কলঙ্কিত নভেম্বর: ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ

আনোয়ার কবির
Published : 3 Nov 2017, 07:39 AM
Updated : 3 Nov 2017, 07:39 AM

প্রতিটি জাতির জীবনে এমন কয়েকটি দিন থাকে যেগুলো সে জাতিকে মহিমান্বিত করে, বিশ্বদরবারে সর্বোচ্চে তুলে ধরে। আর সেই দিনগুলির পেছনের মানুষেরা সর্বসময়ে সেই জাতির সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। আমাদের জাতীয় জীবনে ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর ঠিক তেমনি কয়েকটি দিন। এ দিনগুলো অর্জনের পেছনে যে মানুষদের অবদান সব সময় আলোচিত-প্রশংসিত হয়েছে তাদের অন্যতম ছিলেন জাতীয় চার নেতা। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ধারাবাহিক সংগ্রামের সর্বোচ্চ অর্জন আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের জনগণ সারা পৃথিবীকে যে রকম অনেকগুলো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দিন উপহার দিয়েছে, একইভাবে কিছু কুলাঙ্গারের জন্য বিশ্বইতিহাসে কয়েকটি কলঙ্কিত দিনের অধিকারীও হয়েছে। ৩ নভেম্বর ঠিক তেমনি একটি দিন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট এবং নভেম্বর মাস যেন এক নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল আমাদের। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অর্জনের প্রাণপুরুষ আলোকিত-আলোচিত মানুষদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে এই দুইমাসে। এই হত্যাকাণ্ডের খেসারত দেশ ও জাতিকে দিতে হচ্ছে আজও।

পৃথিবীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আর এই অধ্যায়ের স্রষ্টাদের বিশ্বরাজনীতির একটি অংশ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে চায়নি। তাদের সঙ্গে সে সময় যুক্ত হয়েছিল দেশের কিছু কুলাঙ্গার। সেদিন নির্মম নৃশংসভাবে জেলখানায় তাদের হাতে নিহত হন চার জাতীয় নেতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এই চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ড সারা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। বিশ্বের কাছে জাতি হিসেবে নত করেছিল আমাদের। দুনিয়ার আর কোথাও জেলখানায় এই পর্যায়ের ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতীয় নেতারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা বাংলাদেশে যে নারকীয় গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজসহ যাবতীয় যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করে তার বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন এই নেতারা। মূলত বাংলাদেশের জন্মই এই জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ডের পটভূমি তৈরি করে।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে রাজনৈতিক দিক থেকে যে প্রতিরোধের আশা ছিল এই হত্যাকাণ্ড সেটি শেষ করে দেয়। ১৯৭১ সালে এই নেতৃবৃন্দ প্রমাণ করেছিলেন কীভাবে একটি দেশের ধাত্রীর ভূমিকা পালন করা যায়– সমস্ত অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তৈরি করা যায় জনগণের সংগঠিত সশস্ত্র প্রতিরোধ। আর এভাবে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটানো যায়।

বাংলাদেশ সৃষ্টিতে জাতীয় চার নেতার অবদান কখনও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার পর, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী প্রথম যে সরকার গঠন করা হয় সেখানে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্প্রাপ্ত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ; এম মনসুর আলীকে করা হয় অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন-বিষয়ক মন্ত্রী। ৬ সদস্যের সরকারের চার জনই ছিলেন এই নেতৃবৃন্দ। এঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। জন্ম লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর মানবতাবাদী নেতা উইলি ব্রান্ট বলেছিলেন:

"এই নির্মম মৃত্যুই যদি মুজিবের প্রাপ্য ছিল তাহলে বাংলাদেশের জন্মের কোনো প্রয়োজন ছিল না।"

