সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন থাকুক

তুরিন আফরোজ
Published : 5 Nov 2017, 04:42 AM
Updated : 5 Nov 2017, 04:42 AM

৪ নভেম্বর আমাদের দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হল 'সংবিধান দিবস'। পৃথিবীর বেশিরভাগ উন্নত দেশ তাদের নিজস্ব সংবিধান দিবস পালন করে থাকে। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আসুন আমরা জেনে নিই সংবিধান দিবস কী, এর তাৎপর্য এবং সংবিধানের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে।

দেশের জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি সংবিধান। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আমরা আমাদের সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করে সমবেতভাবে গ্রহণ করেছিলাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করে সমবেতভাবে গ্রহণ করার দিনটি তাই আমাদের 'সংবিধান দিবস'। ভারত ২৬ নভেম্বর, যুক্তরাষ্ট্র ১৭ সেপ্টেম্বর, কানাডা ১ জুলাই এবং রাশিয়া ১২ ডিসেম্বর তাদের সংবিধান দিবস পালন করে। এই দিনগুলোতে তাদের নিজ নিজ সংবিধান গৃহীত হয়েছিল।

আমাদের জীবনে সংবিধান দিবস মহান তাৎপর্য বহন করে। দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার ফলে আমরা আমাদের সংবিধান পেয়েছি। স্বাধীনতা অর্জন ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতি হিসেবে আমাদের একটি ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমাদের সংবিধান অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ৫ লাখ নির্যাতিত নারীর দীর্ঘশ্বাস। তাই জাতি হিসেবে সংবিধান রক্ষা করা এবং তার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব।

রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ: নির্বাহী, বিচার ও আইন। যে কোনো আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য এ তিন বিভাগেরই গুরুত্ব সমান। আইন বিভাগ যেমন আইন প্রণয়ন করে, তেমনি নির্বাহী বিভাগ প্রণীত আইনের সঠিক প্রয়োগ করে। বিচার বিভাগ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে যেন অসাংবিধানিক কিছু না ঘটে, সেটি নিশ্চিত করে এবং আইনের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করে। তাই আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এই তিন বিভাগের কেউ কারও উপরস্থ বা অধীন নয়। তিনটি বিভাগের কোনোটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং সব বিভাগই সমান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় আমাদের স্মরণ রাখতে হবে তা হল, আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা হচ্ছে সুপ্রিমেসি অফ কন্সটিটিউশন বা সাংবিধানিক প্রাধান্য– কোনো বিশেষ বিভাগের প্রাধান্য নয়।

১৯৭২ সালের সংবিধান হল জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি। ১৯৭২ সংবিধান অস্বীকার করার মানেই হল, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আদিরূপ অস্বীকার করা। মুখ থেকে মুখোশ আলাদা করলে যেমন মুখটি চেনা দুষ্কর হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি ১৯৭২ সালের সংবিধান অবহেলা করলে আমরা আমাদের প্রকৃত বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলব। কিন্তু ইতিহাসের পরম্পরায় আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি। যুগ বদলে গেছে, বদলে গেছে সময় আর সেই সঙ্গে বদলে গেছে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা। বর্তমানে অনেকেই আমাদের ১৯৭২এর সংবিধানের অবিকৃত অবস্থায় ফিরে যাওয়া নিয়ে বলেন। এই দাবিও অনেক দিনের। তবে আজকের বাস্তবতায় ১৯৭২ সালের সংবিধানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে আমাদের কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তার মানে হল, আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরতে চাই এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি সত্য এটাই যে, সেই সংবিধানের পরিপূর্ণ প্রতিস্থাপন সময়ের বাস্তবতায় সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চেতনা ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াস নিতে হবে।

আমরা জানি, আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা সুপ্রিমেসি অফ কন্সটিটিউশন বা সাংবিধানিক প্রাধান্য। এটি রক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ করা উচিত তা হল, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা এবং সেগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সহায়তা করা।

একইসঙ্গে রাষ্ট্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে স্বাধীনভাবে সাংবিধানিক সীমারেখার মধ্যে কাজ করতে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কেউ কারও উপরস্থ বা অধীন নয়। তিনটি বিভাগের কোনোটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং তিনটি সমান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় মনে রাখতে হবে তা হল, স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা এক নয়। প্রত্যেকটি বিভাগ কোথাও-না-কোথাও কারও-না-কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে। আসলে সংবিধান অনুযায়ী কেউ দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। সর্বোপরি জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

সংবিধান গৃহীত হবার পর থেকে দেশ অনেকবার সাংবিধানিক সংকটে উপনীত হয়েছিল। প্রথম সংকট সামনে আসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। এটি আরও ঘনীভূত হয় ১৯৭৫ সাল ৮ নভেম্বর। তৎকালীন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন এবং জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। যেখানে বিচারপতিগণ সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করবেন বলে শপথ গ্রহণ করেন, সেখানে দেশ প্রথম সাংবিধানিক সংকটে উপনীত হয়েছিল একজন বিচারপতির দ্বারাই।

