দুই ব্রিগেডিয়ার

মো. আনোয়ার হোসেনমো. আনোয়ার হোসেন
Published : 16 Dec 2017, 05:33 AM
Updated : 16 Dec 2017, 05:33 AM

মুক্তিযুদ্ধে দুই ব্রিগেডিয়ারের কথা বলব। একজন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর। অপরজন হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর। এঁদের সম্পর্কে বলবার আগে ভূমিকা হিসেবে কিছু বলা দরকার।

বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা থানার একটি গ্রাম কাজলা। সেখানেই আমাদের বাড়ি। '৭১-এ কাজলায় আমাদের বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। এ বাড়ির সব সন্তান মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে। বিশেষ করে মেজর আবু তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে ১১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক হয়েছেন। সন্ধ্যার পর বাড়ির উঠানে গ্রামের মানুষ জড়ো হয় স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনতে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও রংপুরের রৌমারি-চিলমারি অঞ্চল এবং বিশেষ করে শেরপুর সীমান্তবর্তি কামালপুর রণাঙ্গনের যুদ্ধের খবর শুনলেই সবাই বুঝে যেত এ বাড়ির ছেলে তাহেরের নেতৃত্বে এসব যুদ্ধ হচ্ছে। আম্মা-আব্বার দোয়া-আশীর্বাদ নিয়ে আমাদের গ্রাম ও আশপাশের যুবকেরা ভারতে যেত মেজর তাহেরের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। শ্যামগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে কাজলায় আসতে গাড়ি বা রিকশায় চলার কোন রাস্তা ছিল না। রটনা ছিল আমাদের বাড়ীটি অস্ত্রের ডিপো। বর্ষায় পানি-কাদা-খাল পেরিয়ে এ গ্রামে হানা দিতে পাকিস্তানী বাহিনী ভয় পেত। 'আইয়া পড়ছে' – এমন চিৎকার কয়েকবার শোনা গেলেও ছিলিমপুর ও কান্দুলিয়া গ্রামের সীমানা মগরা খাল পেরিয়ে হানাদার বাহিনী কাজলায় আসেনি। তবে এতদিন যে আশংকা সবাই করেছে, তাই শেষ পর্যন্ত হলো। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এক পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে দুই প্লেটুন সৈন্য ও রাজাকারদের একটি বড় দল আমাদের বাড়ি ও গ্রাম ঘিরে ফেলে।

বাড়ীতে সেদিন আম্মা-আব্বার সাথে আমাদের সবার বড় আরিফ ভাই ও ভাবী তাঁদের শিশুপুত্রকে নিয়ে ছিলেন। মাত্র আগের রাতে তারা বাড়ি ফিরেছেন ভারতের বাগমারা শরনার্থি ক্যাম্প থেকে। বাগমারা শরনার্থি ক্যাম্প ও নদীতীরে আশ্রয় নেয়া মানুষজন কলেরার প্রকোপে পড়েছিল। নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া অগুনিত লাশের বেশির ভাগই শিশু। এ অবস্থায় নিরুপায় হয়ে আরিফ ভাই শিশুপুত্র বাপী ও ভাবীকে নিয়ে কাজলার বাড়ীতে ফিরে আসেন। তার পরদিন পাকিস্তানী আক্রমণ।

