গোটা ভোটে অর্ধেক সম্পত্তি!

পারভীন সুলতানা ঝুমা
Published : 24 Nov 2017, 10:26 AM
Updated : 24 Nov 2017, 10:26 AM

সেদিন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নারীনেত্রীদের বৈঠকে সৌভাগ্য হয়েছিল উপস্থিত থাকার। আমি নেত্রী নই। যে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত তার প্রতিনিধি হিসেবেই আমাকে এ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আলোচনায় এসেছে নারীদের ভোটপ্র্রদান ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়। নতুন ও তরুণ ভোটারদের নির্বাচনমুখী করা। উল্লেখ্য যে, নতুন ৪২ লাখ ভোটারের মধ্যে শতকরা ৫২ ভাগই নারী। নির্বাচন কমিশনারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলে নারী ভোটারদের উপস্থিত শতকরা নব্বই ভাগ হয়ে থাকে। নির্বাচনে নারী ভোটারদের আধিক্য হলেই বুঝা যাবে কোনো পরিবর্তন আসছে। সে কারণে নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের কাছে নারী ভোটারদের গুরুত্ব বেড়ে যায়।

তবে নারী ভোটারদের মধ্যে কজন নিজের ইচ্ছা বা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বাড়ির পুরুষরা যাদের ভোট দিবে, নারীরাও তাদের দিবে এমনই বিধান চলে আসছে। নারী ভোটার বেশি হওয়া মানে নারীর পছন্দের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় চলে আসা তা কিন্তু নয়। শিক্ষিত ও সচেতন নারীদের মাঝে কেউ কেউ ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছা বা পছন্দের স্বাধীনতা প্রয়োগ করতে পারলেও পারতে পারেন। এক সময় গ্রামে প্রগতিশীল এনজিওগুলো নারীদের ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে প্রভাবান্বিত করতে পারত। এখন এ ধারা বেশ কমে এসেছে। ইদানিং ধর্ম দিয়ে নারীদের প্রভাবান্বিত করা হচ্ছে, প্রকাশ্যে না হলেও ভিতরে ভিতরে। তা করছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসহও তাদের পৃষ্ঠপোষক এনজিওরা।

শুধু নারী কেন, এদেশে ধর্মর সুড়সুড়ি সবাইকে দেওয়া যায়। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে শুধু গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের নয়, শিক্ষিত ও তথাকথিত প্রগতিশীলদের ইদানিং বশ মানানো যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দুর্বলের মধ্যে দুর্বল নারী, তাদেরকে অতি সহজে ধর্মের ভয় দেখানো সম্ভব। ২০০১ সালের নির্বাচনে এই অস্ত্র ব্যবহার করেছিল যারা পরবর্তীতে তারা পূর্ণিমার মতো ভয়াবহ ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছিল। কোরান শরীফ ছুঁয়ে নারীদের থেকে প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়েছিল একটি নিদিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে। আমরা যারা বাংলাদেশকে আবার অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র দেখার স্বপ্ন দেখি তারা এবার এ ধরনের শঙ্কা করছি আরও বেশি। চারপাশে নাগিণীরা নিঃশ্বাস ছাড়ছে। কালো আবরণে আপদমস্তক ঢাকা এ নাগিণীরা ভোটের আগে কী মিশন নেবে তা ভেবে আমরা আতঙ্কিত।

রাজনৈতিক দলের কাছে নারী ভোটার যতটা আদরণীয় নারী প্রার্থী ততটা অবহেলিত। নারী প্রার্থী কারও স্ত্রী, কারও কন্যা। তৃণমূল বা সক্রিয় সদস্য থেকে কতজন নারীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়? অবশ্য দলসমূহে তো নারী সদস্যের আকাল রয়েছে। বড় বড় দল যেগুলোর শীর্ষপদে নারীরাই অধিষ্ঠিত রয়েছেন, সেখানেও শতকরা ২ থেকে ৫ ভাগের মধ্যে নারী সদস্য সংখ্যা সীমিত। অথচ ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধি অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক দলসমূহে শতকরা ৩৩ ভাগ নারী থাকতে হবে। তা না হলে দলের রেজিস্ট্রেশন হবে না। তিন বছরেরও কম সময় আছে। নারী সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির কোনো আলামতই দেখা যাচ্ছে না।

