যে দেশ চেয়েছিলাম যে দেশ পাইনি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 6 Dec 2017, 12:57 PM
Updated : 6 Dec 2017, 12:57 PM

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ গর্ব করতেই পারে। কিন্তু আজ যখন বিজয় দিবস আমাদের দ্বারপ্রান্তে আর আমরা জাতি হিসেবে ইতিহাস ও অতীত নিয়ে এখনও বিতর্কে জানতে চাই, তাদের কি আসলে ইতিহাস ও সত্য ধরে রাখার বিষয়ে সত্যিকার মনোভাব কাজ করে? বাংলাদেশে এখন আর যাই থাক লোকের টাকার অভাব নেই। খবরে দেখলাম স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বাজেট নাকি সাত লাখ কোটি টাকা। একটা সময় এমন অংক শুনলে অনেক মানুষ মূর্চ্ছা যেতেন। এখন হবতো তা হবে না। কিন্তু তার মানে কি এই যে, কেবল টাকার মাপে আমরা স্বাধীনতা বিজয় এসব দিন বা ইতিহাস মনে করার মনে রাখার দায়িত্ব পালন করব?

যে ইতিহাসের গৌরবে আওয়ামী লীগ বিএনপি বা অন্যদের চাইতে এগিয়ে সে বিষয়ে তাদের একপেশে মনোভাব আর অনিচ্ছা কিংবা না-জানার যে ফাঁক তাতেই মূলত অনেক কিছু হাতছাড়া হয়ে গেছে আমাদের। স্বাধীনতার পরপর সময় পাননি বলে বঙ্গবন্ধু বা চার জাতীয় নেতা যা করতে পারেননি এত বছর পর আপনারা সেদিকে মনোযোগ দেন না কেন? স্বাধীনতা বা বিজয় সমুন্নত রাখার মানে কি অন্য দলের কাউকে গালাগাল করা কিংবা তাদের সমালোচনাতেই পার পাওয়া?

সেটাই কিন্তু করে চলেছে সরকারি দল। মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই পাওয়া জাসদ বা বাম নেতাদের মুখে যা শুনি তাতে বিচলিত বোধ করার বিকল্প থাকে না। কে-না-জানে তখনকার বাম শিবির ছিল দুধারায় বিভক্ত। সোভিয়েতঘেঁষা বামেরা ছিলেন আওয়ামী লীগের ছায়াসঙ্গী। তাদের নেতাকর্মীরা ছোটখাট বিরোধ ব্যতীত আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুর অনুগামী হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পরও আজ তারা আওয়ামীবিরোধী বলে পরিচিত। আর চৈনিক বাম বা জাসদের যারা লড়াইয়ের সময় এই যুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বা পরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর জায়গায় ছিলেন তারাই এখন মুখে ফেনা তুলছেন রাতদিন।

এই কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বা ইতিহাস চাইলেও দানা বাঁধতে পারছে না। এই যে সরকারে থাকার সুবিধা এবং দীর্ঘ সময় সরকারি দলে থেকে সুবিধা নেওয়ার নেতারা একবারও কি ভেবেছেন আমাদের ইতিহাসে এত বড় বিজয়ের পরও আমাদের সেই উদ্যানটির নাম কেন বঙ্গবন্ধু উদ্যান বা বিজয় উদ্যান রাখা হয়নি? হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অবদান বা অতীত কেউ অস্বীকার করে না। তিনি বঙ্গবন্ধুর গুরুও বটে। কিন্তু তাঁর জীবন তো স্বাধীনতার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। রেসকোর্স আমাদের সেই উদ্যান যেখান থেকে বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম'। সেই ভাষণ আজ বিশ্বস্বীকৃত।

সে আনন্দে মাতোয়ারা হবার নাম কি স্কুল-কলেজ থেকে জোর করে শিক্ষক আর ছাত্রছাত্রীদের ধরে নিয়ে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা? না আগামী দিনের নাগরিকদের কাছে সেই উদ্যান আর ইতিহাস প্রাঞ্জল ও বাস্তব করে রাখা? যদি তাই হয় আমাদের নেতাদের মনে একবারের জন্যও কেন এই প্রশ্ন জাগে না যে, উদ্যানটির নাম কেন বঙ্গবন্ধুর নামে হল না? বঙ্গবন্ধুর নামে মেডিক্যাল হাসপাতাল কি জরুরি?

