রূপসী কন্যার জন্মদিনে প্রত্যাশা

Published : 17 Dec 2017, 11:58 AM
Updated : 17 Dec 2017, 11:58 AM

রূপে অনন্য, সাজে অপরূপ, চিরসবুজময় রূপসী বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দিন ষোলই ডিসেম্বর। জাতির বীরত্বের কীর্তিগাথা রচনার এক অবাক-করা স্বীকৃতির দিন আজ। বছর ঘুরে আবার ফিরে এল ১৬ ডিসেম্বর। এ দিন সকল বাংলাদেশির মহাআনন্দের দিন। বিশাল এক অর্জন এবং স্বপ্নপূরণের দিন। এ বিজয় অন্যসব বিজয়ের অনেক ঊর্ধ্বে। এই বিজয়ের আনন্দের সীমা-পরিসীমা নেই। তাই আজ আবারও সমগ্র বাংলাদেশ এবং জাতি বিজয়উল্লাসে মেতে উঠবে। বাংলার আকাশে-বাতাসে অনুরণিত হবে জয়ধ্বনি। 'জয় বাংলা বাংলার জয়'।

এ দেশ কী করে আমাদের হল? এই একটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার জানা থাকা কর্তব্য। এই প্রশ্নের উত্তর যদি জানা না থাকে কিংবা জেনে রাখার গরজ না থাকে তাহলে ছেচল্লিশ বছর বয়সী এই রূপসী কন্যার প্রেমে পড়া যে কারও পক্ষে সম্ভব নয়। এই রূপসীর বয়স যত বাড়ছে, তার রূপশ্রী (গণতন্ত্র, অসাম্পদায়িক চেতনা, উন্নয়ন, অগ্রগতি, শান্তি, সহিঞ্চুতা ইত্যাদি) ততই বৃদ্ধি পাবার কথা। পার করে আসা ছেচল্লিশটি বসন্ত কী বলে? এই হিসাব-নিকাশও জানা থাকা দরকার। অন্তত দেশের একজন নাগরিক হিসেবে।

১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়। পরবর্তীতে ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভারত। নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত হয়– পূর্ব পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে অবস্থিত এ দুটি অংশের মধ্যে মিল ছিল কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এর পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের তুলনায় নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ তেইশ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ-বঞ্চনার ইতিহাস।

'৫২এর ভাষা আন্দোলন, '৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০এর নির্বাচন, অতপর রঞ্জিত রাজপথ ধরে এল '৭১এর মুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রাম কোনো জাতিবিদ্বেষ থেকে উদ্ভূত সংগ্রাম ছিল না। এই সংগ্রাম আবেগপ্রসূতও নয়। এই সংগ্রাম ছিল বাঙালি জাতির ভবিষ্যত নির্ধারণের এক অনিবার্য পরিণতি। এছাড়া যে অন্য উপায় ছিল না। এই যুদ্ধের মহান সেনাপতি ছিলেন এমন একজন যাঁর নেতৃত্বে এই যুদ্ধে জয়ী না হওয়াটাই ছিল অবাক হওয়ার মতো বিষয়। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই মহান সেনাপতি। এমন নেতা না জম্মেছেন আগে, না জম্মাবেন পরে। এই বীরের নেতৃত্বে পুরো জাতি বীর হয়ে ওঠার যে অনুপ্রেরণা পেল তার সুফল এবং প্রাপ্তিই হল বাংলাদেশ। যার বয়স সদ্যই ছেচল্লিশ পূর্ণ হল। শুভ জন্মদিন তোমায় প্রিয় জননী বাংলাদেশ।

