রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গে কানাডা ব্যতিক্রম

Published : 15 Nov 2017, 06:44 AM
Updated : 15 Nov 2017, 06:44 AM

একবার কানাডা আর বাংলাদেশের মধ্যে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। দ্বৈত নাগরিক হিসেবে তখন লিখেছিলাম– জিতলেও আমার দেশ, হারলেও আমার দেশ। আরেক বার দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক এক বৈঠকে মিলিত হলে লিখেছিলাম– 'আমাদের দুই প্রধানমন্ত্রী'।

ঘটনাটা খুলেই বলি। গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ট্রিয়লে মন্ট্রিয়লে 'ফিফথ রিপ্লেনিশমেন্ট কনফারেন্স অফ দ্য গ্লোবাল ফান্ড' সম্মেলনে যোগ দেন। সেই সময় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর হাতে 'ফ্রেন্ডস অফ লিবারেশন ওয়ার অনার' পুরস্কার তুলে দেবেন। কারণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ও অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত পিয়েরে ট্রুডোকে (জাস্টিন ট্রুডোর বাবা) মরণোত্তর এই পুরস্কার প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের দুঃসময় যেমন পিয়েরে ট্রুডো বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, একইভাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিনও এগিয়ে এসেছেন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে।

বিস্ময়ের ব্যাপার, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন নিয়ে বিশ্বের বড় বড় এবং ক্ষমতাশীল দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, চীন এমনকি রাশিয়াও কোনো ভূমিকা বা পদক্ষেপ নেয়নি। বাংলাদেশের পর একমাত্রই কানাডার বিরল ভূমিকা সকলের দৃষ্টি কেড়েছে। যদিও দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কানাডা বা কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নানাভাবে পদক্ষেপ নেননি। তিনি কানাডিয়ানদের পক্ষে মানবতার কারণেই এগিয়ে এসেছেন। তিনি বার্মার নেত্রী অং সান সু চিকে এজন্য ফোন করেছেন, চিঠি দিয়েছেন। এছাড়াও নিয়েছেন নানামুখী কার্যকরী পদক্ষেপ। তারপরও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, কানাডার বিরোধী দল এবং কোনো কোনো মিডিয়া জাস্টিনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যে, জাতিসংঘের ভাষণে রোহিঙ্গা শব্দটিও উচ্চারণ করলেন না জাস্টিন ট্রুডো!

অথচ একমাত্র তিনিই প্রতিবাদ করে সুচিকে ব্যক্তিগতভাবে লিখেছেন:

"আপনি শান্তিতে নোবেলবিজয়ী হয়ে বহির্বিশ্বে সম্মান পেয়েছেন, আপনি একজন সন্মানজনক কানাডিয়ান। তারপরও মিয়ানমারের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা-নির্যাতন, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, চার লাখ মানুষকে জবরদস্তিমূলক বাংলাদেশে বিতাড়িত করার মতো নিষ্ঠুর নিপীড়নের মুখে আপনার ক্রমাগত নীরবতায় আপনার সাথী কানাডিয়ানরা গভীর বিস্মিত, হতাশ এবং বেদনাক্রান্ত। তাই অনুরোধ, মানবাধিকার নিশ্চিত করে তাদের পাশে দাঁড়ান এবং মিয়ানমারকে একটি জাতিগত বিভক্তি থেকে রক্ষা করেন।"

তার আগেও, জাস্টিন মিয়ানমার রাষ্ট্রীয় পরামর্শদাতা ও দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। দেশটির রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম এবং সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেকটা আন্তরিকতা এবং অধিকারের সুরেই। কারণ, রাউল ওয়ালেনবার্গ, নেলসন ম্যান্ডেলা, দালাই লামা, আগা খান এবং মালালা ইউসুফজাইএর মতো অং সান সু চিও কানাডার সন্মানসূচক নাগরিক। তাই তাঁর সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রত্যাহারের দাবিতে দশ হাজার গণস্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়েছে এবং তা হাউস অফ কমন্সে উপস্থান=পন করা হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, সু চিকে দেওয়া কানাডিয়ান সম্মানজনক নাগরিকত্ব বাতিল করে দেওয়ার পক্ষে ৪০ শতাংশ নাগরিক।