আমরা যদি কলকাতার দিকে তাকাই দেখব, তারা মেডিক্যাল কলেজ বা হাসপাতালের নামাকরণ করেছে স্বনামখ্যাত চিকিৎসকের নামে। এটাই তো হতে হবে। যিনি কালজয়ী একটি ভাষণে আমাদের দেশে-বিদেশে গৌরবদীপ্ত করলেন তাঁর সেই স্মৃতিময় উদ্যানটির নাম কী হওয়া উচিত তাহলে?

তার চেয়েও আর একটি বিষয় মনে জেগে থাকে। আর কি কোনোদিন আমাদের কাছে কেউ এভাবে আত্মসমর্পণ করবে? না করার দরকার পড়বে? বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে বীরত্ব বড় কম। হিন্দু রাজারা না জানত বীরের মতো আচরণ করতে না তাদের ছিল ভালোবাসা। নারী শরীর আর মদ বা নেশানির্ভর রাজারা কর তুলে আনন্দ আয়েশ করতেন আর দুশমনে এলে কাছার কাপড় তুলে পালাতেন! সে থেকে আমাদের ইতিহাস পরাজয় আর ভীরুতার।

প্রথমবারের মতো বাঙালি একাত্তরে প্রমাণ করে দিয়েছিল তারাও পারে। সে অসম যুদ্ধে পাকিস্তানের মতো একটি দেশ যেটি সামরিক শক্তি আর বল ছাড়া মেধাশূণ্যের কোঠায় তাদের আমরা হারিয়েছিলাম যুদ্ধে। ডিসেম্বরের এক হিমেল সন্ধ্যায় তখনকার রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করা পাকিদের চেহারা কি শুধু জাদুঘরে রাখলেই চলবে? যদি উদ্যানটির নাম 'বিজয় উদ্যান' হত তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জানত কেন এর এই নাম। যারা সেখানে কোনো বিকেলে ঘুরতে যেতেন তারাও জানতে চাইতেন, এর নাম বিজয় উদ্যান কেন, কীসের বা কোন বিজয় অর্জিত হয়েছিল এই মাঠে?

সে সুযোগ আমরা দিইনি। অথচ দিনরাত টেলিভিশনে, সর্বত্র বিজয় আর স্বাধীনতা নিয়ে তর্ক চলছে। আপনি দিল্লি গেলে দেখবেন তারা গান্ধীর সমাধির পাশে শক্তিস্থল নামে একটি জায়গা বানিয়ে নেহেরু ও অন্যদের স্মৃতি ধরে রেখেছে। আমরা কি চার নেতা বা মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ওসমানীর নামে এমন কিছু রেখেছি ঢাকায়? কেন রাখিনি? জানি এর যোগ্য জবাব নেই।

বাংলাদেশের রাজনীতির এই আরেক রূপ। ঝগড়া আর হানাহানিতে বহু আগে পথ হারিয়েছে শুভবোধ। তাই কাজগুলো ঠিকমতো হয়নি। বলছিলাম স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বা বিজয়ের ঘটার কথা। এটা আরেক ফ্যাশন। মূলত সমাজের যে কী চিত্র তা আমরা সবাই জানি। খবরে দেখি আজ এখানে কাল ওখানে কোথাও-না-কোথাও অপমানিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। সবচেয়ে অধিক অপমান আমাদের সমাজের বদলে যাওয়ায়। ধর্ম বা বিশ্বাস আদিকাল থেকে চলে আসছে। ধার্মিক মানুষেরা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়ও না। যারা ঘামায় তাদের আমরা চিনি। আজ সমাজ ও দেশজুড়ে তাদের দাপট কি অস্বীকার করার মতো? একদল মানুষ যারা মুখে বিজয় ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশ জাগাতে এগিয়ে গিয়েছিলেন তারা কি তাদের আচরণ ও ভালোবাসায় মানুষের মন জয় করতে পেরেছেন আসলে?