ভয়ঙ্কর কথা হচ্ছে, কিছু ইসলামি দল এই নিয়ম বাতিল করতে চাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন ৪০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। যার মধ্যে ১৮টি ইসলামিক দল। অর্থাৎ প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ। তাদের এ ধরনের মন্তব্য ভয়াবহ, আমাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অপেক্ষা করতে হবে এদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কী পদক্ষেপ নেয়। তেত্রিশ ভাগ তো নয়ই, এ সকল ধর্মভিত্তিক দল একজনও নারী সদস্য রাখতে চায় না। বরঞ্চ তারা অন্য একটি দল তৈরি করতে চায় যেখানে সব সদস্যই নারী থাকবে। তাহলে তো সেটি অন্য একটি রাজনৈতিক দল হবে এবং তাকে আলাদা করে নিবন্ধন নিতে হবে। এতটুকু বুদ্ধি কি তাদের নেই?

নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে তাদের কাছে সবচেয়ে অসহ্য একটি শব্দ। নারীকে ধর্মের প্রতিপক্ষ তৈরি করে নিয়েছে তারা। কিন্তু এটা বলে না যে, নারীদের ভোটের প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র ভোটার হিসেবে নারীরা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। তাদের মুরব্বি সৌদি আরবের মতো নারীরা যদি ভোটাধিকার না পেত তাহলেই হয়তো তারা সবচেয়ে বেশি খুশি হত। পারলে এ দাবি তারা যে ভবিষ্যতে তুলবে না এ নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? আর তাদের এ দাবী যে মানা হবে না এমন নিশ্চয়তাই-বা কোথায়?

স্কুল পাঠ্যবই, মেয়েদের বিয়ের বয়স ইত্যাদিতে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তাতে তো বুঝা যাচ্ছে যে, তাদের দাবি পূরণে সমস্যা হবে না। দেখেশুনে মনে হয়, নারীদের ভোট অর্ধেক আর মোল্লাদের ভোট গোটা!

দলে তেত্রিশ ভাগ নারী সদস্য যদি না রাখা যায়, তাহলে প্রার্থী মনোয়নের সময় তেত্রিশ ভাগ নারীকে মনোয়ন দেওয়া হোক, কারও কারও সুপারিশ। মনোনয়ন মানে তো এখন কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। নারীদের অত টাকা কোথায়? ত্যাগী সাহসী প্রার্থী নয়, কয়েকশ কোটি টাকার মালিক এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী। নারীদের হাতে টাকা কম থাকে। যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তাদের বেশিরভাগ সৎ উপায়ে ব্যবসা করেন। কালোবাজারি, চোরাকারবারিতে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই কম।

আর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার? তথৈবচ। পিতৃসম্পত্তিতে কন্যা পুত্রের অর্ধেক পাবে, ধর্মে বলা আছে। ধর্মে বলা আছে সুদ খাওয়া যাবে না। ব্যাংক, সঞ্চয় পত্রসমূহ থেকে যারা সুদ খাচ্ছেন তারা কন্যার সম্পত্তি দেওয়ার ব্যাপারে অনেক ধার্মিক হয়ে যান। একটা ঘটনা বলি।

মেয়েদেরকে সমান সম্পত্তি দিতে চেয়েছিলেন এক মা। রে রে করে উঠেছে ছেলে। মাকে বলে, "ধর্মের বাইরে যেতে পারবে না।"

মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, "বাবা, তোকে তো একদিনও পশ্চিম দিকে সেজদা দিতে দেখলাম না জীবনে। এখন এমন ধার্মিক হয়ে উঠলি?"

একজন প্রগতিশীল ভদ্রলোক। ছোট ভাই মারা গেছেন এক মেয়ে রেখে। ভাইয়ের পুরো সম্পত্তি ভাইঝিকে দেননি। কারণ শরিয়াতে নাই। অনেক বোন সেই অর্ধেক সম্পত্তিও পায় না। এক ওয়াজে মৌলভী সাহেব বলছিলেন (এই প্রথম কোনো ওয়াজে ভালো কথা শুনলাম), "ভাইয়েরা বোনদের সম্পত্তি দিতে গেলে এমন এক জমি খুঁজে তাদের দেবে যার কোনো মূল্যই নাই। হয়তো বাড়ির পিছনে বন-জঙ্গলভারা জমি দেখে সেটি বোনদের দিবে। শহরে তবু এখন ফ্ল্যাট তৈরি হওয়ায় বোনরা একটা করে ফ্ল্যাট পায়। তবে এমনও শুনেছি সব বোনকে দেওয়া হয় না। বাবার অন্যান্য সম্পত্তি, যেমন গ্রামের জায়গা-জমি, ব্যাংকের টাকা-পয়সা সব ভাইদের। সেগুলোর কোনো ভাগ বোনরা পায় না।"

