সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন কি নগরজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে পারবে?

ধীরাজ কুমার নাথ
Published : 20 Nov 2017, 12:08 PM
Updated : 20 Nov 2017, 12:08 PM

রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। এ বছরের ২১ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচন হবে এই মহানগরীতে। প্রথমবার হয়েছিল ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর। এবার ভোট দেবেন ৩৩টি ওয়ার্ডের প্রায় ৩ লক্ষ ৮৮ হাজার ভোটার। ইতোমধ্যে মেয়র ও কমিশনার পদপ্রার্থীদের পদচারণায় নগরীর জনপদ মুখর হয়ে উঠেছে।

জনগণের একটি অংশের প্রশ্ন, রংপুর সিটি কর্পোরেশন ঘোষণার পর নগরবাসীর কতটা উপকার হয়েছে অথবা নগরের লোকজন নাগরিক সুবিধা কতটুকু উপভোগ করতে পেরেছেন? পুরাতন পৌরসভার সঙ্গে কয়েকটি গ্রাম যোগ করে রংপুরকে মহানগরের রূপ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নগরের নিরাপত্তা, সক্ষমতা বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়নসহ নগরবাসীর অন্যান্য সুবিধার বিধান করতে না পারলে, মহানগর ঘোষণা এবং বারবার নির্বাচন করে লাভ কী?

২০১৮ সালের শেষভাগে নির্বাচন হবে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন, চট্টগাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশনের। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নগর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের শোরগোলে সারাদেশে শুরু হবে মহারণ।

চট্রগ্রাম মহানগরীর প্রায় অর্ধেক বছরের তিন মাস জলমগ্ন থাকে। দুদিনের বৃষ্টিতে ভেসে গেলে মহানগরী ঢাকায় নৌকা চলাচলের ছবি নগরবাসীর মনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে। খুলনা নগরী লবণাক্ততায় ভুগছে। এ সকল প্রতিবন্ধকতার মাঝেও বাস্তবতা হচ্ছে, নগরের অভিবাসন প্রতিরোধের উপায় নেই– হয়তো কিছুটা লাঘব করা যাবে, কিন্তু এ স্রোত বন্ধ করা যাবে না।

নগর মানুষকে আকর্ষণ করছে; আবার নগরে অভিবাসনে অনেকে বাধ্য হচ্ছেন। নগর হচ্ছে প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উদ্ভাবনীমূলক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। গ্রামীণ জনপদের জীবনযাত্রার চেয়ে নগরের পরিবেশ, আর্থিক এবং সামাজিক জীবনপদ্ধতি ভিন্ন। সুযোগের দুয়ারও এখানে অবারিত, অফুরন্ত।

প্রাচীন বিশ্বের শহরগুলিও ছিল আকর্ষণীয় এবং সভ্যতার কেন্দ্রস্থল। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সালে এই উপমহাদেশে গড়ে উঠেছিল মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার মতো প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনমূলক নগরী। সিন্ধু নদীর অববাহিকা, হোয়াংহো-ইয়াংসিকিয়াং এবং ইউফ্রোটিস-টাইগ্রিস নদীতীর এবং নীলনদের তীরের সভ্যতা হচ্ছে প্রাচীন। যার কুলে গড়ে উঠেছে বড় বড় শহর। মিশরের পিরামিড, খেমার সাম্রাজ্যের নিদর্শন আংকরভাটের মন্দির, ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান এবং বাগদাদ, কর্ডোভা, কনস্টানটিনোপল (ইস্তাবুল) শহরসমূহ সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।

শিল্প বিপ্লবের পর জনতার স্রোত যেভাবে গ্রামাঞ্চল বিরান ভূমি করে শহরমুখী হতে শুরু করছে তা প্রণিধানযোগ্য। ১৮০১ সালে লন্ডন শহরে বাস করতেন জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ। যা ১৮৯১ সালে উপনীত হয় ৭২ শতাংশে। তেমনিভাবে ইউরোপে ও আমেরিকায় অতিদ্রুত নগরায়ন হয়েছে।