সদ্য জন্ম নেওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ এবং ছেচল্লিশ বছর বয়সী বাংলাদেশের মধ্যে যেন আকাশ-পাতাল ব্যবধান। যে দেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেল সেই পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে বাংলাদেশ। গণতন্ত্র, রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, শান্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতির বিকাশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে তা আজ সকলের কাছে দৃশ্যমান। কিন্তু বিশাল জনসংখ্যার ভার নিয়ে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের সামনে অনেক প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা এসেছে। ভেতর-বাইরের গভীর ষড়যন্ত্র, আত্মঘাতী রাজনীতি, লাগামহীন দুর্নীতি, ধর্মীয় গোঁড়ামি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র আজও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে ক্ষতবিক্ষত করছে।

'৭১পূর্ববর্তী এবং ৭১'পরবর্তী দেশপ্রেমের প্রশ্নে এদেশের মানুষের মধ্যে এক বিশাল পরিবর্তন চলে এসেছে। '৭১পরবর্তী এদেশের এক শ্রেণির মানুষ যে আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠেছে এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। আজ আমরা এদেশের আলো-বাতাস এবং অন্নে লালিত-পালিত হয়েও এদেশের বুকে ছুরি চালাতে দ্বিধা বোধ করছি না। ধর্ম এবং জাতসম্প্রদায়ের ধোয়া তুলে একে অপরের উপর হামলে পড়ছি। অথচ এটা বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য নয় এবং এদেশের মানুষের চরিত্রও নয়। তবু কেন যেন তারা আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকতাও। অপরাধ করে পেয়ে যাচ্ছে পার। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি না যে, এতে সামগ্রিকভাবে আমাদের সকলের ক্ষতি হচ্ছে।

পরাধীনতা থেকে কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড মুক্ত করার নাম দেশের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা ছেচল্লিশ বছর আগে লাভ করেছে এদেশের জনগণ। ক্ষুধা, দারিদ্র, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং বৈষম্য চিরতরে অবসানের চেতনা ও শপথ নিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই লক্ষ্য এখনও পূরণ হয়নি। এর দায় কার?

এখন তো পাকিস্তানি শাসন-শোষণ নেই। 'হরিণের শত্রু হল তার মাংস'। এদেশের বিপথগামী কিছু মানুষ আজ এদেশের সার্বিক ক্ষতি করে চলেছে। এদের ফেরাতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বেপথু না হওয়ার আগে তাদেরকে রক্ষায় আগাম ব্যবস্থা নিতে হবে। পূর্বপুরুষেরা তিলে তিলে সম্পদ অর্জন করেন এবং অর্জিত সম্পদ রেখে যান তাদের উত্তরসুরীদের সুন্দর ও সুখী ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু সেই উত্তরসুরীরা যদি যোগ্য না হয় তাহলে পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া কিছুই তারা অবশিষ্ট রাখে না। সব কিছু তছনছ করে ফেলে।

আগামীর বাংলাদেশের যোগ্য প্রজন্ম যদি বর্তমান বাংলাদেশ গড়ে দিতে না পারে তাহলে এর মাশুলও দিতে হবে আগামীর বাংলাদেশ এবং এদেশের জনগণকে। '৭১এর পূর্ববর্তী আমাদের পূর্বসুরীরা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রেখে গেছেন। তার সুফল বিনা রক্তে এবং শ্রমে '৭১পরবর্তী উত্তরসুরীরা ভোগ করে চলেছে। কিন্তু সোনার বাংলা গড়ার যে ভার তারা উত্তরসুরীদের দিয়ে গেছেন সেটা যদি পালন করতে তারা ব্যর্থ হয় এর পরিণতিও আগামী প্রজন্মকে ভোগ করতে হবে। এটাই বাস্তবতা।

তাই শিক্ষার নামে কুশিক্ষা, অত্যাধুনিকতার নামে বর্বরতা, ধর্মের নামে ধর্মান্ধতার পথে যেন আমাদের ভাইবোনরা পা না বাড়াতে পারে সেদিকে পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়ে আমাদেরকে আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে। এটাই হোক এবারের বিজয় উদযাপনের সারবাণী।

জয়তু বাংলাদেশ।