একই কথা এই চার নেতার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এই নেতৃবৃন্দের জীবনইতিহাসের দিকে তাকালে একটি বিষয় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে, বাংলাদেশ ছিল তাদের ধ্যান, জ্ঞান। বাংলাদেশ কেন্দ্র করেই সারাজীবন অতিবাহিত করেছেন এই নেতৃবৃন্দ। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর এই নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সোনার বাংলা গড়া এবং তাঁর প্রতি বিশ্বস্ততা ও নিষ্ঠার প্রমাণ সারাজীবনই দেখিয়েছিলেন। সর্বশেষ নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে তার বাস্তব রূপ দেখিয়ে গেলেন। এই নেতৃবৃন্দের আত্মত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান আমাদের জাতীয় ইতিহাসে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল কয়েকটি নাম। জাতীয় রাজনীতিতে আদর্শের জন্য জীবন উৎসর্গের ক্ষেত্রে এঁরা অগ্রণী সৈনিক। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই, ২৩ আগস্ট এঁদেরক গ্রেফতার করে ঘাতকরা। ঘাতকেরা একটি ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল– এই নেতৃবৃন্দকে হত্যা করতে না পারলে স্বাধীন বাংলাদেশের চাকা পেছনের দিকে ফেরানো সম্ভব নয়। আর তাই সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়টি রচনা করল জেলখানায়, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশ ছিল ২৪ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের সর্বোচ্চ উদাহরণ– পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের জ্বলন্ত বাস্তবতা। আর তাই বলতে হয়, এই নেতৃবৃন্দকে হত্যা ছিল দেশকে রাজনীতিশূন্য করার এক গভীর চক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে সামরিক শাসনের সূচনা ঘটেছিল তার জঘন্যতম প্রকাশও এই জেল-হত্যাকাণ্ড। সে কারণেই ঘাতকদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। দেশে পাকিস্তানের মতো সামরিক শাসন স্থায়ী করার প্রচেষ্টাও চলে। পরে, ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে সেই নিকষ কালো অন্ধকার অধ্যায়ের।

জেলখানায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার সময় রাষ্ট্র ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় দায়িত্বরত ছিলেন এই নেতৃবৃন্দ। এম মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী ও বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেল, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট, এইচএম কামারুজ্জামান বাকশালের অন্যতম নেতা আর তাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতি থেকে এক ধরনের দূরত্ব বজায় রাখছিলেন।

১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের উত্থান শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঘাতক চক্র যে সরকার পরিচালনা করছিলেন তারা জাতীয় চার নেতাকে নানারকম টোপ দিয়েছিলেন। চেষ্টা চালিয়েছিলেন আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে। কিন্তু জীবন দিয়ে এই নেতৃবৃন্দ রক্ষা করে গেছেন বাঙালির আত্মমর্যাদাবোধ। আদর্শের প্রতি সৎ, নিবেদিত থাকার পথ দেখিয়ে গেছেন এঁরা। ১৯৭১ সালের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে যে সংগ্রাম তারা সফল করতে পেরেছিলেন, স্বাধীন দেশে কিছু কুলাঙ্গারের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে জীবন উৎসর্গ করেছেন তারা ঠিকই কিন্তু রক্ষা করে গেছেন জাতীয় আদর্শের মূল চেতনা।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এই নেতৃবৃন্দকে কীভাবে টোপ দেওয়া হয় তার একটি বিবরণ অধ্যাপক আবু সাইয়িদের 'জেল হত্যাকাণ্ড' গ্রন্থে রয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন:

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেই মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করেন তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারের সাথে। তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মাহবুবুল আলম চাষীসহ আরও কতিপয় উপদেষ্টা ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের বৈঠকেই ঠিক করা হল যে, মোশতাক সরকারকে অবশ্যই আওয়ামী লীগদলীয় বিশিষ্ট প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও সংসদ সদস্যদের আনুগত্য লাভ করতে হবে।

আলোচনার এক পর্যায়ে তাহের ঠাকুর বললেন,

"আমার মনে হয় প্রেসিডেন্ট সাহেবই ঠিক করবেন কাকে কাকে নিয়ে তিনি একটি বেস্ট টিম গঠন করতে পারবেন।"

ঠাকুরের এ কথায় কর্নেল ফারুক রহমান বলে উঠল, "স্যার, লিস্টটা চূড়ান্ত করার আগে আমরা যেন একটু দেখতে পাই।"

এ কথায় সবাই ফারুকের দিকে একবার তাকালেন। মোশতাক চকিত হেসে জবাব দিলেন, 'তা তো অবশ্যই।"