শুধু প্রধানমন্ত্রীই নন, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিরা, সাংসদেরাও নানা ভূমিকা নিচ্ছেন। যেমন, কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা ফ্রিল্যান্ড বলেছেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্তে রোহিঙ্গাদের জন্য 'নিরাপদ জোন' গঠন, শরণার্থীদের 'শান্তিরক্ষা মিশন' গড়ে তোলার জন্য কানাডা ভূমিকা নিবে। সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হলাইংকেও টেলিফোন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিন। তিনিও রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবরে কানাডা সরকারের তীব্র অসন্তোষ এবং উদ্বেগের কথা জানান মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে।

ইমিগ্রেশন মন্ত্রী আহমেদ হোসেন রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য 'এক্সিট ভিসা' সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

কানাডা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ, পরামর্শ এবং পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য লিবারেল পার্টির সাবেক প্রধান বব রেকে প্রধানমন্ত্রীর মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত নিয়োগ দিয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য আরও ১২ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য কানাডার দেওয়া আর্থিক সহায়তার পরিমাণ দাঁড়াল ২৫ মিলিয়ন ডলার। আর কোনো দেশ এই পদক্ষেপ নেয়নি। ইতোমধ্যে বব রে দুই দেশ সফর করছেন।

তিনি ঘুরে ঘুরে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ক্যামেরা আর কর্মীদের উপস্থিতি ছাড়াই শিবিরে আশ্রিত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ১২ রোহিঙ্গা নারীর কথা শুনেছেন। ওই নারীরা বব রে-কে যৌননিপীড়ন, বিমান হামলা, শিরোশ্ছেদ এবং শিশুদের ওপর চাপাতি নিয়ে হামলাসহ বিভিন্ন ভয়াবহ সহিংসতার বহুমাত্রিক বিপন্নতার আখ্যান শুনিয়েছেন তাঁকে। সিটিভিকে তিনি বলেছেন, মিয়ানমারে গিয়ে সু চির সঙ্গে তিনি ঘটনা আড়াল করার অপচেষ্টা নিয়ে কথা বলবেন। 'আমি তাকে বলব, কিছুই ঘটেনি এমন ভণ্ডামি কোনো কাজে আসবে না। একে দুই পক্ষের লড়াই হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেও লাভ হবে না'– ওই প্রচেষ্টাকে 'বাজে' প্রচেষ্টা আখ্যা দিয়েছেন বব রে।

তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে যা শুনেছেন, নিজের চোখে শরণার্থী শিবিরে তাদের যে বিপন্নতা দেখেছেন, সেগুলো নিয়েই কথা বলবেন মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের বর্ণিত নিপীড়নের ঘটনাগুলো কানাডীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করবেন।

কানাডা-বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফ্রেন্ডশিপ গ্রুপের চেয়ারম্যান নাথানিয়েল এরস্কাইন স্মিথ, যিনি টরন্টোর ইস্ট ইওয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত এমপি, তিনি পিতামাতাহীন রোহিঙ্গা শিশুদের কানাডায় আনার প্রস্তাব করেন।
মিয়ানমার কর্তৃক সে দেশের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে এক বিস্তারিত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে কানাডার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে। অটোয়ার পার্লামেন্ট হিলের সিনেট মানবাধিকার বিষয়ক কমিটিতে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি, সিনেটর জিম মানসন। সভায় উপস্থিত থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন কমিটির ডেপুটি চেয়ার সিনেটর সালমা আতাউল্লাহজান, সিনেটর মারিলু ম্যাকফ্রেডান, সিনেটর ইয়োনাহ মার্টিন, সিনেটর থান হাই গো, সিনেটর রেইনেল এ্যান্ড্রিচুক এবং সিনেটর রাতনা ওমিডভার। সিনেটর জিন মুনসন বলেছেন, প্রত্যক্ষদর্শীরা সেখানে নির্মম, নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে, সেজন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের গুরুত্ব তুলে ধরেন।

