দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়

Published : 28 April 2012, 02:43 PM
Updated : 28 April 2012, 02:43 PM

গুমের মাসুল হরতাল ?
সারা দেশে একটানা হরতালের তিন দিন পার হলো গত সপ্তাহে। ইলিয়াস আলীকে খুঁজে না-পাওয়ায় হরতালের ফাঁসের দড়িতে বাংলাদেশ ক্রমশই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে অবশ হয়ে পরেছিলো। যেমনটা হয়েছিলো এক সময় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় ৯-এর দশকে। শনিবারের(২৮ এপ্রিল) মধ্যে তাকে পা্ওয়া যায়নি বলে আবারও একটানা হরতাল শুবু হবে রোববার থেকে।

রাজনৈতিক দলের একজন নেতার নিখোঁজ হওয়ার মাশুল দিতে হয় সাধারণ মানুষকে জীবন দিয়ে। গরীবের গরীব এই দেশটির যাওবা একটু আধটু সম্পদ আছে হরতালপন্থীদের আক্রোসের আগুনে পুড়ে তা ছাই হয়ে যায়। আমরা যারা আমজনতা তাদের অবস্থা যে কী তা আর নতুন করে বলার দরকার আছে বলে মনে হয না। এই অবস্থা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে কবি বিষ্ণু দে'র বিখ্যাত কবিতা ' কাসাণ্ড্রা'র সেই অবিস্মরণীয় পংক্তিগুলো:

আমরা কখনো হেরিনি হেলেন সে-মায়াননে
তবু কেন মরি ঘরে বসে লোভী ট্রয়ের রণে

উন্নত দেশ নই কোনদিন, দিন আনি খাই,
আমরা কখনো ঘামাইনি মাথা দেশ শাসনে;

ক্ষমতার হেলেনের জন্য যারা লড়াই করেন তাদের গাড়িও কেউ ভাঙে না, মূল্যবান বিলাসী জীবনও তাদের খোয়া যায় না। যা হারাবার তা কেবল সাধারণ জনতাই হারায়।

হাইড এন্ড সিক, হাইড এন্ড সিক . . . . .হোয়ার ইজ বেবি হাইডিং
বিএনপি অভিযোগ করেছে ইলিয়াস আলীকে সরকারই তাদের কোন বাহিনী দিয়ে গুম করেছে। বিএনপি যতই বলুক না কেন যে সরকার 'লোক দেখানো' অভিযান চালিয়েছে ইলিয়াসকে উদ্ধারে– এ কথাটা জনগণের কাছে আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় আছে। সংশয়ের কারণ প্রথমত বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্য ধুরন্ধর আওয়ামী লীগ এতো বোকাটে পথে আগাবে কেন? কাউকে গুম করা মানে সবার মধ্যেই আতংক ছড়িয়ে দেয়া। সাধারণ মানুষের কথা বাদই দিলাম, কারন সাধারণ মানুষকে তো কেউই পোছে না, এখনতো দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী নেতারাও নাকি গুমের আতংকে আছেন। সুতরাং বিরোধী দলের কাউকে গুম করাটা আওয়ামী সরকারের জন্য কোন দিক থেকেই সুফল তো বয়ে আনবেই না, বরং কুফলই বয়ে আনবে– এই সরকার সাধারণ এই হিসাবটি মাথায় রাখবে না তা বিশ্বাস করা কঠিন। আর ইলিয়াস আলীতো বিএনপির এমন কোন স্তম্ভও নয় যাকে গুম করে দিলে বিএনপি ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ে যাবে। শোনা যায় ইলিয়াস আলী এর আগেও একবার নিখোঁজ হয়েছিলেন এবং আবার তিনি ফিরেও এসেছেন।

দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন এবং বিদেশে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং সংবাদ মাধ্যম বিবিসি গুমের ঘটনা বাংলাদেশে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে অনেক দিন থেকেই। এগুলো আওয়ামী সরকার নিশ্চয় জানে। এসব জেনেও সরকার জনপ্রিয়তা এবং বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর নৈতিক সমর্থন হারানোর বোকাটে ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।

তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগ যেহেতু আবারও ক্ষমতায় আসতে চায় এবং এই চাওয়াটাই অনিবার্য, প্রথমত ক্ষমতার মধুর লোভে, দ্বিতীয়ত অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে। কারণ পরবর্তী টার্মে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারলে যুদ্ধাপরাধীদের অসমাপ্ত বিচার কাজ শেষ করতে পারবে না।