রাজাকারেরা বাড়ির জিনিষপত্র উঠানে ফেলছিল। আম্মা উর্দুতে কথা বলতে পারতেন। কাছে দাঁড়ানো পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনকে উদ্দেশ্য করে ধমকের সুরে বললেন এসব লুটপাট বন্ধ করতে। কেন তারা এসেছে জানতে চাইলেন। অবাক কাণ্ড। রাজাকাররা নিবৃত হলো ক্যাপ্টেনের নির্দেশে। গ্রামে ছড়িয়ে পড়া সৈন্য ও রাজাকারেরা অল্প বয়সী নারী ও গরু-ছাগল ধরে এনে জড়ো করেছে আমাদের বাড়ির বাইরের রাস্তায়। পাকিস্তানী ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। আম্মা বললেন, আমাদের নিতে এসেছ নিয়ে যাও। আমার গ্রামের এইসব মেয়েদের নিলে তোমাদের বিপদ হবে। আমি তোমার বড় অফিসারকে সব বলবো। তাতে কাজ হলো। শেষ পর্যন্ত আম্মা-আব্বা ও বড়ভাইজানদের নিয়ে হানাদার বাহিনী ফিরে গেল প্রথমে নেত্রকোনায় এবং একদিন পর ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউসে পাকিস্তানী আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টারে। সে সময় তাহের ভাইয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি থাকতেন ঈশ্বরগঞ্জে। তাদেরকেও গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। পাঠান ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদির খান বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় হানাদার বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। একই অঞ্চলে ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মেজর তাহের। পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে কাদির খান ছিলেন তাহেরের প্রশিক্ষক। জীবন-মরণ যুদ্ধে এখন তারা প্রবল প্রতিপক্ষ।

ব্রিগেডিয়ার কাদির খান তার অফিসে নিজেই কথা বললেন আব্বা-আম্মা ও বড়ভাইজানের সাথে। পরে শুনেছি কি অদম্য সাহস ও দৃঢ়তায় আম্মা কথা বলেছিলেন পাকিস্তানী অধিনায়কের সাথে। বলেছিলেন, আমার ছেলেরা তোমাদের বাহিনীতে ছিল। তারা কোথায় জানিনা। হয়তো মেরে ফেলেছো। তোমরা এই দেশকে ছারখার করে দিচ্ছ। তোমরাও রক্ষা পাবে না। কাদির খান বললেন, তাহের ও আপনার অন্য ছেলেরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তাদের জায়গায় আমি থাকলে হয়তো তাই করতাম। তাহের খুবই সাহসী কমান্ডো। আমার প্রিয় অফিসার ছিল সে। তাকে খবর পাঠাবেন সে যেন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। আপনাদের দেশ স্বাধীন হবে। তখন তাহেরের বড় প্রয়োজন হবে। সবাইকে সসম্মানে কাজলায় ফেরত পাঠালেন তিনি। যেখানে কাফনের কাপড় কিনে সবার অপেক্ষা, সেখানে অবাক বিস্ময়ে গ্রামবাসী দেখলো হাসিমুখে আব্বা-আম্মা-ভাইজানদের ঘরে ফেরা। মাথার উপর ছাতি ধরে তাদের বাড়ীতে পৌঁছে দিচ্ছে রাজাকারেরা! এ দৃশ্যের কথা স্মরণ করে গ্রামের মানুষের হাস্য-কৌতুক অনেকদিন চলেছে। কাদির খানের নির্দেশমত আরিফ ভাইজানদের অবশ্য ফিরে যেতে হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রায় এক বছর পর বড়ভাইজান আফগানিস্থান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত হয়ে দেশে ফেরেন।

