অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের থ্রি পার্সেন্ট প্রস্তাব ও কতিপয় কৈফিয়ত

আকতার হোসেন
Published : 18 Nov 2017, 09:46 AM
Updated : 18 Nov 2017, 09:46 AM

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বহুদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষকে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। বিশেষ করে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র এবং পরবর্তীতে 'আলোর ইশকুল', 'আলোর পাঠশালা' ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি আলোকিত মানুষ গড়ার কাজে ব্যস্ত। সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখা সত্বেও তিনি শিক্ষক হিসেবেই অধিক জনপ্রিয়। জীবন্ত কিংবদন্তীতুল্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাংলাদেশে মানুষের কাছে 'স্যার' নামে খ্যাত।

জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থানরত এই শিক্ষক এখনও অতিথি বক্তা হিসেবে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গিয়ে দেশ ও মানবতার সপক্ষে যুবসমাজকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব, মেধা, চিন্তা ও ভাবপ্রকাশের ভিন্নতার কারণে তিনি অগণিত শিক্ষার্থীদের মনের গভীরে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন: "আমার চ্যালেঞ্জ ছিল কেবল শিক্ষক হওয়া নয়, সব ছাত্রের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানো, সব ছাত্রের হৃদয় আপ্লুত করা৷"

তাঁর এই চ্যালেঞ্জ তিনি যে সাফল্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ করেছেন সে নিয়ে কারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

যে সমস্ত ব্যক্তি সশরীরে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতা শুনতে পারেন না তারা অনলাইন বিশেষ করে ইউটিউবে গিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনে থাকেন। সময় পেলে আমিও ইউটিউবে গিয়ে তাঁর বক্তব্য শুনি। ইউটিউবে অপলোড করা একটি ভিডিও ক্লিপে দেখলাম প্রবাসী শ্রমিক বনাম অনাবাসী প্রফেশনালদের নিয়ে স্যারের একটি বক্তব্য। একটি বিশেষ কারণে তিনি শক্ত ভাষায় অনাবাসী বাংলাদেশিদের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরামর্শ দিয়েছেন। ব্যাপারটা খুলেই বলি।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন,

"যে সব বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিদেশে থাকে তারা আমাদের দেশে রেমিটেন্স করে, টাকা পাঠায়, তাদের কষ্টে-শ্রমে-ঘামে-রক্তে উপার্জন করা টাকা দেশে পাঠায়, সেই টাকা দিয়ে আমাদের বাইশ বিলিয়ন ডলার জমেছে। এর ফলে আমাদের শিরদাঁড়া কিছুটা শক্ত অবস্থায় আছে। কিন্তু আমাদের যারা প্রফেশনালরা বাইরে আছে তারা কী পাঠায়? কয়জন পাঠায়? আমি তো মনে করি একজন শ্রমিকের ঋণ এই দেশের কাছে যতটা একজন প্রফেশনালের ঋণ তার থেকে বেশি না কম? অনেক বেশি। অনেক বেশি ঋণ। তারা এই দেশ থেকে সব নিয়েছে। গরিব মানুষের রক্ত– যে গরিব মানুষের ছেলেটা কোনোদিন কলেজে আসতে পারবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে পারবে না– তার সেই হাড়ভাঙ্গা খাটনির উপার্জিত অর্থ দিয়ে সে এদেশে পড়াশুনা করে চলে গেছে।"

"ঋণ থাকলে তো তার ঋণ পরিশোধের একটা হৃদয় থাকা উচিৎ। তোমাকে এই দেশের জন্য কিছু না কিছু করতেই হবে। কিছু না কিছু তোমায় দিতেই হবে। তুমি যদি না দাও আমি মনে করি তারও শাস্তি হওয়া উচিৎ। আমি গভার্মেন্টের সঙ্গে ইতিমধ্যে কথাবার্তা শুরু করেছি যে, যারা দেশের বাইরে আছে তাদের আর্নিংএর থ্রি পার্সেন্ট বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। এই থ্রি পার্সেন্ট সে দিয়ে দেবে না। এই থ্রি পার্সেন্ট হয় সে ইনভেস্ট করবে তারই জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ ডলারটা পাবে। সে ইনভেস্ট করবে, না হলে সে কোনো আত্মীয়কে দেবে, স্বজনকে দেবে। না হলে কিছু একটা ভালো কাজের মধ্যে দেবে। এইটুকু হওয়া উচিৎ। আর তা না হলে, বাংলাদেশি পাসপোর্ট যদি থাকে সেটা ক্যানসেল করে দেওয়া উচিৎ এবং কোনোদিন যেন সে ভিসা না পায় বাংলাদেশের আসার সে ব্যবস্থা করতে হবে।"

অপর একটি বক্তৃতায় দেখলাম তিনি এই প্রসঙ্গে আমেরিকাপ্রবাসী এক ভদ্রমহিলার কথা উল্লেখ করে বলেছেন,