খোন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের খুঁজে বের করে তাদের কাছে দূত পাঠাতে লাগলেন। অবশ্য যাদের তিনি মন্ত্রী বানিয়েছিলেন, এদের মধ্যে শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী ছাড়া আর কারও কাছ থেকে তিনি তেমন কোনো উদ্যোগ পাচ্ছেন না। সবাই যেন কেমন নিস্প্রাণ। যন্ত্রচালিত। কেবল অতিউৎসাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ উল্লাহ।

এমতাবস্থায় ১৭ আগস্ট ওবায়দুর রহমান মনসুর আলীকে মোশতাকের কাছে নিয়ে গেলেন। মোশতাক তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের আহ্বান জানালেন। মনসুর আলী তার কোনো জবাব না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মোশতাকের মুখের দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে থাকলেন। মোশতাক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,

"কী দেখছেন অমন করে?"

মনসুর আলী বললেন, "দেখছি তোমাকে, আর ভাবছি বঙ্গবন্ধুকে। মোশতাক, তুমি শেখ মুজিবকে হত্যা করলে, করতে পারলে"– আবেগে-উদ্বেগ-কান্নায়-ঘৃণায় বুজে এল তাঁর কণ্ঠ।

মোশতাক বুঝলেন, মনসুর আলীকে পাওয়া যাবে না। তার ইঙ্গিতে ওবায়দুর রহমান মনসুর আলীকে নিয়ে গেলেন। ওবায়েদ তাঁকে বলেছিলেন, "মনসুর ভাই, আপনি সব পণ্ড করে দিলেন। রাজনীতিতে আবেগের স্থান নেই, এটা আপনার জানা কথা। আপনি প্রেসিডেন্টের কথায় রাজি হলে ভালো হত।"

মনসুর আলী সেদিন ওবায়েদকে আর কোনো জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করেননি। ২২ আগস্ট গ্রেফতার হয়ে ঢাকা জেলে যাওয়া পর্যন্ত মনসুর আলী ছিলেন বেইলি রোডের বাড়িতে নজরবন্দি।

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন মোশতাকের চিরশত্রু। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে জনাব তাজউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে সরানো এবং বঙ্গবন্ধুর কাছছাড়া করার পেছনে মোশতাকের ষড়যন্ত্র সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়েছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক তাজউদ্দীনের বাড়িতে সশস্ত্র প্রহরা মোতায়েন করে নজরবন্দি করে রেখেছিলেন তাঁকে। তাজউদ্দীন কোনোদিন মোশতাককে মেনে নেবেন না, এটা তিনি জানতেন। তাই তাঁর কাছে যাননি বা কাউকে পাঠাননি।

মোশতাকের ধারণা ছিল শান্ত প্রকৃতির সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং নরম মানুষ কামারুজ্জামান হয়তো তার কথা মানবেন। তাদের কাছে যখন তাহের ঠাকুর ও শাহ মোয়াজ্জেমকে পাঠানো হল– নূরে আলম সিদ্দিকীসহ– তখন সৈয়দ নজরুল বলেছিলেন, "আমার আর কোনো সরকারি পদের দরকার নেই। মোশতাককে বল আমাকে ছেড়ে দিতে। আমি ময়মনসিংহ চলে যাব। আর কদিনই বাঁচব। একটু অবসর জীবন কাটাতে চাই।"

কামারুজ্জামানের জবাব ছিল, "পার্টির আর সব লোক না গেলে আমিই-বা যাই কী করে? তার চেয়ে বাকি কটা দিন এমনি থাকি।"

মোশতাক দেখলেন এখানেও ব্যর্থ। তাই তিনি থেপে গেলেন। ১৯৭৫ সালের ২২ আগস্ট এঁদের ৪ জন এবং কোরবান আলী, আবদুস সামাদ আজাদসহ মোট ১৯ জনকে তিনি জেলে পাঠালেন। তারপর চেষ্টা চালালেন পার্টির অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতৃত্ব, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদকে দলে টানার। কিন্তু তাঁরাও ছিলেন অনমনীয়। জিল্লুর রহমান জানালেন, "এটা হতে পারে না।"