১৯৫০এর দশকে তার প্রভাব পড়েছে এশিয়া ও আফ্রিকায়। যার ফলশ্রুতিতে ২০০৯ সালের মধ্যেই সমগ্র বিশ্বে গ্রাম ও শহরের জনসংখ্যা হয়েছে সমান সমান। জাতিসংঘের আর্থিক ও সামাজিক সংস্থার মতে, ২০১৪ সালে নগরবাসীর সংখ্যা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। বিভিন্ন জনপদের মানুষ শহরে এসে বসতি স্থাপন করে এক ভিন্নমুখী জীবনপদ্ধতির সূচনা করেছে। যার মধ্যে নিবিড় ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজনীয়তা এখন অনুভব করা যাচ্ছে অধিকভাবে।

নগর সমৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু সত্যি, কিন্তু সকল প্রকার রাজনীতি, দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, রোগ-শোক, নিরাপত্তাহীনতা, গৃহায়ন সংকট, পরিবহনে বিপর্যয়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, শব্দদূষণসহ অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর উৎকণ্ঠার কারণ হয়েছে। ১৯৭৬ সালে হ্যাবিটেট-১এর ভ্যাঙ্কুভার ঘোষণা এবং ১৯৯৬ সালে হ্যাবিটেট-২ নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করে।১৯৯২ সালে রিও ডি জেনেরিওতে ধরিত্রী সন্মেলন অনেকগুলি চুক্তি ও মত্যৈকের সূচনা করে।

ফলে ২৫-২৭ সেপ্টেম্বর আয়োজিত জাতিসংঘের ৭০তম অধিবেশনে 'টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য ২০৩০' বিশ্বের প্রায় সব কটি দেশের সমর্থন লাভ করে। বিশ্ববাসী ২০৩০ সালের মধ্যে নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য ১৭টি লক্ষ্য ও ১৬৯টি টার্গেট সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। বিশ্ব থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন, সুস্বাস্থ্য সংরক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন, সুযোগের সমতা বিধান ইত্যাদি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এসবের মধ্যে ১১নংএর লক্ষ্য হচ্ছে শহর নিরাপদ, বাসযোগ্য ও টেকসই হিসেবে পরিণত করা। (Making cities and human settlements inclusive, safe, resilient and sustainable).

এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আছে ৭টি টার্গেট। যার মধ্যে রয়েছে, গৃহায়ন, পরিবহন, দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা, ঐতিহ্য-সংরক্ষণ, বায়ুদূষণ প্রতিরোধ, সবুজ বেষ্টনী ও বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়সমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৫১ সালে জনসংখ্যা ছিল ৪.৫১ কোটি যা ২০১৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে উপনীত হয়েছে ১৬.২১ কোটিতে, মাত্র ৬৫ বছরে চার গুণ বেড়েছে। আরও লক্ষণীয় যে, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে শহরবাসীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। যা এখন হয়েছে ৩০ শতাংশের উর্ধে।

হিসাব হচ্ছে, ২০৩৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে শহরবাসীর সংখ্যা হবে ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশে বর্তমানে ১১টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৩২৭টি পৌরসভা রয়েছে। যার সংখ্যা বেড়ে যাবে দ্রুতগতিতে। কিন্তু নগরজীবন আকর্ষণীয় করতে হলে চাই অনেক বিনিয়োগ। সর্বোপরি একটি শহর বাসযোগ্য ও টেকসই করতে হলে চাই পরিচ্ছন্ন ও প্রশস্ত রাস্তাঘাট, পরিবহনের ব্যবস্থা, কঠিন বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ,বায়ুদূষন ও শব্দদূষণ থেকে মুক্তি। বৃহত্তর ঢাকা শহর হবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ ঘনবসতিপূর্ণ শহর।

রাজনীতি, প্রশাসন, কুটনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক এবং স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এই শহরে বর্তমান পরিবহন ব্যবস্থা, যানজট, জলজট, শব্দদূষণ, দুর্ঘটনা ও দুর্বত্তায়ন সব মিলেমিশে একাকার। তারপর সর্বত্র দৃশ্যমান হচ্ছে বৈষম্য। প্রায় ৩৩ শতাংশ লোকজন বসবাস করে বস্তিতে, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে শৌচাগার ব্যবহার করে পুরুষ মহিলানির্বিশেষে। কিছুদিন পর পর দেখা দেয় নিত্যনতুন রোগ, কখনও ডেঙ্গি, আবার কখনও চিকনগুনিয়া এবং ম্যালেরিয়া। খাদ্যে চলছে ভেজাল অবাধে, ফুটপাতে চলছে মোটরসাইকেল, বিনোদনের কেন্দ্র বা উন্মুক্ত স্থান নেই বললেই চলে। কর্মের সন্ধানে অথবা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তির লক্ষ্যে আসা জনগণের জন্য শহরে বসবাস করা হয়ে উঠেছে বিড়ম্বনার সামিল। নগরজীবনের স্বাচ্ছন্দ্য হচ্ছে কল্পনামাত্র।

বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ জারি করেছেন। এই আইনে নগর কর্তৃপক্ষকে ১০০টির অধিক দায়-দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু আয়ের উৎস হয়েছে মাত্র ২৬টি। নগর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে জনস্বাস্থ্য, কঠিন বর্জ্য ও মেডিকেল বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধীকরণ, গণশৌচাগার নির্মাণ, নিরাপদ পানির ব্যবস্থাকরণ, কসাইখানা নির্মাণ, মৃতদেহের সৎকার, জননিরাপত্তা বিধান, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও গণপাঠাগারের ব্যবস্থা এবং সামাজিক কল্যাণ সাধন।

এসব কাজের জন্যে প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ এবং অর্থের সংন্থান। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষের আয়ের উল্লেখযোগ্য উৎস হচ্ছে, হোল্ডিং ট্যাক্স এবং রিকসা ভ্যান থেকে আদায় করা শুল্ক। এই আয় দিয়ে কোন অবস্থায় ৬০ শতাংশের অধিক ব্যয় নির্বাহ সম্ভব নয়। তাই প্রায় প্রতিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভা নির্ভর করতে হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের থোক বরাদ্দের উপর, যা পেতে হলে প্রয়োজন সরকারের প্রতি আনুগত্য। আইন আছে যদি কোনোভাবে অসদাচরণের ঘটনা প্রমাণিত হয়। তবে স্থানীয় সরকার বিভাগ নির্বাচিত কর্পোরেশন/পৌর কর্তৃপক্ষকে সুপারসিড বা বাতিল করতে পারে।

প্রশ্ন হচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, প্রশাসনিকভাবে পরনির্ভরশীল নগর কর্তৃপক্ষ কীভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে বাসস্থান, পরিবহন, কঠিন বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাসহ একটি নিরাপদ ও টেকসই আদর্শ নগরী গড়ে তুলবে?

তাই এবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ বাড়িয়ে করেছে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। জাতীয় সংসদে এ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। বাড়িভাড়াও বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। সাধারণ নগরবাসীর বিড়ম্বনার শেষ নেই। পক্ষান্তরে, যানজট, জলজট, প্রতারণার বেড়াজালে জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য হচ্ছে দূরীভূত।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যসমূহের মধ্যে ১১নং লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে এখনই প্রয়োজন বৃহৎ পরিকল্পনা। লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রধানত চারটি বিষয় কেন্দ্র করে। যার মধ্যে আছে অন্তর্ভুক্তিকরণ, (Inclusiveness), নিরাপত্তা (Safety), স্থিতিকরণ (Resilient) এবং টেকসই উন্নয়ন (Sustainability)।

সার্বিকভাবে অর্ন্তভুক্তিকরণ তখনই বলা হবে যখন দেখা যাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মেয়র এবং কাউন্সিলরগণ নির্বাচিত হয়েছেন এবং যেখানে গরিব মানুষ ও নারীরা কথা বলতে পারছেন এবং নীতি নির্ধারণীতে তাদের কণ্ঠস্বর দৃশ্যমান হচ্ছে। একটি নগরী তখনই নিরাপদ হবে যখন নারী ও শিশুরা নিরাপদে শহরের সর্বত্র চলতে পারবে এবং সকল প্রকার উৎপীড়ন ও দুর্বলের প্রতি আক্রমণ ও বৈষম্য বন্ধ হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হলে টেকসই উন্নয়নের প্রত্যাশা বৃথা এবং কল্পনামাত্র।

এখনই সময় এসেছে শহরমুখী জনগণের অভিবাসনের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে শহরকে গড়ে তোলা এবং টেকসই উন্নয়নের ১১নং লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার প্রয়োজনে গ্রহণযোগ্য নগর উন্নয়ন কৌশলপত্র প্রণয়ন করা। নির্বাচনে বিজয় লাভ বড় কথা নয়, নগরজীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বিধানই হোক নির্বাচনের প্রধান লক্ষ্য।