তলস্তয়ের বোদলেয়ার বিচার

জাহেদ সরওয়ার
Published : 8 August 2013, 03:30 PM
Updated : 8 August 2013, 03:30 PM

তলস্তয় তার অসামান্য বই শিল্প কী-এর দশম অধ্যায়ে বোদলেয়ারসহ অন্যান্য ফরাসি আধুনিক লেখকদের তুলাধূনা করেছেন, উড়িয়ে দিয়েছেন রীতিমত ফুঁ দিয়ে। শিল্পচেতনার ক্ষেত্রে এসবের অনেক কিছু তিনি শুধু অস্বীকারই করেননি, মানবজাতির জন্য ক্ষতিকর দাবি করে এসবের বিচারও করেছেন। অন্যদিকে বোদলেয়ারকে বলা হয় এমনেএকজন কবি, যিনি রোমান্টিকদের কাছ থেকে কবিতাকে অন্যদিকে, মানে যেদিকে তখনো কবি ও কবিতা পাঠকদের দৃষ্টি যায়নি, সেদিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কবিতার বাঁকফেরানোর নায়ক হিসাবে কাব্য জগতে প্রভূত সম্মানও পেয়ে থাকেন তিনি। জগতে হয়তো সর্বকালের পাঠ্য বইগুলোর মধ্যে ইতিমধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে তার F'leurs du Mal বা ক্লেদজ কুসুম।

জগতের অন্য অনেক নীতিবাদী যে কবি বা কবিতাকে আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করতে চেয়েছেন তা আমরা জানি। প্লাতনের রিপাবলিক কিতাব থেকে যখন কবিদের নির্বাসিত করা হয় তখন আমরা বুঝতে পারি কবি হৃদয় প্লাতনের অবগত। কারণ প্লাতন নিজেও একজন কবি ছিলেন। প্লাতন অবশ্যই কবিদের যে দায়ে দায়ী করেন তা রাজনৈতিক। তিনি বুঝেছিলেন কবি হৃদয় এমন এক আত্মা যা নিজেই রচনা করে নিজের সংবিধান।
প্রত্যেক ভাল কবিতাই কবির স্বরচিত সংবিধান। সেখানে তিনি বলেন তিনি কেমন জীবন/পৃথিবী চেয়েছিলেন আর কিভাবে জগতটা চলছে। এই সব সংঘর্ষ ও সঙ্কটই তো দেখা যায় কবিতা সৃষ্টির মূলে। এমন অনেক ঘটনা যা রাষ্ট্রও নিজের সার্বিক কল্যাণের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যায়। কিন্তু কবিরা সেটা লিখে রাখে কবিতার খাতায়।


তলস্তয় এখানে 'ক্ষয়িষ্ণু' শব্দটা উল্লেখ করে বলেন, কেবল অস্পষ্টতা, রহস্যময়তা, দুর্বোধ্যতা এবং স্বাতন্ত্র্যকেই (জনসাধারণকে দূরে সরিয়ে রেখে) যে শুধু শিল্পগুণের স্তরে উন্নীত এবং কাব্যশিল্পের শর্ত বলে মেনে নেওয়া হল তা নয়, এমনকি যাথার্থ্যহীনতা, অবয়বহীনতা এবং প্রকাশদৈন্যও মর্যাদার আসন লাভ করল। বিখ্যাত F'leurs du Mal- এর ভূমিকায় থিয়োফিল গোতিয়ের বলেছেন, 'বোদলেয়ার কাব্যের জগৎ থেকে বাগবিভূতি, আবেগ এবং সত্যের একনিষ্ঠ অনুকৃতিকে নির্বাসিত করেছেন।'

বোদলেয়ার শুধু এতেই ক্ষান্ত হননি, স্বীয় কবিতায় এই তত্ত্বকে অনুসরণও করেছেন। তাঁর Petits poems en prose- এর গদ্যে এই তত্ত্বের অনুসৃতি আরও উল্লেখ্যভাবে দেখা যায়। চিত্রাদির দ্বারা হেঁয়ালিপূর্ণভাবে নাম লিখনের মতো সে গদ্যের অর্থ অনুমান করে নিতে হয়। ফলে সে অর্থ অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনাবিষ্কৃতই থেকে যায়।'