"আমি সেই মহিলাকে ঠিক একই কথা বলেছিলাম। বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে শিক্ষিত প্রফেশনালেরা যখন কোনো ডলার বাংলাদেশে পাঠাবে না তাদের পাসপোর্ট বাতিল করে দেওয়া হোক। এই দেশকে যখন সে ভালোবাসে না, এদেশকে যখন সে কিছু দেবে না, এই দেশের সাথে যখন কোনো সম্পর্ক রাখবে না, তাহলে দেশ কেন তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে? সেই মহিলা অপমানিত হয়ে তার পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে বলল, 'এই নেন আপনার পাসপোর্ট'।"

বিয়েবাড়ির আড্ডায় স্যার তখন সেই মহিলাকে (মহিলার শরীর-স্বাস্থ্য-নখ নিয়ে পরিহাস করে) বলেছিলেন,

"হ্যাঁ, এখন তো পাসপোর্টের আর দরকার নেই। কেননা যা মাখন-ননি খাবার ছিল তা তো খাওয়া শেষ। এখন তো বাংলাদেশের আর প্রয়োজন নেই।"

এই বক্তৃতায় তিনি পুনরায় বললেন,

"মানুষ যে, সে তার ঋণ পরিশোধ করে। অমানুষ ঋণ পরিশোধ করে না।"

প্রসঙ্গত আরও একটি বক্তৃতার কথা উল্লেখ করেতে চাই। সেই বক্তৃতায় (ইউটিউব দেখা) আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বুঝাতে চেয়েছেন যে, যারা বিদেশে থাকে তারা জীবনের স্বাদ পায় না। তিনি বলেছেন,

"আমি বিদেশে গিয়ে দেখেছি যারা চাকুরী করে– সেই সকাল ছয়টায় উঠে রেডি হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে অফিসে যায়। তারপর সারাদিন অফিস করে রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে ফেরে। একটু যদি ভাগ্যবান হয়, মানে নিচের দিকের অফিসার হয়, তারাই তাড়াতাড়ি ফেরেন। আর উপরের হলে তো রাত বারোটার আগে কোনো উপায় নেই। বাড়িতে আসল, বসল, সোফার উপর টাই টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে একটু টেলিভিশন দেখল। কিছু খেল, কিছুক্ষণ ঘুমল। পরের দিন আবার সেই দৌড়। পাথর ঠেলতে ঠেলতে আর দৌড়াদৌড়ি করতেই জীবন শেষ হয়ে গেল। জীবন কত মহিমান্বিত আলোকময়, সৌন্দর্যময়, শ্রেষ্ঠ, মহৎ সে কথা জানার কোনো সুযোগ মানুষ পাচ্ছে না।"

আমি বলব যথার্থ পর্যবেক্ষণ। লেখাপড়া করার খচর না মিটিয়ে দেশ ছেড়ে যারা দীর্ঘদিন বিদেশে থাকছে তারা জন্মভূমি বাংলাদেশের ঋণ কেন শোধ করবে না? তবে এ প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে প্রথমে বলি 'প্রবাসী' এবং 'অনাবাসী' এই দুটো শব্দের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। যিনি প্রবাসী আর যিনি অনাবাসী দুজনেই থাকেন বিদেশে। প্রবাসী বলতে আমরা বুঝি যারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে চুক্তিভিত্তিক চাকুরীতে নিয়োজিত আছেন তাদেরকে।

প্রবাসীরা যেহেতু চুক্তিভিত্তিক অন্য দেশে অবস্থান করছেন, তাই চুক্তি শেষ হয়ে গেলে তাদের দেশে ফিরে আসতে হয়। চাকুরীর ধরন (দক্ষ, আধা-দক্ষ, অদক্ষ, লিগ্যাল, ইল-লিগ্যাল ইত্যাদি) অনুযায়ী বিভিন্ন দেশে এদের বসবাসের পরিবেশ ও আয়-ব্যয় ভিন্ন। প্রবাসীদের বেশিসংখ্যক সদস্য পরিবার নিয়ে বিদেশে যেতে পারেন না। বিদেশে যাবার অনুমতি না থাকার কারণে কিংবা সন্তানদের স্কুল-কলেজের টিউশন ফি, চিকিৎসা এবং আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর সাধ্য থাকে না বলেই এরা বিদেশে একা থাকেন। সংসারের দায়িত্ব মেটাতে তাই বাংলাদেশে অবস্থানরত পরিবারকে এদের টাকা-পয়সা পাঠাতে হয়। এছাড়াও যেহেতু চুক্তি শেষ হয়ে গেলে তাদের দেশে ফিরে যেতে হয়, তাই উপার্জিত অর্থের পুরোটাই দেশে না পাঠিয়ে উপায় থাকে না।

প্রবাসীদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রা এভাবেই দেশের রেমিটেন্স বাড়ায়। চুক্তিভিত্তিক চাকুরী বা কাজ থেকে অর্জিত বেতন বা ভাতা যদি বিদেশে রাখার সুবন্দোবস্ত থাকত তাহলে কতজন শ্রমিক, চাকুরীজীবী দেশে কতটুকু রেমিটেন্স পাঠাতেন সে ভিন্ন আলোচ্য বিষয়।