এদিকে বিএনপিকে ইতিমধ্যে নানান ভাবে নাজেহাল করেছে আওয়ামী লীগ; খালেদাকে সেনানিবাস থেকে বাইরে এনেছে, ছেলে কোকো ও তারেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যাবহারের দায়ে মামলা হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এসবের ঝাল তুলতে কী কী করতে পারে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। আমাদের রাজনীতিতে পরিবারতান্ত্রিকতার পাশাপাশি যেভাবে প্রতিশোধের উপাদান যুক্ত হয়েছে তাতে করে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলবে–এটা আমরা সাধারণ বুদ্ধি দিয়েই বুঝতে পারি।

অতএব, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ক্ষমতায় আসাটা খুবই জরুরি। আর এলে তাকে নির্বাচনের মাধ্যমেই আসতে হবে। আর নির্বাচনকে মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য করতে হলে আওয়ামী লীগের একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি দরকার হবে অবশ্যই। নির্বাচনে অদৃশ্য সব কলাকৌশল যে ঘটবে না তা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে দলীয়করণ বা মাগুরার মতো বড় ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটে গেলে আওয়ামী লীগের জন্য তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

আমার ধারণা আওয়ামী লীগ সাধারণ এই হিসেবগুলো মাথায় রাখছে। এইসব কারণেই ইলিয়াসকে গুম করলে আওয়ামী লীগের কোন লাভ নেই। এবার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দক্ষ কুট্-চালে বিএনপিকে পরাস্ত করে এসেছে, অতএব এখন এই ক্ষমতার বিকেলবেলায় এসে ইলিয়াসের মতো তৃতীয় সারির নেতাকে গুম করে পচা শামুকে পা কাটবে কেন? ইলিয়াস এমন কোন ক্যারিজম্যাটিক নেতা নয় যে তার ডাকে সমস্ত জাতি, বা গোটা জাতি না হোক, অন্তত গোটা বিএনপি একসাথে হয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। তাহলে ইলিয়াসকে আ্ওয়ামী লীগের ভয় পাবার কি আছে?

তবু এইসব হিসেব নিকেশ যাই বলুক না কেন, সরকারকে গুম হওয়ার দায়টুকু নিতেই হবে। কারো বেডরুম পাহারা দেওয়ার দায় সরকারের নেই যদি বলেন তাহলে ইলিয়াসতো বেডরুমের বাইরে থেকে নিখোঁজ হয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী এখন কী বলবেন? বিএনপিই নাকি সরকারকে বিব্রত করার জন্য ইলিয়াসকে লুকিয়ে রেখেছে–বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাই যদি সত্যি হয় তাহলে আশা করা যাচ্ছে তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব। লুকানো জিনিস ভালোভাবে খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আমাদের সাহারা খাতুন আছেন, তার সঙ্গে শামসুল হক টুকু আছেন, তাদের নিরাপত্তা বাহিনী র‌্যাব ও পুলিশ আছেন। ওনারা সক্রিয় হলে যে কাউকে বের করা সম্ভব। ওনারা ঠিকই ইলিয়াসকে বের করে ফেলবেন যদি তিনি লুকিয়ে থাকেন।

যদি লুকিয়েই থাকেন তাহলে ইলিয়াসের কাছে এবং বিএনপির কাছেও আমাদের বিনীত নিবেদন প্রকাশ্যে আসুন অথবা ধরা দিন। কারণ একজন ইলিয়াস কিংবা সুরঞ্জিত বিপদে পড়লে আমাদের গণতন্ত্র বিপদে পড়ে। একজন ইলিয়াস গুম হলে গণতন্ত্র গুমরে কাঁদে। এমনিতেই আমাদের গণতন্ত্র জনলগ্ন থেকেই লুকোচুরি খেলছে। 'সে-যে চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা।' এই গায়েবী গণতন্ত্র ছাড়া আমরা বাঁচবো কী করে!

দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়
প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সবসময়ই বলে আসছে 'আমরা জনগণের পাশে আছি' এবং 'জনগণ আমাদের সাথে রয়েছে'। রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণ কী জিনিস তা বুঝা কঠিন। যখন বড় বড় জনসভা হয় তখন তাতে প্রচুর লোক দেখা যায় বটে। তারা কি একেবারেই সাধারণ জনগণ নাকি দলীয় কর্মী ও সমর্থক? আমার কাছে তাদেরকে দলীয় কর্মী সমর্থক বলেই মনে হয়। রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ মানুষের এসব জনসভায় গিয়ে নেতা নেত্রীদের পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার, কুৎসা শোনার সময় এবং আগ্রহ কোথায়? সম্প্রতি এফবিসিসিআই-এর সভাপতি এ কে আজাদ এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীরা বলেছেন হরতালের প্রতি ৯৫ ভাগ মানুষের কোন সমর্থন নেই। সুতরাং আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যখন বলে জনগণ তাদের পাশে আছে তখন তারা আসলে তাদের কর্মী এবং সমর্থকদের বুঝিয়ে থাকেন। জনগণের গুরুত্ব তাদের কাছে ভোটের বাইরে আদৌ আছে কিনা তার প্রমাণ তাদের দেয়া কর্মসূচী বলে দেয়। জনগণের প্রতি আসলেই তাদের কোন সহানুভূতি নেই। যদি থাকতো তাহলে হরতাল করে জনদুর্ভোগ এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন এবং জনগণের প্রাণ নাশের মতো ঘটণা তারা ঘটাতে পারতো না। অতীতে আ্ওয়ামী লীগ যা করেছে এখন বিএনপি বিরোধী দলে থেকে একই কাণ্ড করছে।

