আনিসুল হক: গুজব ও মৃত্যুতে সমাপ্তি

স্বদেশ রায়
Published : 4 Dec 2017, 01:29 PM
Updated : 4 Dec 2017, 01:29 PM

আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে আনিসুল হককে নিয়ে গুজবে ভরে গেছে ঢাকা শহর। বাঙালি তথ্যের চেয়ে গুজব তৈরি ও ধারণা করতে ভালোবাসে বেশি। রাতে কোনো ক্লাবে বা কোথাও যাওয়ার মতো নেই। সবখানে নোংরা গুজব তাঁকে ঘিরে। চারদিকে এই নোংরামি দেখে মনে হল, বন্ধু ও সাংবাদিক হিসেবে আমার কিছু করার আছে। আমাদের লন্ডন প্রতিনিধিকে ফোন করে রুবানা হকের ফোন নাম্বার দিলাম। বললাম, "আপনি তাঁকে বলেন আমি কথা বলতে বলেছি। আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলে আনিস ভাইকে দেখে আসুন এবং একটা তথ্যভিত্তিক নিউজ পাঠান।"

কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের লন্ডন প্রতিনিধি আমাকে ফোন করে জানালেন যে, রুবানা হক তাঁর হোয়াটসঅ্যাপের নাম্বারে তাঁকে ফোন করতে বলেছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে ফোন করি। তিনি বললেন, "স্বদেশদা, আপনি তো জানেন কী অবস্থার ভিতর আছি। আনিসের দিকে তাকাতে পারি না, তার ভেতর এই সব! পেরে উঠছি না।"

রুবানা হককে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ জানেন, তিনি দশ-পাঁচ জনের মতো সাধারণ নন। তিনি শুধু বিবিসির জরিপে সেরা ১০০ ওয়ার্ল্ড উইমেনের একজন নন, তাঁকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তারা জানেন, কতটা শক্তি রাখেন এই নারী। তাঁর এমন ভেঙে-পড়া গলা শুনতে হবে কখনও ভাবিনি। তাঁর গলার স্বরেই আমার চশমার গ্লাসের কোণ বেয়ে চোখের পানি নেমে আসে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলি, "ভাবি, আমি চাচ্ছি কারও বরাত দিয়ে একটা তথ্যনির্ভর নিউজ করতে। যাতে গুজবের কিছুটা অবসান হয়।"

রুবানা হক জানালেন যে, প্রধানমন্ত্রী নিয়মিত ফোন করে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। হাইকমিশনার ও তাঁর স্ত্রী যা করছেন সে ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবেন না বলেও জানালেন রুবানা। হাই কমিশনারের স্ত্রী তাদের জন্য রান্নাবান্না করে নিয়ে যেতেন প্রায়ই। তারপরে তিনি জানালেন, হাইকমিশন থেকে আজ মনে হয় ওরা কিছু বলবে। ভাবিকে বলি, তিনি যেন হাইকমিশনারকে বলেন কিছু বলার জন্যে। পরদিন হাইকমিশন থেকে দেওয়া প্রেস রিলিজ ও হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বলে আমাদের রিপোর্টার একটি রিপোর্ট করেন আনিসুল হকের বাস্তব অবস্থা নিয়ে।

আমাদের সেই রিপোর্টও পারেনি গুজব ঠেকাতে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পরনিন্দা, পরচর্চায় পারদর্শী এই বাঙালির মুখের গুজব বন্ধ করা সত্যি কঠিন কাজ। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর ভিতর দিয়েই টানা হল সে অপপ্রচারের সমাপ্তিরেখা।

যাহোক, এরপর মাঝে মাঝেই রুবানা হককে ফোন করেছি। তখন শত অসুবিধার মধ্যেও আনিস ভাইয়ের খবর দিতেন আমাকে। অমন যোগ্য মানুষটার ওই দীর্ঘশ্বাসসহ কথা– "স্বদেশদা, কী বলব বলেন, আনিসের সেই একই অবস্থা। শুধু মাঝে মাঝে একটু চোখের পাতা পিট পিট করে নড়ে।"

তাঁর কথা শুনে এতই কষ্ট লাগত যে, পরে আর নিজে তাঁকে ফোন করতাম না। কখনও কখনও অনিমেষের মাধ্যমে আনিস ভাইয়ের খবর নিতাম। এছাড়া মাঝে মাঝে এসএমএস পাঠাতাম। তিনি উত্তর দিতেন আর দোয়া চাইতেন। বুঝতাম তাঁর কষ্ট। কারণ আমরা আমাদের আপনজন, বন্ধু আনিসুল হকের সঙ্গে কতটুকু সময়ই-বা কাটাতাম! তাই সারাক্ষণ মনে পড়ে হাস্যোজ্জ্বল পরম আনন্দ বয়ে বেড়ানো মানুষটিকে। আর এই মানুষটিকে যিনি জীবনের দীর্ঘ সময়ের সঙ্গী হিসেবে দেখছেন– তাঁর পক্ষে প্রায় নিথর এক আনিসুল হককে দেখা কত যে কষ্টের!