মুক্তিযুদ্ধে কত বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। ব্রিগেডিয়ার কাদির খানকে নিয়ে তেমন একটি ঘটনা এবার বলবো। তার আগে বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তে কামালপুর শত্রু ঘাঁটি নিয়ে একটু বলতে হবে। সেই সূত্রে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ায় হরদেব সিং ক্লেয়ারেরও কথা আসবে। কামালপুরের পতন হলে দ্রুততম সময়ে ঢাকায় প্রবেশ সম্ভব হবে। গেরিলা বিশেষজ্ঞ মেজর তাহের তা বুঝেছিলেন বলে কামালপুরের শত্রু ঘাঁটি থেকে মাত্র ৮০০ গজ দূরে মহেন্দ্রগঞ্জে ১১ নম্বর সেক্টর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছিলেন। আমাকে স্টাফ অফিসার নিয়োগ করেছিলেন সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। সেই সুবাদে তাহের ভাইয়ের যুদ্ধ পরিকল্পনার কথা আমি জানতাম। কামালপুর – শেরপুর – জামালপুর – টাঙাইল হয়ে সবচেয়ে দ্রুত ঢাকা পৌঁছানো ছিল মেজর তাহেরের লক্ষ্য। কামালপুর দুর্গের দখল নিতে একের পর এক আক্রমণ করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। বস্তুত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থকে প্রচারিত রণাঙ্গনের সংবাদের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে থাকতো কামালপুরের কথা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও কামালপুরের যুদ্ধ আলোচনায় এসেছে। '৭১-এ মার্কিন যুদ্ধ সংবাদদাতা জ্যাক এন্ডারসন কামালপুরকে অভিহিত করেছিলেন 'ঢাকার প্রবেশদ্বার' হিসেবে।

১৪ই নভেম্বর তাহের ভাইয়ের জন্মদিন। এই দিনে কামালপুর শত্রু ঘাটি দখল করতে গিয়ে তাহের ভাই হাঁটুর উপর থেকে তাঁর বাম পা হারান। আমাদের পিতা-মাতা যারা সকল পুত্র-কন্যাকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠালেও নিজেরা বাড়ি ছেড়ে যাননি, তারাই কাজলা থেকে বহু দূরে গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসারত পুত্র তাহেরকে দেখতে এলেন নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। তাহের ভাইয়ের সাথে আমাকেও গৌহাটি পাঠানো হয়েছিল। আম্মা-আব্বার কাছ থেকে আমরা শুনলাম ব্রিগেডিয়ার কাদির খানের কারণে মৃত্যুর হাত থেকে তাদের বেঁচে আসার অবিশ্বাস্য কাহিনী। তাহেরের প্রতি কাদির খানের কুশল বার্তাও জানালেন আব্বা-আম্মা। মেজর তাহের আহত হওয়ায় কামালপুর দুর্গের পতন বিলম্বিত হয়েছিল। ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের লাগাতার আক্রমন ও অবরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত ১৯৭১-এর চৌঠা ডিসেম্বর তারিখে কামালপুর দুর্গের পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের ৭০ জন ও প্যারা মিলিটারি বাহিনীর আরো ৭০ জন সৈনিক সহ আত্মসমর্পণ করেন। পতন হয় কামালপুর দুর্গের। এই যুদ্ধে মিত্র বাহিনী কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারের সাথে আছেন তাহেরের অবর্তমানে আমাদের মেজভাই আবু ইউসুফ। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সৌদি বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে লন্ডন হয়ে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন সেক্টর কমান্ডার অনুজ মেজর তাহেরের নেতৃত্বে।

মেজর তাহেরের যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী কামালপুর দখলের পর যৌথ বাহিনী এগিয়ে যায় ঢাকার দিকে। সামনে শেরপুর হয়ে জামালপুর। পথে পাকিস্তানীদের পুতে রাখা ল্যান্ড মাইনের আঘাতে ভারতীয় মেজর জেনারেল গুরবক্স গিল ও ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার আহত হন। তারা দুজন একই জিপে ছিলেন। গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য জেনারেল গিলকে আনা হয়। এই হাসপাতালেই ভিআইপি কেবিনে চিকিৎসারত ছিলেন মেজর তাহের। মনে আছে জেনারেল গিল আসবার পরও তাহের ভাইকে ভিআইপি কেবিন থেকে স্থানান্তরিত করা হয়নি। জেনারেল গিল চিকিৎসা নিয়েছিলেন পাশের আরেকটি ছোট কেবিনে।

