বাজাই আমার ভাঙা রেকর্ড

মুহম্মদ জাফর ইকবালমুহম্মদ জাফর ইকবাল
Published : 23 Nov 2011, 05:50 AM
Updated : 2 Nov 2017, 07:49 PM

আবার ভাঙা রেকর্ডটা বাজই। এই ভাঙা রেকর্ড বাজানো ছাড়া আর কী-ই-বা করতে পারি?

(ভাঙা রেকর্ড বাজানোর অর্থ, এক কথা বার বার বলা। কথাটা কোথা থেকে এসেছে এই যুগের ছেলেমেয়েদের জানার কথা নয়। গ্রামোফোনের যুগে যে রেকর্ড বাজিয়ে গান শোনা হত সেখানে খুব সূক্ষ্ম খাঁজ কাটা থাকত। ঘুরতে থাকা রেকর্ডের বাইরের প্রান্তে গ্রামোফোনের পিন লাগানো মাথাটা বসিয়ে দিলে সূক্ষ্ম খাঁজটা অনুসরণ করে গান বাজাতে বাজাতে সেটি রেকর্ডের ভেতরের প্রান্তে এসে শেষ হত। রেকর্ড ভাঙা হলে বা সেখানে ফাটল থাকলে পিনটা একটা খাঁজে আটকে গিয়ে সেই খাঁজের অংশটুকই বারবার বাজিয়ে যেত! তাই এক কথা বার বার বলা হলে আমরা বলি ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যাওয়া!)

আমি কোন ভাঙা রেকর্ড বাজানোর কথা বলছি সেটা অনুমান করা নিশ্চয়ই খুব কঠিন নয়। সেটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষা। দেশে এখন বিয়াল্লিশটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। সব বিশ্ববিদ্যালয় যদি ভর্তিপরীক্ষার জন্য একটি করে উইক-অ্যান্ড নিতে চায় তাহলে বিয়াল্লিশটি উইক-অ্যান্ড দরকার। এইচএসসি পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পর থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হওয়ার মাঝখানে বিয়াল্লিশটি উইক-অ্যান্ড নেই। তার চেয়ে বড় কথা, দেশের প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক উইক-অ্যান্ডে পরীক্ষা শেষ করে না, তাদের বেশ কয়েকটি উইক-অ্যান্ড দরকার হয়। তারা তাদের পছন্দের উইক-অ্যান্ডগুলো বেছে নেওয়ার পর উচ্ছিষ্ট উইক-অ্যান্ডগুলো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাগাভাগি করে নেয়।

শুধু তাই নয়, এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে প্রত্যেকটা বিভাগ আলাদা করে নিজের বিভাগের পরীক্ষা নেয়। সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিতে হলে ছেলেমেয়েদের গাট্টি-বোঁচকা নিয়ে দিনের পর দিন থাকতে হয়। তারা কোথায় থাকবে কীভাবে থাকবে সেটি নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই।

এই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিষ্ঠুরতা দেখার সময়। এই সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাওয়া ছেলেমেয়েদের কষ্ট পাওয়ার সময়। আর এই সময়টা আমার সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হওয়ার সময়।

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষার এই সময়টাতে প্রতি বছরই নানা ধরনের অঘটন ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেগুলো লুকিয়ে-ছাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে। একটা-দুটো খবর বের হয়ে যায়। সেটা নিয়ে কিছুদিন হৈচৈ হয়; তারপর সবাই সবকিছু ভুলে যায়।

এবারে সর্বশেষ ঘটনাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের দুটি প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার প্রয়োজন নেই, একেবারে খুবই সাধারণ মানুষের চোখে পড়লেও তারা বলে দিতে পারত যে, এ রকম প্রশ্ন ঠিক নয়– এটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন– এক ধর্মকে বড় করে দেখিয়ে অন্য ধর্মকে খাটো করে দেখানোর প্রশ্ন। কিন্তু এই প্রশ্ন দুটো কারও চোখে পড়েনি। যে কোনো পরীক্ষার প্রশ্ন কখনও একজন করেন না, বেশ কয়েক জনের একটা কমিটি প্রশ্নগুলো প্রস্তুত করেন। কাজেই সেই কমিটির সব সদস্য উগ্র সাম্প্রদায়িক হবেন তার সম্ভাবনা কম। কমিটির কারও না কারও চোখে পড়ার কথা। কমিটির সদস্যদের কারও চোখে পড়েনি দেখে অনুমান করা যায়, সদস্যদের কেউ সম্ভবত প্রশ্নগুলো পড়ে দেখেননি। তাই কেউ হয়তো জানতেন না যে, সদস্যদের কোনো একজন এ রকম একটা প্রশ্ন ঢুকিয়ে রেখেছেন।