আনিস ভাই যে স্ত্রী রুবানা হককে কতটা ভালোবাসতেন বন্ধু হিসেবে আমরা তার সামান্য যা দেখেছি তাই অবাক করে। লিখতে বসে মনে পড়ছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রুবানা হকের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে আনিসুল হকের উচ্ছ্বাস। মাঝে মাঝে বৃহস্পতিবারে কোলকাতায় বা বোম্বেতে বড় পর্দায় ছবি দেখতে যাওয়া। তাদের কাশ্মীর ভ্রমণের সেই ঘোড়ায় চড়ার স্মৃতি নিয়ে আনিসুল হকের উচ্ছ্বাস।

উজ্জ্বল ও উচ্ছ্বল এই মানুষটি যখন ক্রমেই রাজনীতির দিকে আসছিলেন, তখন নানা কারণে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়ছিল। মাঝে মাঝে মনে হত, আনিসুল হক অনেক বুদ্ধিমান, কিন্তু কুটিল নন। পারবেন কি– যদি রাজনীতিতে যান– নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে? তবে রাজনীতিতে তিনি যে আধুনিকতা দেবেন তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না। তার প্রমাণ তিনি প্রথম রাখেন ২০১৪ সালে নির্বাচনের বেশ আগে– প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের কথামতো আওয়ামী লীগের উন্নয়ন ও ভোট ক্যাম্পেইনের জন্য কিছু প্রমোশনাল তৈরির ভেতর দিয়ে। সে সময় জয় ও ববির তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু প্রমোশনাল তৈরি হয়। সেগুলো ছাড়া আর যে আধুনিক প্রমোশনাল কয়েকটি তৈরি হয়েছিল সব আনিস ভাইয়েরই অবদান।

মেয়র হিসেবে ঢাকা শহরের মানুষ এক কাজপাগল আনিসুল হককে দেখেছেন। যে কোনো ভালো কাজ করার জন্যে পাগলপ্রায় হয়ে যেতেন। ২০০১১-২০১২এর দিকে বিএনপিসহ এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী সরকারকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে এই বলে যে, সরকার কুইক রেন্টাল, আইপিপি এই সব বিদ্যুত কেন্দ্রে ভর্তুকি দিয়ে দেশকে দেউলিয়া করে দিয়েছে। বামপন্থীরাও কোনো হিসাবনিকাশ ছাড়াই একথা বলছেন। এই মিথ্যে প্রচারের প্রভাবে পড়ে অর্থমন্ত্রী নিজেও বলে বসলেন, কুইক রেন্টাল করে তাঁরা ভুল করেছেন।

অর্থমন্ত্রী এ কথা বলার পর আমি আমাদের সাংবাদিকদের মেথডে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে একটা লেখা তৈরি করি যেখানে দেখাই যে, বিদ্যুতে সরকারের ভর্তুকি গেছে নয় হাজার কোটি টাকার মতো। আর এই বিদ্যুতের ফলে রফতানি, কর্মসংস্থান সব মিলে অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। এরপর অর্থনীতিবিদ রমণীমোহন দেবনাথ দেখান কৃষিসহ এই যোগ প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা।

এই সময় একদিন আনিসুল হকের বাসায় বসে শুধু মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেছিলাম যে, এই বিষয় নিয়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা হলে ভালো হত। তার প্রায় তিন মাসের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে আনিসুল হক গবেষণা করান যাতে দেখা গেল যে, ওই ভর্তুকির বিপরীতে যোগ হয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। এটা অর্থমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে গেলে তিনি সেটা বাজেটের অংশীভূত করেন।

পজিটিভ কিছু করার সুযোগ পেলেই যেন পাগলপ্রায় হয়ে যেতেন মানুষটি। সব কাজেই তিনি একবার শুনতেন রুবানা হকের মতামত। সাহায্য নিতেন তাঁর। বাইরে যেমন তিনি তাঁর বন্ধুদের অন্যতম সেরা বন্ধু, তেমনি ঘরের বন্ধুটিরও ছিলেন তিনি এক অনন্য বন্ধু।

আনিসুল হকের জানাজা থেকে ফেরার পর রাতে মতিয়া চৌধুরী ফোন করেন। তাঁর কথা শুনে বুঝলাম তিনি ঠিক মেনে নিতে পারছেন না বিষয়টি। আসলে গোটা জাতি তাঁর এই অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। মতিয়া আপা টেলিফোনে অত্যন্ত ভারী গলায় বললেন, "আনিস যেভাবে রুবানাকে দেখত, তাতে ওর কষ্টটা মনে করে কিছুই ভাবতে পারছি না। সে অনেক বেশি ভেঙে পড়েছে।"