আহত ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার চিকিৎসার জন্য ভারতে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ৯ই ডিসেম্বর জামালপুরে পাকিস্তানী বাহিনীর অধিনায়ক ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের লে. কর্নেল সুলতানকে আত্মসমর্পণের জন্য পত্র পাঠান। পত্রবাহক ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সী জহুরুল হক। তা প্রত্যাখ্যান করে মুন্সীর হাতে একটি বুলেট সহ উত্তর পাঠান কর্নেল সুলতান। দুদিনও যায়নি। পাকিস্তানী দম্ভ ধূলিসাৎ হয়। জামালপুরের পতন হয় ১১ই ডিসেম্বর। টাঙাইল হয়ে ঢাকার পথে অগ্রসর হয় যৌথ বাহিনী। পথে নাটকীয় ঘটনা ঘটে। ১২ই ডিসেম্বর টাঙাইলে পলায়মান পাকিস্তানীদের একটি দল ঘেরাও হয়ে আত্মসমর্পণ করে। দেখা গেল ময়মনসিংহ সেক্টরের পাকিস্তানী অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদির খান আছেন এই দলে। ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার তাঁর লেখা '12 Days to Dacca' গ্রন্থের ৮৬ পৃষ্ঠায় কাদির খানের আত্মসমর্পণ প্রসঙ্গে বলছেন, "৯৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদির খান তাঁর পুরো স্টাফসহ আত্মসমর্পণ করেন। এই প্রথম এমন উচ্চপদস্থ একজন পাকিস্তানী অধিনায়কের আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটলো"। ১৬ই ডিসেম্বরে রেসকোর্স ময়দানে হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের ৪ দিন আগেই তা ঘটলো। এখন কাদির খান বন্দী। তার দেখা হবে মিত্রবাহিনীর সাথে ঢাকার পথে আগুয়ান ১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ ভাইয়ের সাথে। আম্মা-আব্বার কাছে আমরা আগেই জেনেছিলাম কাদির খানের কথা। ভারতীয় অধিনায়ক ক্লেয়ারকে সে কথা জানালেন ইউসুফ ভাই। যুদ্ধবন্দী ব্রিগেডিয়ার কাদির খানকে বললেন তিনি মেজর তাহেরের বড়ভাই। যুদ্ধ চলাকালে বন্দী করার পরও আমাদের পিতা-মাতা-ভাইকে সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিলেন বলে তাকে ধন্যবাদ জানালেন। এ কথা শোনার পর ইউসুফ ভাইকে জড়িয়ে ধরে অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন সুদূর পাকিস্তান থেকে বহু দূরে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এক রণাঙ্গনে বন্দী পাঠান সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদির খান। তাহের বেঁচে আছেন জেনে তিনি বারবার 'শুকরিয়া' প্রকাশ করছিলেন। বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ভারত থেকে ১৯৫ জন শীর্ষ পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীর সাথে ব্রিগেডিয়ার কাদির খান পাকিস্তানে ফিরে যান। পরে আমার অনেক সময় মনে হয়েছে পাকিস্তানী এই সেনানায়কের সাথে যোগাযোগ করে তার একটি সাক্ষাৎকার নেই। তা আর হয়ে উঠেনি।

তবে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার যিনি মেজর জেনারেল হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন, তার সাথে ৪৪ বছর পর আবার যোগাযোগ হয়েছিল ইমেইল-এ। আমাদের পুত্র সানজীবের ঐকান্তিক চেষ্টায় তা সম্ভব হয়। ৯১ বছর বয়সী জেনারেল ক্লেয়ার তখন ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাস করছিলেন। আমার পরামর্শে ইউসুফ ভাইয়ের ছেলে সালাহউদ্দিন ও তার স্ত্রী শম্পা আমেরিকা পরিভ্রমনকালে জেনারেল ক্লেয়ারের সাথে দেখা করে তাঁর ভিডিও সাক্ষাৎকার নেয়। তারিখটি ছিল ২০১৫ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর। মাত্র আট দিন আগে ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৫ – ৯১তম জন্মদিনে তার বাম পা হাঁটুর উপর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে মাইনের আঘাতে তার দুটো পা জখম হয়েছিল। তা নিয়েই এত বছর কষ্ট করেছেন।