বাস্তবে এরা মিডিয়া বা সমাজের এলিট অংশ বাদে এখন একেবারেই সংখ্যালঘু। যারা মূলত জনপ্রিয় তাদের আমি বলি ককটেল। এই ককটেল এমন এতে এক খাবলা মুক্তিযুদ্ধ আছে, এক চিমটি পাকিপ্রেম, কিছুটা আমেরিকা বা পশ্চিমা-ফ্লেভার আর অল্পস্বল্প ভারত। ব্যস, এটাই হল সেরা। বুঝে-না-বুঝে এর প্রিয়তা এত বেশি, আসল বা অকৃত্রিম বিজয় কিংবা ইতিহাস এখন কঙ্কালসার।

মানুষকে দোষ দেবেন না, হে রাজনীতিবিদগণ। মানুষ তাদের জীবন দিয়েও দেখেছে, লাভ হয়নি। খুব বেশি দিনের কথা নয়। আমাদের চোখের সামনে মরলেন নূর হোসেন। তাঁর মৃত্যুর কারণ যিনি, তিনি এখন রাজদূত। তার দলকে নিয়ে পিংপং বলের মতো দোটানায় আছে বড় দুদল। কারণ তাকে ছাড়া গদিতে যাওয়া যায় না। এরপর আমরা যদি মানুষকে আদর্শের সবক দিই তারা তা কেন মানবে? কোন দুঃখে তারা তা মানতে চাইবে?

আমাদের সমাজে এখন একদিকে অন্ধকার, আরেকদিকে বেলেল্লাপনা। এমন আগে কখনও দেখা যায়নি। মানুষের মনে বা চিন্তায় আদর্শ কিংবা শুভবোধ আছে কি নেই সেটা দুরবিন দিয়ে দেখলেও বোঝা মুশকিল। অন্যদিকে সব কিছুতে আচার আর সংস্কার। পোশাক-খাবার সব মিলিয়ে মনে হবে এক সংস্কারমুখী জাতি আমরা। সেটাই যদি সত্য হত এই সমাজের তলায় এত অন্ধকার থাকে কী করে? কী করে সস্তা হয় নারীদেহ বা ঘুষের মতো উপসর্গ? কে-না-জানে দেশে কোনো কাজ হয় না উপরি ছাড়া? কে-না-জানে কতটা সহজলভ্য নারীশরীর?

আমাকে বলেছেন এমন বেশ কজন নারীকে চিনি যাদের রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ভালো রাখতে হচ্ছে নিজেকে। বস থেকে আর্দালি সবার কুনজর এড়িয়ে চলা সহজ কিছু নয়। এটা এমন রোগ, এখন রোহিঙ্গাদের বেলায়ও তার আছড় পড়েছে। শরণার্থী-বিষয়ক মানবতা আর সহমর্মিতা শেষ না হতেই শুরু হয়ে গেছে যৌনতা। খবরে দেখলাম রীতিমতো গ্রেপ্তারও হচ্ছে আমাদের ভাইবন্ধুরা। শরণার্থী মানে অসহায় আর বিপন্ন মানুষ। তাদেরও ছাড় দিতে রাজি নয় আজকের লোভী সমাজ। সেগুলো কি আমাদের জাতীয় চরিত্রের বদলে যাবার নমুনা নয়?

এই মানুষদের নিয়ে আপনি ডিজিটাল দেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন, এটা শুনলে মনে হয় কলা গাছে আঙুর ফলতে চলেছে।

রাজনীতি আমাদের একসময় মুক্তির পথ দেখাত। যখন এদেশের স্বাধীনতা আমাদের আরাধ্য আর পাকিদের কবল থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা ছিল প্রবল, তখন রাজনীতি ছিল প্রধান হাতিয়ার। সে সুবর্ণসময় আজ বিগত। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় অভিভাবকের তিরোধানের পর আমাদের রাজনীতিতে জগাখিচুড়ি দল বিএনপির জন্ম হয়। যতদিন আমরা বাঁচব আমাদের বলে যেতেই হবে, ইতিহাসে তার জন্ম বা দরকার যে কারণেই হোক, আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো এই দলের হাতেই মূলত পাকিকরণের শুরু। আজ এমন এক জায়গায় তা পৌঁছে গেছে, চাইলেও কিছু করা যায় না।

এ লেখা যখন লিখছি তখন সামাজিক মিডিয়ায় দেশের দুই প্রধান ক্রিকেটারের কথোপকথন ফাঁস হয়েছে। যার মাধ্যম উর্দু। আরবি হলেও ধরে নিতাম এক ধরনের বিশ্বাসবশত তারা তা করেছেন। কিন্তু উর্দু কেন?