আমরা জানি গদ্য আর কবিতার প্রকাশভঙ্গি আলাদা; শুধু আলাদা বললেও মনে হয় কম বলা হয়; বলা যায় একেবারে বিপরীত। গদ্যের কাজ সম্প্রসারণ আর কবিতার কাজ সংকোচন অর্থাৎ অল্পে অধিক বলা। গদ্যকার এবং কবি একই বিষয় নিয়ে কাজ করলেও প্রকাশের কারণে সেটা আলাদা হতে বাধ্য।
সম্মান দিয়েই বলছি, তলস্তয় ভাস্করের মতো লেখক। তিনি কলমের মাধ্যমে ভাস্কর্য রচনা করেন। সেটা আমরা তার বৃহদায়তন উপন্যাসসমূহ যুদ্ধ ও শান্তি, আনা কারেনিনা বা পুনরুজ্জীবন পড়লে দেখতে পাই। তলস্তয় কখনো কবিতা লিখেছিলেন বলে জানি না। ফলে একেবারেই একজন গদ্যলেখক ও গদ্যপাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকেই তলস্তয়ের কবিতা সম্পর্কে অভিযোগ মনে হয় খানিকটা এড়িয়ে যাওয়া যায়। তিনি 'অস্পষ্টতা' 'রহস্যময়তা' 'দুর্বোধ্যতা' ও 'জনসংযোগহীনতা'কে দায়ি করছেন বোদলেয়ারের কবিতায়।

জনসংযোগহীনতা প্রসঙ্গে বলা যায়, কবিতার গণপাঠক কল্পনাতীত। শেষ পর্যন্ত মায়াকোভস্কির মতো গণকবিকেও বলতে হয় 'জনরুচির গালে এক থাপ্পড়।'
সংগীতে রাগসংগীত যেমন গণশ্রাব্য নয়, তেমনি সাহিত্যে কবিতাও গণপাঠ্য নয়। রাগসংগীত বা কবিতা যে শুধু ধনিকশ্রেণি শ্রবণ করে এটাও সত্য নয়। কারণ তলস্তয় বারবার তার এই বইয়ে যা জনবিচ্ছিন্ন তাকেই সমাজের ভোগী শ্রেণি বা পুঁজিপতিদের সৃষ্ট বলে গালাগাল করেছেন।

অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্যতা ইত্যাদি প্রমাণ করার জন্য তলস্তয় এই বইয়ে বোদলেয়ার ছাড়াও হাজির করেছেন পল ভের্লেন ও মালার্মের রচনা। ভের্লেনের বিখ্যাত 'শিল্প সম্পর্কে' কবিতা (Art poetique) ও মালার্মের খানিকটা গদ্য উদদ্ধৃত করে তিনি এর উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। মালার্মে সম্পর্কে তলস্তয় বলেন, 'মালার্মে তরুণ কবিদের মধ্যে যিনি খুবই উল্লেখযোগ্য বলে বিবেচিত। তিনি সোজাসুজিই বলেন, কবিতার চমৎকারিত্ব নিহিত তার অর্থ অনুমানের মধ্যে- কবিতার মধ্যে সবসময় একটা ধাঁধা থাকবেইঃ
'আমার মতে পরোক্ষ উল্লেখ (allusions) ছাড়া আর কিছুরই স্থান থাকা উচিত নয়। বস্তুর অনুধ্যান, সেই বস্তু-অনুপ্রাণিত জাগর-স্বপ্নের চলমান মুর্তিই সংগীত সৃষ্টির উপাদান। পারনেশিয়ানরা (Parnassians- ফরাসি কবিগোষ্ঠী যারা কলাকৈবল্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী) সম্পূর্ণভাবে বস্তুর বিবরণ দেন, এবং বর্ণনায় তা দেখান। সুতরাং সৃজনকারী কল্পনায় তা রহস্যবঞ্চিত। তাঁরা মনকে সৃজনশীল কল্পনার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেন। কোন বস্তুর নামকরণ করার অর্থ একটা কবিতা উপভোগের বারো আনা ছেঁটে ফেলা। সে আনন্দ উপভোগ নিহিত অর্থকে অল্প অল্প করে অনুমান করে নেবার মধ্যে। ব্যঞ্জনা সৃষ্টি দ্বারা স্বপ্নকেই সৃষ্টি করা হয়। রহস্যের পুর্ণাঙ্গ ব্যবহারই প্রতীকঃ আত্মার অবস্থা প্রদর্শনের জন্য ক্রমশ বস্তুবোধকে জাগ্রত করতে হবে। অথবা বিপরীত ক্রমে প্রথমে একটি বস্তু নির্বাচন করতে হবে এবং স্তর পরম্পরায় সংকেতলিপির পাঠোদ্ধারের সাহায্যে সে বস্তু থেকে আত্মার অবস্থা বিমোচন করতে হবে।'
'.. . মধ্যম শ্রেণির কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি সামান্য সাহিত্যিক প্রস্তুতি নিয়ে এভাবে লিখিত পুস্তক খুলে তা উপভোগ করছেন বলে ভান করলে তাতে বিভ্রান্তিই ঘটবে–বস্তুগুলোকে আবার স্বস্থানে প্রেরণ করতে হবে। কবিতায় সব সময় হেঁয়ালি থাকাই উচিত। সাহিত্যের লক্ষ্য পাঠক-অন্তরে বস্তুরূপকে সঞ্চার করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।'
তলস্তয়ও তার এই বইয়ে বার বার বলেছেন, যা শিল্প তা পাঠক হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু সেই সঞ্চারিত অনুভব যেন মানবমনের সুস্বাস্থ্যের পক্ষে হয়। উপরোক্ত কবিতা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা নেহায়েত মালার্মীয়। গদ্যাংশটা পড়তে যদিও চমৎকার লাগে,খানিক কবিতার মতই, তবুও একথা আজকে বলা যায়, বস্তুর শব্দতান্ত্রিক নির্মাণের যে কবিতা তা আজ পাঠক ভুলে গেছে। এবং নির্মিত কবিতার দাফন হয়ে গেছে। কারণ নির্মিত কবিতার ভেতর আসল জিনিসটাই থাকে না। শব্দে প্রাণ প্রতিষ্ঠাই তো কবিতা। সেই প্রাণটাকে নির্মাণ করা যায় না। এটা একমাত্র তাদের কাজ যারা নিজেরাই প্রাণবন্ত। এই প্রাণকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রামই কবিজীবন। যা যাপন করতে পারেনি মার্লামীয় অধ্যাপকেরা। কিন্তু বোদলেয়ারের ক্ষেত্রে এই দুর্নাম দেয়া যায় না।

তলস্তয় এক্ষেত্রে ফরাসি সমালোচক ডুমিককে হাজির করে বলেন, এভাবে নতুন গোষ্ঠীর কবিদের মধ্যে অস্পষ্টতা একটা মতবাদে উন্নীত হল। ফরাসি সমালোচক ডুমিক যথার্থই বলেন, নতুন কবিগোষ্ঠী যে মতবাদকে কার্যত একটি অন্ধ বিশ্বাসে উন্নীত করেছেন– সে বিখ্যাত 'অস্পষ্টতা' তত্ত্বেরও অবসান ঘটাবার সময়ও এসে গেছে।'

তলস্তয় বোদলেয়ারের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেন।

Fleurs du mal ( flowers of evil)