আবদুর রাজ্জাকের জবাব ছিল, "আমি যাব না। আমাকে বিরক্ত করবেন না। যা খুশি করতে পারেন।"

তোফায়েল আহমদ জানালেন, "আমি যাব না। আমার কথা বাদ দিন। আমার আর দরকার নেই।"

ফলস্বরূপ ৯ সেপ্টেম্বর এঁদের তিনজনকে গ্রেফতার করে নেওয়া হল পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। সেখানে তোফায়েলের কাছ থেকে মোশতাকের প্রতি সমর্থনসূচক বিবৃতি লাভের জন্য মারধোর করা হল তাঁকে। কিন্তু কেউ বিবৃতি দিলেন না। পরে জিল্লুর-রাজ্জাককে কুমিল্লা এবং তোফায়েলকে ময়মনসিংহ জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

পার্টির নেতাদের না পেয়ে মোশতাক তখন দলীয় সংসদ সদস্যদের পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। হুইপ আবদুর রউফকে নির্দেশ দেওয়া হল শেরেবাংলানগর ও নাখালপাড়াস্থ সংসদ সদস্য ভবনের সদস্যদের সংগঠিত করার জন্য। বলা হল– ১৬ অক্টোবর বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের একটি বৈঠক আহ্বান করেছেন প্রেসিডেন্ট, সদস্যরা যেন তাতে যোগদান করেন।

এদিকে দিনাজপুরের সিরাজ, পাবনার অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সিরাজগঞ্জের সৈয়দ হায়দার আলী, বগুড়ার হাসান আলী ও মোজাফফর, মোস্তাফিজ পটল, রাজবাড়ীর ডা. এস এ মালেক, নোয়াখালীর হানিফ ও বেলায়েত, মানিকগঞ্জের কামাল, মাগুরার আসাদুজ্জামান, এখলাছ, নওগাঁর জলিল, ফেনীর তালেব আলী, কুমিল্লার কামাল মজুমদার এঁরা ভেতরে ভেতরে চেষ্টা চালালেন যেন সংসদ সদস্যরা না যান। বেগম সাজেদা চৌধুরী বৈঠকে না যাবার পক্ষে ছাত্র-যুব নেতাদের উদ্বুদ্ধ করেন।

ফলে দেখা গেল ১৬ অক্টোবর মোশতাক আহুত বঙ্গভবনের বৈঠকে যে সংখ্যক সদস্য উপস্থিত হয়েছেন তার মধ্যেও মোশতাকের রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে বৈধতা তোলা হয়েছে। সেদিন মোশতাক বুঝলেন তার পায়ের তলায় মাটি নেই। পার্টি পেলেন না, সংসদও নেই। ফলে তিনি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন।

[ 'জেল হত্যাকাণ্ড' , পৃষ্ঠা: ২৪-২৬]

খোন্দকার মোশতাক আহমদ এম মনসুর আলীকে ১৭ আগস্ট দেখা করিয়ে ১৮ আগস্ট পত্রিকায় সে ছবি, সংবাদ প্রকাশ করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করারও চেষ্টা চালিয়েছিলেন। সংসদ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে এডভোকেট সিরাজুল হকের (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সরকার নিযুক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) নেতৃত্বে সংসদ সদস্যরা খোন্দকার মোশতাকের প্রেসিডেন্ট পদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করে তাকে খুনি হিসেবে অখ্যায়িত করেছিলেন।

চার জাতীয় নেতা হত্যা মামলার চার্জশিট থেকে হত্যাকাণ্ডের যে-বিবরণ জানা যায় তা থেকে এ কথা পরিস্কার যে, হত্যাকারীরা জাতিকে নিঃসহায় করার জন্য খুব দ্রুতই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করে। ভোররাতে অন্ধকারে নির্জনে ঘাতকরা নেতাদের হত্যা করে। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে যে রকম সমগ্র জাতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘাতকরা, পঁচাত্তরেও একইভাবে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর রাতে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও গণতন্ত্রিক চেতনার উপর আক্রমণ করে। সে সময় তারা হত্যা করার চেষ্টা করেছে স্বাধীন স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নটি।