অন্যদিকে, যারা অনাবাসী তারা হাতে দুটি সুটকেস নিয়ে বিদেশের বাড়িতে হয় একা কিংবা পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যান। যাবার সময় হাতে দুটো সুটকেস নিয়ে গেলে কী হবে কিছুদিনের মধ্যেই এদের নিজস্ব বাড়ি, নিজস্ব গাড়িসহ দুনিয়ার টুকিটাকিতে ঘর ভরে থাকে। কোনো কারণবশত যদি এদের কাউকে দেশে ফিরে যেতে হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে জাহাজের কন্টেইনার লাগবে।

আজ যারা অনাবাসী সাধারণত তাদের পিতামাতারা অনেক আগে গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হয়েছিলেন। একবার শহরমুখী হলে কেউ গ্রামে ফিরে যেতে চান না। কাজেই বলা যেতে পারে ঐ সমস্ত পরিবারগুলো প্রথমেই দেশের মধ্যেই অনাবাসী হয়েছিলেন। অর্থাৎ আজ যারা অনাবাসী, তাদের পূর্বপুরুষেরা প্রথমে গ্রাম ছেড়ে শহরের জীবন বেছে নিয়েছিলেন এবং শহরবাসী থেকে এখন তারা অনাবাসী হচ্ছেন। জীবনের গতি মেনেই মানুষ অগ্রসর হচ্ছেন।

ধারণা করা হয় বিভিন্ন দেশে যারা চুক্তিভিত্তিক শ্রমজীবী তাদের বেশিরভাগ এখনো স্থায়ীভাবে গ্রামের বাসিন্দা। কাজেই তাদের পাঠানো টাকা-পয়সা সরাসরি চলে যাচ্ছে পরিবারগুলোর কাছে। এরাই হয়তো কিছুদিন পর শহরমুখী হবেন। অতঃপর তাদের কিছু অংশ হবেন অনাবাসী।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বিদেশে প্রফেশনাল বলতে অনাবাসীদেরকেই বুঝিয়েছেন। কাজেই সেই অনাবাসীদের নিয়ে কিছু কথা বলব।

একজন অনাবাসী প্রবাসের চাকুরীর বাজারে নিজ প্রচেষ্টায় এক কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে সুযোগ খুঁজে নেন। বলা যেতে পারে তারা স্বাধীনভাবে পেশা বদল করেন। একটা চাকুরী গেলে অন্যটা যাতে পাওয়া যায় সে জন্য বিদেশে বসেই যোগ্যতা ও প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে নিজেদের শিক্ষা-দীক্ষা অভিজ্ঞতা অনবরত উন্নত করতে থাকেন। এর জন্য তাদের ব্যয় করতে হয় প্রচুর অর্থ। এছাড়াও এদের প্রায় সবাই বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেওয়া মানেই সেই দেশের উৎপাদনে অংশগ্রহণসহ সব ধরনের নাগরিক দায়িত্ব পালন। অতিরিক্তভাবে রয়েছে গাড়ির কিস্তি পরিশোধ, বাড়ির মর্টগেজ, গাড়িবাড়ি মেইন্টেনেন্স খরচ, ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খরচ ইত্যাদি মেটাতে এবং জীবন ব্যবস্থার সমতা আনতে সেই পাথর ঠেলার জীবন হয়ে ওঠে এদের।

প্রতিটা পরিবারের জন্য সন্তানই হল ভবিষ্যৎ। সেটা যেমন প্রবাসী শ্রমিকদের বেলায় প্রযোজ্য তেমনি অনাবাসী পিতামাতার জন্যও আবশ্যক। পার্থক্য হল, প্রবাসীদের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশে নিজস্ব পরিবেশ ও সমমানের জীবনব্যবস্থায় বড় হচ্ছে। সামাজিক পরিচিতি আয় ও বাসস্থান অনুযায়ী যা অভিন্ন।

অন্যদিকে অনাবাসী পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েরা মূলধারার (যে যেই দেশে থাকে) ছেলেমেয়েদের মতো কিংবা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চক্রে হাবুডুবু খায়। ওদের তাল মিলিয়ে চলতে হয় একটা বড় ডাইভার্স গোষ্ঠীর সাঙ্গে। পিয়ার প্রেশারটা এখানে অনেক বড়। তাই মূলধারার মানুষের মতো অনাবাসী পরিবারের অনেকেই ছাত্রজীবন থেকে বাবা-মায়ের পাশাপাশি পাথর ঠেলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সেই পাথরটানা জীবনের আয় থেকে থ্রি পার্সেন্ট কেন বাংলাদেশ পাচ্ছে না সেটাই দেখতে হবে।

হয়তো এমন কিছু বিষয় আছে যে কারণে কোনো কোনো অনাবাসী পরিবার বাংলাদেশে সরাসরি অর্থ বিনিয়োগ করছে না। অনাবাসীদের উপার্জিত বেতন বা আয় বাংলাদেশি টাকায় কনভার্ট করে সত্তর-আশি গুণের অঙ্ক কষলে যেটা বোঝা যাবে না তা হল, একজন অনাবাসীর নেট (গ্রস নয়) আয় থেকে মাসিক আয়-ব্যয় মিটিয়ে আদতে কি কোনো সঞ্চয় থাকে, থাকলেও কতটুকু থাকে? ডলার থেকে টাকায় কনভার্ট করলে মনে হবে অনেক বেশি টাকা। কিন্তু স্থানীয় বাজার দর, চাহিদা ও চালচলন মেটাতে গেলে সেই বেশির কিছুই থাকে না।