অমঙ্গলের ফুল
২৪ নং

রাত্রির খিলানগুলির মতো আমি তোমাকে পুজা করি
ওগো শোকের তরি, বাগবিমুখ মহান,
তোমার উড়ন্ত সৌন্দর্যের জন্য তোমাকে আরো বেশি ভালোবাসি।
মনে হয় আমার রাত্রিকে সুন্দর করেছ তুমি, তুমি
যোজনের পর যোজন পুঞ্জীভূত করে চল, ব্যঙ্গের সঙ্গে পুঞ্জীভূত কর!
যা আমার আলিঙ্গন থেকে অসীম নীলিমাকে বিচ্ছিন্ন করে।
আক্রমণের জন্য আমি এগিয়ে যাই, আঘাত করবার জন্য আরোহণ করি,
সমাধিতে শবের দিকে অগ্রসর ক্ষুদ্র ক্রিমির ঐকতান সংগীতের মতো,
তোমার শীতলতা, ওগো নিষ্ঠুর অপ্রশম্য পশু!
তবু তা তোমার সৌন্দর্যকে তীব্রতর করে, যা আমার
দৃষ্টির পক্ষে ভোজ বিশেষ।

যদিও তলস্তয় মূল বইয়ে এইসব কবিতা ফরাসিতেই উদ্ধৃত করেছেন, ফরাসি থেকে আইলমির মড-কৃত ইংরেজি থেকে বাংলা করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ। ফলে কবিতাংশগুলো অনুবাদের অনুবাদ।

তবুও 'সমাধিতে শবের দিকে অগ্রসর ক্ষুদ্র ক্রিমির ঐকতান সংগীতের মতো' এই রকম অসাধারণ লাইনকে তলস্তয় বোঝেন না, বা কেন বুঝতে চান না তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। এবং আমরা যারা বোদলেয়ার পড়ি বা পড়েছি তারা জানি বোদলেয়ারের কবিতা এত বছর পরে এখনও কী প্রাণবন্ত!

তলস্তয় বলেন, অন্য কবিদের থেকে দৃষ্টান্ত দেখাবার আগে আমি বর্তমান কালের মহৎ কবি বলে স্বীকৃত বোদলেয়ার এবং ভেরলেন নামক দুজন কবির আশ্চর্য খ্যাতির বিষয়ে কিছু বলতে চাই। যে ফরাসি লেখদের মধ্যে ছিলেন শ্যেনিয়ে, মুসে, লা মার্তিন, এবং সর্বোপরি উগো, এবং যাদের মধ্যে সাম্প্রতিককালে লেকৎ দ্য লীল, স্যুলি প্রুধোম প্রভৃতি তথাকথিত পার্নাসিয়ানেরা আবির্ভুত হয়েছিলেন, তাঁদের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও রূপকর্মের দিক থেকে কলাকুশলতাহীন এবং বিষয়বস্তু উপস্থাপনার দিক থেকে অত্যন্ত ধিক্কারযোগ্য এমন দুজন পদ্য লেখককে ফরাসিরা কী করে এত মূল্য দিলেন তা আমার বুদ্ধির অগম্য। তাঁদের মধ্যে বোদলেয়ারের জীবনদর্শন ছিল স্থুল অহংবাদকে একটা তত্ত্বের স্তরে উন্নীত করা এবং নৈতিকতার স্থলে ধোঁয়াটে সৌন্দর্য-কল্পনা, বিশেষভাবে কৃত্রিম সৌন্দর্য স্থাপন করা। বোদলেয়ারের নিকট নারীমুখের স্বাভাবিক সৌন্দর্য থেকে তার প্রসাধিত মুখের সৌন্দর্যের প্রতি এবং প্রকৃত বৃক্ষ এবং স্বাভাবিক জল থেকে ধাতব বৃক্ষ এবং রঙ্গ মঞ্চে অনুকৃত জলের প্রতি ছিল অধিকতর পক্ষপাত এবং তা তিনি প্রকাশও করেছেন।'


