বিশ্ববিদ্যালয়ে এত রঙের কী দরকার?

তারানা হালিম
Published : 3 May 2012, 01:39 PM
Updated : 3 May 2012, 01:39 PM

আমি কিন্তু একান্তই আমার ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকে পয়লা মে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। কাউকে প্রতিনিধিত্ব করতে নয় বা কেউ আমাকে এ বিষয়ে কোন মধ্যস্থতার জন্য দায়িত্বও দেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনেট সদস্য হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে, এখানে আমার ভূমিকা রাখা উচিত। আমি মনে করি, শুধু সিনেট সদস্য হিসেবে নয়, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবেও বিশ্ববিদ্যলয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আমার কিছু দায়িত্ব রয়েছে। কিছু পত্রিকায় এসেছে যে আমি সিনেটের পক্ষ হয়ে কাজটা করেছি। সিনেট কাউকে প্রতিনিধিত্বের জন্য পাঠালে সেটার জন্য সভা ডেকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এখানে তেমন কিছুই হয়নি।

আমি ভেবেছিলাম, আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সংকট নিরসন করা সম্ভব হয় তাই বা কম কিসে? তাই খুব খোলামন নিয়ে ওখানে গিয়েছিলাম। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে দু' পক্ষের সঙ্গেই আলোচনা করলাম। যে মন নিয়ে গিয়েছিলাম সে মন নিয়ে কিন্তু ফিরতে পারিনি। কারণ শুরুতে আমার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কারণে কিছু ভুল বোঝাবুঝি থেকে সংকটটা তৈরি হয়েছে। দু'পক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৈঠক করে আমার মনে হল, সংকটের কারণটা একদম রাজনৈতিক। দুটো বিষয় বলব। আমাদের দেশে কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের একটা বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, তারপর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনে ছাত্রসমাজ মূল ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু একটা সময়ের পর কিছু কিছু গোষ্ঠী রাজনৈতিক স্বার্থে ছাত্রদের ব্যবহার করতে শুরু করেছে। আর এর ফলেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সময়ে নানা সংকট তৈরি হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে। এখানেও কারও কারও রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। প্রথমত যে কারণে আমার একথা মনে হয়েছে তা হল, এখানে আন্দোলনকারী এবং আন্দোলনবিরোধী দুটি পক্ষের অভিযোগ একই। উপাযার্য-বিরোধী আন্দোলন যারা করছেন তারা বলছেন, উপাচার্য বা তার পক্ষের শিক্ষকরা স্বাধীনতাবিরোধী জামাত ও শিবিরের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। একইভাবে উপাচার্যের পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন তারাও আন্দোলনকারীদেরকে মৌলবাদীদের সমর্থক বা পৃষ্ঠপোষক বলে সমালোচনা করছেন। ভারি অদ্ভুত মনে হল আমার কাছে। যারা আন্দোলন করছেন আর যারা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, দুটো পক্ষের অভিযোগ অভিন্ন হয় কী করে?

আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতাবিরোধী ও মৌলবাদী কোন গোষ্ঠীকে কোন ক্ষেত্রে ন্যূনতম ছাড় দিতে রাজি নই। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, জাহাঙ্গীরনগরে পরস্পরবিরোধী দুটি পক্ষ একে অন্যের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ কেন দিচ্ছেন। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি এই সংকটটা তৈরির পেছনের কারণগুলো রাজনৈতিক নয়?

আমি আইনের ছাত্রী। একজন আইনজীবীও। সে হিসেবে বলব, সবকিছুই নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে হবে। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন শিক্ষার্থী নিপীড়নের শিকার হোক বা খুন হোক এটা আমরা চাইব না। আবার কোন শিক্ষককে অন্য শিক্ষক বা ছাত্ররা মারধোর করবেন সেটাও তো হতে পারে না। শিক্ষক বা ছাত্র হত্যা বা নির্যাতন যেমন মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন, তেমনি উপাচার্যকে সপরিবারে তার বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল। কোনটিই গ্রহণযোগ্য নয়। সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধেই আমি কথা বলব। ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি তো ঘটনা বিবেচনায় পৃথক হতে পারে না।

এসব কারণেই খুব খোলামন নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমি অত্যন্ত আহত হয়ে ফিরে এসেছি। আমি ওখানে উভয় পক্ষের সঙ্গেই কথা বলেছি। আমার বক্তব্য হল, সবকিছুরই একটি প্রক্রিয়া আছে। আমি কোথাও কোন অন্যায়ের শিকার হলে অভিযোগ করতে পারি, বিচার চাইতে পারি। নিজে পাল্টা অন্যায় করতে পারি না। কোন শিক্ষার্থীই অন্য শিক্ষার্থীকে আঘাত করতে পারে না। এক শিক্ষক অন্য শিক্ষককে মারধর করলে অবস্থা কী দাঁড়াবে?

