের নল ঢুকিয়ে গুলি করত। অত্যাচারে মেয়েদের শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলত। এসব আমাদের চোখের সামনেই হতে দেখেছি। যতটুকু দেখেছি তার বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। নির্যাতিত নারীদের মধ্যে যারা কথা বলতে পারত, তারা চিৎকার করে বলত 'আমরা তো মরে যাব, আপনারা যদি কেউ বেঁচে থাকেন আমাদের মৃত্যুর খবরটা বাড়িতে পৌঁছে দেবেন।' ওখানে প্রায় একশ' পঁচিশজন মহিলা বন্দী ছিলেন। এসময় মহিলাদের বাঙালিরাই পাকিদের হাতে ধরে দিত। পাকি আর্মি মহিলাদের মুরগি বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু, জামায়াতের এখন বড় নেতা, আমি তাকে প্রত্যক্ষভাবে কমপক্ষে পঁচিশ বার দেখেছি মেয়েদের আনা নেওয়া করতে। বাঙালি পিস কমিটির সদস্য আলাউদ্দিন, আফজাল উকিল, ময়েজ উদ্দিন উকিলসহ অনেকেই স্টেডিয়ামে যাতায়াত করত, মুসা বিন শমসের তো পাচারি, প্রথম থেকেই এসব কাজে জড়িত ছিল। মেয়েদের ধরিয়ে দেওয়ার ফলে মেজর আকরাম কোরেশীর সাথে তার সখ্য খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল।" [৭]

বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকায় ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে দিনাজপুরের টিঅ্যান্ডটি অফিসে এক নির্যাতন কক্ষের খোঁজ পাওয়া যায় যার মেঝেতে পাওয়া গিয়েছিল ৩ ইঞ্জি পুরু জমাট বাঁধা রক্ত। সেই প্রতিবেদনে লেখা হয় এমন করে-

"একটি টর্চার সেলের মেঝেতে যখন ১০০০০ বাঙালিকে নির্যাতনের পর ৩ ইঞ্চি পুরু রক্ত জমাট বেঁধে যায়। দেয়ালে-জানালায়-সিলিং এ যখন শুকনো রক্ত লেপ্টে থাকে। তখন সহজেই বোঝা যায় সশস্ত্র প্রিডেটর জন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস রক্তারক্তির প্রিডেটর অ্যান্ড প্রে খেলা যেকোন মানুষের ভেতরেই স্নায়বিক অসুস্থতা তৈরি করবে।

হোক সে একজন কার্ডিয়াক সার্জন, যার অসংখ্য বাইপাস সার্জারীর অভিজ্ঞতা আছে কিংবা একজন ফরেনসিক ডাক্তার, লাশকাটার ঘরে যার অহরহ যাতায়াত। ইস্পাত স্নায়ুর পরীক্ষা দিতে হবে তাদেরকেও।

৭১-এ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বোবা জড় নরম দোঁ-আশ মাটি তার প্রিয় "অ্যাভাটার" অসংখ্য বাঙালির মৃতদেহের গড়িয়ে পড়া রক্ত শুষে নিয়েছিলো। কোরবানির জবাইখানার মতো রক্ত জমাট বেঁধে ছিলো বাছুর দৌড়ানোর মেঠো পথে, সবুজ ঘাসের দাড়িয়াবান্ধা খেলার মাঠে। একেবারেই শুষ্ক-অসিক্ত-নিরাবেগভাবে বলছি কথাগুলো। মাস্টার অ্যান্ড দ্য কমান্ডার টিক্কার শিকারী কুকুরের দল পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙালির রক্ত মাংস নিয়ে এমনই এক কামড়াকামড়ি করেছিলো দিনাজপুর টিঅ্যান্ডটি অফিসে। লাশকাটার ডোমঘরগুলোও লজ্জা পাবে টিক্কার কুকুরের দলের কাছে…" [৮]

ডঃ এম এ হাসানের কালজয়ী গ্রন্থ "যুদ্ধ ও নারী" থেকে একটা ঘটনা উদ্ধৃত না করলে এই লেখা অসমাপ্ত থেকে যাবে-