কারও কারও উদ্ভট যুক্তি, মেয়েরা বাবার সম্পত্তি পায়, স্বামীরটাও পায়। আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে, ছেলেরাও বাবারটা পায়, স্ত্রীরটা পায়। বরঞ্চ স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির যেটুকু পায়, স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তির ভাগ আরও বেশি পায়। স্ত্রীরা পায় স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ আর স্বামীরা স্ত্রীর সম্পত্তির ১/৪ ভাগ!

১৯৯৭ সালে তৎকালীর শাসক দল আওয়ামী লীগ একটি উদার নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করেছিল। সেই নীতিতে পৈত্রিক সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছিল। এ নীতি পাশ করে যেতে পারেনি তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগ। জোট সরকার এসে নারীনীতির কিছু পরিবর্তন করে। মারাত্মক পরিবর্তন হয় পৈত্রিক সম্পত্তির ক্ষেত্রে। তারা পৈত্রিক সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অধিকারের বিধানটি উঠিয়ে দেয়। ২০০৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার সেই বিধান রেখে নারীনীতিটি পাশ করাতে গিয়ে মোল্লাদের ভয়াবহ তাণ্ডবে পড়ে।

দুঃখের বিষয়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও নিজেদের বিধান ফিরিয়ে আনেনি।

পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান ছিলেন স্বৈরশাসক। পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করেছেন সর্বক্ষেত্রে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন। ইতিহাসে তিনি কুখ্যাত হয়ে থাকবেন। বাঙালির মনে তিনি সবসময় ঘৃণিত ব্যক্তি। এরপরও, ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ জারি করে তিনি প্রশংসার দাবিদার হতে পেরেছেন। এ আইনের কিছু দিক উল্লেখ করছি।

এর আগে শরিয়াহ আইন মোতাবেক কোনো ওয়ারিশের দাদা বেঁচে থাকতে তার বাবা মারা গেলে সে দাদার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হত। ১৯৬১ সালের অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী সেটি পরিবর্তিত হয়ে মৃত ব্যক্তির সন্তানদেরকে দাদার সম্পত্তির ভাগিদার করা হয়। পিতৃহারা বহু শিশু আক্ষরিক অর্থে বাঁচতে পেরেছে এ আইন পরিবর্তনের কারণে।

যে রাষ্ট্র ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠে সে দেশে শরিয়াহ আইন পরিবর্তন করা গেছে। আর যে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারায় জন্ম নিয়েছিল সে দেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে এভাবে নারীদের প্রতি বৈষম্য চলছে! শুধু নারীদের অধিকার দিতে গেলেই রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, রাষ্ট্র কেমন যেন একাট্রা হয়ে যায়।

ধর্মীয় আইনে মেয়েরা ছেলেদের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে। কিন্তু সমান সমান পেলে গুনাহ হবে এমন কথা ধর্মীয় গ্রন্থে লেখা নেই। এছাড়া যখন এ বিধান জারি হয় তখন মেয়েরা বিয়ের পর দূরে চলে যেত। সম্পত্তি হয়তো বিক্রি করে দিত। এখন নিম্ন উচ্চ প্রায় সব শ্রেণির পরিবারে দেখা গেছে, সামর্থ্য থাকলে মেয়েরাই বাবা-মাকে দেখছে। এসব যুক্তি দেখিয়ে পিতার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমান অধিকার আদায় করা যেতে পারে। কে বলবে? বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধার জন্য যে কেউ নেই। মোল্লাদের ভয়ে থরথর কম্পমান সকলে।

প্রতিক্রিয়াশীলদের একটি ভোট, নারীদেরও একটি। তাদের সকল দাবি মানা হবে, নারীদের নয়। যে সকল নারী তাদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার তাদেরকে পাত্তা না দিলে চলবে। কারণ তাদের ভোট তো সংরক্ষিত আছে। ভোটের ক্ষেত্রে সমানাধিকার, সম্পত্তির ক্ষেত্রে নয় কেন?

এ প্রশ্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীরা করতেই পারে। ধর্ম আর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করে যুক্তি দিয়ে নারীর অধিকার দেওয়ার সময় এল বুঝি।