ভর্তিপরীক্ষা মানেই হেলাফেলা– যেনতেনভাবে কিছু গাইড বই থেকে কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়ে একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করে ফেলা। সেই সব প্রশ্ন এত নিম্নমানের হয় যে, মাঝে মাঝে মনে হয়, পরীক্ষা না নিয়ে লটারি করে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করার জন্যে বেছে নিলেও হয়তো তাদের প্রতি বেশি সুবিচার করা হত।

হাইকোর্ট থেকে একবার আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভর্তিপরীক্ষার ফলাফল প্রক্রিয়া করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমি তখন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছিলাম, সেই পরীক্ষার প্রত্যেকটা প্রশ্ন গাইড বই থেকে নেওয়া। যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই এ রকম ঘটনা ঘটে তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই ব্যাপার কেন ঘটবে না?

কাজেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ভর্তিপরীক্ষায় আমরা চরমভাবে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন দেখতে পেয়েছি। অনেকেই হয়তো অবাক হয়েছেন, আমি মোটেও অবাক হইনি। ভর্তিপরীক্ষায় এই ধরনের ব্যাপার সব সময় ঘটে যাচ্ছে। আগে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। এই বার যে কোনো কারণেই হোক এটা নিয়ে অনেকে মাথা ঘামাচ্ছে।

এবারে শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যে সংবাদের শিরোনাম হয়েছে তা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়েছে। আমি ডেইলি স্টারে পড়েছি, তারা রাতে ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্ন পেয়েছে– পরের দিন সেই প্রশ্নগুলো ভর্তিপরীক্ষার প্রশ্নের সাথে মিলিয়ে দেখা গেছে, সব মিলে গেছে। এটা সংবাদপত্রের খবর, এর মাঝে ভুল বা মিথ্যা হওয়ার কিছু নেই। প্রশ্নফাঁসের এর থেকে অকাট্য প্রমাণ আর কী হতে পারে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যি পুরোটা অস্বীকার করে রেকর্ড সময়ের ভেতরে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে ফেলেছে। এ রকম অবস্থায় এটি হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। একবার ফলাফল প্রকাশ করে ফেললে আর কেউ কিছু করতে পারবে না। ফলাফলে যাদের নাম চলে আসবে এখন তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অন্য সবার সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করলেও আমরা সবাই জানি, আসলে সত্যিই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁস করার সাথে জড়িত থাকার ব্যাপারে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম উঠে এসেছে, কাউকে কাউকে বহিস্কার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটা চরম ঘোলাটে অবস্থা।

ভর্তিপরীক্ষার ফলাফলে ভালো ছেলেদের সাথে সাথে পরীক্ষার প্রশ্ন যারা পেয়ে গেছে তারাও চলে এসেছে। আমি যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষার কাজকর্মগুলোর সাথে যুক্ত ছিলাম তখন দেখেছি, কেউ যদি এক নম্বর বেশি পেত সে তিরিশ জনকে ডিঙিয়ে সামনে চলে আসত। কাজেই যারা ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে, তারা অন্যান্য সকল ছেলেমেয়েদের ডিঙিয়ে অনেক সামনে এসে গেছে। তারাই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হবে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের প্রশ্নগুলো দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ভর্তিপরীক্ষায় একটি অনেক বড় অমানবিক ঘটনা ঘটেছে জেনেও তারা দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করেনি, তারা দুবৃর্ত্তদের অন্যায় করতে দিয়েছে, এর চাইতে হতাশার ব্যাপার আর কী হতে পারে?