আমি কিন্তু জাহাঙ্গীরনগরে আন্দোলনরতদের কথাই প্রথম শুনেছি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের দেশে সাধারণত আন্দোলনরতদের উপেক্ষা করা হয়। আমি সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-সংস্কৃতিকর্মী সবার সঙ্গেই কথা বলেছি। সব পক্ষের বক্তব্যই শোনার চেষ্টা করেছি। আমার মূল উদ্বেগের বিষয় ছিল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন। আমার যদিও কিছু করার এখতিয়ার নেই, কিন্তু উভয় পক্ষকে আমি এটাই বলেছি যে উপযুক্ত জায়গায় আমি বিষযগুলো তুলে ধরব। তাই দু'পক্ষকেই কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা দিতে বলেছি।

একথা সত্যি, জাহাঙ্গীরনগরের পরস্পরবিরোধী দুটি পক্ষই আমার সদিচ্ছার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। তারা আমাকে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণও করেছেন। উপাচার্যের পক্ষের শিক্ষক-ছাত্রদের গ্রুপটি আমাকে বলেছেন, আমি যে সিদ্ধান্ত দেব তাই তারা মেনে নেবেন। উপাচার্যের বিরোধী পক্ষটি আমাকে জানিয়েছেন, তারা কেবলমাত্র উপাচার্যের পদত্যাগই চান। আমি তাদের কাছে একটু সময় চেয়েছিলাম। যাতে আমি সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারি। সিনেটের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আলাপ করতে পারি। কারণ আামি তো এসেছি ব্যক্তিগত তাগিদ থেকে। তাই একটু সময় লাগবে। কিন্তু উনারা বললেন, এভাবে অনেকবার আমাদের কথা দেয়া হয়েছে কিন্তু তা রাখা হয়নি। আমি তাদের বলেছি যে, আমি হয়তো কোন অথরিটি নই, তবে অন্তত তাদের কথা যথাযোগ্য জায়গায় পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করতে পারি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয়েক মাসে যেসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে, জুবায়ের নামে একজন প্রতিভাবান ছাত্র খুন হয়েছে, এ নিয়ে আমি কথা বলেছি ওখানে দু'পক্ষের সঙ্গেই। আন্দোলন-বিরোধী পক্ষটি বলেছেন, ঘটনাগুলোর তদন্তে কমিটি হয়েছে, মামলা হয়েছে। আন্দোলনের পক্ষটি বলেছেন, কিছুই হয়নি। আসলে আমি নথিপত্র কিছুই দেখতে পাইনি। তাই এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে পারছি না। ক্যাম্পাসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে আমি ছাত্রলীগের কর্মীদের সঙ্গেও কথা বলেছি। ছাত্রলীগ কর্মীরা আমাকে জানিয়েছে ওখানে কোন কমিটি নেই আজ কয়েক বছর ধরে। তাদের নাম করে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস করে একটি গ্রুপ। আমি তাদের বললাম, বিষয়গুলো তোমাদের মিডিয়ার কাছে বলা উচিত। কারণ তা না করাতে তো বদনাম হচ্ছে তোমাদের। ওরা আমাকে অনেক অনুরোধ করল যাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কাউন্সিল করে কমিটি গঠনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেই।

সব মিলিয়ে আমার মনে হয়নি যে আমি তেমন ইতিবাচক কিছু করতে পেরেছি। তবে এখন সময় এসেছে শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে রাজনৈতিক বিভাজন দূর করা। এই যে সাদা-লাল-নীল-হলুদ-সবুজ এত সব রঙের কী দরকার? হ্যাঁ, ছাত্ররা রাজনীতি করবে, তবে তাদের কোন দলীয় পরিচয় থাকবে না। আমার কথা হল, আমি বাংলাদেশের নাগরিক। সে হিসেবে দেশের মঙ্গল আমার কাছে সবচেয়ে আগে।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে উদারতার চর্চাটা তাই এখন জরুরি। একটি ঘটনার কথা বলব। আমার এলাকার এক উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা বিরোধী দলের সমর্থক বলে আমার কাছে সুপারিশ এসেছিল তাকে বদলি করার। আমি কিন্তু তা করিনি। কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে দলীয়করণে বিশ্বাসী নই। আমার সরকারও এ ধরনের কাজ করুক তা আমি চাই না। মজার ব্যাপার হল, ওই সরকারি কর্মকর্তা কিন্তু আমার উদারতাকে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি প্রটোকল মেনে কখনও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেননি। আমার কোন অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার প্রয়োজনও অনুভব করেননি। তবে আমি সন্তুষ্ট এই ভেবে যে, আমি তো অন্য কারোর রাজনীতি করতে আসিনি, এসেছি জনগণের সেবা করতে। এ প্রসঙ্গে দু'বছর আগের আরেকটি ঘটনার কথা বলছি। দারিদ্র্য বিমোচনের ওপর একটি প্রোগ্রাম করেছিলাম আমরা। প্রধানমন্ত্রী প্রোগ্রামের উদ্বোধন করলেন। ওই অনুষ্ঠানে বিরোধী দলীয় নেত্রীরও উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি এলেন না। দেশের মঙ্গলের জন্য একটি অনুষ্ঠান করছি আমরা, সেখানেও কেন দলীয় চিন্তা?