চার নেতা হত্যা মামলার চার্জশিটে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে: ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাত ৪টা থেকে ৫টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত ১ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটের মধ্যে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। এ সময় হত্যাকারীরা দুবার কারাঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তারা গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে চার নেতাকে।

১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাত পৌঁনে দুটার সময় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে জলপাই রঙের একটি জিপ এসে থামে। জিপ থেকে নেমে আসেন সেনাবাহিনীর সশস্ত্র চার সদস্য। এদের একজন রিসালদার মোসলেম কারাগারের জেলারকে জানান যে, ফারুক ও রশিদ তাদের পাঠিয়েছেন। তারা জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানকে নিয়ে যেতে চান। ডিআইজি প্রিজন কাজী আবদুল আওয়াল এতে খুব ভয় পেয়ে যান। তিনি এটা জেল কোডের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু রিসালদার মোসলেম নাছোড়বান্দা। তিনি বঙ্গভবনে ফোন করেন। ফোন ধরেন কর্নেল রশিদ। তিনি মোশতাককে দেন। খন্দকার মোশতাক ডিআইজিকে কর্নেল রশিদের কথামতো কাজ করার হুকুম দেন।

এই হুকুমের ফলে কারাগারে প্রবেশের অধিকার পেয়ে যায় চার ঘাতক। তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন নিউ জেলের ১ নম্বর সেলে। পরবর্তী সেলে ছিলেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান। তাদের সবাইকে জড়ো করা হয় তাজউদ্দীনের সেলে। এরপর খুব কাছ থেকে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা যান। তাজউদ্দীনের পেটে ও হাঁটুতে গুলি লাগে। প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের পরও তিনি দীর্ঘ সময় তিনি বেঁচে ছিলেন। তাজউদ্দীন বেঁচে আছেন বিষয়টি এক কারাবন্দি দেখতে পায়। সে ঘাতকদের এ কথা জানালে ঘাতকরা সেলের মধ্যে প্রবেশ করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চার নেতার হত্যা নিশ্চিত করে।

লক্ষ্যণীয়, ঘাতকরা কারাগারে প্রবেশ করে রাত ৪টায় আর বের হয়ে যায় ৫টা ৩৪ মিনিটে। এই দীর্ঘ সময়ে নির্বিঘ্নে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে ও পুরো নিশ্চিত হয়ে তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে যায়।

মধ্যরাতে কারাভ্যন্তরে এমন নৃশংস এক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও বাইরের পৃথিবীর কেউ তা জানত না। এমনকি সেলের মধ্যেই সকাল ১০টা পর্যন্ত লাশগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। ১০টার পর কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসকরা সেলে প্রবেশ করেন। সেখানেই লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করেন ম্যাজিস্ট্রেট আজমল হোসেন চৌধুরী ও মিজানুর রহমান। এরপর ময়না তদন্ত সম্পন্ন করেন সিভিল সার্জন ডা. ফয়েজউদ্দিন মিয়া ও কারা ডাক্তার রফিক উদ্দিন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ডা. পোদ্দার ও ডা. মনোয়ার উল্লাহ। তাদের ময়না তদন্ত ও সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয় গুলিবর্ষণ করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এঁদের হত্যা করা হয়েছে।

হাজার বছরে বাঙালি জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের পর এক সুখী সমৃদ্ধ জাতি ও দেশ গড়ার স্বপ্নে আত্মনিয়োগ করেছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃবৃন্দ। লাখো শহীদ আত্মত্যাগ করেছেন এই স্বপ্নের পেছনে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশ। আর ইতিহাসের এই স্বপ্ন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সফলভাবে রূপায়িত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তাঁর সহযোদ্ধা চার নেতা, লাখো শহীদ এবং সমগ্র জাতিগোষ্ঠী।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ইতিহাসের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মধ্য দিয়ে চার নেতাসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে চেষ্টা চলেছে ইতিহাসের স্বপ্ন ভঙ্গ করার। বর্তমানে আমাদের এবং নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব তা হতে না-দেওয়া। সুখী স্বনির্ভর বাংলাদেশ ইতিহাসের সেই গতিপথ ফিরিয়ে আনতে পারে। পারে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাসহ দেশপ্রেমিক লাখো মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ সফল করে তুলতে।