১৫ নভেম্বর: আমার প্রথম মৃত্যুর স্বাদ

সৌমিন শাহ্‌রিদ
Published : 15 Nov 2017, 05:15 PM
Updated : 15 Nov 2017, 05:15 PM

১৫ নভেম্বর। কে জানত আমার জীবনে এই সংখ্যাটাই তীব্র কালো হয়ে ক্যালেন্ডারের অন্যান্য সব সংখ্যার রঙ ছিনিয়ে নেবে। ইচ্ছা করলে এই কালো চোখের পানির সঙ্গে মিশিয়ে তীব্র লাল একটা বর্ণ পাওয়া যায়, যেটা দেখার দুর্ভাগ্য খুব কম মানুষের হয়। এটা রক্তের লাল রঙ। ২০১৪ সাল থেকে আমার জীবনটা এই দুটি রঙের আবরণে একদম ঢাকা পড়ে গেছে। চোখ খুললেই কালো অন্ধকার দেখি আর বুজলেই রক্ত-লাল!

তিন বছর আগে এই দিনেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটিকে হারাই, আমার বাবাকে হারাই। 'হারাই' কেন বলছি, আমার কাছ থেকে তো কেড়ে নেওয়া হয়েছে এই মানুষটিকে। যে মানুষটা কথায় কথায় বলত 'একশ বছর বাঁচব', সেই মানুষটাকে চাপাতির কোপে পৃথিবী থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে যা হারিয়েছি তা 'সব'এর মতো দুটি বর্ণের ছোট্ট একটি শব্দের মধ্যে সংকুলান করা আমার জন্য অসম্ভব।

আমারই বাবা, অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম। সমাজ বিজ্ঞানের 'লিলন স্যার', মনে পড়ে? আজ যার কোনো অস্তিত্বই আর নেই। সবই বিলীন হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে নেই, চেম্বারে নেই, জুবেরি ভবন ক্লাবের গোলটেবিলের আড্ডায় নেই। এমনকি মমতাজউদ্দিনের পশ্চিম পার্শ্বের সিঁড়ির নিচে বিকট আওয়াজ করা তাঁর মোটরসাইকেলটাও আর কোনো দিন দেখা যাবে না। উনি হারিয়ে গেছেন আপনাদের কথোপকথন থেকেও। এটাই বাস্তবতা। মেনে নিলাম।

আজ সকাল হলেই আপনারা হয়তো একত্রিত হবেন। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত ধরে আপনাদের পূর্বনির্ধারিত পরিবেশনা উপস্থাপন করবেন। বুকে হয়তো একটা কালো ব্যাজও থাকবে। মাইকে চিৎকার করে বলবেন, 'তিনি আমাদের হৃদয়ে আছেন' ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু মহান অভিনেতা হয়তো বলবেন, Justice delayed is justice denied– কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার উপলব্ধিতে আপনাদের হৃৎপিণ্ডগুলো অনেক আগেই অকেজো হয়ে গেছে। এসব কথার মিষ্টরস আমাকে আর একদমই স্পর্শ করে না। আপনারাও মেনে নিন, আপনাদের সান্ত্বনা আমার কাছে বিষ হয়ে আমার প্রতিদিনের প্রাণ দূষিত করে।

আমি আর এসব কিছুই চাই না। আমি সত্যিই ক্লান্ত। আপনাদের সান্ত্বনা চাই না, মানববন্ধন চাই না, কিছু চাই না। তিনটা বছরই যেখানে আপনাদের নির্বাক দেখলাম সেখানে এই দিনটায় অনুষ্ঠান করে 'এক মিনিটের নীরবতা' আর না-ই-বা করলেন। আর 'সহানুভূতি'এর কথা তো বলবেনই না। ঐ শব্দটার সন্ধিবিচ্ছেদ তো নিশ্চয় জানেন, কিন্তু তার মর্মটা কি আপনাদের উপলব্ধিতে আছে? দয়া করে আর শব্দটা যত্রতত্র ব্যবহার করবেন না। আমি আসলেই আর চাই না এসব। সত্যি বলতে, আমার তিক্ত জীবনে এসব মিষ্টতা আর ধাতে সয় না।

আমাকে একটু শিখিয়ে দিন না কীভাবে আপনারা এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারেন!

তিনটা বছর হয়ে গেল। এই বছরেও এর মধেই শীতের হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। তিন বছর আগে সেদিনও বইছিল। কিন্তু তিনটা বছর হয়ে গেল এই হাওয়া আমার জন্য শুধুই জীর্ণতা আর শূন্যতা রেখে গেছে। আমিও তো চেয়েছিলাম শীতকে ভালোবাসতে, আপনাদেরই মতো।

এই তিন বছর পর ভালোবাসার এই ঋতুতেই হিসাবের একটা খাতা নিয়ে আজ লিখতে বসেছি। হিসাবটা সময়ের যা চোখের জল দিয়েই মাপতে হবে। অনেককেই বলতে দেখা যাবে, দেখতে দেখতেই তিনটা বছর কেটে গেল। দেখতে দেখতে তিনটা বছর কাটেনি, আমার কাছে প্রত্যেকটা সেকেন্ডের হিসাব রয়েছে। প্রত্যেকটা সেকেন্ড! বাবার শারীরিক অনুপস্থিতি প্রতিটা সেকেন্ড আমাকে সহ্য করতে হয়। আমি তাঁকে ছুঁতে চাই, প্রতিবার ঘরে ফিরে আগের মতোই তাঁকে জড়িয়ে ধরতে চাই। হাসিঠাট্টা করতে চাই।

