আমাদের তান্ত্রিক, ভাষা ও বাংলাদেশ

Published : 24 Nov 2011, 09:57 AM
Updated : 29 Nov 2017, 04:02 AM

মাঝে মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। কখনও কখনও দেখা হয়েছে অনুষ্ঠানে-আড্ডায়। তবে কখনও তাঁকে 'দেখতে' যাইনি। এবার গিয়েছি সে উদ্দেশ্যেই। তিন দিকে শূন্য মাঠের একপ্রান্তে দাঁড়ানো লন্ডনের বিশাল নর্থউইক পার্ক হসপিটালের বেডে শুয়ে আছেন বিশালদেহী মানুষটি। চোখ খুলে কেবল তাকিয়ে আছেন। সে তাকানোয় অজস্র প্রশ্ন।

বলছিলাম অমর একুশের গানের স্রষ্টা কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা। অন্যসময় দেখা হলে তিনিই বেশি কথা বলেন। শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বহুবিধ বিষয় থাকে সেসব আলোচনায়। এবার তাঁর মুখে কথা কম, চোখে শূন্যতার ছাপ। সেখানে নেই আগের সেই প্রখরতা। প্রায় সব প্রসঙ্গেই যাঁর ঠোঁট গলে হাসি নেমে আসত সে মুখে এখন ঝুলে আছে নানা জিজ্ঞাসা।

৭ নভেম্বর অসুস্থ হয়ে তাঁকে যেতে হয় হাসপাতালে। সেই থেকে নিত্যসহচর তাঁর মোবাইল ফোনটিও বন্ধ। যে ফোনে লন্ডনে বসে বাংলাদেশ থেকে শুরু করে পুরো বিশ্বের খবরাখবর রাখতেন। নেই বাসায় একের পর এক ভক্তকূলের আসা-যাওয়া। দীর্ঘ তিন সপ্তাহ এই মানুষ অসুখের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। ২৭ নভেম্বর চিকিৎসকরা কিছুটা আশার কথা শোনালেন। বললেন, শরীরে অন্য কোনো সমস্যা নেই। কাশি আর চেস্ট ইনফেকশন। মানসিক চাপের কারণে এমন হতে পারে।

চিকিৎসকের কথা শুনেও তাঁর চোখের শূন্যতা কাটল না। জিজ্ঞাসা, কবে বাড়ি ফিরবেন। বাড়ির সেই চেয়ারে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতেন সাতচল্লিশের দেশভাগের সাক্ষী, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সহযাত্রী, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই রূপকার। আজ কেমন করে চুপ থাকবেন তিনি? যখন ইতিহাস খুলে বসেন মনে হয় নিখুঁত এই ইতিহাস-বলিয়ে যেন রচিত কোনো গ্রন্থ থেকে তুলে আনছেন কথা। দিন, তারিখ এমনকি সময় পর্যন্ত বলতে তিনি ভুল করেন না।

আবুদল গাফফার চৌধুরী আমাদের চলন্ত ইতিহাস। পাহাড়ের মতো শরীরের মানুষটির ধারণক্ষমতাও যেন পাহাড়সম। প্রায় বিশ বছর ধরে শরীরে ডায়াবেটিস রোগ বহন করছেন তিনি। হাঁটতে লাঠি ব্যবহার করছেন তা-ও বেশ কয়েক বছর হল। এই অবস্থায় দেশে-বিদেশে চষে বেড়িয়েছেন। শারীরিব এসব প্রতিবন্ধকতা কোনোভাবেই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি। লন্ডন ছেড়ে অন্য যে কোনো শহরে, যে কোনো দেশে বাংলাদেশ ও স্বাধীনতার পক্ষে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেই ছুটে গেছেন। তাঁর তো এভাবে শুয়ে থাকা চলে না। বার কয়েক আশ্বস্ত করলাম 'সুস্থ হয়ে যাবেন' বলে। উত্তরে বললেন, "যদি ভাগ্যে থাকে।"

যদি সুস্থ হয়ে ফিরেন আরও কিছু কাজ করবেন বলে আশা পোষণ করেন তিনি। আমিও বললাম, "গাফফার ভাই, শুয়ে থাকলে চলবে না, এখনও অনেক কাজ বাকি।"

আশা করছি আবদুল গাফফার চৌধুরীকে নিয়ে কিছু কাজ করার। এমনই কথা হয়েছে আমাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার। সেই কাজ করার ফুরসৎ মেলেনি। এবার সুস্থ হয়ে ফিরলে করব আশা রাখি।

তিনি এখন আর একুশের স্মৃতিচারণ করে বারবার জাবর কাটতে স্বস্তি পান না। মনে পড়ে একদিন বলেছিলেন, "যারাই স্বাক্ষাৎকার নেয় ওই একই প্রশ্ন। নতুন প্রশ্ন নেই। একই কথা বলতে বলতে আর ভালো লাগে না।"

