অদৃশ্য-দর্শন

রশীদ হায়দার
Published : 1 Nov 2017, 06:01 PM
Updated : 1 Nov 2017, 06:01 PM

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। স্বাধীনতা লাভের আগে ট্রেনে কুমিল্লার ওপর দিয়েই একাধিকবার চট্টগ্রাম গিয়েছি, কুমিল্লায় নামিনি কোনোবার, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে দেখবার কথা মনেও আসেনি কখনও। এই সামান্য লেখাটি লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে, কোনো কোনো মানুষকে দেখলে যে একটা ইতিহাস দেখা হয়ে যায় তা আগে সেভাবে উপলব্ধি করলে কুমিল্লা শহরের মধ্যে অরক্ষিত ওই বাংলো প্যাটার্নের টিনের বাড়িটির বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখে জীবনের একটা মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখতে পারতাম। না করাটা আমার অপরাধ।

আমার আরেকটি অপরাধ, 'স্মৃতি: ১৯৭১' এ শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম খণ্ডে নয়, দ্বিতীয় খণ্ডেও নয়, গ্রন্থভুক্ত হলেন তৃতীয় খণ্ডে। পাঠকবৃন্দ আশা করি জানেন, ১৯৮৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বাংলা একাডেমী 'স্মৃতি: ১৯৭১' প্রকাশ করে আসছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদের স্মৃতিচারণ-সম্বলিত এই সংকলন গ্রন্থ এখনও প্রকাশিত হচ্ছে। গত ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯২ প্রকাশিত হয়েছে পঞ্চম খণ্ড।

সৌভাগ্য আমার, বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ আমাকে সংকলনটি সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। আমার উচিত ছিল, যেভাবেই হোক প্রথম খণ্ডে শহীদ ধীরেন দত্ত সম্পর্কে লেখা সংগ্রহ করা। কারণ যে-প্রতিষ্ঠান থেকে ওই সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে, সে-প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে ওই মানুষটির অবদান সূচিত হয়েছে দেশভাগের কয়েক মাস পরেই।

তিনিই প্রথম। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে শহীদ দত্ত যে দুটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন তার একটি হচ্ছে, উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। মানতেই হবে, এই প্রস্তাব পরবর্তীকালে রূপান্তরিত হয় অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। স্বীকার করতেই হবে, সেই দাবি আন্দোলনে পর্যবসিত হয় ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে। ১৯৫২এর ২১ ফেব্রুয়ারির আগে ১১ মার্চ প্রতিপালিত হত 'ভাষা দিবস' হিসেবে। একটি প্রস্তাব থেকে আন্দোলন, আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান ও সবশেষে সর্বাত্মক যুদ্ধ– পরিণতিতে স্বাধীনতা লাভ।

কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছিলাম পাকিস্তান লাভের পরপরই, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিশাল ব্যক্তিত্ব ও অতুলনীয় জনপ্রিয়তার মধ্যেও মাতৃভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে যে মানুষটি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কুমিল্লায় গিয়ে তাঁকে দেখার চেয়েও 'স্মৃতি: ১৯৭১' প্রথম খণ্ডে তাঁকে স্মরণ না করা আমার জন্যে অমার্জনীয় অপরাধ এবং পাপ।

মৃত্যুর আগে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আমি দেখিনি, দেখেছি মৃত্যুর পরে। তিনি চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যাবার প্রায় বিশ বছর পর। 'স্মৃতি: ১৯৭১' তৃতীয় খণ্ডে শহীদ দত্তের নাতনি আরমা গুণ দাদুর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যে সব তথ্য পরিবেশন করেছেন, তাতে একজন সচেতন ও ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা রাজনীতিবিদের পাশাপাশি একজন সাধারণ রক্তমাংসের মানুষও হয়ে উঠেছেন অসাধারণ। আরমা লিখেছেন তাঁর ছোটবেলার খেলার এক সঙ্গিনীর কথা। মেয়েটি ধুনকর পরিবারের, নাম নূরজাহান। ধীরেন দত্ত জমিদার পরিবারের সন্তান। তাঁর নাতনি খেলবে একটি ধুনকর পরিবারের মেয়ের সঙ্গে! পাড়ারই একজন বিশিষ্ট উকিল আরমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন:

"জান না, তোমরা কত বড় বংশের ও জমিদার বাড়ির মেয়ে?"

এই প্রসঙ্গেই শহীদ দত্ত অকপটে নাতনিকে সাবধান করে দেন:

"জমিদার বংশের কথা কাউকে বলবে না– কলঙ্কময় ও লজ্জাকর অধ্যায়– আমাদের পূর্বপুরুষ কাঠুরিয়া, আমরা মানুষ, এই হল আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়– আমরা খেটে খাওয়া মানুষ…।"

এটাই শুধু নয়, নারী জাতির প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা।

"তিনি বাড়িতে কাজের মেয়েদের 'মা' ছাড়া ডাকতেন না।"

আরও উদ্ধৃত করি:

"দাদুর কাছে যে সব মক্কেল আসত তাদের অধিকাংশই পয়সা দিত না। এসেই বলত, 'বাবু, হালের গরু বেইচ্যা পয়সা আনছি'– সাথে সাথে তার কেস নেওয়া হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, খাওয়া, থাকা ও বাড়ি ফেরার পয়সা পর্যন্ত দাদু দিয়ে দিতেন। এমনকি পুরোনো কাপড়ও দেওয়া হত। আমরা দাদুর সাথে ঝগড়া করেছি। দাদু ধমক দিয়ে আমাদের থামিয়ে বলতেন, 'গরিবের সমস্যা ও দুঃখ বুঝতে চেষ্টা কর– না হলে মানুষ হবে না। মানুষকে অবিশ্বাস করবে না। আমরা বড়লোক হব না, তবে না খেয়ে তো মরব না। ওরা না খেয়ে মরে যাবে।'"

আরমার লেখা থেকে আরও জানতে পারি, ধর্মব্যবসায়ীদের তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন, তাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে দিতেন না। ছিলেন অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িক। সে জন্যে মানুষের মুক্তির জন্যে তিনি চাইতেন, 'ইন্টার ম্যারেজ' হলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প আপনা-আপনিই উবে যাবে।

কিন্তু আজ? মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা কোন পর্যায়ে গেছে তা সবার কাছেই স্পষ্ট। তাই মনে হয়, শহীদ ধীরেন দত্ত বহু আগেই তা উপলব্ধি করে আমাদের সাবধান করে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু আমরা গ্রহণ করিনি।

এসব দৃষ্টান্তেই আমি বিশ্বাস করি আমি তাঁকে দেখেছি, কিন্তু আমরা তাঁকে সেই মর্যাদা দিইনি। আরমা যখন অভিযোগ করেন– "পাকিস্তান হয়েছিল ধর্মের উপর ভিত্তি করে, আর আজ বাংলাদেশ হয়েছে বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করে– প্রশ্ন থাকে, তাহলে বাংলাদেশের জন্মের জন্যে আমার দাদু শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কী অবদান? অবদানের কথা সবাই জানে, কিন্তু তার সম্মানজনক স্বীকৃতি কোথায়?"

এখন এ প্রশ্ন আমাদেরও।