যখনই হরতাল হয় এর প্রধান ভুক্তভোগী হয় সাধারণ জনগণ। মারাও যায় সাধারণ জনগণ। ২২-২৪ এপ্রিলের হরতালে এ পর্যন্ত পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে দুজন গাড়ির ড্রাইভার, একজন ছাত্রদল কর্মী আর অন্যজনের পরিচয় জানা যায়নি। তবে কোন রাজনৈতিক দল যেহেতু তাদের নিজেদের লোক বলে তাকে দাবী করেনি, অতএব ধরে নেয়া যায় তিনিও সাধারণ জনগণ। বিশ্বনাথে হরতালের সময় গুলিবিদ্ধ রিক্সা চালক আহত জাকির মারা গেছে গত বুধবার ।

এদের নিহত হওয়ার পাশাপাশি যানবাহনের ক্ষয়ক্ষতিতো আছেই। এমন হারজিরজিরে, গরীবের গবীর একটি দেশের যে-সীমিত সম্পদ তাও যদি হরতালের মাধ্যমে এভাবে ধ্বংস হতে থাকে তাহলে এই জাতিকে উম্মাদ আর আত্মঘাতী কে না বলবে? রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল কর্মসূচী দেয়ার সময় কি এসব কথা বিবেচনা করেন? একজনকে গুম করার অভিযোগে হরতাল করে পাঁচজন মানুষ হত্যা করাটাকে কীভাবে বৈধ করবে তারা? এই বিএনপিই তাদের প্রচারপত্রে ফলাও করে বলে আসছে 'ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।' সাধারণ মানুষ কোনভাবেই এই বক্তব্যকে মেলাতে পারে না তাদের দেয়া রাজনৈতিক কর্মসূচীর সাথে। কারণ খালেদা জিয়াকে যখন সেনানিবাসের বাড়িটি ছাড়তে হলো তখন এর প্রতিবাদে হরতাল করেছিলো বিএনপি। এটা কি সাধারণ মানুষের কোন সমস্যা ছিলো? আর তিনিই কি এতে করে গৃহহারা হয়ে গিয়েছিলেন? আর যা কিছু ঘটেছে তা আইনানুগভাবেইতো ঘটেছে।

বিএনপি বৃহত্তম বিরোধী দল। তাদের কাছ থেকে গণমুখী কর্মসূচীই আশা করে মানুষ। গত সপ্তাহের হরতাল কর্মসূচীও প্রমাণ করলো বিএনপি সাধারণ মানুষের বৃহত্তর সমস্যার পরিবর্তে দলের একজনের গুম হওয়াকে ইস্যু করে টানা তিন দিনের হরতাল করাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে । এদিকে ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার জন্য সরকারকে শনিবার পর্যন্ত সময় বেধে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। অর্থাৎ খুঁজে না পেলে আবারও হরতালের সম্ভাবনা। সুতরাং সাধারণ মানুষের কাছে এখন এটা স্পষ্ট যে প্রচারপত্রে বলা কথাকেই বাস্তবে উল্টে দিয়ে যেভাবে পালন করা হচ্ছে তার অর্থ দাড়ায় এইঃ দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। তা না হলে কিছুদিন আগেও যে-তীব্র পানি সংকট দেখা দিয়েছিলো প্রায় গোটা শহরে তখন তো তারা কোন হরতাল করেনি। চরম বিদ্যুত সংকট সমাধানের দাবীতেও তো হতে পারতো হরতাল । এসব সংকটে সাধারণ মানুষের জীবন জেরবার হলেও হরতালের জন্য এগুলোকে ইস্যু করতে পারেনি তারা। অর্থাৎ গনস্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থটাই বিএনপির কাছে বড় হয়ে উঠলো। রাজনৈতিক দলগুলোর এ্ই ধরণের দেউলিয়াত্বকেও নিরুপায় জনগণ যেন মেনেই নিয়েছে ।

রাজু আলাউদ্দিন: লেখক ও সাংবাদিক।