ইউরোপে পেট্রি, মেরিন ও কতিপয় নাৎসীপন্থীদের উত্থান কতটা বিপদ ডেকে আনবে?

সাজ্জাদুল হাসান
Published : 19 Nov 2017, 06:36 AM
Updated : 19 Nov 2017, 06:36 AM

এ বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জার্মানির নির্বাচনী ফলাফলে অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার খবর ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে 'জার্মানির জন্য বিকল্প' (অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি, এএফডি) নামক কট্টর দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলটির বিস্ময়কর উত্থান। মাত্র চার বছর আগে, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দল এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সবচাইতে বৃহৎ অর্থনীতি জার্মানির তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলটি যেখানে মাত্র ৪.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, এবার তাদের প্রাপ্ত ভোট ১২.৬ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় তাদের ভোট বেড়েছে প্রায় ৭.৮ শতাংশ। যা অন্যসব দলের তুলনায় অনেক বেশি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, বিগত ষাট বছরের মধ্যে এই প্রথমবার জার্মানির সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে এএফডির মতো কট্টরপন্থী নব্য নাৎসিবাদী একটি রাজনৈতিক দল। বুন্ডেসট্যাগ (Bundestag) নামে সমাধিক পরিচিত দেশটির সংসদে এবার তাদের আসনসংখ্যা ৯৪। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ন্যূনতম ৫ ভোট পেতে ব্যর্থ হওয়ায় সংসদে তারা ছিল প্রতিনিধিত্বহীন।

স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসে যায়, এএফডির এই বিস্ময়কর উত্থানের পিছনের রহস্য কী? চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেলের উদার অভিবাসী মনোভাব বিশেষ করে সিরীয় শরণার্থীদের ব্যাপারে তাঁর মানবিক অবস্থান বিশ্বব্যাপী দারুণভাবে প্রশংসিত হলেও, নিজ দেশে রক্ষণশীল মহলের কাছ থেকে ব্যাপক বিরোধিতা এবং সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। ভূমধ্যসাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় একের পর এক মর্মান্তিক নৌকাডুবির ঘটনার প্রেক্ষিতে, চ্যান্সেলর মের্কেল জার্মানির সীমানা শরণার্থীদের জন্যে উম্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রায় দশ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করে দেশটিতে।

এই বিপুল আশ্রয়প্রার্থী জনগোষ্ঠীর খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের পিছনে ২০১৬ সালে জার্মান করদাতাদের ব্যয় করতে হয়েছে ২০ বিলিয়ন ইউরো। সরকারের শরণার্থীদের প্রতি উদার নীতির কারণে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সেটিকে অনেকেই জনগণের উপর বাড়তি চাপ হিসেবে প্রচার করতে থাকে।

এএফডির মতো সংগঠনগুলো ব্যাপারটা সামনে নিয়ে আসে এবং ব্যাপক প্রচারণায় নামে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলকামও হয়। কেননা জনসাধারণের একটি অংশ এই বিপুল ব্যয় অপচয় হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছিল। বিষয়টা কেবল এ পর্যন্ত থেমে থাকে না, শরণার্থীদের জার্মানির নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখানোর প্রয়াস পায় অনেকে। দুঃখজনকভাবে ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম এবং মুসলমানদের মোটাদাগে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার এক ভয়ঙ্কর প্রচারণায় মেতে উঠে কট্টর দক্ষিণপন্থী কিছু রাজনৈতিক শক্তি।

এভাবে জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং তথাকথিত দেশপ্রেম ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এএফডি চালাতে থাকে শরণার্থী তথা ইসলামবিরোধী প্রোপাগাণ্ডা। মে মাসে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় দলটির প্রতিনিধিরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো অনুমোদন করেন। সেখানে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়:

"ইসলামের সঙ্গে জার্মানির কোনো সম্পর্ক নেই।"

সেখানে মসজিদ, মিনার এবং বোরকা নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়। অনতিবিলম্বে সকল শরণার্থী প্রবেশের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং যারা ইতোমধ্যে জার্মানিতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে তাদের দেশ থেকে বিতাড়ণ করার জন্যে সরকারের উপর চাপ প্রদান অব্যাহত রাখে তারা।