হয়তো সমগ্রের অংশ হয়েও প্রত্যেক মানুষের জীবন আলাদা। সম্ভবত একমাত্র শিল্পেই তা প্রকাশ সম্ভব। কারণ প্রত্যেক কবি লেখকের রয়েছে আলাদা আলাদা জীবন। তাই শিল্পের গড়পড়তা বিচার অসম্ভব। প্রকাশভঙ্গির কারণেই সে আলাদা। কবিতা সবসময় কমসংখ্যক পাঠক পেয়েছে এবং এতে তার ক্ষতি হয়নি। বরং কিছুই না হওয়ার ভান করে টিকে আছে।
স্বল্প লাইনে লেখা গেলেও কবিতা চায় সর্ব্বোচ্চ ত্যাগ। জীবনকে জানার, আত্মোৎসর্গের চরম পরীক্ষা দিতে হয় কবিকেই। যত সংখ্যক কবি টিকে আছে জগতে তার চেয়ে লক্ষগুণ কবি তলিয়ে গেছেন কালের বিচারে। গণমানুষের মুখ চেয়ে কবি কবিতা লিখলে অনেক সময় তা নিম্নমানের কবিতায় পর্যবসিত হয়। কবিতা তন্ময় করে, সবরকম কৃত্রিমতা থেকে আলাদা করে কবি ও তার পাঠকদের। কবি যত পরিণতির দিকে যায় ততই সে সৎ হয়ে উঠতে থাকে।

কবিতার সাথেই সবচেয়ে বেশি সখ্য অমরতার। হুইটম্যান বা নজরুল, নেরুদা বা নাজিম হিকমতদের যতই আমরা গণকবি বা আন্দোলনের কবি, বলি তাদের তন্ময় কবিতাগুলোই আমাদের আন্দোলিত করে বেশি। আমরা কি ভাবতে পারি রবীন্দ্রনাথ গণমানুষকে সামনে রেখে কবিতা লিখছেন! কিন্তু বাংলাভাষার লোকদের কাছে সবচেয়ে পাঠ্য এখনো কি তিনি নন? দুইচার লাইন রবীন্দ্রনাথ বলতে পারে না এরকম বাঙালির কি সন্ধান মিলবে?

তলস্তয়ের সাথে আমার তর্কটা এখানেই যে, কবিতার প্রকাশভঙ্গি ও স্বভাবের সাথে তিনি তত আন্তরিকভাবে পরিচিত নন। তদুপরি শিল্পের প্রত্যেক শাখাতেই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এগুলোকে সরলীকরণ করা যায় না। ঔপন্যাসিকদের ঋষিত্ব অর্জন করতে হয়, কবি জন্মায় ঋষি হয়ে। ফলে একজন প্রকৃত কবির অনুভবের মাত্রার সাথে গণমানুষ পাল্লা দিচ্ছে, এটা ভাবাই হাস্যকর। কিন্তু এরপরেও কথা আছে। আমরা দেখি কবি লালন ফকিরের জন্য সাধারণ মানুষকেও উৎসাহিত হতে। কিন্তু লালনের কয়টা গান বা কবিতার মর্ম গণমানুষ জানে!

ইনিড স্টার্কি রচিত 'বোদলেয়ার' বইয়ের মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যে বোদলেয়ারের জীবন সম্পর্কে জানি। বলা যায় এক অসহায় মায়ের অসহায় সন্তান। ফরাসি বিপ্লবের সময় ইংলন্ডে পালিয়ে যাওয়া ষোড়শ লুইর সেনা-বাহিনীর উচ্চপদস্থ এক কর্মচারীর ঘরে জন্ম নেন বোদলেয়ারের মা ক্যারোলাইন।
জন্মের কিছুদিন পর মা-বাবা দুজনকেই হারান ক্যারোলাইন। অনাথ ক্যারোলাইন বেড়ে ওঠেন এক পুরানো পারিবারিক বন্ধুর বাড়িতে। হয়তো অনাথ বলেই কোনো যুবকই এগিয়ে এলো না। আশ্রয়দাতার মৃতদার বৃদ্ধ বন্ধু ফ্রাঁসোয় বোদলেয়ার একদিন তার পাণি প্রার্থনা করলে ক্যারোলাইন অপরের গলগ্রহ হয়ে খাকার চেয়ে এটা ভাল মনে করে রাজি হয়ে যান।