এ সময় আনিসুল হকের দুবছরের কাজ নিয়ে মতিয়া আপার সঙ্গে অনেক কথা হয়। বাস্তবে গত দুই বছরে আনিসুল হক শুধু ঢাকা উত্তরের চেহারা বদলে দেননি, সব থেকে বড় যে বিষয়টি তিনি প্রমাণ করেছেন তা হল, কাজ করার ইচ্ছে থাকলে করা যায়। তাঁর এই কাজ করার ইচ্ছে থেকে মেয়র হবার অনেক আগেই তিনি পরিকল্পনা করেই নেমেছিলেন মেয়র নির্বাচনে।

মনে পড়ছে মেয়র প্রার্থী হবার আগে একদিন অর্থমন্ত্রীর বাসায় বসে তিনি তাঁকে বললেন, "স্যার, আমি যদি মেয়র নির্বাচিত হই ঢাকা উত্তরের, আপনি কি আমাকে ১৮০০ কোটি টাকা বাড়তি দেবেন কাজ করার জন্যে?"

মুহিত ভাই তাঁর পরিচিত দিলখোলা হাসি দিয়ে বললেন, "এটা শেখ হাসিনার সরকার, তুমি কাজ করতে চাও আর টাকা পাবে না? যাও, তুমি মেয়র হলে আমি তোমাকে বাড়তি তিন হাজার কোটি টাকা দেব।"

আনিস ভাইও তাঁর পরিচিত উচ্চস্বরের হাসি দিয়ে বললেন, "স্যার, তাহলে আমিও আপনাকে কথা দিলাম, তিন বছরেই বদলে দেব ঢাকা উত্তর সিটি।"

আনিসুল হক তিন বছর সময় পাননি। তার আগেই নিষ্ঠুর মৃত্যু, দুরারোগ্য রোগের ভিতর দিয়ে তাঁকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল। এর মাধ্যমে শুধু ঢাকা উত্তরের নাগরিকরা একজন আনিসুল হককে হারাননি, গোটা দেশ হারিয়েছে এক সম্ভাবনাময় রাজনীতিককে। সফল ব্যবসা শেষে মাত্র চৌষট্টি প্লাসে চলে গেলেন তিনি। তাঁর যা গতিবেগ ছিল, তাতে আরও পনের বছর সমান গতিতে তিনি দেশকে দিতে পারতেন। চলে যেতেন তিনি ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া পিতার সন্তান আনিসুল হক সঠিক রাজনীতির পথটি বেছে নিয়েছিলেন। ভুল পথ তাঁকে ডেকেছে, তবে তিনি কখনও তাতে পা দেননি। আনিসুল হক নিজেই যে কথা বলে গেছেন ব্যক্তিগত আলোচনায়। এক-এগারোর পর ড. ইউনূস রাজনৈতিক দল করার ঘোষণা দিয়ে আনিস ভাইকে ডাকেন। তিনি গিয়ে দেখেন সেখানে আছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। ড. ইউনূস আনিসুল হককে বললেন, "আপনাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে।"

আনিস ভাই বলেন, "স্যার, আমি তো ব্যবসায়ী, আমি কেন রাজনীতি করতে যাব? তাছাড়া আপনি যে রাজনৈতিক দল করবেন, আপনি কি দলের সেক্রেটারি পাবেন?"

তিনি বললেন, "কেন পাব না?"

তখন আনিসুল হক বলেন, "কে হবেন আপনার সেক্রেটারি? দেবপ্রিয়?"

দেবপ্রিয় বলেন, "আমি কেন হতে যাব?"

আনিস ভাই তখন বলেন, "মতি ভাই, টিটু ভাই (মাহফুজ আনাম) হবেন?"

মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনাম বলেন, "না, আমাদের পেশা তো ভিন্ন।"

আনিসুল হক তাঁর স্বভাব অনুযায়ী ড. ইউনূসকে মুখের ওপর বলে দেন, "একজন সেক্রেটারি পাচ্ছেন না দলের, রাজনীতি করবেন কীভাবে?"

মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষক পিতার ছেলে নিজ থেকেই আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। অর্থাৎ রাজনীতির সঠিক প্লাটফর্মটি চিনতে তিনি ভুল করেননি।

মানুষ মাত্রই ভুল করে। তারপরও তাঁর চৌষট্টি-প্লাস জীবনে ওভাবে তাঁর কোনো ভুল চোখে পড়ে না। বরং এখন চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতে ইচ্ছে করে, প্রিয় আনিস ভাই, আপনি বড় ভুল করলেন এভাবে অকালে চলে গিয়ে। আপনার এই একমাত্র ভুল দীর্ঘকাল বহু মানুষকে চোখের জল মুছতে বাধ্য করবে।