হুইল চেয়ারে বসে জেনারেল ক্লেয়ার সাক্ষাৎকার দেন। এত বছর পরও যুদ্ধের সব কথা তার মনে আছে। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে নিয়াজির হেডকোয়ার্টারে আত্মসমর্পণ আলোচনাকালে ইউসুফ ভাই কর্তৃক নিয়াজির ইম্পালা স্টাফ কারের পতাকা উঠিয়ে নেয়া এবং পরে তারই পরামর্শে তার দেখানো পথে ধানমণ্ডিতে বন্দী বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাছে যাওয়া, সেখানে অবস্থানকারী পাকিস্তানী গার্ডদের নিরস্ত্র করে সরিয়ে দেয়া এবং বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী ও কন্যাদের সাথে চা পানের কথা আছে সে সাক্ষাতকারে। আছে নব্বইয়োর্ধ সর্দারজির মুখে 'হুসিনার' (শেখ হাসিনা) ও রেহানার কথা, 'ফাদার অফ দি নেশন'-এর নির্মম হত্যাকাণ্ডে তার ক্ষোভ ও কষ্টের কথা। দুঃখবোধ ও হতাশাও আছে। ১৭ই ডিসেম্বর ভারতীয় মেজর অশোকতারা সিং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সংগে ছবি তুলে বিখ্যাত হলেন, বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা পেলেন, কিন্তু ক্লেয়ারের নেতৃত্বে ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেডের সর্বপ্রথম ঢাকায় প্রবেশ এবং জেনারেল নাগরাকে সাথে নিয়ে নিয়াজির হেডকোয়ার্টারে আত্মসমর্পণ চুক্তি স্থির করা এবং ১৬ই ডিসেম্বরে সর্বপ্রথম পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী বঙ্গবন্ধু পরিবারকে মুক্ত করার বিরল কীর্তির কথা অপ্রকাশিত রয়ে গেল। জেনারেল ক্লেয়ারের ভিডিও সাক্ষাৎকার না পেলে সে খবর আমাদেরও জানা হতো না।

মেজর (পরে লে কর্নেল) আবু তাহের, বীর উত্তম এবং আবু ইউসুফ, বীর বিক্রম বেঁচে নেই। ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর সকালে শুধু মিত্র বাহিনীর সেনানায়কেরা নন, ১১ নম্বর সেক্টরের আহত অধিনায়ক তাহেরের অবর্তমানে তাঁর পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ উপলক্ষে জেনারেল নিয়াজির হেড কোয়ার্টারে প্রবেশ করেছিলেন, তারপরে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে মুক্ত করতে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারকে পথ দেখিয়ে ধানমন্ডিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব বা কীর্তির কথা সত্যিকারের বীরগণ তেমনভাবে প্রকাশ করার কথা ভাবেননি। সে জন্যই হয়তো বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাহত মহান সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ারকে সম্মাননা দিতে পারেনি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েছি কয়েকবার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই ভারতীয় বীরের কথা তাঁকে জানাবো যেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পাওয়ার গৌরব ও তৃপ্তি নিয়ে এই বৃদ্ধ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা ও ঔদার্যের কারনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের ৪০ বছর পর রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করেছিল ঐসব মহান বিদেশী বন্ধুদের, যারা মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ আমি পাইনি। আমি যে সাক্ষাৎ প্রত্যাশী, সে খবরটি পর্যন্ত তিনি পেয়েছিলেন কিনা তাও জানিনা। ৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর এক শিখ সেনানায়ক এবং সাথে বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফকে চা পানে আপ্যায়নের কথা তাঁর মনে পড়ে কিনা, তা জানা হলো না। গভীর বেদনার কথা, এক অতৃপ্তি নিয়েই জন্মভূমি থেকে বহু দূরে ক্যালিফোর্নিয়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের অকৃত্তিম বন্ধু মহাবীর চক্র হরদেব সিং ক্লেয়ার। 'মহাবীর চক্র' ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক খেতাব।