শুধু তাই নয়, এএফডির নেত্রী মিস পেট্রি শরণার্থীদের নিবৃত্ত করতে প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ঘোষণা দেন। তাদের মতে, জার্মানি কেবল জার্মানদের জন্য। তাই অন্য সংস্কৃতি বা জাতিগোষ্ঠীর লোকদের জার্মানিতে বসবাস তারা প্রকারান্তরে ঘৃণার চোখে দেখে। মিজ পেট্রি একবার বহুসংস্কৃতির (multiculturalism) ধারণাটি আবর্জনার স্তুপের (compost heap) সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন।

তাদের এই উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচারণা জনসাধারণের একটি অংশ– যারা শরণার্থীসহ আরও বিভিন্ন কারণে বিক্ষুব্ধ ছিল– তাদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। ফলে ২০১৬ সালের শেষ প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে তারা সফল হতে থাকে। ১৬টি প্রাদেশিক সংসদের ১০টিতেই তাদের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয় এএফডি।

জাতীয় নির্বাচনে এই অভাবনীয় ফলাফলে এএফডি নেতৃবৃন্দ ভীষণভাবে উৎফুল্ল এবং অনুপ্রাণিত। দলের অন্যতম এক প্রভাবশালী নেতা আলেক্সান্ডার গাউল্যান্ড উদ্বেলিত দলীয় সমর্থকদের এক সমাবেশে বলেন:

"আমাদের দলের রাজনৈতিক ইতিহাসে আজকের দিনটি অন্যতম এক স্মরণীয় দিন। আমরা প্রথমবারের মতো বুন্ডেসট্যাগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি এবং আমরা নিশ্চয়ই এদেশে পরিবর্তন আনব।"

২০১৫ সালে কোন আইনি ক্ষমতার বলে মের্কেল সরকার সীমান্ত উম্মুক্ত করে দিয়েছিল তা তারা জানতে চান। তারা দেশটাকে তাদের জনগণকে ফিরিয়ে দিতে চান।

কট্টর দক্ষিণপন্থীদের উত্থান কেবল জার্মানিতে সীমাবদ্ধ নেই, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মহাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডে কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদী দল 'পিভিভি'র (PVV) উত্থানও অতিসাম্প্রতিক ঘটনা। ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত দলটি ২০১২ সালের নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা তাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে। হাউস অফ রিপ্রেসেনটেটিভে তাদের অবস্থান এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম। আদর্শগতভাবে দলটি চরম অভিবাসনবিরোধী আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্ধ মুসলিমবিদ্বেষ। দলটির প্রধান গ্রিট উইল্ডার্স ইউএসএ টুডের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন:

"ডাচ মূল্যবোধ খ্রিস্ট আর ইহুদি ধর্মভিত্তিক। ইসলাম এবং স্বাধীনতা সমার্থক নয়। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ মুসলিমশাসিত সেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতা, আইনের শাসন ইত্যাদির অভাব রয়েছে।"

উইল্ডার্স তার দেশে সমস্ত মসজিদ বন্ধ করতে চান, নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চান মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান। আর চান তার দেশের সীমান্ত একেবারে সিলগালা করে দিতে যাতে মুসলিম অভিবাসীরা নেদারল্যান্ডে প্রবেশ করতে না পারে। ওদিকে কট্টর ডানপন্থী মেরিন লে পেনের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফ্রান্সের গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিশেষ সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিল।

ইউরোপজুড়ে দক্ষিণপন্থীদের উত্থানের এরকম আরও বেশ কিছু নজির লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ডেনিশ পিপলস পার্টি, ইতালির লেগা নর্ড (Lega Nord), সুইডেন ডেমোক্র্যাটসরা নিজ নিজ দেশের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করছে।

চতুর্দিকে কেমন এক অস্থিরতা, গুমোট অস্বস্তি, জাতিগত বিদ্বেষ প্রিয় এই পৃথিবীকে করে তুলছে অনিরাপদ। জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে অভাবনীয় উন্নতি সাধন করছে মানুষ। তারপরও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধে উঠে মানবতার জয়গান গাওয়ার মতো সভ্য হয়ে উঠতে পারিনি আমরা। আর তাই বোধহয় কট্টর জাতীয়তাবাদীরা দেশে দেশে মানুষের ভোট ও সমর্থন পাচ্ছে। বিশেষত ইউরোপের মতো বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অংশে।

এখন দেখা যাক রাজনীতির এই নতুন সমীকরণ আমাদের কোন পৃথিবী উপহার দেয়।