শুধু সরকারি দলই নয়, এগিয়ে এসেছে কানাডার হাউজ অফ কমন্সের বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টির। তারা যেন এক ধাপ এগিয়ে। কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান এন্ড্রু শিয়ার অভিযোগ, কানাডার বর্তমান সরকার যথার্থ পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। যেমন জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন কিছু বলেননি বা কানাডার সঙ্গে চীনের যে ব্যবসায়িক, সামরিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে তা কাজে লাগায়নি, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চাপ দেয়নি!

এদিকে প্রবাসী বাঙালিরাও নানাভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশিরা টরন্টোস্থ মিয়ানমার দূতাবাসের সামনে এক প্রচার বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। মন্ট্রিয়লে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় 'ফান্ড রেইজিং গালা' অনুষ্ঠিত। 'মানুষ মানুষের জন্য' শীর্ষক তহবিল সংগ্রহ করা হয় অটোয়া থেকে। অনুরূপভাবে ভ্যাংকুভার, হ্যালিফ্যাক্সের প্রবাসী বাঙালিরা প্রতিবাদ সমাবেশ করে।

তবে অ্যাঙ্গাস রেইড ইন্সটিটিউশনের এক জরিপে প্রকাশ, ৫৫ শতাংশ বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কানাডার হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন ৫৫ শতাংশ কানাডিয়ান। কারণ, তাদের মতে, রোহিঙ্গা সমস্যা কানাডার ইস্যু নয়। আর ৩৫ শতাংশের মতামত, কানাডা ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য যথেষ্ট খরচ করে ফেলেছে।

আরও পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, কানাডা ২০০৬ থেকে ২০১০ সালে ৩৫৯ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে সেদেশে স্বাগত জানিয়ে আশ্রয় দিয়েছে। সেই সময় কানাডাই প্রথম দেশ যারা রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য এগিয়ে এসেছিল। এ নিয়ে ডেইলি 'টরন্টো স্টার' তিন দফায় দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

[১২ আগস্ট ২০১২, টরন্টো, কানাডা]

'ফ্রি ইন কানাডা, বাট লস্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: রোহিঙ্গাস রিকল ব্রুটাল লাইফ ইন ক্যাম্প' শীর্ষক প্রতিবেদনে বার্মার সামরিক জান্তার চালচিত্র, নোবেলবিজয়ী অং সান সু চির প্রতি আচরণ, মিডিয়া্র উপর সেন্সরশিপ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, পশ্চিম-বার্মার রাখাইন ও মুসলিম-বার্মিজদের উপর নির্যাতন-নিপীড়িনসহ নানান বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াও থেকে রেহাই পাবার প্রত্যাশায় সাগর পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসা শরণার্থী শিবিরের মানবেতর জীবনযাপন, বাংলাদেশের সহযোগিতা, অতঃপর ইউএনের মাধ্যমে ২০০৬ এবং ২০১০ সালে কানাডায় আসা। কানাডায় এসেও সৈয়দ আলম, নূর হাসিম, আজিজ নূর, বদু জামা, সাদিয়া জামান, তায়েবা খাতুনেরা ভুলতে পারেনি বার্মা সেনা কর্তৃক স্বামী-সন্তানের হত্যার ভয়াবহ দৃশ্য, নিজ কন্যাকে ধর্ষণচিত্র। তারা কানাডায় এসে বেঁচে গেলেও ভুলতে পারেনি তাদের স্বদেশ-স্বজনের কথা। টরন্টোর কিচেনারে বসবাসরত এক রোহিঙ্গা শরণার্থী যেমন বলেন:

"কানাডায় স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু হারিয়েছি আমাদের জগত।"