তাদের দেশের নাম বাংলাদেশ, তাদের জাতীয় পরিচয় আমাদের গর্ব আর তারা প্রতিনিধিত্ব করেন বাংলাদেশের। তাদের ভাষা কেন হবে উর্দু? এর জন্যে তারা থোড়াই দায়ী। পুরো সমাজ আর দেশের ভেতরে এক বাইরে আরেক। যার পেছনে আছে এই রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। যে প্রজন্ম আজ বিপিএল দেখছে, যারা নিজেদের সাকিব-তামিম-সৌম্য বা তাসকিনের গর্বে আনন্দ করছ, তোমরা ভাবতেও পারবে না কী কঠিন সময় আমরা পার করেছিলাম। আমরাও ক্রিকেট খেলতাম। তবে আমাদের ছিল না আসল বল বা ব্যাট কেনার সামর্থ্য।

আমার এক কবিবন্ধু একবার ম্যাচের ওপেনিং করতে এসেছিল অদ্ভূত এক প্যান্ট পরে। না-পাজামা না-পাতলুন ধরনের সে প্যান্ট দেখে অনেকে মুখ টিপে হাসলেও আমরা জানতাম এর পেছনে কারণ আছে। আমার সেই সরল মেধাবী কবিবন্ধুটি অকপটে বলেছিল তাদের যৌথ বড় পরিবারে নতুন প্যান্ট কেনা বিলাসিতা। তাই সে বাবার প্যান্ট কেটে এটা বানিয়ে নিয়েছিল।

কিন্তু সে সময় আমাদের ঐশ্বর্য ছিল ভালোবাসা। আজ যে প্রজন্ম নিজেদের মাঠে দেশ-বিদেশের সেরা খেলোয়াড়দের অনায়াসে দেখতে যাও তারা জান না আমরা এদের স্বপ্ন ছাড়া আর কোথাও দেখতে পেতাম না। আমাদের সবার বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। কোনো এক বন্ধুর বাসায় সবাই মিলে একসঙ্গে ক্রিকেট বা ফুটবল দেখার আনন্দ আর নিজে নিজে পপকর্ন খেয়ে দেখার আনন্দ এক নয়। সেই সমবেত উদযাপন আজ কি আসলেই শেষ হয়ে গেছে?

যে প্রজন্ম এই দেশকে সামনে নেবে তাদের বলি, তোমরা জান না আমাদের সম্পদ বা প্রাচুর্য কম থাকলেও দেশপ্রেমের ঘাটতি ছিল না। যে কারণে পাকি ক্রিকেটাররা চট্টগ্রামে এসে দেশের পতাকা আর মানুষকে অসম্মান করার ফল পেয়েছিল হাতে হাতে। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য! মেঘলা দুপুরে চট্টগ্রামের পুরনো সে ষ্টেডিয়ামে কিছু তরুণ জাতীয় পতাকা কাঁধে গ্যালারিময় ঘুরতেই জেগে উঠেছিল মানুষ। তখন চাইলেই পতাকা কেনা যেত না। হয়তো বানিয়েই এনেছিল তারা। আর সে পতাকা মুহূর্তে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিল, আর যা-ই যাক না কেন, দেশের সম্মান ও পবিত্রতায় ছাড় দেওয়া যাবে না। বাকিটা পাকিদের জন্য ইতিহাস।

আর আর আজ তোমরা গালে উল্কি এঁকে মেরী মি আফ্রিদি বা পাকি পতাকা নিয়ে মাঠে যাও। এই কি দেশের প্রাপ্য?

আজ এই ডিসেম্বরে নিজেদের সমালোচনা আর প্রকৃত কাজগুলো ছাড়া এগুনো যাবে না। কথা আর উৎসবে বিজয় উদযাপন হবে, লালন হবে না। হবে না স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের দেশ নির্মাণ। সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধত্ব, সংকীর্ণতা, পাশাপাশি দলবাজি– এর বাইরে একটি মুক্তদেশ আমাদের স্বপ্নই থেকে গেল।

জানি না আগামী প্রজন্ম এ থকে বের হয়ে নতুন কিছু দিতে পারবে কি না। জয় হোক বাংলাদেশের। এই মাসে তার বুকে জেগে থাকা আনন্দ কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। পারবেও না।