তিনি নতুন প্রশ্ন চান, নতুন কিছু বলতে চান। এই নতুন নিয়েই কাজ করতে চাই তাঁর সঙ্গে। কী হতে পারে সেই কাজ? আবদুল গাফফার চৌধুরী সব সময় বলতেন এ জীবনে একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করতে চান। যাতে তিন বাংলাসহ (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, লন্ডন) বিশ্বের বাংলা সাহিত্যের লেখকদের তুলে আনতে চান। তাঁর এ কাজ বাংলা সাহিত্যের জন্য একটি নতুন যাত্রাপথ উন্মুক্ত করতে পারে। বলে দিতে পারে সাহিত্যের চিহ্ন তৈরির কারিগরদের পরিচয়। উঠিয়ে আনতে পারে আগামীর প্রবক্তা।

সাহিত্য বিষয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরীর পঠন-পাঠন দেখে চমৎকৃত হই। একুশের গান রচয়িতা কলামিস্ট এবং সাংবাদিক হিসেবেই অনেক পরিচিত তিনি। তবে সাহিত্য বিষয়ে তাঁর যে পাণ্ডিত্য তাতে তাঁকে এক বিস্ময় বলে মনে হয় আমার। তাই বলছি, তিনি যেন সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। প্রকাশ করতে পারেন সাহিত্য পত্রিকা।

চলচ্চিত্রের দিকেও রয়েছে আবদুল গাফফার চৌধুরীর আগ্রহ। চান বঙ্গবন্ধুর জীবননির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। যেখানে পুরো বঙ্গবন্ধু থাকবেন। যেখানে বঙ্গবন্ধুর মধ্য দিয়ে কীভাবে বাংলাদেশের মানচিত্র রচিত হয়েছিল সে চিত্র ফুটে উঠবে। সেখানে থাকবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ভোগান্তি ও উত্থানের চিত্র। সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে ছিলেন বলেই তিনি এ আশা প্রবলভাবে লালন করেন। কাজটি যদি হয় তাহলে সেটি হবে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি দলিল। আমাদের জীবনীনির্ভর চলচ্চিত্রের মধ্যে নানান তথ্যবিভ্রাট থাকে। মেশানো থাকে অতিকল্পনা। কিন্তু গাফফার চৌধুরী যদি বঙ্গবন্ধু বিষয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করতে পারেন তাহলে অতিরঞ্জন হবে না। বঙ্গবন্ধুর জীবন এত বৈচিত্র্যময় যে, সেখানে নতুন কোনো রঙের প্রয়োজন পড়বে না। এ কাজগুলোর জন্য গাফফার চৌধুরীর সুস্থ হয়ে ওঠা জরুরি।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর অনেক সাক্ষাৎকার রয়েছে। তবে এসব সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে তাঁর মজ্জায় মিশে আছে যে ইতিহাস তা পূর্ণাঙ্গভাবে উঠে এসেছে বলে মনে করি না। তাঁর অনেক কথা আছে যেগুলো প্রকাশিত হয়নি। আবার অনেক সময় কঠিন সত্য তিনি অকপটে বলে ফেলেন। যার ফলে তাঁকে নিয়ে বিতর্কও কম নয়। মেধাবী মানুষদের নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আজাদ কি কম বিতর্কিত ছিলেন? যাঁদের মেধাবিকিরণে নতুন মেরুকরণ হয় তাদের নিয়ে বিতর্ক থাকে। আমাদের সমাজ প্রথাবাদিতার পক্ষে। প্রথা ভাঙার পক্ষে নয়। আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রথা ভেঙে ভেঙেই সামনে এগিয়েছেন। ধীমান, দার্শনিকরা প্রথা মানলে নতুন দ্বার উন্মোচিত হয় না। দিগন্তের ওপারে কী আছে তা তো কোনো ছকে থেকে দেখা যায় না। ওই ছক মুছে যে বাইরে তাকাতে পারে তাকেই বলে নবযাত্রার নাবিক।