এছাড়াও আমরা দেখেছি বিচারপতি ফজলে মুনিম, বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন কীভাবে সংবিধানের উপরে সামরিক ফরমানে স্থান দিয়ে দেশে সাংবিধানিক সংকট তৈরি করেছেন। এটি আরও প্রকট হয় যখন সাবেক প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন যে, ১৯৭৫পরবর্তী সকল অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ড মূলত আমাদের সাংবিধানিক ইতিহাসেরই একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা দেখেছি কীভাবে আমাদের দেশের সামরিক শাসকরা দেশকে সাংবিধানিক সংকটের দিকে ধাবিত করেছেন। দিনের পর দিন সামরিক শাসন জারি করে রাখা হয়েছে, হ্যাঁ–না ভোটের নামে জাতির সঙ্গে করা হয়েছে প্রহসন। সর্বশেষ আমরা দেখেছি, ২০০৭ সালে দেশকে আরও একবার সাংবিধানিক সংকটে পড়তে। যেখানে একটি অনির্বাচিত সরকারের ৩ মাস ক্ষমতায় থাকার কথা, সেখানে দেশের সংবিধানিক আইন উপেক্ষা করে দেড় বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল তারা।

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের মাধ্যমে আমাদের আরও একটি সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে কিনা, এমন আশঙ্কা সাধারণের মধ্যে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে এ রায়ের মধ্য দিয়ে নতুন সংকট হয়নি। কারণ রায়ের ২৪৬ নং পৃষ্ঠায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজেই বলেছেন রায় নিয়ে সাধারণ জনগণ, মিডিয়া কিংবা সিভিল সোসাইটি আলোচনা-সমালোচনা করবে। তিনি ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে আরও বলেছেন, এ রায় নিয়ে সাধারণ মানুষ কথা বলবে, প্রতিক্রিয়া জানাবে আর এটাই হচ্ছে জবাবদিহিতার জায়গা।

এ রায় সাংবিধানিক সংকট তৈরি না করলেও আমি মনে করি, এতে আদালতের প্রতি জনগণের বিরূপ ধারণা জন্মের একটি আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তবে এ জন্য শুধু বাইরের সমাজকে দায়ী করলে চলে না, আদালতকেও দায়িত্ববান হতে হয়। আদালতের সম্মান, বিচারপতির পদ ও পদমর্যাদা দায়িত্বের সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হয়।

দ্বিধাবিভক্তি সব সমাজেই আছে, ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধ সব সময় হবে। সত্য-মিথ্যার মধ্যে লড়াই অনিবার্য। সেদিক থেকে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে যে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি হয়েছিল সেটাও সমাজেরই বৈশিষ্ট্য। সাদা-কালোর মধ্যে যে কোনো একটি জয়লাভ করে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আদালতের প্রতি জনগণের বিরূপ ধারণা তো আদালত কর্তৃক সংবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমেই তৈরি হয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে আদালত কি তার সম্মান ধরে রাখতে পারে?

একইসঙ্গে এটাও বলতে চাই, হ্যাঁ, একটা সময় আদালত কর্তৃক সামরিক ফরমান বা মার্শাল ল' অসাংবিধানিক ঘোষণা করায় আদালতের প্রতি সম্মান ফিরে এসেছে। জনগণ আবার আদালতের সম্মান করা শুরু করেছে। ফলে আদালতের প্রতি সম্মান দেখানোর বিষয়টি আদালতের ন্যায়বিচারের ওপর নির্ভর করে। আমরা একটা কঠিন সময় পার করছি। আশা করছি, খুব শিগগিরই এই ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।

বিচারিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিচারকদের অবশ্যই সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের সংবিধানের আলোকে বা সংবিধান-মোতাবেক বিচারকার্য পরিচালনা করতে হয়। বিচারক চাইলেই সংবিধানের বাইরে কিছু করতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা সুপ্রিমেসি অফ কন্সটিটিউশন বা সাংবিধানিক প্রাধান্য। সেই প্রাধান্য রক্ষা করেই একজন বিচারককে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হয়।

এ জন্যই সংবিধান সমুন্নত রাখতে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হয় সময়ের বাস্তবতা। আর যে কোনো ধরনের সংশোধনী হতে হয় সংবিধানসম্মত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সংবিধানের যে সব সংশোধনী সামরিক সরকারগুলো ক্ষমতার জোরে করেছে তা পরবর্তীতে আদালত অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছেন। তাই সংবিধানের আদৌ কোনো সংশোধনীর প্রয়োজন আছে কিনা তা ভবিষ্যতের বাস্তবতাই বলে দেবে।

তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সব সংশোধনী হতে হবে সাংবিধানিক উপায়ে, অর্থাৎ সংসদের মাধ্যমে এবং সংবিধান সংশোধনীর ক্ষমতা থাকবে জনপ্রতিনিধিদের অর্থাৎ সাংসদদের হাতেই।