প্রবাসীদের, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যারা আছেন তাদের সুবিধা হল, আয়ের জন্য তাদের কোনো আয়কর দিতে হয় না। তাদের বসবাসও যৌথ ব্যবস্থার মধ্যে সীমিত। সম্ভবত উপার্জিত অর্থের শতভাগই তাদের হাতে পৌঁছায়। কিন্তু অনাবাসীদের পে-চেক থেকে সরকারি ট্যাক্স, কোম্পানি-প্রদত্ত স্বাস্থ্য-বীমা, সঞ্চয়-বীমা, জীবন-বীমা ইত্যাদি না কেটে কোনো টাকা দেওয়া হয় না। দেশকালপাত্রবিশেষে এই হিসাব ভিন্নতর হতে পারে, তবু মোটামুটিভাবে আয়ের ৩০-৩৫ ভাগ অর্থ চলে যায় পে-চেক হাতে আসার আগেই। এরপর বাসস্থান ও যাতায়াত বা দুএকটা ভালো গাড়ী মেইন্টেন করতেই আয়ের বাকি ৪০-৪৫ ভাগ খরচ হয়। খাওয়া-দাওয়া কিংবা লিকুইড এসেট বা অন্যান্য খরচের জন্য বাঁচে কি?

জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে বেশিরভাগ মানুষকে তাই অতিরিক্ত একটি চাকুরী করতে হয় অথবা ওভার টাইম করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরেন তারা। যাদের কপাল ভালো কিংবা প্রফেশনাল জব করেন তারা অবশ্য একটা চাকুরী করেই সংসার সদস্যদের সঙ্গে দিনের বাকিটা সময় ব্যয় করতে পারেন।

এদিকে বাংলাদেশের মতো আবহাওয়া অনেক দেশেই নেই। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশে বছরের মাত্র কয়েকটা দিন দীর্ঘ সূর্যের আলো পাওয়া যায়। তা না হলে অন্ধকারের মধ্যে দিনের শুরু আবার অন্ধকারেই দিনের শেষ। অনেকে বরফ ঠেলে কিংবা তাপমাত্রা মাইনাসের কোঠায় ঘুম থেকে উঠে কাজে যান। তার আগে বাংলাদেশের একজন কাজের বুয়া, ড্রাইভার চাচা যা যা করে তার সবই একজন অনাবাসীকে করতে হয় নিজ হাতে। শুধু টাই পড়া দেখে ভুল বুঝলে চলবে না, এই টাই গুঁজে বাথরুম পরিষ্কার করা, থালা-বাসন মাজা সব করতে হয় অনাবাসী পরিবারগুলোকে।

বলা হয়, একজন অনাবাসী মা দিনে প্রায় দুটি ফুলটাইম চাকুরীর সময় ব্যয় করেন পরিবারের জন্য। বিশেষ করে যারা নিউকামার বা যাদের ছেলেমেয়েরা এখনও স্কুল-কলেজের গণ্ডি শেষ করতে পারেননি তাদের অবস্থা আরও করুণ।

এছাড়াও বাচ্চাদের খেলার মাঠে নিয়ে যাওয়া, সুইমিং শিখতে কিংবা মিউজিক ক্লাসে, লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতে হয় অভিভাবকদের। বাড়িতে নানি-দাদি নেই, আয়া-বুয়া নেই, ফুপাত-খালাতো ভাইবোন নেই– বাচ্চাগুলো তো আর চার দেওয়ালের মধ্যে বসে থাকতে পারে না। তাই বাবা-মাকে ছুটতে হয় ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে।

এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের সব কিছুর পেছনে টাকা লাগে। ভাগ্য ভালো হলে কেউ কেউ হয়তো সরকারি সুযোগ সুবিধার কিছু ভোগ করতে পারে। জানি না এরপরও কজনের হাতে টাকা জমা থাকে যা দিয়ে থ্রি পার্সেন্ট শোধ করতে পারবেন।

বাস্তবতা হল, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি অংশ কোনোদিন দেশে ফিরে যাবে না। তাদের ছেলেমেয়েরাও হয়তো কখনও বাংলাদেশে গিয়ে বসতবাড়ি গড়বে না। ঠিক আজ যারা বাংলাদেশে শহরবাসী হয়ে আছেন তাদের মতন। বিশেষ করে যারা ঢাকাবাসী তারা যেমন বাসাবাড়ি ছেড়ে বাপ-দাদার ভিটেমাটিতে আর ফিরে যাবেন না, অনাবাসীদের ছেলেমেয়েরাও হয়তো তাই করবেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ক্যারিবিয়ানদের মতো বাংলাদেশের এক বড় জনগোষ্ঠী বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে এবং বলবে, আমাদের ফোর-ফাদার্স এসেছিল বাংলাদেশ থেকে।