আবদুল গাফফার চৌধুরী সেই নাবিক। যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমানের আদর্শে বেড়ে উঠেছেন। তাই বলে কি আওয়ামী লীগের সমালোচনা করবেন না? তিনি সব সময় দলটির সমালোচনায় মুখর থেকেছেন। নেতা-কর্মী, এমপি-মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বাদ যান না তাঁর সমালোচনার তীর থেকে। কোথাও কোনো অসঙ্গতি দেখলেই তাঁর তীর্যক কলম সেদিকে আঘাত করেছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বেলায়ও সেটাই সত্য। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিএনপি যে মিথ্যাচার করেছিল, তার মোক্ষম উত্তর আমরা আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে শুনেছি। অভিজ্ঞতা ও তীর্যক দৃষ্টির কারণে তিনি আমাদের বারবার সঠিক ইতিহাস জানিয়ে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করেছেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নেও তিনি অটল। তাঁর মুখে শুনেছি রাজাকারদের ভূমিকার কথা। জেনেছি বঙ্গবন্ধুর আশেপাশে থাকা বিভিন্ন মানুষের কথা। এমন ইতিহাস সম্মুখে থাকতে অন্য কোনো পাঠের প্রয়োজন নেই। দেখা হলেই ইচ্ছে হয় পাতা খুলে খুলে ইতিহাসের পাঠ নিই। কিন্তু এখন তো পাতা খুলতে পারছি না। গ্রন্থটি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। সুস্থ হলেই আবার পাতা উল্টাব। ইতিহাসের আরও পাঠ নেব।

১৯৭৫ সাল থেকে আবদুল গাফফার চৌধুরী লন্ডনে বসবাস করতে শুরু করেন। বুকে এক বাংলাদেশ নিয়েই বসে থাকেন বিলেতের বুকে। এখানে বসে তিনি রচনা করেন দেশের চেহারা। তুলে আনেন সময়। সেই সময় থেকে আমরা জেনে যাই নিজের পরিচয়। যে পরিচয় আমাদের শাণিত, আলোড়িত করে। পয়োমন্ত মানুষ তিনি। তাঁকে ঘিরে কত আড্ডা হয়, অনুষ্ঠান হয়, হয় আলোচনা। তিনি কথা বলতে শুরু করলে আর থামেন না। তাঁর কথার মধ্যে ইতিহাস আছে, রস আছে, আছে ঘুরে দাঁড়াবার ইঙ্গিত। ফলে সবাই তাঁর কথা শুনতে পছন্দ করেন। আমরা প্রশ্ন করি আর তিনি উত্তর দিয়ে চলেন। কোনো রাগ নেই, বিরক্তি নেই। যেন সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাঁর প্রধান কাজ।

তবে একবার শুধু আমার বেলায় হয়েছিল বিপরীত। তিনি আমাকে বাসায় ডেকে পাঠালেন। যাওয়ার পর বল্লেন, তিনি একজন তরুণ লেখককে নিয়ে লিখতে চান। নির্বাচন করেছেন আমাকে। এবার তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, আর আমি উত্তর দিই। পাশে বসে আমাদের কথা লিপিবদ্ধ করেন বন্ধু সাজিয়া স্নিগ্ধা। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের কোনো অংশ বাদ যায়নি আলোচনা থেকে। বাংলা সাহিত্যের সম্প্রতিক ধারা নিয়েও কথা হয়েছে। আমার মতো এত ক্ষুদ্র মানুষের লেখালেখি বিষয়ে তাঁর আগ্রহ দেখে সেদিন বিস্মিত হয়েছিলাম।

সেদিনও হাসপাতালে দেখতে গেলে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেন, "আপনার কি কোনো বই প্রকাশিত হয়েছে গত বই মেলায়?"

বললাম, "জি, প্রকাশিত হয়েছে একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ।"

মৃদু হেসে বললেন, "আমি ব্যাকডেটেড হয়ে গেছি। কোনো কিছুর খবর রাখি না।"

বললাম, "গাফফার ভাই, আপনি বাসায় চেয়ারে বসে যে খবর রাখেন, তা তো আমরা দৌঁড়েও পারি না।"

এমন অনেক বিষয় আছে যা কেবল তাঁর কাছে গেলেই জানতে পাই। এ ক্ষেত্রে তথ্য জানা এবং জানানোর বিষয়ে তিনি অত্যন্ত দক্ষ একজন সাংবাদিক।

এ মানুষ এখন লন্ডনের হাসপাতালে শুয়ে আছেন। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। তাঁর মাথার পিছনের দেয়ালে ইংরেজিতে লেখা 'আবদুল চৌধুরী'। মনে মনে ভাবি এই হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকরা কি জানেন এই মানুষটি কে? তারা কি জানেন আজ বিশ্বে যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়, সেই একুশের গানের রচয়িতা এ বিছানায় শুয়ে থাকা এই মানুষটি? ভাবি আর চোখের কোণে জমে ওঠা জল মুছি। গাফফার ভাইয়ের বুকে ও মাথায় হাত বুলাই। বলি, "খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন আপনি। অনেক কাজ আছে বাকি। সেসব না করে আপনার ছুটি নেই।"

আপনি আমাদের তান্ত্রিক, আপনি আমাদের জ্যোতির্বিদ। আপনি আমাদের ভাষা ও বাংলাদেশ।