নাগরিক সমাবেশউত্তর কিছু ভাবনা দুর্ভাবনা

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 22 Nov 2017, 04:10 PM
Updated : 22 Nov 2017, 04:10 PM

সাত মার্চের ভাষণ বিশ্বস্বীকৃতি পাবার পর ঢাকায় যে নাগরিক সমাবেশ হয়ে গেল তাতে আমরা দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী-লেখক-সাহিত্যিক-কবিদের দেখলাম অংশ নিতে। বিষয়টা রাজনীতির হলেও সে ভাষণ এখন আর দলের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। সব জাতির ইতিহাসে এমন ঘটনা থাকে না। কিছু ভাষণ ইতোমধ্যে দুনিয়ায় এমন উঁচু জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, সে সব নিয়ে মানুষ আর তর্ক করে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা বহুধাবিভক্ত। যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীন করেছিল তার ইতিহাস নিয়েও আমরা এক থাকতে পারিনি।

অমন একটি ভাষণ না হলে সেদিন কারও বাঁশির ফুঁয়ে দেশ স্বাধীন হত আর বাঙালি যুদ্ধে যেত এমন ভাবনা যাদের মাথায় তারা আসলেই হঠকারী। বিএনপি এদেশের ইতিহাসে যে দুটো বড় ভুল করেছে তার একটি তাদের ঘোষক-বিতর্ক। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন আদৌ ছিল না সেদিন। সাত মার্চের সে ভাষণ মূলত ঢাকাকে পাকিস্তান থেকে আলদা করে ফেলেছিল সেদিনই। এই জোয়ার, এই উদ্দীপনা, এই ভালোবাসা আমরা আগে-পরে আর কখনও দেখিনি। দেখবও না। আওয়ামী লীগের সমস্যা হল তারা সব কিছু দেরিতে বোঝে। যখন তারা তা বোঝে বা মাঠে নামে তখন আর আসলেই করার কিছু থাকে না।

এবার তারা যে উৎসাহে যে উদ্দীপনায় জাগল তার পেছনে আছে বৈশ্বিক স্বীকৃতি। প্রধানমন্ত্রীর একটা কথা বড় ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন, ইতিহাস তার প্রতিশোধ নিয়েছে। আসলেই তাই। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যত বড় আর বিশাল হোক না কেন, এই বিতর্কে তারা বিএনপিকে টলাতে পারেনি। বিএনপির পেছনে থাকা জামায়াত বা একদা মুসলিম লীগের মেধা জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছিল, এটা তাদের বড় পাওয়া।

কে না জানে মুক্তিযুদ্ধের সরকার বা তখনকার প্রশাসন ছিল আওয়ামী লীগের। সেখানে জিয়াউর রহমান কোনো ফ্যাক্টর ছিলেন না। এমনকি তিনি সেনাবাহিনীর বিশেষ কোনো দায়িত্বেও ছিলেন না। মুশকিল হচ্ছে, পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ছিটকে পড়া কর্নেল ওসমানী বা অন্যানভদের কাহিনি চাপা দিতে গিয়ে জিয়ার এই উঠে আসা ঠেকানো যায়নি। আজ এত বছর পর বিদেশিদের কাছে স্বীকৃত হবার পর হালে-পানি-পাওয়া আওয়ামী লীগ যা করছে সে কাজ করা উচিত ছিল অনেক আগে।

এই সভায় অধ্যাপক আনিসুজ্জমানের মতো মানুষকে দেখে যেমন ভালো লেগেছে তেমনি কিছূটা বিস্মিতও হয়েছি। আমাদের এই প্রিয় স্যার আরও অনেক বুদ্ধিজীবীর মতো একসময় আওয়ামী লীগবিরোধী হয়ে উঠেছিলেন প্রায়। সেটা যে-কেউ হতেই পারেন। জীবনের নানা ঘটনায় আমি বা আমার মতো অনেকেই বর্তমান আওয়ামী লীগের সঙ্গে চলতে পারি না। যারা মানুষের পাশে থাকেন তারা কোনো দলের অধীনে থাকতে পারেন না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারা সুশীল সমাজের নামে কোনো দলের বিপদ আনতে গিয়ে ইতিহাস বা অতীতের কথা মনে রাখবেন না।

একসময় সুলতানা কামাল, বদিউল আলম মজুমদার, মানবাধিকারের মিজানুর রহমান আর দেশের একটি সংবাদপত্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, অন্য অনেকের মতো স্যারও পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন প্রায়। সে সময় আমরা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, তাহলে কি ইতিহাসে জিয়াউর রহমানের ঘোষণাই ঠাঁই পেয়ে যাবে?