আগে মানুষ মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত ব্যক্তির লাশ প্লেন করে দেশে নিয়ে যাওয়া হত। এখন সেটা খুব দেখা যায় না। ইতিমধ্যেই বিদেশের মাটিতে অনাবাসীরা নিজস্ব কবরস্থানের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির, বাংলা স্কুল, বাংলা গ্রোসারি অঞ্চল, বাংলাদেশ কমিউনিটি সেন্টার থেকে শুরু করে যা যা লাগে সব ব্যবস্থা করে বিদেশের মাটিতে মিনি বাংলাদেশ গড়ে তুলেছেন। বাংলা টাউন শব্দটা এখন বহুলশ্রুত শব্দ। এই বাংলা টাউনে মূলধারার মন্ত্রী-মিনিস্টার-মেয়রদের আনাগোনা বেশি। মূলধারার নাগরিকেরা বই-পুস্তকে কিংবা ম্যাপে দেখে থাকবে বাংলাদেশের মানচিত্র। অনাবাসীরা তাদের কাছে সাক্ষাত বাংলাদেশ।

এক সময় দেশের ছেলেমেয়েদের শাসন বারণ করা হত যেন পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে না পড়ে। ছোটবেলায় তাদের ভয় দেখানো হত, বিদেশি সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতিকে একদিন গিলে খাবে। এখন উল্টোটা হচ্ছে। বিদেশের মাটিতে বাংলা সংস্কৃতি ঐতিহ্য পালনের মধ্য দিয়ে অনাবাসীরা সেই দেশের মানুষদের কাছে টেনে আনছে। বিদেশি সংস্কৃতি আমাদের গিলে খেতে পারেনি, অনাবাসীরাই বরং তাদেরকে শীতের পিঠা খাওয়াচ্ছেন। ওরাও শাড়ি পরে বাংলাদেশের অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হচ্ছেন।

এবার বলছি, কী করে কিছু কিছু অনাবাসী তবু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সাহায্য করছেন। বাংলাদেশের উৎপন্ন শাক-সবজি মাছ থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পণ্য যা কিছু বিদেশে আসে, অনাবাসীরা বিদেশের মাটিতে বসে সেগুলো ক্রয় করে অর্থনীতির চাকা সক্রিয় রাখতে সাহায্য করছেন। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহলও কথাটি স্বীকার করে নিয়েছেন। আমি যা জানি তাতে মনে হয় অনাবাসীরা যদি বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত পণ্য থেকে হাত উঠিয়ে নেন তাহলে বড় একটা ধস নামবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।

কথা হল, হাত উঠানোর তো প্রশ্নই আসে না বরং এর উল্টোটা হচ্ছে। বিদেশে জন্ম নেওয়া সন্তানদেরকেও বাবা-মায়েরা দেশি খাবার খাওয়ানো শেখাচ্ছেন। ছোট্ট টুকটুকে মেয়েটাও এক প্যাঁচে শাড়ি পরে মেলায় যাচ্ছে।

এছাড়াও অনাবাসীরা যা করেন তা হল, সপ্তাহের ছুটির দিনে ছেলেমেয়েদের বাংলা গানের স্কুল, নাচের স্কুলে নিয়ে যান। দেশে গেলে সুটকেস ভরে নিয়ে আসে বাংলাদেশি পণ্য। হারমোনিয়াম, পায়ের নূপুর, বই, হস্তশিল্প থেকে শুরু করে যা যা সুটকেসে আটে ডলারগুলো বাংলাদেশে রেখে পণ্যগুলো নিয়ে আসেন বিদেশের বাড়িতে। ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাবে অনাবাসীদের আসা-যাওয়ার সঠিক চিত্র। বিশাল বিমানবন্দর এমনিতেই প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে নাই, এর পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে।

বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা এসেও অনাবাসীদের কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন প্রচুর ডলার। যারা সুদূর বাংলাদেশ থেকে শিল্পী আনতে চান না তারা এই কঠিন জীবনের মধ্যেও চার পাঁচ মাস রিহার্সাল করে বাংলা নাটক নামাচ্ছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহে লেগে থাকে স্থানীয় শিল্পীদের দ্বারা আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখন তো বাংলাদেশের সিনেমাও আসতে শুরু করেছে প্রবাসে। এগুলো বাংলাদেশি ছাড়া অবাঙালি কেউ হলে গিয়ে দেখে না। বিদেশের মাটিতে শুধুমাত্র বাংলা বই বিক্রি করে অনেকে তাদের সংসার চালাচ্ছেন।

তাই বলা যেতে পারে, কচুর লতি থেকে শুরু করে বাংলা সিনেমা পর্যন্ত, অর্থাৎ বিনোদন থেকে শুরু করে উৎপাদনের বিভিন্ন শাখার অর্থনীতির চাকা অনাবাসীরা সক্রিয় রেখেছেন।

শুধু শাড়ি আর পাঞ্জাবির হিসাবটাই কম কীসের? বিশেষ করে ঈদ, পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস বিজয় দিবসের কাপড়-চোপড়ের দিকে নজর দেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে, দেশি পণ্যের জন্য অনাবাসীরা কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছেন। আগে ছিল পালা-পার্বণ উপলক্ষে দেশি কাপড় পরার চল। এখন দেশি শাড়ি লুঙ্গির দোকান খুলে নিত্যদিনের প্রয়োজনও মেটানো হচ্ছে। পণ্য আসছে সেই বাংলাদেশ থেকেই।