এই জায়গা থেকেই বলব, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে উদারতার চর্চা করতে হলে সব পক্ষের মধ্যেই সেই মানসিকতা থাকতে হবে। যেটা যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বে এমনকি ভারতেও রয়েছে। সেসব জায়গায় যে কোন সংকটে সব পক্ষ এক হয়ে যায়।

আর আমাদের দেশে আমরা এখন আমাদের নাগরিক পরিচয়ের আগে দলীয় পরিচয় দেই। এটা আমার খুব খারাপ লাগে। এরই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যেন পেলাম সেদিন জাহাঙ্গীরনগরে। আমার মনে হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিপথগামী করা হয়েছে। শিক্ষকরা কি মানুষ গড়ার কারিগর থেকে এখন মানুষকে ব্যবহারের কারিগর হয়ে গেলেন?

আমি তো এখনও আমরা শিক্ষকদের সম্মান করি। আমার সেই উদয়নের শিক্ষক শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, আমার হলিক্রসের প্রধান শিক্ষক মমতাজ বেগম, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শিক্ষকরা, তাদের সঙ্গে এখনও দেখা হলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি। আমার চোখে সানগ্লাস থাকলে খুলে ফেলি। মনে হয় এতে যেন ওনাদের অসম্মান করা হয়। আমার কথা হল, এখনকার শিক্ষার্থীরা কি পনেরো কী বিশ বছর পর তাদের শিক্ষকদের দেখলে এভাবে শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়বে? নাকি বলবে, 'দ্যাখো দ্যাখো, উনারা আমাদের ব্যবহার করেছিলেন!'

সেদিন জাহাঙ্গীরনগরে গিয়ে আমি হয়তো কিছুই করতে পারিনি। হয়তো বা সবটাই শূণ্য। তবে আমার মনে হয়েছে, দু'পক্ষের কথা শুনতে পেরেছি এটাও একটা কাজ হয়েছে। কারণ এদেশে তো দু'পক্ষের কথা শোনার লোক নেই। এরপর আমি হয়তো বিষয়গুলো নিয়ে আরও আলোচনার উদ্যোগ নেব। সিনেটের সভা হতে পারে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত আচার্যর কাছে যাবে। হয়তো বিষয়টিতে আচার্যকে হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে। তবে আমার খারাপ লাগছে যে শিক্ষার্থীদের অনশনটা বন্ধ করাতে পারলাম না।

আমার বারবার মনে হয়েছে যে, আমরা দু'কান দিয়ে শুনি না। দু'চোখ দিয়ে দেখি না। শেষ পর্যন্ত মনে হল, আমাদের বিবেকের জায়গাটাও বুঝি বড় বেশি দুর্বল হয়ে গেছে। তবে আমার নিজের একটা উপকার হয়েছে। আমি সবসময় সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো দেখেছি। মাঝে যে রঙগুলো আছে সেগুলো চেনার জন্য আমার ওখানে যাওয়ার দরকার ছিল।
আমি খুব স্পর্শকাতর একজন মানুষ। কিন্তু আমার ক্ষমতা সীমিত। তবু চাই কোথাও কোন ছাত্র নির্যাতনের শিকার হবে না। খুন হবে না। তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হবে না। শিক্ষকরাও পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবেন না। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষার্থীরা কারও দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবত হবে না। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংকটের একটি সুন্দর সমাধান হবে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরবে। আবার তাদের কলকাকলিতে মুখর হবে প্রতিষ্ঠানটি।

তারানা হালিম: আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, সংসদ সদস্য।