ব্রিগেডিয়ার কাদির খান এখনো বেঁচে আছেন কিনা জানিনা। থাকলেও পরাজিত হানাদার বাহিনীর যুদ্ধবন্দী ১৯৫ জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর একজন হয়ে দুর্বিষহ জীবনই হয়তো কাটাতে হচ্ছে পাকিস্তানী ৩৬ পদাতিক ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত ৯৩ এডহক ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার কাদির খানকে। যুদ্ধই মানুষের জীবনে এমন নিয়তি ডেকে আনে। এ কথা সত্য মূলত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মম গণহত্যা ও এক অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল আমাদের উপর। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে সমরনায়ক ইয়াহিয়া ও রাজনীতিবিদ বিশেষ করে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর অশুভ আঁতাতের ফলই হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর একটি ব্রিগেডের অধিনায়ক কাদির খানের যুদ্ধাপরাধের দায় নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এ প্রশ্নও মনে জাগে সুদূর পাঠান মুল্লুক থেকে বহু দূরে বাঙালীদের উপর চাপিয়ে দেয়া এক অন্যায় যুদ্ধে হয়তো ইচ্ছা বহির্ভূতভাবে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার কাদির খানকে। কি করে ভুলি প্রতিপক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর তাহেরের বন্দী পরিবারকে শুধু সসম্মানে মুক্তিই তিনি দেননি, তাহেরের কুশল কামনা করেছেন আন্তরিকভাবেই। যুদ্ধ মানুষকে পশুর পর্যায়ে অবনমিত করে, কিন্তু প্রবুদ্ধ মানুষ সে অবস্থা থেকেও ঘুরে দাঁড়াতে চায়। ন্যায়বোধ হয়তো একেবারেই সে হারিয়ে ফেলে না। খুব ভাবতে ইচ্ছা করে ব্রিগেডিয়ার কাদির খান ছিলেন তেমন একজন মানুষ।

এ প্রসঙ্গে ২রা জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে 'ডেইলি স্টার' পত্রিকায় "যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে একজন সাক্ষী অস্ত্র হাতে কামারুজামানকে দেখেছেন" শিরোনামের এক রিপোর্টকেও বিবেচনায় নেয়া যায়। রিপোর্টে দেখা যায়, বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধী বদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানের আইনজীবীর প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী দবির হোসেন ভূঁইয়া যিনি মুক্তিযুদ্ধকালে আগস্টের দ্বিতীয়ার্ধে ময়মনসিংহ জেলা কাউন্সিল রেস্টহাউসে আরো কয়েকজনের সাথে বন্দী ছিলেন, তিনি জানান অস্ত্র হাতে কামারুজামানকে সেখানে তিনি দেখেছেন। কামারুজামান বন্দীদের হত্যা করার জন্য নিয়ে যেতেন। ঐ বন্দী শিবিরে তার ২৬-২৭ দিন বন্দিত্বকালে এমন ৪ জন যাদের কামারুজামান নির্বাচন করে দিয়েছিলেন তারা আর ফিরে আসেননি। তিনি আরো জানান, যখন কামারুজামান তাকে তাঁর সাথে বন্দী হামিদ ও অন্য আরেকজনকে ব্রিগেডিয়ার কাদির খানের কাছে নিয়ে আসেন, তখন কাদির খান তাদেরকে ছেড়ে দিতে কামারুজামানকে নির্দেশ দেন"।

