গণহত্যার নতুন হিসাব

মুনতাসীর মামুন
Published : 16 Dec 2017, 10:25 AM
Updated : 16 Dec 2017, 10:25 AM

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল সেটি নিয়ে ইদানিং আগ্রহ-বিতর্ক দুই দেখা দিয়েছে। বিষয়টি আমি একেবারে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করিনি। কেননা এই বিতর্ক এবং তারপর আগ্রহ গণহত্যার বিষয়টি আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করে তুলেছে। সম্প্রতি ইয়েমেন, সুদান প্রভৃতি দেশে বিশেষ করে মিয়ানমারের সামরিক সরকার ও অংসান সুচির সরকার যৌথ সম্মতিতে রাখাইন রাজ্যে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাতে এটি প্রমাণিত যে, গণহত্যা বিষয় হিসেবে এখনও প্রাসঙ্গিক।

একটি গণহত্যায় কত জন নিহত হয়েছেন তার নির্ভুল সঠিক হিসেব আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। গণহত্যার তীব্রতা, স্থায়িত্ব, জনসংখ্যা সব মিলিয়ে গণহত্যায় নিহতদের আনুমানিক হিসাব করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপজুড়ে নাজি, ফ্যাসিস্ট ও ফ্যালানজিস্টরা যে গণহত্যা চালায় তার সময়সীমা ছিল চার বছরের বেশি। এলাকার ব্যাপকতা ছিল।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ খুবই ছোট, জনঘনত্ব খুব বেশি। সে কারণে এখানে গণহত্যায় একটি সুবিধা পায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, শান্তিকমিটির সদস্যরা, রাজাকাররা। অর্থাৎ এখানে গণহত্যা ধীরে ধীরে দীর্ঘদিন ধরে হয়নি। দ্রুত হয়েছে এবং জনঘনত্ব থাকায় বেশি মানুষ হত্যা সম্ভব হয়েছে। যেমন, চুকনগরে কয়েক ঘণ্টায় প্রায় ১০,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের গণহত্যার বৈশিষ্ট্য হল, এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ কোথাও আর হত্যা করা হয়নি।

এ প্রেক্ষিতে, যুদ্ধশেষে গণহত্যার হিসাবটা শুরু হল। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা জানাল, গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা ৩০,০০০,০০ (ত্রিশ লক্ষ)। অনেকে বলতে পারেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিলেন– '৩০ লক্ষ হত্যা কর, বাকিরা আমাদের হাত থেকে খাবার খুঁটে খাবে'– প্রাভদা কর্তৃপক্ষ হয়তো সেটি মনে রেখেছিল এবং সে আলোকেই ঘোষণা করেছিল ৩০ লক্ষ নিহত হয়েছিল।

সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপ নামে একটি জরিপ করেছিল জাতিসংঘ এবং তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬০০০ থেকে ১২০০০ মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। এ হার গণহত্যার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।

[Among the genocides of human history the highest number of people killed in lower span of time is in Bangladesh in 1971. An average of 6000 to 12000 people were killed every single day… This is the highest daily average in the history of genocide.]

জাতিসংঘ অনুমিত সর্বোচ্চ গড় ধরলে বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা ৩০ লক্ষ পেরিয়ে যায়।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হলে বাংলাদেশের গণহত্যা আবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। পাকিস্তান প্রতিবাদ করে, বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত প্রতিবাদ করে। এই কারণে গণহত্যার দায় হ্রাস পায়। এটি যে কোনো যুক্তি নয় সেটি বুঝিয়েও লাভ নেই। পাশ্চাত্য প্রথমে খানিকটা শঙ্কা প্রকাশ করেছিল এ কারণে যে, গণহত্যা যারা চালায় এবং যারা সমর্থন করে তাদের অপরাধও সামান্য নয়। কিন্তু পরে তারা শঙ্কামুক্ত হয় এ কারণে যে, যারা অপরাধ সমর্থন করেছিল তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কিছু বলেনি, বলার ক্ষমতাও রাখেনি। আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কী করার আছে? তবে ঐ যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল তার রেশ মিলিয়ে যায়নি।

গণহত্যায় সরকার যে হিসাব দেয় সেটি সারা বিশ্ব মেনে নেয়। বাংলাদশে সরকার বলেছে, গণহত্যায় ৩০ লক্ষ নিহত হয়েছিল আমরা সেটি মেনে নিয়েছি। গণহত্যা বিতর্ক শুরু হতে পেরেছে তার কারণ গণহত্যাকে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রে রাখা হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের মূল বৈশিষ্ট্য গণহত্যা-নির্যাতন।