মাত্র অল্প কিছু দিন আগে আমি ভর্তিপরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক এ রকম একটি মেয়ের কাল্পনিক একটা গল্প লিখেছিলাম। সেখানে লিখেছিলাম, এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যাবার সময় রাতের বাস পথে দেরি করার জন্যে মেয়েটি সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি বলে ভর্তিপরীক্ষা দিতে পারেনি। আমরা সবাই দেখেছি, এ রকম ঘটনা এখন মোটেও কাল্পনিক ঘটনা নয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক এই ঘটনাটি ঘটেছে। শত শত ছেলেমেয়ে পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে সময়মতো পরীক্ষার হলে হাজির হতে পারেনি বলে ভর্তিপরীক্ষা দিতে পারেনি।

একজন ছাত্র বা ছাত্রী সমস্ত জীবন দিয়ে পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিয়ে যখন পরীক্ষাটি দিতে পারে না, তখন তাদের কাছে কি পুরো জীবনটি একটা অর্থহীন বিষয় মনে হয় না?

যদি সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তিপরীক্ষা নিত তাহলে এই কোনোটিই কিন্তু ঘটত না। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যদি একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করত তাহলে সেটি হত একটি অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নপত্র, মোটেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার প্রশ্ন নয়। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যদি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই প্রশ্নপত্র ছাপাত, সংরক্ষণ করত, বিতরণ করত তাহলে সেটি কখনও ফাঁস হয়ে যেত না। যদি সবাই মিলে একসাথে ভর্তিপরীক্ষা নিত, তাহলে সবাই নিজের এলাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিত– দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হত না। ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে দেরি করে পরীক্ষা কেন্দ্রে হাজির হয়ে পরীক্ষা দিতে না পারার ভয়ংকর দুর্ভাগ্যটি মেনে নিতে হত না।

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রক্রিয়া নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই কেন আমি বুঝতে পারি না। আমি সংবাদ মাধ্যমে দেখেছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে যিনি সাম্প্রদয়িক প্রশ্ন করেছেন তাকে কেন শাস্তি দেওয়া হবে না সেটি হাইকোর্ট জানতে চেয়েছে। চারুকলা বিভাগের এই সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি পরীক্ষা নেওয়া। আমি বহুদিন থেকে অপেক্ষা করে আছি কখন হাইকোর্ট সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জানতে চাইবে কেন সবাই মিলে একটি ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে এই দেশের ছেলেমেয়েদের উপর একটি চরম অমানবিক নির্যাতন বন্ধ করছে না।

ছয়-সাত বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একবার একটা সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তখন আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের সামনে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা কীভাবে নেওয়া যায় তার উপর একটা বক্তব্য দিতে। আমি গাধা টাইপের মানুষ, তাই সরল বিশ্বাসে ভাইস চ্যান্সেলরদের সামনে বক্তব্য রেখেছিলাম। সকল ভাইস চ্যান্সেলরদের সেই সম্মিলিত প্রতিক্রিয়টির কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। সোজা ভাষায় বলে দেওয়া যায়, আমি সেদিনই বুঝেছিলাম এই দেশের অসহায় ছেলেমেয়েদের জন্যে কারও মনে বিন্দুমাত্র মায়া নেই। তাদেরকে পীড়ন করে কোনোভাবে কিছু বাড়তি টাকা আয় করা ছাড়া আর কারও মনে অন্য কোনো ইচ্ছা নেই।

সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার বিষয়টি অবশ্যি এর থেকেও জটিল। যেহেতু কেউ সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষায় রাজি হতে চাইছে না, তাই তখন যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের আগ্রহে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি এ রকম বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মিলে সেই পরীক্ষাটি বন্ধ করার আয়োজন করেছিল।

রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে যখন বামপন্থী দলগুলো সারাদেশে সভা-সমিতি করছে তখন তাদের আমার খুবই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, একেবারে নিজের ঘরে ছেলেমেয়েদের সাহায্য করার এই বিপ্লবটিকে তারা কেন গলা টিপে হত্যা করেছিলেন?

একবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছিল সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে। সেই আলোচনায় সবাই এক বাাক্যে স্বীকার করেছিলেন যে, সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা ছাড়া উপায় নেই। সেই বক্তব্য শুনে আমি খুবই আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু দেখা গেল যে, তারপর আর কিছুই হয়নি।

আমি একেবারে সত্যিকারভাবে আশাবাদী হয়েছিলাম যখন আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং চ্যান্সেলর সকল ভাইস চ্যান্সেলরদের একটি সভায় সম্মিলিতভাবে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে দেশের ছেলেমেয়েদের কষ্ট লাঘব করার অনুরোধ করেছিলেন। আমি যেটুকু জানি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধ দেশের আইনের মতো, সবাইকে এটি মানতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চয়ই দেশের আইনের উর্ধে। তারা রাষ্ট্রপতির অনুরোধ রক্ষা করেনি!