মৃত্যুর পরের জীবন কিংবা পুনর্জন্ম– এসবে আমার কোনো দিনই বিশ্বাস ছিল না। এই জাদুবাস্তব চিন্তাগুলো ক্যানভাসে দেখতে ভালো লাগলেও তা বিশ্বাসের রূপ দিয়ে জীবনের একটা অংশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু বাবার স্মৃতি মনে পড়লেই মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে এসব বিশ্বাস করতে। বাবা হয়তো অন্য কোথাও বেঁচে আছেন, হয়তো সুখেই আছেন ভেবে একটু ছেলেমানুষি করতে ইচ্ছা করে। কোনোদিন দেখা হলে প্রশ্ন করতাম, "তুমি শেষ মুহূর্তে আমার মুঠোফোনের কলটা কেন ধরলে? কেন মাথায় কোপের অসহ্য যন্ত্রণায় করা চিৎকারটাই শেষ স্মৃতি হিসেবে রেখে গেলে? আমারই অপেক্ষা করছিলে, বাবা? তোমার এই চিৎকার যে তিন বছর হল আমার রাতের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে।"

সেটাও চাইলেই যে পারি না। এই প্রশ্নগুলো আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। আর 'শূন্য' বিষয়টা কী তা যতই বুঝতে পারছি ততই উপলব্ধি করছি এর ভার বহন করার ক্ষমতা এখনও তৈরি হয়নি। কখনও হয়তো হবে না।

এ বাদে চাওয়া-পাওয়া-বাকির হিসাব অনেক আগেই চুকিয়ে দিয়েছি। আমি বিচারও আর চাই না।

স্পষ্ট মনে আছে, রাজশাহী পৌঁছেই আমি প্রথমেই মামলার কথা জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু সাবেক উপাচার্য সেই মুহূর্তে আমাকে বলেন, "তোমার বাবার সৎকার এই মুহূর্তে তোমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আর এসব নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমরা তো আছিই।"

পরদিনই রেজিস্ট্রার বাদি হয়ে একটি মামলা করলেন। দুমাস পরই তাঁকে মামলার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তিনি আর খোঁজ রাখেননি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো মামলা করা হলে সেটা রেজিস্ট্রারকেই করতে হয় দেখে তিনি করেছেন। এর বেশি কিছু নয়। এমনকি সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ক সেলের তৎকালীন প্রধান জানান যে, তাঁরা তখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্দেশ দেয়।

এরপরও আমি বহুবার এই বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে প্রশাসনের অনেকেই এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বলেন আমাকে। এখন আপনারাই ভেবে দেখুন কতখানি আছেন।

আমি সত্যিই আর বিচার চাই না। যে চাওয়া কখনও পূরণ হবে না, সেটা জেনেও চাওয়াটা বোকামি। তাছাড়া ঠিকমতো তদন্তই যেখানে হয়নি সেখানে বিচার কী হবে? যে অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারপ্রক্রিয়া চলছে তার ত্রুটি একটি শিশুও ধরতে পারবে। সুতরাং রাস্তায় দেখা হলে আর যাই হোক হাসতে হাসতে এসে জিজ্ঞাসা করবেন না, "বাবা, কেমন আছ?"

আমি ভালো নেই, ভালো কখনও থাকব না, আর এটাই স্বাভাবিক। আমি এটাও মেনে নিয়েছি। এর কোনো দায়ভার আপনাদের নয়।

তবে প্রত্যেক মানুষই নিজের অজান্তে অনেকের কাছে অনেক রকম আশা করে বসে। অনেক ক্ষেত্রে তা ভুলও হয়। জীবন আমাকে এতটা আঘাত করলেও এখনও লোহায় পরিণত হতে পারিনি। রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ হিসেবে আমিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের কাছে আমার বাবার প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা আশা করেছিলাম। ভাবতাম, এটা একটা পরিবারের মতোই। ভুল করেছি! সেখানেও যে ধাক্কা খাব তা আশা করিনি।

শুনেছি, বাবা শিক্ষক হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ভালো পড়াতেন, বিভাগের জন্য অনেক করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও করেছেন। এক নামে পরিচিত ছিলেন। আসলে সেখান থেকেই আশাটা জেগেছিল। এখন ভাবি যে, ভুল শুনেছি কিংবা ভুল শোনানো হয়েছে। বাবার বিতর্কিত এবং স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তিগত জীবন তো রয়েছেই, উনি শিক্ষক হিসেবেও আসলে খুবই খারাপ ছিলেন। এখন থেকে এটাও মেনে নেওয়া শুরু করেছি।

আশা করি আমার এটুকু অপরাধ আপনারা ক্ষমা করতে পারবেন।

আপনাদের প্রতি আমার ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই, এমনকি কোনো দাবিও আর নেই কিছু। তবে নিজের অজান্তেই মনের ভেতর আপনাদের প্রতি যে অনুভূতি জন্ম নিয়েছে সেটিকে 'ঘৃণা' ছাড়া অন্য নামে ডাকা যায় না। আপনারাও মেনে নিন।