এ কারণে আমরা কিছু কাজ শুরু করি। প্রথমেই খুলনায় আমরা দেশের প্রথম গণহত্যা-নির্যাতন জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করি। এ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিগতভাবে আমি উদ্যেগে নিই। আমরা গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালা প্রকাশ করি, ইংরেজিতে যাকে বলা যেতে পারে 'জেনোসাইড ইনডেক্স'। এ গ্রন্থমালার মূল বৈশিষ্ট্য বাংলদেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান। এ অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে গণহত্যা ঘটেছে তারা জানেন, কিন্তু বিস্তারিত নয়। অনেক স্থান নদীভাঙনে তলিয়ে গেছে। অনেক স্থান দখল হয়ে গেছে। অনেক স্থান বিস্মৃত।

আমরা প্রতিটি গণহত্যার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শী, বেঁচে যাওয়া মানুষ, আত্মীয়-স্বজন এদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। স্থান চিহ্নিত করে অনেক জায়গায় ফলক লাগিয়েছি। গণহত্যা সম্পর্কে এখন অনেকেই বলেছেন। আমরা ৫০টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছি এই গ্রন্থমালায়। এই ৫০টি গণহত্যার সিংহভাগের নাম আমাদের অনেকে শোনেননি। অর্থাৎ আমরা গণহত্যা সম্পর্কে যা জানি তার বাইরেও গণহত্যা হয়েছে।

গণহত্যা-গণকবর-বধ্যভূমি সম্পর্কিত তিনটি স্ট্যান্ডার্ড রেফারেন্স বই হচ্ছে– সুকুমার বিশ্বাস, একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, ঢাকা, ২০০০, আমার সম্পাদিত, মুক্তিযুদ্ধকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা, ২০১৩ এবং ডা. এম এ হাসান, গণহত্যা যুদ্ধাপরাধ ও বিচারের অন্বেষণ, ঢাকা, ২০০১।

আমরা গণহত্যার যে নির্ঘণ্ট প্রকাশ করছি তাতে এমন অনেক গণহত্যার কথা আসছে যা ঐ বই তিনটিতে নেই। এরপর মনে হয় ৬৪ জেলায় গণহত্যা গণকবর বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র সম্পর্কে একটি জরিপ চালালে কেমন হয়। এর জন্য প্রচুর অর্থ ও লোকবল দরকার। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে জাদুঘরের অধীনে কাজটি শুরু করি। যাদের ওপর এ দায়িত্ব দেওয়া হয় তারা সবাই পরিশ্রমী ও কমিটেড। অর্থ তাদের কাছে মুখ্য নয়। গত ৪৬ বছরে এ ধরনের জরিপের কথা কেউ ভেবেছে বলে মনে হয় না। জরিপ যারা করেছেন তারাও পূর্বোল্লিখিত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। এ জরিপের প্রাথমিক ফলাফল পাওয়া গেছে এবং সে ফলাফলে আমি বিস্মিত।

মুক্তিযুদ্ধ কোষ, দ্বিতীয় খণ্ডটি যদি মাপকাঠি হিসেবে ধরি তাহলে দেখি, ঐ গ্রন্থে মোট ৯০৫টি গণহত্যা গণকবর বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের নাম রয়েছে। গণকবর বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। আমাদের পাওয়া প্রাথমিক ফলাফলগুলি বিশ্লেষণ করা যাক।

নীলফামারী জেলা জরিপ করেছেন আহম্মদ শরীফ। ডা. হাসানের বইতে নীলফামারি জেলায় পাচঁটি গণহত্যার কথা সংকলিত হয়েছে। মোটামুটি এ জেলায় ৫/৬টি গণহত্যা ও কিছু গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের কথা এলাকার মানুষও জানতেন। শরীফের জরিপ অনুযায়ী, নীলফামারীতে খোঁজ পাওয়া গেছে:

গণহত্যা: ১১
বধ্যভূমি: ৩৭
গণকবর: ১৭
নির্যাতন কেন্দ্র: ২০
মোট ৮৫টি।

শরীফ বগুড়া জেলায় ও জরিপ চালিয়েছেন, বগুড়া সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ কোষ এ বেশি তথ্য আছে। গণহত্যা- বধ্যভূমি ও গণকবর সম্পর্কে এ বইতে ১৪টির উল্লেখ আছে। শরীফ যে জরিপ করেছেন তার প্রাথমিক ফল:

গণহত্যা: ৪৫
বধ্যভূমি: ৩৩
গণকবর: ১৪
নির্যাতন কেন্দ্র: ৪১
মোট ১৩৩টি।

সুমা কর্মকার জরিপ করেছেন নাটোর জেলার। নাটোর সম্পর্কে তথ্য কম। মুক্তিযুদ্ধ কোষে নাটোরে গণহত্যা বধ্যভূমি গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা ৯টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুমা যে জরিপ চালিয়েছেন তাতে আমরা পাচ্ছি:

গণহত্যা: ৬৩
বধ্যভূমি: ২২
গণকবর: ১৮
নির্যাতন কেন্দ্র: ২৩
মোট ১২৬টি।

কুড়িগ্রাম জরিপ করেছেন আক্তার বানু। মুক্তিযুদ্ধ কোষে উল্লেখ করা হয়েছে ৪টি গণহত্যা, ১টি বধ্যভূমি ও ২টি গণকবরের, মোট ৭টির।

গণহত্যা: ১৭
বধ্যভূমি: ১৫
গণকবর: ১২
নির্যাতন কেন্দ্র: ৪২
মোট ৮৬টি।

পাবনায় জরিপ করেছেন রোকুনুজ্জামান বাবুল ও শিউলি খাতুন। মুক্তিযুুদ্ধ কোষে এ-সম্পর্কিত তথ্য দেখা যায়। সেখানে ১৩টি গণহত্যা ও ৮টি বধ্যভূমি-সম্পর্কিত তথ্য আছে, অর্থাৎ মোট ২১টি। বাবুল ও শিউলির জরিপ অনুযায়ী:

গণহত্যা: ৪২
বধ্যভূমি: ১৯
গণকবর: ১১
নির্যাতন কেন্দ্র: ১১
মোট ৮৩টি।

রাজশাহীর জরিপটি করেছেন মাহবুবর রহমান ও তাহসিনা শরমিন। সুকুমার বিশ্বাসের গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ আছে। তিনি রাজশাহী জেলায় বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পেয়েছিলেন ১৮টি। গণহত্যার হিসাব দেননি। মাহবুবর ও তাহসিনা যে জরিপ চালিয়েছেন তাতে নিম্নলিখিত ফলাফল পাচ্ছি:

গণহত্যা: ৭৫
বধ্যভূমি: ৮
গণকবর: ২৩
মোট ১০৬টি।

এখানে নির্যাতন কেন্দ্রের কোনো হিসাব এখনও পাইনি।

সাতক্ষীরা জেলায় জরিপ চালিয়েছেন ফাহিমা খাতুন। মুক্তিযুদ্ধ কোষে গণহত্যা গণকবর বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা ৭টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফাহিমার জরিপে পাওয়া গেছে:

গণহত্যা: ১৫
বধ্যভূমি: ১১
গণকবর: ৮
নির্যাতন: ৭
মোট ৩১টি।

রীতা ভৌমিক জরিপ চালিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলায়। সেখানে তিনি এই চারটি ক্ষেত্রে যা পেয়েছেন তার সংখ্যা:

গণহত্যা: ১৭৯
বধ্যভূমি: ২৩
গণকবর: ১০
নির্যাতন কেন্দ্র: ৪
মোট ২১৬টি।

গাইবান্ধার ওপর জরিপ করেছেন জহিরুল কাইয়ুম। গাইবান্ধা সম্পর্কেও আমাদের তথ্য ছিল। জহিরুলের জরিপ অনুসারে:

গণহত্যা: ৬
গণকবর: ৯
বধ্যভূমি: ৯
মোট ২৪টি।

মোট ৯টি জেলায় প্রাথমিক জরিপ অনুসারে যা পাচ্ছি তা হল–

গণহত্যা: ৪৫৩
গণকবর; ২২৬
বধ্যভূমি: ১৫৯
মোট: ৮৩৮।

৭টি জেলায় নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৯০টি। চারটি ক্ষেত্রে মোট সংখ্যা ১০২৮টি। আর সারা বাংলাদেশে যে তথ্য আগে পেয়েছিলাম যা মুক্তিযুদ্ধ কোষে সংকলন করেছিলাম তার সংখ্যা ৯০৫।

৯টি জেলায় সংখ্যা যদি হয় ৮৩৮টি তাহলে ৬৪ জেলায় সে সংখ্যা কত দাঁড়াতে পারে? তাহলে গণহত্যার সংখ্যা কি ৩০ লাখে সীমাবদ্ধ থাকে?

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে পারি। গণহত্যার যে হিসাব ১৯৭১ সালে দেওয়া হয়েছিল সেখানে উদ্বাস্তু শিবিরে মৃত্যুর সংখ্যা ধরা হয়নি। শিবিরের কর্তৃপক্ষও দিতে পারেনি। কিন্তু তৎকালীন পত্রপত্রিকায় এ-সম্পর্কিত বীভৎস রিপোর্ট ও ছবি ছাপা হয়েছে। একটি ছবিতে দেখেছি মহামারীতে মৃত্যু হয়েছে এমন মরদেহ কুকুরে খুবলে খাচ্ছে। আমেরিকার লাইফ পত্রিকার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, শকুনরা এসব মৃতদেহ এত খেয়েছে যে তাদের অরুচি ধরে গেছে। সেই সংখ্যা অবশ্য গণহত্যার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

তাহলে শহীদের সংখ্যা কত দাঁড়ায়? এ বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকা রয়েছে।