একজন লোক অনাবাসী হয়েছেন বলেই নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি আচার-ব্যবহার খাবার অভ্যাস পরিবর্তন করে বিদেশিদের মতো বসবাস করছেন বলে যাদের ধারণা, তারা অনাবাসীদের চিনতে ভুল করেছেন। কাজেই অনাবাসীরা ঠিকই বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতির পেছনে তাদের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করছেন। কথা হল, সেই ডলার বাংলাদেশ কীভাবে ইনভেস্ট করছে সেটা দেশের সরকারের দেখা উচিৎ।

একজন অনাবাসী বিদেশের মাটিতে নিয়ম-শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হয়েও ঢাকা বিমানবন্দরে পা রাখার পর থেকে অনিয়মের পাহাড়ের মধ্য ছুটি কাটিয়ে আসেন। তবুও তাদের মুখে বিরক্তির ছাপ নেই। শুধু তাই নয়, পরবর্তী বছরে আবার দেশে যাবার জন্য তাদের মন কাঁদে। রেমিটেন্স পাঠানো থেকে হয়তো বেশি ডলার পাউন্ড সাথে করে নিয়ে আসেন অনাবাসীরা। এদের যদি শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হয় তাহলে অনেকেই দেশে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন।

স্যার আর একটি কথা বলেছিলেন,

"তাদের (অনাবাসীদের) বাবা মারা গেলে ঐ বাড়ি বিক্রি করার জন্য দেশে আসে, ঐ প্রোপার্টিটা নিয়ে যেতে আসে।"

ঢালাওভাবে অনাবাসীদের লোভী ও অকৃতজ্ঞ ভাবার কী কারণ সেটা কিন্তু স্যার পরিষ্কার করে বলেননি। কিছু লজ্জা, কিছু অপমানবোধ থেকে হয়তো অনাবাসীরা নিজেদের বৈষম্যের শিকার বলে মনে করতে পারেন।

বাংলাদেশি অনাবাসীরা অর্থাৎ যারা বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বা নিতে পারেন তারা দেশ ও সংস্কৃতির ঋণ কীভাবে শোধ করছেন তার আরও কিছু উদাহরণ রয়েছে। বিদেশ থেকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রস্তাব উঠেছিল। অনাবাসীরাই খুঁজে খুঁজে প্রামাণ্য ফুটেজ যোগাড় করেছিলে বলেই 'মুক্তির গান' বানানো সম্ভব হয়েছিল। বিদেশের পার্লামেন্টের স্পিকার বা সংসদ সদস্যরা পার্লামেন্ট ভবনে উড়াচ্ছেন বাংলাদেশের পতাকা। বিদেশি রাষ্ট্র বা স্থানীয় সরকার উদযাপন করছে বাংলাদেশ দিবস। এসব উদ্যোগ অনাবাসীরাই নিচ্ছেন।

এরাই আবার বিদেশের মাটিতে গড়ে তুলছেন শহীদ মিনার। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ার মতো। প্রায় প্রতিটি শহরে পাওয়া যায় বাংলা পত্রিকা, বাংলা টেলিভিশন কিংবা রেডিও। কেউ হাত গুটিয়ে বসে নেই। বিদেশের মাটিতেই ছায়ানট উদীচীর মতন সংগঠন নিয়মিতভাবে জাতীয় ও বিশেষ দিনগুলো উদযাপন করছে। শুধুমাত্র রসের পিঠা কিংবা মেজবানির আয়োজন করতে নয় দেশীয় বন্ধন টিকিয়ে রাখতে এরা চিটাগাং ফরিদপুর সিলেট বরিশাল নানা জেলার নামে এসোসিয়েশন গড়ে তুলেছের।

বন্ধন আর অতীত দিনের স্মৃতিবিজড়িত সুখ আনন্দ পেতেই এগুলো করা হয়। এই সমস্ত এসোসিয়েশন জীবন্ত ফেসবুক। স্কুলের জীবনের বন্ধুদের মিলনমেলা। দেশের সঙ্গে বন্ধনমুক্ত নয়, বন্ধনে আবদ্ধ থাকার প্রয়াসে ব্যস্ত অনাবাসীদের সকল প্রচেষ্টা।

অনাবাসী ব্যবসায়ীদের চেম্বার অব কমার্স ও বিভিন্ন সংগঠন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। প্রায় প্রতিটি রপ্তানিযোগ্য পণ্যের জন্য স্থানীয় এজেন্ট বা পার্টনার রয়েছে প্রবাসে। বাংলাদেশি টেলিভিশনগুলোর মালিকদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে বিদেশি দর্শকদের কাছ থেকে কী পরিমাণ আয় উপার্জন তারা করছেন। অনলাইন সার্ভিস– সে অনলাইন পত্রিকা হোক কিংবা ওয়েব সাইট– সেগুলো কী পরিমাণ ভিজিট করে অনাবাসীরা সে হিসাব পাওয়া কঠিন কিছু নয়।

একজন অনাবাসী বাংলাদেশি শিক্ষক ত্রিশ বছর যদি শিক্ষকতা করে থাকেন তবে তিনি প্রতি ব্যাচের বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে একজন বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর বাংলাদেশি নাম সেই সমস্ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চারিত হচ্ছে ঘূর্ণির মতো।