বিএনপির দেশশাসনে আসাটা যখন প্রায় নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল তখন আমরা অনেকের বৈকল্যে মন খারাপ করা ছাড়া আর কিছুই পারতাম না। বুদ্ধিবৃত্তির সহজ দিক হচ্ছে, পালে হাওয়া দেখলে নিজের পথ খুঁজে নেওয়া। আর কঠিন দিকটা হল, কঠিন সময়ে সমস্যা মোকাবেলা করে নিজেদের আলোয় দেশ-জাতিকে পথ দেখানো। বহুকাল হয় আমরা এমন কাজ দেখি না।

তারপরও সাত মার্চের ভাষণ কেন্দ্র করে এই সমাবেশের একটা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। মনে রাখতে হবে, কদিন আগে একই জায়গায় বিএনপির নেত্রী ভাষণ দিয়ে গেছেন। তাঁর ভাষণে তিনি মাফ করে দেওয়ার কথা বলেছেন। এই 'মাফ' শব্দটি আমাদের রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। হঠাৎ এই মাফ করার কথা ঘরপোড়া গরুর কাছে সিঁদুরে মেঘের মতো। যেখানে ইতিহাস অতীত কিংবা ভবিষ্যত বিষয়ে কোনো কথা নেই। মার্জনা কি মানুষের প্রতি মানুষের, না দলের সঙ্গে দলের না ইতিহাসের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির?

সেটা পরিষ্কার না হলে আমরা ধরে নিতে পারি যে, এখানে দুজন মানুষ বা কিছু মানুষের সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। তাতে কি রাজনীতি বা দেশের কোনো লাভ আছে আসলে?

ফিরে আসি সাত মার্চের ভাষণের কথায়। এই ভাষণ নিয়ে সমাবেশ করলেই কাজ শেষ হবে না। এর দুনিয়াময় ব্যপ্তি আর প্রসার চাই। পৃথিবীতে সেরা ভাষণের যেসব সংকলন আছে তাতে এটি নেই। সেখানে ঢোকানোর কাজ না করলে আবারও ছিনতাই হতে পারে এই মূল্যবান ভাষণ। আত্মতৃপ্তি রাজনীতি এগুতে দেয় না। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছিলেন, 'স্বপ্ন হচ্ছে তাই যা মানুষকে ঘুমোতে দেয় না, জাগিয়ে রাখে'। সে স্বপ্ন দেখা মানুষ বলেই কেউ বঙ্গবন্ধু আর তাঁর কর্ম দমাতে পারেনি।

তিনি এই ভাষণে বলেছিলেন, 'দাবায়ে রাখতে পারবা না'। সে অদম্য বাঙালির ইচ্ছাশক্তি আজ বহু জায়গায় অবদমিত। তাকে ভালোবেসে ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারলে সমাবেশের আলো দেশকে কতটা জাগাতে পারবে বলা মুশকিল।

তবে এটা মানি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই আজ দেশ ও জাতি এ জায়গায় আসতে পেরেছে। সে কারণে তাঁর দুশমনরাও সক্রিয়। দল যাই করুক, দেশের মানুষের কাছে এখনও সাত মার্চের ভাষণ এক প্রেরণা। সে প্রেরণা যেন বহুল ব্যবহারে মলিন না হয় আর আমরা যেন মনে করি এ ভাষণ সকলের। তবেই হয়তো সুদৃঢ় হবে আমাদের জাতিসত্তা।

আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে, মানুষের মনে বিএনপির প্রতি সমর্থন এখনও অধিক। বিশেষ করে প্রান্তিক শ্রেণির মানুষদের ভেতর বিএনপির জোয়ার রয়েছে। এর অনেক কারণ। ইতিহাস বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই বাঙালির। থাকার কারণও নেই। যে দল যখন দেশশাসনে তখন তার আসল চেহারা দেখে জনঘণ।।

এই সরকারের আমলে যত উন্নয়ন আর অগ্রগতি হোক না কেন, সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে। আর সেগুলো দমানো বা সেসব নিয়ে আইনি ও প্রশাসনিক কাজ করার পরিবর্তে কথা দিয়ে সামাল দিতে চাইছেন নেতারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাঠে পর্যায়ে সক্রিয়। খবরে দেখলাম, তিনি বলেছেন, ভারতকে চটাতে নাকি এসব করা হচ্ছে! জানেনই যখন থামাচ্ছেন না কেন তবে? আর না থামাতে পারলে কি মানুষ তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারবে আসলে?