১৮১৯ সালে তাদের যখন বিয়ে হয় পাত্রের বয়স ৫৯ আর ক্যারোলাইনের ২৬। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান শার্ল বোদলেয়ার জন্মান ১৮২১ সালের ৯ এপ্রিল।
ছেলে শার্লই হয়ে ওঠে ক্যারোলাইনের একমাত্র বেঁচে থাকার প্রেরণা। স্টাকির্র ভাষায়, হয়তো ছেলেকে ভালবাসার মধ্যে যেন উপলব্ধি করলেন ক্যারোলিন প্রথম প্রেমের শিহরণ। যা-হোক, বোদলেয়ারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাঠকমাত্রই জ্ঞাত। ফরাসি বুর্জোয়া সমাজে বোদলেয়ার বেড়ে উঠেছেন। ফ্রাঁসোয়া বোদলেয়ারের মৃত্যুর পর ক্যারোলাইন বিয়ে করেন ক্যাপ্টেন ওপিককে। ভালবাসায় যেন হেরে গেলেন বোদলেয়ার। অভিমান ও ক্ষোভে কালো তার অন্তমূল। ওপিক বাচ্চাকাচ্চা পছন্দ করতেন না। ফলে তাকে বেশিরভাগ সময় কাটাতে হয়েছে স্কুলের বোর্ডিং হাউসে। জীবনযাপন করবার মতো যথেষ্ট অর্থও ছিল না কখনো। তার নিজের পিতা বেশ কিছু অর্থ রেখে গিয়েছিল তার জন্য। কিন্তু ওপিক তার মাকে পরামর্শ দিলেন ছেলের হাতে বেশি টাকা দিলে চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে। অল্প কিছু টাকা মাসোহারা দেয়ার ব্যবস্থা হল যাতে কোনোদিন চলেনি বোদলেয়ারের।

কর্মজীবনেও অসফল তিনি। কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল পত্রিকায়, সামান্য। সমালোচক ও প্রবন্ধ লেখারও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু লিখে অর্থাগম ঘটেনি কখনো। মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার আগে তার যে খরুচে স্বভাব তৈরি হয়েছিল, তা বদলাতে পারেননি। প্রায় সবসময় ঋণে ও আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। আয় ও অস্থিরতার কারণে স্থায়ী হতে পারেননি কোথাও। ঘুরে বেড়িয়েছেন হোটেল থেকে হোটেল রুমে। তার ওপর দেখা দিল সিফিলিস। যা তখনকার দিনে পথ্যবিহীন ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল ইউরোপে। হয়তো এই বেদনাবহ জীবনই বোদলেয়ারকে অনুপ্রাণিত করেছিল তার মনের অবস্থা কবিতায় পরিণত করতে।
চল্লিশ বছর বয়সে কেউ একজন উপন্যাস লেখা শুরু করে এবং সফলতা লাভ করে। কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সে কাউকে কবিতা লেখা শুরু করতে দেখা যায় না। মনে হয় জগতের সাথে প্রথম পরিচয়ের তিক্ততা, বেদনা ও বিষাদই একজনকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে। যে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে জগতের অজস্র সফল কবি।
অন্যদিকে তলস্তয়ের জীবন ও বেড়ে ওঠা পাঠকমাত্রেই জ্ঞাত। তার পারিবারিক অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা। তলস্তয় বেড়ে উঠেছেন বলতে গেলে একটা রাজপরিবারে। কোন কিছুরই অভাব ছিল না। বলা যায় সমাজের উচ্চ সুবিধাভোগী ভোগবাদী সমাজে জন্ম নেয়ার কারণে অতিভোগের যে বিবমিষা তাকে ‍বিতৃঞ্চ করেছিল তা আমরা তলস্তয়ের প্রতিটি উপন্যাসেই দেখতে পাই। ফলে বোদলেয়ারের মানস গঠন যেমন বেদনাহত জটিল, তেমনি তার প্রকাশভঙ্গিও জটিল হতে বাধ্য। এই বিষয়টি সহজাত ধনী পরিবারে জন্ম নেয়া তলস্তয়ের পক্ষে কখনো বুঝে ওঠা সম্ভব বলে মনে হয় না।