একইভাবে পেশাজীবী, শ্রমজীবী অনাবাসীরা বাংলাদেশের পতাকা ভাষা-সংস্কৃতি প্রতিদিন প্রকাশ করছেন অবাঙালিদের কাছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে হালের রোহিঙ্গা সমস্যায় বাংলাদেশের অনাবাসীরা পথে নেমে আসতে পিছপা হননি। শাহবাগ আন্দোলন, বন্যাকবলিত এলাকার জন্য সাহায্য, লেখক ও মুক্তমনাদের হত্যা, রেপ ভিকটিম, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার কোনো ইস্যুতেই অনাবাসীদের বসে থাকতে দেখা যায় না। এরপরও কী করে বলি অনাবাসীরা দেশের কথা ভাবেন না?

একজন অবাঙালি মূলধারার নাগরিক যখন মেইড-ইন-বাংলাদেশ কাপড় বা পণ্য কিনে কোনো অনাবাসীকে দেখিয়ে বলে, 'তোমার দেশের পণ্য কিনলাম'- তখন সেই অনাবাসীর নিজস্ব অনুভূতি ব্যক্তি পর্যায় থেকে উড়ে গিয়ে হয়ে ওঠে জীবন্ত বাংলাদেশ। ভেবে দেখুন বিদেশ জন্ম নেওয়ার পরও যখন পিতামাতা তার সন্তানের নাম রাখেন 'কথা' 'কাব্য' 'অভিধান' 'বর্ণমালা' কিংবা 'সুগন্ধা'র মতো বাংলা নাম আর যখন সেই নামে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি কর্মক্ষেত্রে উচ্চারিত হয় তখন কে জয়ী হয়? সঙ্গে সঙ্গে কি বেজে উঠে না বাংলাদেশের গান?

থ্রি পার্সেন্ট টাকা-পয়সা পাঠিয়ে যে সম্পর্ক ধরে রাখার কথা বলা হচ্ছে, তার বদলে তো দেখি নিরানব্বই পার্সেন্ট সম্পর্ক ধরে রেখেছে অনাবাসীরা। থ্রি পার্সেন্ট হলে হয়তো একশো পার্সেন্টের উপর হত। কিন্তু ঐ যে বললাম, অন্যদেশের নাগরিকত্ব নিলেই হবে না, সে দেশের কাছেও ঋণ আছে সেটাও বজায় রাখতে হবে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার যদি বাংলাদেশিদের অনাবাসী হবার কারণ ও সূত্র খুঁজে একটা প্রতিকারের কথা বলতেন যাতে দেশের মানুষকে দেশ ছেড়ে আর বিদেশে যেতে হত না এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সম্ভাবনার সুযোগ যদি দেখা দিত, তবে শুধু থ্রি পার্সেন্ট নয়, অনেক অনাবাসী দেশে ফিরে এসে শতভাগ দিতে প্রস্তুত বলে আমি মনে করি। এখন কথা হল, দেশ এদের ফিরে পেতে চায় কি না। এই অনাবাসীরা থ্রি পার্সেন্ট পরিশোধ না করার জন্য যদি শাস্তি পান তবে তারা কতটুকু কষ্ট পাবেন জানি না।

আগেও কিছু কিছু মানুষ উচ্চশিক্ষা কিংবা প্রফেশনাল ট্রেনিং নিতে বিদেশে এসেছেন। তারা পড়ালেখা বা কোর্স শেষ করে আবার দেশে ফিরে গেছেন। সাধারণত শিক্ষকেরা এই সুযোগ পেয়ে থাকেন বেশি। তাদের ফিরে যাওয়াটাও সঠিক হয়েছে। কেননা তাঁরা স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত অবস্থায় স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে এসেছিলেন।

কথা হল, তাদের সঙ্গে বর্তমান প্রফেশনালদের যে তুলনা করা হয়েছে সেটা বোধহয় এক মাত্রার তুলনা হল না। এখন গ্লোবাল ভিলেজ বা মুক্ত অর্থনৈতিক বাজারে মেধা মাইগ্রেশন বা মেধা ইমিগ্রেশনের ব্যাপারটা অনেক খোলামেলা। আগের দিনগুলো ছিল অনেক লম্বা। একই নিয়ম চলত অনেক বছর ধরে। এখন সুযোগ-সুবিধা নিয়ম-কানুন দ্রুত বদলে যায়। সেই বদলানো ব্যবস্থায় যদি কেউ স্বেচ্ছায় অনাবাসী হতে চান সেটা বোধহয় রোধ করা যাবে না। দেশে এরা পড়ালেখা করেছেন ঠিকই কিন্তু বিদেশে আসার যোগ্যতা তাঁর নিজস্ব যোগ্যতা ও জোগাড় করা ব্যবস্থা।