"আমার পাশেই একটা মাইয়া ছিলো। দেখতে যেমন সুন্দর,বয়সটাও ছিল ঠিক। আর তারেই সবাই পছন্দ করত বেশি। তাই তার কষ্টও হইত বেশি বেশি। একদিন দুই তিনজন একলগে আহে। এরপর সবাই তারে চায়। এই নিয়া লাগে তারা তারা। পরে সবাই এক সঙ্গে ঝাঁপায় পড়ে ঐ মাইয়াডার উপর। কে কি যে করবে, তারা নিজেরাই দিশা পায়না। পরে একজন একজন কইরা কষ্ট দেয়া শুরু করে। তখন সে আর সইতে না পাইরা একজনরে লাথি মাইরা ফেলাইয়া দেয়। তারপর তো তারে বাঁচায় কেডা। হেইডারে ইচ্ছামত কষ্ট দিয়ে মাইরা ঘর থাইকা বের হয়ে যায়। আমরা তো ভাবছি, যাক বাঁচা গেল। কিন্তু না, একটু পরে হে আবার আহে, আইসাই বুটজুতা দিয়ে ইচ্ছামতো লাইত্থাইছে। তারপরে গরম বইদা (ডিম) সিদ্ধ করে তার অঙ্গে ঢুকায় দেয়। তখন তার কান্না, চিল্লাচিল্লি দেখে কেডা। মনে হইছিল যে,তার কান্নায় দেয়াল পর্যন্ত ফাইটা যাইতেছে। তারপরেও তার একটু মায়া দয়া হলো না। এক এক করে তিনটা বইদা ঢুকাল ভিতরে। কতক্ষণ চিল্লাচিল্লি কইরা এক সময় বন্ধ হয়ে যায়।

তার পরের দিন আবার হেইডা আহে। আর কয় চুপ থাকতে। চিল্লাচিল্লি করলে বেশি শাস্তি দিব। সেই মেয়ের কাছে গিয়ে দেখে তার অবস্থা খুব খারাপ। তখন বন্দুকের মাথা দিয়ে তার ভেতরে গুতাগুতি করছে। আরেকজন তার পেটের উপর খাড়াইয়া বইছে। আর গড় গড়াইয়া রক্ত বাইর হইতেছে। যেন মনে হয়,গরু জবাই দিছে। সে শুধু পড়েই রইল। প্রথমে একটু নড়ছিলো পরে আর নড়ল না। তারপরেও তার মরণ হইল না। ভগবান তারে দেখল না। এমন কত রকম নির্যাতন করে প্রতিদিন। এই অবস্থায় বাইচা ছিল সাত-আট দিন। পরের দুই দিন চেতনা ছিল না। এক সময় অবশেষে মরল…" [৯]

১৯৭১ সালের রাজনৈতিক ঘটনাগুলোকে আমরা বহুমাত্রিক মূল্যায়ন করি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন বিজয় ইত্যাদি নিয়ে আমরা আলোচনা করি। দুঃখজনকভাবে আমাদের আলোচনাগুলো থেকে বাদ পড়ে যায় গণহত্যার বিষয়গুলো। এই দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৯৪২টি বধ্যভূমি, প্রায় ৩০০০ গণকবর। এই দেশের এমন একটি জেলা নেই, এমন একটি থানা নেই, এমন একটি ইউনিয়ন নেই, এমন একটি গ্রাম নেই যেখানে পাকিস্তানী বাহিনী নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ করেনি। আর সেই হত্যাকাণ্ডগুলো এমন ভয়ানক ভাবে তারা করেছিল যে হিটলারও লজ্জিত হয়ে যেতো।

যেই তিরিশ বা তার অধিক লক্ষ মানুষ এই জমিনে শুয়ে আছে, যাদের অনেকের কবর পর্যন্ত হয়নি সেই প্রত্যেকটা হত্যাকাণ্ডের আলাদা আলাদা একটা ঘটনা আছে। সেই ঘটনাগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে আনা আমাদের কর্তব্য।

তথ্যসূত্র
১. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সংগৃহীত তথ্য সূত্র: একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৮৯; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৯।
২. দৈনিক পূর্বদেশ, ৮.১.১৯৭২, দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ২০ জুলাই ২০১৩ সালে প্রকাশিত ডঃ মুনতাসির মামুনের লেখা "মুজাহিদের দন্ডের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ অপরাধমূলক রাজনীতি প্রতিরোধ" শিরোনামের কলাম থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত।
৩. রণাঙ্গণে সূর্যসৈনিক-সাখাওয়াত হোসেন মজনু, মুক্তিযুদ্ধের দু'শো রণাঙ্গন-মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি।
৪. বধ্যভূমির গদ্য পৃ.-৬৫, একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর – সুকুমার বিশ্বাস, পৃ.-৫৭; যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ – ডা. এম এ হাসান, পৃ.-৩৮১; মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ড – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, পৃ.-২৬১; দৈনিক বাংলা, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।
৫. যুগান্তর, আগস্ট ১২, ২০১৫।
৬. "বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও নারী ধর্ষণ"- তপন কুমার দে
৭. "শীর্ষ পনেরো পাকি যুদ্ধাপরাধী" – ডা. এম এ হাসান
৮. বাংলাদেশ অবজারভার, ফেব্রুয়ারী ১১, ১৯৭২
৯. "যুদ্ধ ও নারী" – ডঃ এম এ হাসান