আওয়ামী লীগ মনে করছে সংখ্যালঘুদের আর কটা ভোট! কিন্তু এটা হিসাবের বিষয় নয়, মূলত দলের আদর্শ আর নৈতিক মানদণ্ডের বিষয়। সেটা নড়বড়ে হয়ে গেলে একদিন দলই তেমন হয়ে যাবে। প্রগতিশীল সংখ্যাগুরুরা সব দেখছেন আড়াল থেকে। তাদের ভরসা দেবার বিষয়টাও কাজ করছে না। যতগুলো হানাহানি মারামারি, তার বিচারে বিলম্ব আর গড়িমসি মানুষকে উদভ্রান্ত করছে মাত্র। গদি আঁকড়ে থাকা আর গদিতে থেকে মন জয় করার ভেতর অনেক ফারাক। আমার ধারণা সে জায়গায় নিচের দিকে আওয়ামী লীগ অসফল।

কে না জানে বিএনপি যদি দেশশাসনে আসতে পারে ভাষণ তো ভাষণ এবার দেশের খোলনলচেও বদলে দেবে। কারণ লীগ সরকার জামায়ািতের হাঁটু ভেঙে দিয়েছে। তাদের মূল নেতাদের কেউ বেঁচে নেই। সে কারণে তারাও ছেড়ে কথা বলবে না। নির্বাচনে যাবে কি না সেটা ঠিক করার আগেই মির্জা ফখরুল বলে দিয়েছেন, জোট হবে এবং তা জামায়াতের সঙ্গে।

আওয়ামী লীগের নেতারা জানেন দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর মনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে বিচারক নিয়েও। চলমান প্রধান বিচারপতি নাটক বিএনপিকে নতুন শক্তি দিয়েছে। বেগম জিয়া চাঙ্গা হয়েছেন। ফলে নাগরিক সমাবেশের আনন্দ উজ্জ্বলতা নিরাপদ এটা মানতে পারছি না। রাজনীতিতে সুধীজনদের সমর্ধন ও অংশগ্রহণ জরুরি। কিন্তু আসল মালিক আমজনতা। তাদের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হলে ভাষণের পরিবর্তে ঘোষক উঠে আসবে এবার এবং এবারের খেলা হবে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের।

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির একটা বড় দিক হল, আঞ্চলিক ভাষায় বললে, 'পালটি-খাওয়া'। প্রয়াত আহমদ ছফা স্বাধীনতার পরপর লিখেছিলেন– বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন তা শুনলে দেশ স্বাধীন হত না'– একইভাবে তাঁরা যা বলছেন তা শুনলে দেশের উন্নতি হবে না। আজও কি তা সত্য নয়?

এই ধরুন আজ যখন জিম্বাবুয়েতে নেতা পরিবর্তনের চেষ্টা চলছে, ৩৭ বছর গদি আঁকড়ে থাকা মুগাবেকে হটানোর কাজ প্রায় শেষ, তখন মনে পড়ছে আমাদের অতীত পাসপোর্টের নিয়মের কথা। সেখানে লেখা থাকত, তাইওয়ান, ইসরায়েল ও তৎকালীন রোডেশিয়া (যার এখনকার নাম জিম্বাবুয়ে) যাওয়া নিষিদ্ধ। ইসরায়েলের কারণটি বুঝলেও বাকি দুটোর উপর নিষেধাজ্ঞার কারণ কী?

রহস্য হল, একটি সাদাদের খুশি রাখতে, অন্যটি চীনকে। যে চীন আমাদের স্বাধীনতা চায়নি, তাকে খুশি রাখতে আমরা তাইওয়ান যাওয়া বন্ধ রাখলাম। আর যারা আমদের লাখ লাখ মানুষ মারল লুটপাট করল ধর্ষণ করল, আমাদের দুনিয়া থেকে উজাড় করে দিতে চাইল, সেই পাকিস্তান ভ্রমণের ওপর থাকল না কোনো নিষেধাজ্ঞা!

সেদিন তা থাকলে আজ এত রাজাকার পয়দা হত না স্বাধীন দেশে। কোনো বুদ্ধিজীবীকে তো কোনো দিন এ নিয়ে কথা বলতে দেখিনি। সরকারকে এ নিয়ে সাবধানও করেননি কেউ। আজ যখন আওয়ামী লীগ সরকারে শেখ হাসিনা শক্ত অবস্থানে তখন অনেকেই এগিয়ে আসবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কজন আসলে সাবধান করবেন বা পথ দেখাবেন সেটাই দেখার বিষয়।

নাগরিক সমাবেশের রেখে যাওয় প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি। যতটুকু গণতন্ত্র বা সুশাসন কিংবা উন্নয়ন শেখ হাসিনা এনে দিয়েছেন তার বাইরে এখনও কোন শক্তি নেই যে আমাদের ভরসা দিতে পারে। কথাটা বললাম এ কারণে যে, আশা করার পরও খালেদা জিয়ার কাছ থেকে জাতি রোহিঙ্গা, আইন, বিচার কিংবা অন্যসব চলমান সমস্যা বিষয়ে কিছু শুনতে পায়নি। মাফ করে দেওয়ার নামে নিজেদের রাস্তা সাফ করার রাজনীতি ভাষণ তো বটেই মানুষকেও ছাড় দেবে না।

সুশীল নাগরিক সমাজ নিশ্চয়ই তা বোঝেন। মানুষের জীবনে শান্তি আর নিরাপত্তার বিকল্প নেই। এটাই শেষ কথা।