আমার খুবই আশাভঙ্গ হয়েছে যখন এই বছর দেখতে পেয়েছি, আবার প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় আগের মতো আলাদা আলাদা ভর্তিপরীক্ষা নিতে শুরু করেছে।

কয়েকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে আমার থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সভায় বক্তব্য রাখার সময় আমি ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে অনুরোধ করে এসেছি যে, মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধটি রক্ষা করে তারা যেন সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার একটি উদ্যোগ নেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সময় আমাদেরকে জানালেন, প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি যে, এটি ক্রমান্বয়ে কার্যকরী করা হবে।

আমি ন্যাড়া এবং আমি বহুবার বেলতলা গিয়েছি। কাজেই আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা 'ক্রমান্বয়ে' কার্যকরী করার বিষয় নয়, এটি 'একবারে' সবাইকে নিয়ে কার্যকর করতে হবে। যদি সেটি না করা হয় এবং কিছু কিছু প্রতাপশালী বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রক্রিয়া থেকে বাইরে থেকে যায়, তাহলে তাদেরকে উদাহরণ দেখিয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এই প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে যাবে। আলাদা আলাদা ভর্তিপরীক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন। কাজেই হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক নির্লোভ সাধুসন্ত হয়ে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়বেন সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজি করাতে হবে জোর করে। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

আরও একটি বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা হয় যেটি দেখে আমি বুঝতে পারি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষার প্রক্রিয়াটি অনেকেই এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। সেই কথাটি হচ্ছে, 'গুচ্ছ পদ্ধতি'। অর্থাৎ, এক ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি গুচ্ছ তৈরি করা হবে এবং তারা মিলে একটি ভর্তিপরীক্ষা নেবে।

যে বিষয়টা অনেকেই বুঝতে পারেন না সেটি হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পরীক্ষা নেয় না কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ছাত্রছাত্রীদের কৃষি বিষয়ে পরীক্ষা নেয় না। ছাত্রছাত্রীরা এখনও ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষিবিদ হয়নি, তারা মাত্র এইচএসসি পাশ করা ছাত্রছাত্রী। বাংলা, ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান এই সব বিষয় পড়ে আসা শিক্ষার্থী। কাজেই তাদেরকে যাচাই করার জন্যে আসলে তারা যে সব বিষয় পড়ে এসেছে– বাংলা ইংরেজি, গণিত, রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান– এই সব বিষয়েই পরীক্ষা নিতে হবে। গুচ্ছ তৈরি করে সেই গুচ্ছের জন্যে আলাদা পরীক্ষা নিতে হবে সেটা কে বলেছে? সবাই মিলে একই পরীক্ষায় একই বিষয়ে পরীক্ষা দেবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি বিশেষ কোনো বিষয়ে বেশি জোর দিতে চায় সেটি তারা করতেই পারে, তার জন্যে আলাদাভাবে পরীক্ষা নিতে হবে না।

সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার একটা অনেক বড় ইতিবাচক দিক আছে যেটা অনেকেই জানে না। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে যদি সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটা সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে নেয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীদের উপর 'বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং' নামে যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের নির্যাতন হয় সেটি চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, ছাত্রছাত্রীরাও প্রথমবার খানিকটা সময় পাবে নিজেদের জীবন উপভোগ করার জন্যে। মা-বাবার অনেক টাকা বেঁচে যাবে তাদের ছেলেমেয়েদের আর ভর্তি কোচিং করাতে হবে না বলে।

আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি দেখার জন্য কী হয়। ভর্তিপরীক্ষার চলমান এই নির্যাতন শেষ হওয়ার পর সত্যিই সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ যদি নেওয়া হয় আমি তাহলে আশায় বুক বাঁধার জন্য প্রস্তুত হব।

যদি কিছুই না হয় তাহলে আবার শুরু করব ভাঙা রেকর্ডটি বাজিয়ে যাওয়ার জন্য।