দেশে পড়ালেখা করার সময় কেউ বিনা বেতনে পড়েছেন কি না বা পড়লেও কেউ কতদিন বিনা পয়সায় পড়েছেন জানি না। টিউশন ফি, মাসিক বেতন, খাতা কলম পেন্সিল বই তো কিনেই পড়ত। স্কুল-ড্রেস, যাতায়াত খরচ এগুলো সবই দিয়েছেন একজন ছাত্র। কথা রয়ে গেল ভর্তুকি অংশটুকু। মানলাম সেই ভর্তুকি এবং প্রত্যাশার অংশটুকু অপরিশোধিত থাকা ঠিক নয়। দেনা-পাওয়া মিটিয়ে দেয়াই ভালো। সে কারণেই অনাবাসীদের এগিয়ে এসে ঋণ পরিশোধ করা উচিৎ। যেটা অধ্যাপক আবু সায়ীদ বলছেন।

আমার জানামতে, অনাবাসীরা বাংলাদেশ কনসুলেট সার্ভিসসহ পাসপোর্ট ভিসার জন্য যে পরিমাণ ডলার খরচ করেন তা সরাসরি বাংলাদেশ সরকারে একাউন্টেই চলে যায়। একজন অনাবাসী বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় যে পরিমাণ ডলার নিয়ে এসে খরচ করেন তা পুরোটাই বাংলাদেশ পায়। এছাড়াও বড় বড় প্রজেক্ট হাউজিং এস্টেটে অনাবাসীরা যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছেন আমি মনে করি তা কাঙ্ক্ষিত গড় থ্রি পার্সেন্টের অনেক বেশি।

অনাবাসীদের অনেকেই বাংলাদেশে ফ্ল্যাট কিনছেন, কারখানা বানাচ্ছেন। এমনকি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করছেন। কেউ কেউ যে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা করছেন না তা কিন্তু নয়। সরকার প্রদত্ত সঞ্চয় পত্র, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড এ সবেও অংশ নিচ্ছেন অনেকে। যদি এই ফ্ল্যাট কিংবা শেয়ার বা ব্যবসায়ের লগ্নি বাংলাদেশে না করে ফ্লোরিডা বা মালয়েশিয়া কিংবা অন্যান্য দেশে করতেন তাহলে হয়তো বলা যেত, বাংলাদেশের অনাবাসীরা অর্থনীতিতে অংশীদারিত্ব করছেন না।

যে কথাটা পরিষ্কার বোঝা গেল না সেটা হল, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং তাঁর থ্রি পার্সেন্ট মতবাদ কি প্রত্যেক অনাবাসীর জন্য এককভাবে প্রযোজ্য নাকি অনাবাসীদের থ্রি পার্সেন্ট একটা গড় হিসাব? আশা করি তিনি তাঁর এই থ্রি পার্সেন্ট মতবাদের পক্ষে আবার যখন বলবেন একটু বিস্তারিত তথ্য প্রদান করবেন।

যে পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়ার কথা স্যার বলেছেন তাঁর পরামর্শে হয়তো সরকার যে কোনোদিন কার্যকর করে ফেলতেও পারে। কিংবা বিদেশি পাসপোর্টধারী বাংলাদেশিদের ভিসা না-ও দিতে পারে। সেটা বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের ইচ্ছা। আসলে ভিসা পাসপোর্ট কোনো পরিচয় নয়। পাসপোর্ট বা ভিসা হল ভ্রমণ অনুমতির দলিল। সেগুলো না থাকলে অনাবাসীরা জন্মভূমি বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার হারাবেন এ কথা ঠিক। হয়তো তখন লজ্জায় মাথা নিচু করে তাদের সন্তানদের বলবেন, 'হাত ধরে তোমাকে যে বাংলা স্কুলে নিয়ে যাই বাবা, আমি আর সেই বাংলাদেশে যেতে পারব না। তারা আমাকে চায় না। আমি ঋণ শোধ না করার জন্য 'অমানুষ' খেতাব পেয়েছি'।

জানি না এমনটি হলে কী বলবে অনাবাসীদের সন্তানেরা। প্রবাসী ও অনাবাসীর পর আরও একটি নতুন শব্দ যোগ হয়েছে, সেটা হল বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত। যেমন বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত মেয়র, বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত এমপি অথবা বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত লেখক।

থাক এসব কথা। আশা করা যায় গরিবের টাকায় পড়ালেখা করে পালিয়ে আসা অনাবাসীরা পাসপোর্ট রাখার অধিকার হারিয়েও হয়তো মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াসে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মগ্ন হয়ে গেয়ে যাবেন 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি' কিংবা 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'। গাইতে গিয়ে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। সিল-ছাপ্পরের বদৌলতে কি এগুলো বন্ধ করতে পারবে কেউ? হৃদয়ের সিল কী করে মুছে যাবে, কে নেবে সেটা কেড়ে?

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন,

"আমি আশাবাদে বিশ্বাস করি। পতন বলে কিছু নেই, নৈরাশ্য বলে কিছু নেই। নৈরাশ্য বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে। নৈরাশ্য এক ধরনের বিভ্রম।"

স্যার, অগুনতি ছাত্রের মতো নিঃসন্দেহে অনাবাসীদের হৃদয়ের কাছে আপনি অনেক আগেই পৌঁছে গেছেন। তাদের হৃদয় আপ্লুত করেছেন। আপনি ভালো থাকুন, স্যার।