তবে এমনও হতে পারে ব্রিগেডিয়ার কাদির খান হয়তো ততদিনে বুঝে গেছেন তাদের আশু পরাজয়ের কথা। বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবে সে কথাতো তিনি আম্মাকে বলেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজার মাইল দূরে পরাজয় পরবর্তী দিনগুলোর কথা তিনি হয়তো ভেবেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বিচার হবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। তখন প্রতিপক্ষ মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক তাহেরের সহানুভূতি গুরুত্বপূর্ণ হবে। এসব ভেবে হয়তো মুক্তিযোদ্ধা অধিনায়ক মেজর তাহেরের পরিবারকে তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন, কামারুজামানের হাতে বন্দী তিনজন মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তি দিয়েছেন।

কোয়েন্টিন টারান্টিনো পরিচালিত অস্কার জয়ী চলচিত্র 'ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস'-এর মুখ্য চরিত্র জার্মান এসএস কর্নেল হান্স লান্ডার কথাও মনে পড়লো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মান অধিকৃত ফ্রান্সে হিটলারের বিশ্বস্ত এই কর্নেল প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ছিলেন খুবই তৎপর ও নিষ্ঠুর। কিন্তু যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে নাৎসি জার্মানির সমূহ পরাজয় আঁচ করতে পেরে কর্নেল রান্ডা প্রতিরোধ যুদ্ধের সেনানায়ক লেফটেন্যান্ট রাইনের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়ান এই আশায় যে যুদ্ধ শেষে তিনি মার্জনা পাবেন। তা অবশ্য হয়নি। কপালে এঁকে দেওয়া স্বস্তিকার চিহ্ন নিয়ে তাকে যেতে হয় কারাগারে।

পাকিস্তানে ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদির খানের বিষয়ে হামদুর রহমান কমিশনের সুপারিশটি নিম্নরূপঃ
Para 14 of Hamoodur Rahman Commission Report:

Maj. Gen. Nazar Hussain Shah, GOC 16 Division, conceded that "there were rumors that Bengalis were disposed of without trial." Similarly, Brigadier Abdul Qadir Khan (Witness No. 243) Commander 93 (Ad hoc) admitted that "a number of instances of picking up Bengalis did take place."

8. Cases Requiring Departmental Action

(3) The work and the conduct of Brig. Abdul Qadir Khan has come to the notice of the Commission in two capacities, namely as the President of the Inter-Services Screening Committee at Dacca and later as Commander of 93 (Ad hoc) Brigade under 36 Division. In the former capacity, he was responsible for the screening of military and civilian personnel as well as non-officials who had either defected during the Awami League movement or had otherwise come to adverse notice. Allegations were made that some persons in his custody were eliminated without trial, or even without any ostensible cause. However, the allegations were not substantiated so as to fix personal responsibility on him. As Commander 93 (Ad hoc) Brigade, he was captured by the Indians while withdrawing to Dacca from Mymensingh under the orders of Eastern Command. He seems to have reached his ceiling and the Commission formed the impression that his further retention in service would not be in the public interest. We were inferred by the GHQ representative that the Officer had since been retired.

এমনও হতে পারে জার্মান এস এস কর্নেল হান্স লান্ডার বিবেচনা থেকে নয়, ন্যায়বোধ ও বিবেকের দংশন মুহূর্তের জন্য হলেও ব্রিগেডিয়ার কাদির খানের মনকে আচ্ছন্ন করেছিল। মানুষের মনোজগৎ বড় বিচিত্র। কোন বিবেচনা ব্রিগেডিয়ার কাদির খানকে চালিত করেছিল '৭১-এর মধ্য সেপ্টেম্বরের কোন এক তারিখে ময়মনসিংহ সার্কিট হাউসে তার অফিসে প্রবল শত্রু তাহেরের বন্দী পিতা-মাতা-ভাই ও পরিজনদের ভাগ্য নির্ধারণে? কেনই বা তিনি বদর বাহিনীর কমান্ডার কামারুজ্জামানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন দবির হোসেন ভূঁইয়া, হামিদ ও আরেকজন বন্দী কে ছেড়ে দেয়ার? এ জীবনে তা আর জানা হলো না।